Main menu

বই: “সবারে নমি আমি” কানন (বালা) দেবী (সিলেক্টেড অংশ)

[কানন (বালা) দেবী (১৯১৬ – ১৯৯২) হইতেছেন ইন্ডিয়ান ফিল্মের শুরু’র দিকের নায়িকা, কলকাতার। ১৯২৬ থিকা ১৯৪৯ পর্যন্ত মোটামুটি এক্টিভ ছিলেন, সিনেমায়। তখনকার ইন্ডিয়ার ফিল্ম-স্টুডিওগুলা কলকাতা-বেইজড ছিল। গায়িকা হিসাবেও উনার সুনাম ছিল অনেক। ১৯৭৩ সনে (বাংলা সন ১৩৮০) উনার অটোবায়োগ্রাফি “সবারে নমি আমি” ছাপা হয়। সন্ধ্যা সেন উনার বয়ানে এই বইটা লেখেন। অই বইটা থিকা কিছু অংশ ছাপাইতেছি আমরা এইখানে।]

………….

চুম্বন

জোর বরাত’ -এর একটা বেদনাদায়ক ঘটনা আজও আমার কাছে রহস্যাবৃতই রয়ে গেল।

একটা সিনের টেক হচ্ছিল। রিহার্সাল অনুযায়ী যথারীতি সংলাপ বলে গেলাম। সিনের শেষে হঠাৎ ছবির হিরো ইংরাজী ফিল্মের ঢঙে আমায় জড়িয়ে ধরে চুম্বন করলেন।…ঘটনার আকস্মিতায় হঠাৎ বিহ্বল হয়ে পড়লাম। সামলে উঠতে সময় লাগল। যখন প্রকৃতিস্থ হলাম, বিস্ময়, বেদনা, অপমান, অভিমান, নিজের অসহায় অবস্থার জন্য কষ্ট সব মিলিয়ে একটা নিষ্ফল কান্না যেন মাথা কুটতে লাগল। অল্প বয়স, তখন ভাব-প্রবণতাও প্রবল। তাছাড়া বাঙালী ঘরের মেয়ে, আবেগের এমন উগ্র প্রকাশে অভ্যস্ত নই। আর এ-কাজ ঘটল তাঁরই পরিচালনায় অভিভাবক ভেবে যাঁর .. ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। যাঁর দায়িত্বজ্ঞানের ওপর আমার এত শ্রদ্ধা, বিশ্বাস! যদি অভিনয়কে স্বাভাবিক করবার জন্য এই চুম্বনের প্রয়োজন, তবে আমাকে আগে থেকে বলে মনকে কেন প্রস্তুত করবার অবকাশ দিলেন না?

জ্যোতিষবাবুকেও আমি এ প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বললেন, “বললে তুমি রাজী হতে না। ইট ইজ অ্যান এপেরিমেন্ট, অত ‘টাচি হলে চলে? আর্টিস্টদের আরো স্পোর্টিং হতে হয়। সাধারণ মানুষ যা কল্পনায় আনতে পারে না, শিল্পীরা অনায়াসে তা পারে বলেই না তারা শিল্পী।” ইত্যাদি অনেক স্তোকবাক্য শোনালেন।

কিন্তু যাই বলুন আমার মনের ভার নামল না। নিজেকে বড় অপমানিত মনে হয়েছিল, আমি কি পরিচালকের হাতের ক্রীড়নক? নিজের মতামত, স্বাধীন সত্ত্বা কিছুই থাকবে না? ভেবেছি আর কেঁদেছি।

আজ ত নায়িকাদের সম্রাজ্ঞীর সম্মান। আমার এ সমস্যা এ-যুগে হাস্যকর। এখন ত নায়ক-নায়িকার একটিমাত্র ইচ্ছে বা সাজেশনই এ-লাইনে বেদবাক্য। এ আঘাত আজও ভুলিনি। তবে এর মধ্যেও ভাববার কথা আছে বৈকি।

এখন চলচ্চিত্রের অগ্রগতির স্বর্ণযুগ। তবুও বোম্বে ফিল্মে আলিঙ্গন ত আছেই অথবা চুম্বনের প্রায়-চালু অবস্থা। কিন্তু এই প্রগতিশীল যুগের বাংলা ছবিতে চুম্বনের অবতারণা করা যায় কিনা এ নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। কিন্তু আজ থেকে সাঁইত্রিশ বছর আগে চলচ্চিত্রের শৈশবে, বাংলাদেশেরই এক পরিচালক চুম্বন-এর দৃশ্যের কথা ভেবেছিলেন এবং তাকে ছবিতে প্রয়োগ করার দুঃসাহসও হয়েছিল—এটা প্রোগ্রেসিভ মাইণ্ডের লক্ষণ নিশ্চয়। তাঁর সঙ্গে সমান তালে আমাদের মন পা ফেলতে না পারলেও, দুঃসাহসিক পরীক্ষার কৃতিত্ব তার প্রাপ্য নিশ্চয়ই। ভালমন্দর বিচার ত আপেক্ষিক।

যাই হোক, দৃশ্যে আমি অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রান্ত হয়ে নায়ককে দুহাতে ঠেলে দেওয়ার জন্য ছবিটি ঠিক পরিবেশনযোগ্য হয়নি এবং সেইজন্যই শেষ পর্যন্ত ঐ দৃশ্যটি এন জি হয়ে গিয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা আজও ভুলিনি। স্টুডিওতে যে বাবুর্চি বা বেয়ারার ওপর আমাদের খাওয়াবার ভার থাকত, আপাতদৃষ্টিতে খুব হাসিখুশি চেহারা। কি বদান্যতা। সবাইকে তাড়াতাড়ি খাওয়াবার সে কি ব্যগ্রতা! কিন্তু ব্যগ্রতার অন্তরালের কাহিনীটুকু আর কেউ জানত কিনা বলতে পারি না, তবে আমার অজানা ছিল না। ওর একটা অভ্যাস ছিল, একজনকে খাইয়ে পাঁচজনের হিসেব দেওয়া। উদ্বৃত্তাংশ যেত তারই ছাঁদায়। অন্য সবার ভাগ্যে কি জুটত জানি না। তবে লাঞ্চ বলতে আমার বরাদ্দ ছিল চায়ের প্লেটে দু’ স্লাইস পাউরুটি, দু-টুকরো আলু ও চার-টুকরো মাংস। ওপর থেকে পরিমাণের সত্যিই নির্দেশ দেওয়া ছিল কিনা বলতে পারি না। তবে আমার হাতে পৌছত ঐটুকু এবং তালিকায় থাকত আমার মত চারজনের উপযোগী ভোজ্যবস্তুর হিসেব।

নায়ক ও পরিচালক

তখনকার যুগের নায়িকাদের ত আজকের মত সাম্রাজ্ঞীর মর্যাদা ছিল না। অত্যন্ত আনন্দের কথা—আজকের যুগের নায়িকা সত্যিকারের শিল্পীর সম্মান পেয়ে থাকেন। তার ইচ্ছে অনিচ্ছেয় শুনেছি নায়ক নির্বাচন হয়ে থাকে। কিন্তু তখনকার দিনের নায়িকা নামেমাত্র নায়িকা, কার্যতঃ প্রযোজক, পরিচালক থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত নায়কদের পর্যন্ত আজ্ঞাবাহিকা ছাড়া কিছুই ছিলেন না। মাঝে মাঝে মনে হোত আমি কি কলের পুতুল। নিজস্ব কোন সত্তা নেই? শুধু অন্যের জুলুম সহ্য করেই জীবনটা কাটাতে হবে। প্রযোজক, পরিচালকদের কথা ছেড়েই দিলাম। তারা তো সবারই প্রভু। কিন্তু অল্প বয়স ও অনভিজ্ঞতার কত সুযোগই না সবাই নিয়েছে। নিরুপায় অবস্থার জন্য গ্লানিভরা মুহূর্তের সে অসহ্য যন্ত্রণা কি ভোলার?

উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক কোন ছবির নায়কের হঠাৎ খেয়াল হোল আমায় ‘ন্যাচারাল ‘অ্যাকটিং’ শেখাবেন। কাজের ফাঁকে সাজঘরে তার হঠাৎ প্রবেশ। কি ব্যাপার! না তোমার অমুক সিনের অভিনয় বড় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আরো ফ্রি হতে হবে। এখন ত সময় আছে। তাই মেক আপের আগে একটু তালিম দিয়ে দেব। তোমার জন্য আমার অভিনয়ও মাটি হয়ে যাচ্ছে যে। একে বয়োজ্যেষ্ঠ তায় সুপ্রতিষ্ঠিত নায়ক। উঠতে হোল।

“দেখ, আমি তোমার হাতটা এই ভাবে ধরলে তুমি আমার দিকে ঠিক এই ভাবে তাকাবে।”

হিরো এগিয়ে এসে আমার ডান হাতটা সজোরে বুকের ওপর চেপে ধরে গদগদ দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পার্ট শেখানোর কোন গরজ তখন অন্তর্হিত— কিন্তু হাত ছাড়ার নামই নেই। মেক-আপ ম্যানকে এরই মধ্যে এক ফাকে চা খাবার পয়সা দিয়ে রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে সরানো হয়ে গেছে। হিরোর অপ্রত্যাশিত উদারতায় সে যতখানি উল্লসিত, আমি ঠিক ততখানিই শঙ্কিত।

হাতের মুঠির চাপ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। আর সহ্য করতে না পেরে বললাম—

“বুঝেছি, ছাড়ুন। সময় হয়ে এল যে। মেক-আপ শেষ করতে হবে না?”

“না, না—সময় এখন হয়নি। শোন, অভিনয়ের সবচেয়ে বড় জিনিস হোল ‘এক্সপ্রেশান’। আর সেটি নিখুঁত করতে হলে কোন রকম জড়তা থাকলে চলবে না।” “কিন্তু হাতটা যে গেল। এবার ছাড়ুন। এখনও কি দেখানো শেষ হয়নি?”—–একটু বিরক্ত হয়েই বলি।

“এত ধৈর্য কম হলে চলে?” বলে ডান হাত ছেড়ে বাঁ হাত ধরে সে কি বক্তৃতার পালা, “জানো—তোমরা এদেশের মেয়েরা ব্যাকওয়ার্ড বলেই অভিনয়ে এত কাঁচা? ওদেশের অভিনেত্রীদের কত ‘প্রগ্রেসিভ্ আউটলুক’। জড়িয়ে ধরা অথবা চুমু দেওয়া তাদের কাছে ডালভাত।” বলতে বলতে ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে আসা হিরোদের চোখেমুখে ফুটে উঠত কি নির্লজ্জ লুব্ধতা আর স্থূল লোলুপতা। সারা শরীর যেন ঘৃণায়, ভয়ে শিউরে উঠত। ইচ্ছে হোত ছুটে পালাই।…

এতেও কি ছাড়ান আছে? নায়ক যে আবার স্টুডিও সেটের বাইরেও তাঁর নায়কের রোল প্রলম্বিত করতে চাইতেন। সে যে কি বিড়ম্বনা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রতিদিনই টেক্ অথবা রিহার্সালের সময় কাছ ঘেষে বসে “অমুক ছবি এসেছে–গ্রেটা গার্বো তাতে যা অভিনয় করেছে তোমার দেখা দরকার। অভিনয় কাকে বলে বুঝবে, শিখবে।” আমি বাড়ির কাজের দোহাই দিয়ে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করি।

পরের দিন আসে শিশিরবাবুর অভিনয় দেখতে যাবার আমন্ত্রণ। সেও কোনরকমে এড়ানো গেল। তারপরের দিন মনটাকে চাঙ্গা করবার জন্য লেকের ধারে বেড়াতে যাবার আহ্বান—পাশ্চাত্য অভিনেত্রীদের ‘স্পোর্টিং নেচার’-এর উদাহরণসহ। তা থেকেও যদি বা পালাতে পারি তার ক্রুদ্ধ অপমানিত অস্তরের নীচতা থেকে রেহাই পাওয়া দায় হয়ে ওঠে। কারণে অকারণে কর্তৃপক্ষের কাছে আমার আচরণ ও উদ্ধত স্বভাবের বিরুদ্ধে নালিশ, আমার অভিনয়ে স্বতস্ফূর্ততার অভাবের দরুন ‘‘ইম্পর্টেন্ট’ রোল থেকে বাদ দিয়ে দেবার জোর সাজেশান। ওপরওয়ালা যদি বা আমার হয়ে ওকালতি করলেন, “কিন্তু মুখখানি ছবিতে বড় ভালো আসে। চেহারা দেখেই তো দর্শকরা কাত। অভিনয় ক্রমশঃ শিখে নেবে এখন।” হিরোর মুখ ভার। “ঐ তো আমাদের ডিফিকাল্টি স্যার। যা বলব কোন কথাই কানে নেবেন না। ‘কো-এক্টার’ ভাল না হলে অভিনয় খোলে? গরীবের কথাটা সত্যি কিনা বই রিলিজ হলেই বুঝবেন।”

তারপর প্রতিশোধ নেবার অন্ধ জেদে— সেটে আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে অন্যদের কাছে সদ্য দেখা কোন বিদেশী ছবির রসালো রসালো আলোচনা যে ভাবে ও ভাষায় চলত—হাল আমলের আধুনিকতম ঔপন্যাসিকও তা শুনলে লজ্জা পেতেন। এটা আমাকে এক রকম ‘ইনডিরেকট টরচার’ আর কি! উদ্দেশ্য ‘ফাইনাল টেকে’র আগে আমার রুচিবিগর্হিত টপিকের অবতারণা করে আমার মুড নষ্ট করে দিয়ে ডিরেকটরের কাছে অন্যমনস্কতা ও অযোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা।

বইয়ের কাভার

এ তো গেল নায়ক-সংবাদ। পরিচালক-সংবাদ আরো ভয়াবহ। ধরা যাক কোন এক নাম-করা ডিরেকটরের কথা। অমিত পানদোষ এবং রেসখেলা থেকে শুরু করে কোন গুণেই যাঁর ঘাটতি নেই। তাঁর অহেতুক কৃপাদৃষ্টিতে পড়ে শুধু বিব্রত নয়, এমন বিপন্ন হতে হয়েছে যে এভাবে কাজ করা সম্ভব কিনা—অথবা এ লাইন ছেড়ে অন্য কোন্ কাজ করা যায় সেকথাও ভাবতে শুরু করেছি। প্রথম যখন তার সঙ্গে কাজ করি আমার প্রতি পদক্ষেপে, প্রতি ‘এক্সপ্রেশানে’ তিনি বিরাট সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেতেন। এমন কি আমার ভুল-ত্রটিও তার কাছে অসাধারণ প্রতিভাজাত অন্যমনস্কতারই রূপান্তর বলে হোত। অবসর সময়ে সম্ভব অসম্ভব নানা গল্প বলে অল্পবয়সের ভাবপ্রবণ মনকে বিস্ময়বিহ্বল করে রাখতেন। বিভিন্ন লোকের ‘টেম্পারমেণ্ট’ বুঝে রকমারি গল্প ফেঁদে যে কোন মানুষের মনকে একেবারে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার দক্ষতা যেন তাঁর সহজাত ক্ষমতা। এমনই নানা রকম গল্প করতে করতে হঠাৎ একদিন রেসের কথা তুললেন। কিভাবে কপর্দকশূন্য ব্যক্তিও একনিমেষে কোটিপতি হয়ে যেতে পারে তারই চমকপ্রদ চিত্র এমন কুশলতায় এঁকে গেলেন যে অনভিজ্ঞ তরুণ মন অভিভূত না হয়ে পারে না। আমিও আত্মবিস্মৃত হয়ে রেসের ঘোড়া কেমন করে ছোটে কেমন করে মানুষ এমন আলাদীনের প্রদীপ হাতে পায় ইত্যাদি জিজ্ঞাসাবাদে মেতে উঠলাম। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই হয়ত হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, “যাবে একদিন ‘রেস’ দেখতে? চল না, দেখবে তোমাকেই একদিন কত টাকা পাইয়ে দিই।”

ঐ টাকা পাওয়ার কথাটাই যেন চাবুকের মত আঘাত করে আমার সম্বিৎ ফিরিয়ে আনল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল মার কাছে শুনেছি রেস, জুয়া এসব ভাল জিনিস নয়। এসব জিনিস মানুষকে বিভ্রান্ত করে একেবারে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। এই পাপপুণ্য বোধটা যেন সংস্কারের মত মজ্জায় গেঁথে গিয়েছিল। হয়ত সেই জন্যই রেস খেলার কথায় সভয়ে আঁতকে উঠে বললাম, “ওরে বাব্বাঃ! না, না, না! ওসব রেস-ফেসের ব্যাপারে আমি নেই।”

“আচ্ছা নাই খেললে। একদিন রেস কোর্সে গিয়ে খেলা দেখতে ক্ষতি কি?”

“না না—মা ভীষণ বকবেন। শুধু কি বকা? আমি ঐসব জায়গায় গেছি শুনলে হয়ত নাওয়া খাওয়াই বন্ধ করে দেবেন—কিংবা মনে কষ্ট পেয়ে একটা অসুখ-বিসুখে পড়বেন। মার মনে আমি কিছুতেই কষ্ট দিতে পারব না।”

একমাত্র মার ক্ষেত্রেই ছিল আমার সীমাহীন দুর্বলতা এবং সেইখানেই আমার শক্তি। হয়ত সেই জন্যই অত জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে পেরেছিলাম। যাই হোক ও নিয়ে সেদিন আর জোর করলেন না। কিন্তু কয়েকদিন বাদে এক শনিবার স্টুডিওতে দেখা হতেই এক কোণে আমায় ডেকে নিয়ে হাতে এক গোছা নোট দিতেই চমকে উঠলাম।

মনে হোল সাপে যেন ছোবল মারল। “আমি ত আপনার কাছে কোন টাকা পাই না?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।

“কে বললে পাও না?” বলেই এমন একরকম করে হেসে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ খুব কাছে সরে এসে বললেন, “জান তুমি লাকি স্টার? তোমার নাম করে খেলে এবার অনেক টাকা পেয়েছি গো।—তারই কিছুটা তোমার প্রাপ্যহিসাবে দিতে এলাম। তোমার মত ধার্মিক না হলেও আমারও ত একটা ধর্ম অধর্ম আছে? না-কি?”—বলেই টেনে টেনে সে কি অস্বাভাবিক কদর্য হাসি। কথার ভাব৩ঙ্গি, হাসি রসিকতা এত নোংরা। এর পর ওঁর কাছাকাছি থাকতেও নিজেকে ক্লেদাক্ত মনে হোল। আমি চলে আসবার চেষ্টা করতেই হাত ধরে টানলেন– “কি বোকা। এভাবে নিজেকে বঞ্চিত করে?”

“কেন আপনি এভাবে আমায় আপমান করছেন? ছেড়ে দিন।” বলে একরকম জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য ঘরে যখন ছুটে পালিয়ে এলাম নিজেকে আর সংবরণ করা গেল না। অন্য মেয়েরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করবার সাহস পাচ্ছে না।

কারণ সবাই জানত আমি ভীষণ চাপা। কেউ বা ভাবত অহঙ্কারী—সে কথা ত আগেই বলেছি। তবু কথা চাপা থাকে না। কোন না কোন ভাবে এর ওর কানে যায়।

ঠোট উল্টে বলেন, “কত ঢং দেখব”। এতগুলো টাকা হাতে পেয়ে ছেড়ে দেওয়াটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। কেউ বা বলেছে নিজের দাম বাড়াচ্ছে। বোঝো না? উপরি পাওনার মতই এসব পরিপাক করেছি। কারণ নীরবে সহ্য করা এবং বিরলে অশ্রু-মোছাটা একরকম অভ্যাসেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।

কিন্তু বিপদ এল অন্যদিক থেকে। যাঁর একটু হাসি, দুটো কথার জন্য সবাই লালায়িত আমার মত সামান্যা অভিনেত্রীর পক্ষে তাঁরই এতবড় অনুগ্রহের দান প্রত্যাখ্যান করার স্পর্ধা তিনিও সহ্য করেননি। তারই পরিণামস্বরূপ নানাদিক থেকে নির্যাতন শুরু হোল। অসাধারণ প্রতিভাময়ী হয়ে উঠলো “হোপলেস—একেবারে কিছু নয়”। তার সামান্য ত্রুটিও অসামান্য অপরাধ। আর ত্রুটি না থাকলেই বা খুঁজে নিতে কতক্ষণ? – সবার সামনেই আমায় অহেতুক অপমান এবং তা এত স্থূলভাবে যে আমার প্রতি তাঁর আক্রোেশ কারো কাছেই আর গোপন রইলো না। এই হোল আমার কর্মজীবনের অনাবৃত ছবি। এহেন জীবনকে যদি গোড়ার দিকে ভালো বাসতে না পারি—অথবা ভয়াবহ মনে করে থাকি সে কি আমার অপরাধ? এ যেন ক্ষুরের ধারে চলা—এদিকে পড়লে খাদ। ওদিকে গহবর। যদি এদের খেয়ালখুশীর কাছে আত্মসমর্পণ করতাম তবে তলিয়ে যেতাম কোন অতলে। আবার এঁদের অমান্য করব এমন জোরই বা কোথায়? তাহলে যে মাকে নিয়ে নিরঙ্কু উপবাস ও মৃত্যুবরণ। নিজের ক্ষতি যদি বা সহ্য হয় মাকে হারানোর দুঃখ ত সইবে না। যে বয়সে মেয়েরা অভিভাবকদের নিশ্চিন্ত স্নেহাশ্রয়ে হেসেখেলে বেড়ায়—সেই বয়সে জীবিকা সম্বন্ধে কি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বোঝাই না আমার মাথার ওপর চেপেছে। যে মুহূর্তে শুচিতার স্বপ্ন দেখা স্পর্শকাতর মন বিদ্রোহী হয়ে উঠত ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার বিপরীত চিন্তাধারায় মনের মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে বিরুদ্ধ অবস্থার সঙ্গে আপোস করার করুণ প্রয়াস–কি কোনদিন ভোলবার?

বারবার মনে হোত তখন শুদ্ধ সুন্দর জীবন রচনা করে এতবড় অবিচারের জবাব দিতে পারব কি কোনদিন?

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →