Main menu

ঢাকা ডায়েরি

“বিদেশে দীর্ঘ সময় থাকার পর যারা দেশে ফিরে আসে তাদের চেহারায় একটা বোকা বোকা ভাব এসে জড়ো হয় যেটা সারাজীবনেও তারা কাটায়ে উঠতে পারে না।” – শাহবাগের / সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের এক বড়ো ভাই এই কথা বললেন ২০০৫ এর দিকে। উনার কথা শুনে আরও বোকা হয়ে গেলাম। তখন সবে মাত্র বাইরের একটা দেশ থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরছি। সবার মুখে একই প্রশ্ন – ফিরলেন ক্যান। নিজেও ভাবা শুরু করছি – ফিরলাম ক্যান, অবশ্য ফেরার প্ল্যান নিয়েই বাইরে গেছিলাম, থাকার প্ল্যান ছিল না। তারপরেও – এই প্রশ্ন নিজের মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করে যে দেশে, বা নিজের জন্ম শহর এই ঢাকায় ঠিক কী আছে যেটার একটা আন্তর্জাতিকভাবে সত্যিকারের ভ্যালু থাকতে পারে। মানে, ঢাকায় ঠিক কী আছে যেটা, নিজেকে যদি বিশ্ব নাগরিক ভাবি, তাইলে আমার কাছে ভ্যালুয়েবল একটা জিনিস মনে হবে, যেটা কিনা অন্য দেশের অন্য শহরে নাই।

.
আমার এই ভাবনাটা আমি এক পর্যায় শেয়ার করি তৎকালীন একটা উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করা আমার এক কলিগ বন্ধুর সাথে। তিনি কলিগ হবার আগে থেকেই আমার বন্ধু, আর নিজেও নানা দেশ ঘুরে মুরে আসছে । ফলে বিষয়টা তৎক্ষণাৎ তিনি অনুধাবন করতে পারেন। আর তার সেইমুহূর্তের তাৎক্ষণিক উত্তরটাও খুব অসাধারণ। উনি (সে) বলে উঠেন, আরে, পৃথিবীর অনেক দেশে আপনি ‘আধুনিক’ লাইফ দেখতে পাবেন। কিন্তু ‘উত্তর-আধুনিক’ লাইফ খুঁজতে হইলে এই ঢাকা।

ধরেন একটা মানুষ হাঁটতে হাঁটতে ঢাকনা-বিহীন একটা ম্যানহোলে পড়ে গেল। এই যে এই বাস্তবতা – এইটা আপনি পৃথিবীর কোনো উন্নত বা আধুনিক শহরে খুঁজে পাবেন না। এই ধরণের জিনিসগুলা থেকে আনন্দ লাভ করা শিখতে হবে।
ঐসব দেশে সবকিছু সাধারণত একটা সিস্টেমের মধ্যে চলতেসে।
অনেকটা যেন একমাত্রিক একটা লাইফ। কিন্তু ঢাকা শহরের লাইফ বহুমাত্রিক।

এই যে ক্ষমতার কেন্দ্রের এত এত এলিমেন্ট (ধরা যাক বড়ো বড়ো আন্তর্জাতিক অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা আন্তর্জাতিক আধুনিক জীবন ব্যবস্থা) – আবার তারই সাথে প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর কালচারের এলিমেন্টের প্রবল মিশ্রণ বা সহাবস্থান (যেমন, ডাব বিক্রি, শিয়ালের তেল বিক্রি, কবিরাজের গাছ গাছরা শিকড় বিক্রি, টুপি তসবি বিক্রি, চটের বস্তা, কাগজের প্যাকিং, সিলোফেন, রিকশা, গাড়ি, লারেলাপ্পা বাস, আধুনিক গাড়ি – তার সাথে সাথে মানুষের নানারকমের ন্যারেটিভের সহাবস্থান এই যে এই এক শহরে – এই জিনিসটা ইউনিক।

ভেবে দেখি যে খারাপ বলেন নাই ইনি। এত বিচিত্রতা, কালচারে, ব্যাকগ্রাউন্ডে, বেড়ে ওঠায়, বিশ্বাসে, সমাজে প্রচলিত ন্যারেটিভে – এই এত এত ভ্যারাইটির প্রবল সহাবস্থান এক সাথে কোনো একটা শহরে খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর।

.

রাদ আহমদের তোলা ছবি

এর কিছুদিন পরে ঐ একই সংস্থায় বিদেশে বড়ো হয়ে ওঠা এক বাংলাদেশী ছেলে এসে আমাদের কলিগ হন, আর আমাদের সাথেও বেশ জমে যায় । এর কিছুদিন পরে তার ফরাসী বান্ধবী তাকে ভিজিট করতে আসেন আর এক সন্ধ্যায় আমাদের সবার একসাথে আড্ডা দেবার সুযোগ হয়। তো এক পর্যায় আমি কথা চালাবার স্বার্থেই সেই তরুণীকে জিজ্ঞাসা করি যে বাংলাদেশে এসে তার কেমন লাগতেছে, বা এইখানে এসে কোন জিনিসটা তার কাছে ইন্টারেসটিং মনে হইসে।

তিনি উত্তর দেন, এই যে একটা মেইনরোডে নানা স্পিডের বাহন এক সাথে চলতেছে , রাস্তায় কোনোরকমের ডিভাইডার ছাড়া – এই জিনিসটা তার কাছে খুবই অভিনব একটা ব্যাপার মনে হইসে। মানে, এই যে রিকশা, টেম্পো, সিএনজি, গাড়ি, বাস, ঠেলাগাড়ি, বাচ্চাদের স্কুলে নেবার ভ্যান – সবরকম গতির গাড়ি এই একই রাস্তা দিয়ে নির্বিবাদে চলাফেরা করতেছে – এইটা খুবই ইন্টারেসটিং একটা ব্যাপার। উনি কল্পনাও করতে পারেন নাই পৃথিবীর কোথাও এইরকমের কিছু একটা থাকতে পারে। তাদের দেশে বড়োজোর গাড়ি আর বাস, এই দুই গতির বাহন এক সাথে চলতে পারে, তাও স্লো হবার কারণে বাসগুলি সাধারণত বামের লেইন দিয়েই চলবে। সাইকেলের জন্যে পুরা আলাদা রাস্তা। কিন্তু বাংলাদেশে এই নানা পদের বাহনের একযোগে একই লক্ষ্য অভিমুখে যাত্রা – এটা খুব অন্যরকম লাগছে উনার কাছে।

তো এইবারেও পেয়ে গেলাম ঢাকার আরেক বৈশিষ্ট্য, যেটা আন্তর্জাতিক মহলে ইউনিক।

.
তো আমার কথা হলো যে – এই ইউনিক বা স্বতন্ত্র জিনিসটাকে সেলিব্রেট করা-টা জানতে হবে। কারণ এটাই বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে দামী। এই অন্যরকম মিশ্রণটা যেহেতু অন্য কোথাও সহসা পাওয়া যাবে না (হয়তবা উপমহাদেশে বা এশিয়ার কিছুটা আছে) – ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে এটার মূল্য অন্যরকম, এবং দামী।

.
ঢাকা শহর ইদানীং (গত এক দুই দশক ধরে বলা যায়) খুব কিম্ভূত-কিমাকার হয়ে উঠতেছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানারকমের মানুষের আগমন এবং মিশ্রণ, তার সাথে সাথে এসকল আগত তরুণদের ক্রিয়েটিভিটি, এবং তার সাথে সাথে আমাদের দেশীয় মানুষদের কিছু কমন বৈশিষ্ট্য – যেমন দয়া মায়া মমতা বোধ, সহজে মেনে নেয়ার প্রবণতা, একটা আধ্যাত্মিক ঔদাসীন্য, আবার তার সাথে সাথে নাগরিক/আন্তর্জাতিক নানা এলিমেন্ট – এই সকল এসে মিশ্রিত হতেছে আর এসবের একটা আলাদা মজার, রসিক, স্বতন্ত্র, আর অদ্ভুত রূপ আছে।

.
আর এই অদ্ভুত রূপটাকেই (আমার মতে) চমৎকার ভাবে তুলে ধরসেন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার রাহুল তালুকদার । যেইরকম অদ্ভুত সেইরকম হিউমারে পূর্ণ উনার ছবিগুলা। আবার অন্যদিকে এই এত এত সব এলিমেন্টের জন্মদাতা কিন্তু ঢাকা নিবাসী সাধারণ মানুষেরাই। এই কারণে আমি উনার আলোকচিত্র বা ডকুমেন্টারি-ফটোগ্রাফির একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হিসাবে জারি আছি।

জনাব রাহুল তালুকদারের ঢাকা শহরের ফটোগ্রাফির একটা এলবাম, নাম ‘ঢাকা অপেরা’ তার লিংক নিচে দিচ্ছি:

(1) Facebook

.
বিদেশে অবস্থানরত কেউ কেউ মাঝে মাঝে বললেন যে ঢাকায় সেলিব্রেট করার কিছু নাই। উনারা একধরণের মায়ায় আক্রান্ত হইলেন। আমি বলি, যে, না, এইগুলি আছে। এই জিনিস দুনিয়ার অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না। চমৎকার একটা ইউনিক অপেরা চলতেছে পুরা ঢাকা শহর জুড়ে।

.
শুধুমাত্র জ্যাম আর গরমটা না থাকলে ব্যক্তিগতভাবে ঢাকাকে দশে দশ দিয়ে দিতাম আমি।

রাদ আহমদের তোলা ছবি

The following two tabs change content below.
Avatar photo

রাদ আহমদ

কবি। ফ্রিল্যান্স প্রোগ্রামার। থাকেন ঢাকায়।
Avatar photo

Latest posts by রাদ আহমদ (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →