স্টিভেন ওয়াইনবার্গ
Steven Weinberg জুলাইয়ের ২৩ তারিখে মারা গেলেন।
আমার নিজের মৃত্যুর আগে যেসকল মানুষদের সাথে একবার হইলে দেখা করার ইচ্ছা, সেই ছোট্ট তালিকায় তার এন্ট্রি হইছিল যখন আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়ি।
ক্লাস এইটে তখন আমি জ্যামিতি এবং গণিত নিয়া মোটামুটি নেশাগ্রস্ত। মাধ্যমিকের গণিত বই যোগাড় করে পড়তেছি এমন অবস্থা। আমার চাচাতো ভাইরা আমাকে কিছু পুরাতন কারিকুলামের বই দিছিলেন। তার মধ্যে মাধ্যমিকের উচ্চতর গনিতের বইও ছিল। আমরা যেই কারিকুলাম পড়ছি সেইটা সিভিয়ারলি শর্টেন্ড ছিল জ্যামিতির ক্ষেত্রে। মানে টলেমীর উপপাদ্য এবং অন্তঃবৃত্ত, অধিবৃত্ত সংক্রান্ত উপপাদ্য এবং অনুশীলনী অনেক ছোট ছিল পুরাতন কারিকুলামের তুলনায়।
এইরকম সময়েই বাউলমন প্রকাশনীর অনুদিত স্টিফেন হকিং এর “কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” হাতে আসল। বিমান বাহিনীর পাঠাগার থেকে ইস্যু করা বই। আব্বা নিয়া আসছেন। আমি কিছু বুঝি না তাও খালি পড়ি। তারপর বাপের কাছে আবদার করলাম বইটা কিনে দিতে, কারন ইস্যু করা বই ফেরত দিতে হবে। বাপ আমাকে নীলক্ষেতে নিয়া গেল। আমি ইহাকে পাইলাম। কমপ্লিটলি না বুইঝাও এই বইটা যে আমি কতবার পড়ছি তার ইয়াত্তা নাই।
এই বইতেই ছিল ড আবদুস সালাম, সেলডন গ্ল্যাশো আর স্টিভেন ওয়াইনবার্গের কথা। যারা ১৯৭৯ সালে নোবেল পাইছিলেন, বাউলমনের বীভৎস অনুবাদ অনুসারে “দুর্বল এবং তরিৎ চুম্বকীয় বল একত্রীকরণের” জন্যে। বাউলমনের অনুবাদে আরো কিছু এইরকম কিম্ভূতকিমাকার জিনিস ছিল। যেমন র্যাণ্ডম এর বাংলা “যাদৃচ্ছিক”, সিংগুলারিটির বাংলা “অনন্যতা” ইত্যাদি। ওই বইতে একটা ছোট তথ্যও ছিল ওয়াইনবার্গের বিগ ব্যাং নিয়া একটা বই আছে নাম “ফার্স্ট থ্রি মিনিটস”। সুতরাং আমার মিশন দাড়ায়ে গেল এই বই যোগাড় করা। অনেক কষ্টে শেষপর্যন্ত লোকেইট করলাম নিউমার্কেটের বুকভিউতে এই বই আছে। ততদিনে আমি ১১ কেলাসে পড়ি। আমরা তখন বাপের বদলির জন্যে চিটাগাং থাকি। সুতরাং নিউমার্কেট যাইতে পারতাম তিনচারমাসে একদিন। যেদিন ক্যাডেট কলেজ ছুটি হইত, ওইদিনের রাতের ট্রেনে সাধারণত চট্টগ্রাম যাওয়া হইত। সারাদিনটা তাই ব্যয় হইত টুকিটাকি জিনিস কেনা অথবা আমার কোন আবদার। আমার গানের ক্যাসেট/সিডি, বই, গেইমসের সিডি ইত্যাদি এই সময়েই কেনা হইত। বাপে গজ গজ করলেও তিনমাস পরে ছুটিতে আসা ছেলেরে শেষপর্যন্ত জিনিসপাতি কিনে দিতেন। যাইহোক নিউমার্কেটে গিয়া জানলাম বইয়ের দাম ১৩ শ টাকা। বাপের চেহারা শুকাইয়া গেল। আমারও। কারণ আমি জানি বাপের এইটা কিনা দিতে কষ্ট হবে, এতগুলো টাকা। বুকভিউ এর মুরুব্বী মনে হয় আমাদের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনের মোজেজা বুইঝা ফেললেন। বললেন এইটার বাংলা অনুবাদ আছে, দাম অনেক কম। আমি জানে পানি পাইলাম। তারপর এস্ট্রনোমিক্যাল এসোসিয়েশন কৃত আরেকটা জঘন্য অনুবাদ বগলদাবা করে বাসায় ফিরত গেলাম।
এই ফার্স্ট থ্রি মিনিটসও মনে হয় আমি ডজনখানেকবার পড়ছি। সেই থেকেই ওয়েনবার্গ নিয়া আমার মুগ্ধতা ছিল। একটা লোক কিভাবে এতটা বস হয়?
বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পড়েই বই কেনার ক্ষমতা টিউশানির জন্যে বাড়ল। আমার বন্ধু রিফাত আমাকে জানাইল ওয়াইনবার্গের একটা জেনারেল রিলেটিভিটির বই আছে যেইটা খুব ভালো। ঐ বইও পাইলাম বুকভিউতে। আমার কেনা প্রথম জেনারেল রিলেটিভিটির টেক্সট বই।
ওয়ানবার্গ কিন্তু রিলেটিভিস্ট ছিলেন না, মানে ঐটা তার গবেষণার ফিল্ড ছিল না। তিনি মূলত কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির লোক। প্রিফেইসে গ্র্যাভিটেশন এবং কসমোলজি লেখার পিছনে ওয়াইনবার্গ কথা বলছেন। তিনিও সচেতন ছিলেন এমন একটা বিষয় নিয়া তিনি লিখতেছেন যেইটায় তিনি এক্সপার্ট না। পরবর্তীতে অসংখ্য জেনারেল রিলেটিভিটির টেক্সট পরার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ওয়াইনবার্গের ট্রিটমেন্ট সবচেয়ে আলাদা ছিল। জেনারেল রিলেটিভিটিকে সাধারণত পরিচয় করায়া দেয়া হয় ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রির একটা স্পেশাল কেইস হিসেবে। সুতরাং যেকোন আধুনিক রিলেটিভিটির বইতে প্রথম কয়েক চ্যাপ্টার বরাদ্দ থাকে ডিফারেন্সিয়াল জিওওমেট্রি নিয়া। এরপর তারা আইনস্টাইনের সমীকরণে যায়। ধরনে শন ক্যারলের বইতে চতুর্থ চ্যাপ্টারে আইনস্টাইনের সমীকরণ। একই কথা জেনারেল রিলেটিভিটির সবচেয়ে স্ট্যাণ্ডার্ড টেক্সট, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট ওয়াল্ডের বইয়ের ক্ষেত্রে। ওয়াইনবার্গ সেইভাবে আগান নাই। উনার বই অনেকটা উল্টা দিক থেকে লেখা। উনি শুরু করছেন প্রিন্সিপাল অফ ইকুইভ্যালেন্স থেকে। তারপর ফিজিক্যাল প্রিন্সিপল দিয়া আগাইছেন। ওয়াইনবার্গ তার এপ্রোচের ব্যাখ্যা দিছেন দুইটা। প্রথমত তিনি এই বইটা লিখছেন, কারণ তিনি জেনারেল রিলেটিভিটি “শিখতে” চাইছিলেন। আই নো, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপারস্যাপার। ওয়াইনবার্গ মনে করতেন কোন নতুন জিনিস শেখার জন্যে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ঐ বিষয়টা পড়ানোর জন্যে একটা কোর্স নেয়া। ঐ কোর্সের কনটেন্টের জন্যেই বিষয় শেখা হয়ে যাবে। ছাত্রদের এক্সপ্লেইন করতে গিয়ে আইডিয়াও ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
এইটার একটা মজার কনসিকোয়েন্স আছে।
ওয়াইনবার্গ যেই বিষয়ে সবচেয়ে পণ্ডিত ছিলেন , অর্থাৎ কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি, সেইটার উপড়ে তিন ভলিউমের বই আছে। কিন্তু ঐ বই আমার জানামতে কেউ বেশী ব্যবহার করে না। অত্যন্ত ইমপেনিট্রেবল। কেম্ব্রিজের অধ্যাপক ডেভিড টং একবার মন্তব্য করেছিলেন, ওয়াইনবার্গের গ্র্যাভিটেশন বইটা এত ভাল কারণ ঐ বই দিয়া ওয়াইনবার্গ শিখতে চাইছিলেন। কিন্তু সমস্যা হইতে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি নিয়া সম্ভবত পৃথিবীতে ওয়াইনবার্গের চেয়ে বেশী কেউ জানে না। সুতরাং ঐ সংক্রান্ত বই সুখপাঠ্য হয় নাই।
নিজের শেখার জন্যে বই লেখার ঘটনা ওয়াইনবার্গের আরো আছে।
ওয়াইনবার্গের খুব ইন্টারেস্টিং বই হইল “টু এক্সপ্লেইন দ্যা ওয়ার্ল্ড”। ২০১৫ তে প্রকাশ হওয়া এই বইয়ের বিষয়বস্তু হইল বিজ্ঞানের ইতিহাস। এই বইয়ের শানে নযুলও বেশ মজার। ওয়াইনবার্গের সাথে বিজ্ঞানের দার্শনিক টমাস কুনের বেশ তর্কাতর্কি হইত। বিশেষ করে গ্রীকদের অবদান আসলে কতটুকু। কুন অবদান অনেক মনে করতেন, আর ওয়াইনবার্গ ছিলেন সিরিয়াস ইতিহাস নিউটন থেকে শুরু করতে, কারন ক্যালকুলাস। এই ডিবেইটের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াইনবার্গের মনে হইল বিজ্ঞানের ইতিহাসটা ভালো করে জানা দরকার। আর যথারীতি ওয়াইনবার্গের মতে জানার সবচেয়ে ভালো উপায় এইটা নিয়া কোর্স নেয়া। তাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে সফল পদার্থবিদদের মাঝে একজন, যার এইচ ইনডেক্স জীবিত যেকোন বিজ্ঞানীর চেয়ে বেশী ছিল, তিনি তার আশির দশকে নতুন জিনিস শেখার লোভে কোর্স নিলেন। সেই কোর্সের ফলাফল হইতেছে বইটা। বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়া আমাকে সিরিয়াস হওয়ার পিছনে যেই তিনটা বই সাহায্য করছে, এইটা তার মাঝে একটা। অপর দুইটা হইতেছে আব্রাহাম পাইসের ইনওয়ার্ড বাউন্ড, এবং টমাস কুনের স্ট্রাকচার অফ সায়েন্টিফিক রেভুলিউশন।
ওয়াইনবার্গের অধিকাংশ বই আমার সংগ্রহে আছে। লেখক হিসেবে তিনি অসাধারণ ছিলেন। এমনকি উনার পেপারের ল্যাংগুয়েজও সেই। আধুনিক বিজ্ঞানে যেই স্বল্প সংখ্যক বিজ্ঞানীকে দেখে লেজিট awe হইতে হয়, তিনি সেই ছোট্ট তালিকার একজন উপরের দিকের লোক।
উনার মাঝে কিছু কোয়েশ্চেনেবল বিষয়ও ছিল। তিনি নিউ এথিজমের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ডকিন্সগনের চেয়ে হাজার হাজার গুন একমপ্লিশড হইলেও তারে দিয়া এক্টিভিজম হইত না। আসলে এত কিউরিয়াস মানুষ ছিলেন তিনি, তার ইন্টারেস্ট এত ডাইভার্স ছিল, তিনি কোনদিন এক্টিভিজমে মন দিতে পারেন নাই। এছাড়াও তিনি ইজরায়েলের সমর্থক ছিলেন, বিডিএস এর বিপক্ষে ছিলেন।
এইসব কিছুও তার পদার্থবিজ্ঞান , অনুসন্ধিৎসার বৈচিত্র্য, গদ্য লেখার অসম্ভব সুন্দর ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতি আমার মুগ্ধতা যায় নাই।
উনি প্রাউডলি নাস্তিক ছিলেন, তাই পরলৌকিক কিছু না বলাই ভালো।
অসাধারণ একটি জীবন কাটানোর সৌভাগ্য তার হয়েছিল, এবং আমি আশা করব শেষ সময়ে তিনি পেছন দিকে তাকিয়ে সেইটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং শান্তির সাথে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন।
জুলাই ২৬, ২০২১
Latest posts by আরিফ হোসেন (see all)
- অন লিব্রেলিজম - মে 12, 2023
- পাওয়ার অ্যান্ড পপুলার সভারিনিটি - অক্টোবর 18, 2021
- অন ডেবট ট্রাপস অ্যান্ড লিবারালিজম (On Debt Traps and Liberalism) - অক্টোবর 1, 2021