Main menu

চিপকোর ফজিলত

ইকোফেমিনিজম নিয়া আলাপ শুরু হয় চুয়াত্তরের দিকে। ফ্রকোয়া দুবোন এই টার্ম বাজারে ছাড়েন। ইকোফেমিনিজমের সেন্ট্রাল আলাপটা নারীর সাথে পরিবেশরে জড়ায়ে আগায়। এর প্রথম কথাটা হইতেছে, পরিবেশ বিপর্যস্ত হইলে নারী ভুগবে বেশি। মানে ভিক্টিমের জায়গায় মাইয়া। আর পরিবেশরে যে বিপর্যস্ত করে সে হইল পোলা। দ্বিতীয় কথা হইল মাইয়াগোর হক যারা মাইরা খায় তারাও পোলা। সুতরাং, পরিবেশের লগে নারী এইভাবে পোলাসূত্রে জড়িত হইয়া যায়। দুনিয়া তো পোলাদের! আর্থ মানে জমিজমার মালিকদের দিকে তাকান। কারা মালিক? পোলা আর মাইয়ার রেশিও হিসাব করেন। ইকোফেমিনিষ্ট তাত্ত্বিকদের হিসাব হইতেছে, পরিবেশের এক্সপ্লয়টেশন, নারীর এক্সপ্লয়টেশনের লগে হুবুহু মিলে। পোলারা দুনিয়ারে তো রেইপই করতেছে; দুনিয়ার ভাও না বুইঝা যথেচ্ছ চইষা বেড়ানো- রেইপ তো। আবার দেখেন বিভিন্ন তান্ত্রিক-মিথিক রেফারেন্সে দুনিয়া হইল নারী; উর্বর ও ফলনশীল যেহেতু। দুনিয়ার সাথে নারীর এই নানাবিধ সংযোগ স্ট্রাইকিং। সুতরাং তাত্ত্বিকেরা মনে করসেন, ফেমিনিজমের ইকোফেমিনিজম হইয়া ওঠা জরুরী।

কিন্তু, নব্বুইয়ের দশকে আসতে আসতে ইকোফেমিনিষ্ট ডিসকোর্স ম্লান হইতে শুরু করলো। ওয়াঙ্গারি মাথাইরা বলা শুরু করলেন, এই ডিসকোর্স ইনক্লুসিভ না। এইখানে নারী ও পুরুষের বাইনারী দিয়া পরিবেশের ডাইনামিক্স কেপচার করার চেষ্টা করা হইছে। ভিক্টিম হিসাবে কেবল নারী এইখানে ফোকাসে আছে। সেই নারীও আবার মনোলিথিক; মানে নারীদের নিজেদের মইধ্যে যে পার্থক্য তাও এইখানে ইগনোর করা হইতেছে। শেষমেশ মাইরা কাইটা যা থাকে, তা কেবলই শ্বেতাঙ্গ নারী। মানে শোষকের ভিক্টিম তো শুধু নারী না! কালোরাও; গরীবরাও; শ্রমিকরাও। দুনিয়াও ইহাদের বেতিরেকে নয়; সহই। পরিবেশরে রক্ষা করা মানে এইসবই রক্ষা করা। ফেমিনিজম মানেও শুধুই সাদা নারীদের অধিকার লাভের বা, জমির মালিকানা লাভের মহড়া নয়। ফেমিনিজম হইল, নেসেসারিলি, একটা ভাইরাল হইয়া যাওয়া পুরুষীয় বাস্তবরে চ্যালেঞ্জ করার দার্শনিক-রাজনৈতিক পাটাতন।

এই জায়গায় চিপকো কেমনে কন্ট্রিবিউট করে খেয়াল করেন।

চুয়াত্তরেই, উত্তরাখণ্ডের, রেনি গ্রামের সাতাইশ জন নারী তাদের এলাকার জঙ্গলরে সরকারী ধ্বংসযজ্ঞ হইতে বাচাইতে, জঙ্গলের গাছের লগে হাতে হাত ধইরা চিপকাইয়া গেলেন। উনাদের বার্তা সহজ, গাছ কাটতে হইলে, আমাদেরকেও কাটতে হইবে। উত্তরাখণ্ডের কৃষিভিত্তিক সোমাজে মাইয়ারাই মূলত কৃষিজীবি ছিলেন। তারা এই জঙ্গল থেকে লাকড়ি পাইতেন, গবাদি পশুর খাদ্য পাইতেন, সেচের জলও পাইতেন। তারা এর আগে দেখছিলেন যে, সরকারী ও বেসরকারীভাবে গাছ কাটার ফলে পার্শ্ববর্তী নদীর পানিও শুকায় যাইতেছে। এই মাইয়ারা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই জানতে পারছিলেন কীভাবে নদী, জঙ্গল, মানুষ, পশুপাখি একটা আরেকটার উপর নির্ভরশীল। তাই তারা গাছের লগে চিপকাইয়া গিয়া দেখাইলেন, আমরা তো এমনেই চিপকাইয়া আছি জঙ্গলের লগে; একটু দেখেন, দেখার চেষ্টা করেন। এর নাম হইল চিপকো আন্দোলন।

প্রতিরোধের এই নকশা পুরা ইন্ডিয়াই সত্তর আর আশির দশকে ফলো করতে থাকলো। পুরুষতান্ত্রিক মালিকানামূলক লেন্সে সবই হইল সম্পত্তি কিন্তু চিপকোতে দেখা গেল, সবই যে সবার সেই দর্শন সামনে নিয়া আসতেছে নারীরা এই প্রথমবারের মত। চিপকোর ডিসকোর্সে তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়। ইন্ডিয়ান পরিবেশবাদী ভান্দানা শিভা কইতেছিলেন যে, তিনি যাইতেন ওইখানে বছরে একবার ভ্লান্টিয়ার করতে। তার সেবার তো খুবেকটা দরকার ছিলনা ওই মাইয়াদের। স্কুল-কলেজে নাগিয়াই তো এরা বুঝতে পারছিল, জঙ্গল বেইচা ভেনিশ করার চেয়ে জঙ্গল থাকলেই সকলের মঙ্গল। এই সকলের মইধ্যে সব কিছু আছে। তিনি বরং যাইতেন ওইখান থেকাই কিছু শিখা, শিক্ষিতদের কিছু শিখানো যায় কিনা তার খোজদারীতে। মানে যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন কিছু ইংরেজি আর গ্রাফে রূপান্তরিত হইতেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তো কিছু সাদাদের জিম্মায় থাকা বিদ্যায়তনে প্রবেশের যোগ্যই হইয়া উঠতে পারেনা। তো তিনি যেহেতু এই দুইটা জিনিসই পারতেন, তাই এইটুকু কাজে আসা হইত আর কি!

পরবর্তীতে আমেরিকার হিপ্পিদের মইধ্যে যখন এই চিপকো প্রবণতা ছড়ায় পড়লো, তখনও আমেরিকার সাদা চোখে এইটা রিডিকিউলের বেপার হইয়াই ধরা দিল; এই গাছের লগে চিপকাই থাকা, হাস্যকর না! মানে প্রান্ত হইতে, প্রান্তিকের সংস্কৃতি হইতে উইঠা আসা কিছু যেন পাত্তা পাওয়ারই যোগ্য না, ডিসকোর্স তো পরের ব্যাপার। অথচ চিপকোতে রেস, ক্লাস, জেন্ডার উৎরাইয়া, পুরুষতান্ত্রিক প্রকল্পরে চেলেঞ্জ জানানোর ঘটনা ঘটছে। এবং এইটা ঘটতে পারছে একটা লোকাল কালেক্টিভ কনশাসনেসের জায়গা হইতে। একাডেমিক কোন প্রকল্পের ভিত্তিতে ঘটেনাই এমনটা। নারীবাদেরও পলিটিকাল উদ্ভাবনা যতক্ষণ না অব্দি এই লোকাল-কালচারাল ফেনোমেনাগুলির ভেতর দিয়ে ঘটতে পারতেছে, ততক্ষণ ফেমিনিজমও একটা এলিট চর্চা হইয়াই রইয়া যাবে।

কিন্তু নারীবাদ তো দরকারি ইনস্ট্রুমেন্ট একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে। পুরুষতন্ত্র মানেই সোসাইটি অব এক্সক্লুসিভস, যে গুতাগুতি, ঠেলাঠেলি, মারামারি করতে পারবে দুনিয়া তার। না পারলে ঘরে থাকো গিয়া। এই কারণে নারীর ঘরে থাকতে হয়। এখন চিন্তা করেন একটা শহর যদি নারীর কথা ভাইবা ডিজাইন করা হয়, সেই শহরের বাসে ভিড় কম থাকতে হয়, তার জন্য বাস বেশি রাখতে হয়, তার জন্য রাস্তা চওড়া করতে হয়, চলতি পথে বিশ্রামের জায়গা বেশি রাখতে হয়, ফুটপাত বড় রাখতে হয়, পাবলিক টয়লেট বেশি রাখতে হয় এবং আল্টিমেইটলি এই সকল সুযোগ-সুবিধা কেবল নারী না, সকলেই ভোগ করতে পারে; পুরুষও। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা পরিবেশ ক্রিয়েট করা হয়, যেন তা কেবল ‘ফিটেস্ট’ ফিউয়ের জন্যই ব্যবহারের উপযুগী থাকে। তাই এই সমাজে নানান নিপীড়ণ জারি থাকে। সর্বদা শক্তির মহড়া চলতে থাকে। দুনিয়ারে, পরিবেশরে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করতে থাকা এই মহড়ারই আরেকটা পার্ট।

পুরুষের দুনিয়ায়, ভক্তি বা প্রেমও পুরুষালী। ব্রাজিলের এক মন্ত্রী কইতেছিলেন, আমাজন হইল ব্রাজিলের জন্য ঈশ্বরের আশির্বাদস্বরূপ। তাই ব্রাজিলের অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে ব্রাজিল আমাজনরে ব্যবহার করবে। এই যে জঙ্গলরে একটা কমোডিটির মত ভালবাসা এইটাই তো পুরুষের ভালবাসা, যে ভালবাসায় অপরাপর পক্ষগুলির ভাও বুঝার কোন তাগিদ থাকে না, যেইখানে পুরুষের কথাই শেষ কথা, সেইখানেই তো ধ্বংস, সেইখানেই রেইপ।

নারীবাদ আর পরিবেশবাদরে এইখানে জোড়া দিতে পারে চিপকোর মত ফেনোমেনাগুলি। এই মুভমেন্টে নারীরা দেখাইছিলেন একটা আরেকটারে রদ কইরা কোন পরিবেশ নাই। পরিবেশ আমরা সবাই, সবকিছুই। ফলে কোন কিছু যখন ধ্বংস করতে যাই, একটু একটু কইরা আমরা নিজেদেরই ধ্বংস কইরা ফালাই। এবং সেই ধ্বংসের ফল তো এখন মানুষ দেখতেই পাইতেছে। চিপকো দেখায় ইকোফেমিনিজম বা ফেমিনিজম কীভাবে পুরুষতন্ত্ররে প্রতিরোধ করতে পারে, স্রেফ আরেকটা প্রতিক্রিয়া, যেন পুরুষতন্ত্রেরই আরেকটা মিরর ইমেজ, হইয়া ওঠার বদলে। রাজস্থানের অমৃতা দেবী খেজরি গাছ বাচাইতে মরছিলেন; নিজে ও আরও ৩৬৩ বিষ্ণুই। এরা প্রত্যেকেই পুরুষরে প্রতিরোধ করছিলেন, পুরুষ হইয়া উঠার বদলে। চিপকো ওইখান থেকে শুরু হয়, ওই উপাখ্যান হইতে। এবং চিপকো বাড়তি হিসেবে দেখায় না মইরাই কেমনে সাধন হইতে পারে; অর্থাৎ চিপকো বাড়তি হিসেবে মিথের বাইরে গিয়া একটা পলিটিকাল-ইডিওলজিকাল পাটাতনও অফার করে।

১৩ চৈত্র, ১৪২৬

………………………

লেখাটা রাইটারের “তিনখানা নারীবাদ” বইয়ে আছে। বইটা কিনতে পারেন:

ফেসবুক পেইজ থিকা: https://cutt.ly/BbY6kw2

রকমারি থিকা: তিনখানা নারীবাদ: ইব্রাকর ঝিল্লী – Tinkhana Naribad: Ibrakor Ghilli | Rokomari.com

 

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →