দুধ খামারীর মার্সিডিজ ট্রাক
ফ্যাক্টরির শ্রমিকেরা যার যার গাড়ি চালিয়ে এসে ফ্যাক্টরির বাইরে পার্ক করে অসহযোগ আন্দলোনে যোগদান করলেন। উনারা ফ্যাকটরিতে অবস্থান করে সারাদিন কোনো কাজ করবেন না। গত কয়েকদিন ধরেই অচলাবস্থা চলতেছে। এর মধ্যে মালিকপক্ষ আমাদের মতো ২০ জন সিকিউরিটি পারসোনেল নিয়োগ দিছেন – আমাদের মূল উদ্দেশ্য – এই আন্দোনে ফ্যাক্টরির যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য প্রপার্টি যেন অক্ষত থাকে – সেইটা দেখা। শ্রমিকেরা তাদের আন্দোলন নিয়ে ব্যাস্ত আছেন – আমরা আমাদের ডিউটি নিয়ে। দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমস্যা নাই।
.
তো এই ঘটনা থেকে যেইদিকে চোখ ফিরাতে চাই সেইটা হলো – শ্রমিকদের পার্ক করে রাখা গাড়িগুলি। শ্রমিকেরা নিজেদের গাড়ি চালিয়ে ফ্যাকটরিতে কাজ করতে যাবেন – এইটা আমার দৃষ্টিতে অভাবনীয়। ২০০৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মেলবোর্নে ছিলাম উচ্চতর পড়াশুনার জন্যে, আর পড়াশুনার ফাঁকে রাজ্য-সরকার কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন দেয়া সিকিউরিটি পার্সোনেল অথবা ‘ক্রাউড কন্ট্রোলার’ হিসাবে কাজ করতাম নিয়মিত । নাইট-ক্লাবে, ক্যাসিনোতে ডিউটি দিলে আমাদেরকেই লোকমুখে বলে ‘বাউন্সার’। পড়াশুনার পাশাপাশি মাঠে ঘাটে কাজ করার ফলে ঐ দেশের মানুষজন, হালচাল – এইসব কিছুটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটে।
.
হিসাব করে দেখলাম মেলবোর্নে (অথবা বলা যায় ভিক্টোরিয়া স্টেটে) সেই সময় যেই ন্যূনতম মজুরী বিদ্যমান ছিল সেই মজুরীতে যদি কোনো স্বামী স্ত্রী দুইজন মিলে কাজ করে থাকেন তাইলে সুন্দর ভাবে গাড়ি করে, বাড়ি করে, নাগরিক জীবনের অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে, বাচ্চাদেরকে স্কুলে পড়িয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন তাঁরা। গাড়ি হয়ত আগে আগে হবে যেহেতু গাড়ি সস্তা। বাড়ি সামান্য দেরি হতে পারে – হয়ত অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পাড়া-গুলিতে বাড়ি হবে – কিন্তু সেই অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পাড়াগুলি যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন আর সুন্দর। নাগরিক সুবিধা যুক্ত।
.
অন্য আরেক উদাহরণ:
.
এক বাঙালি ভদ্রলোক একটা প্রোগ্রামের অংশ হিসাবে গেছিলেন অস্ট্রেলিয়াতেই অন্য আরেক শহরে। শহর না বলে গ্রাম বলা উচিৎ। উনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল গ্রামীয় এলাকায় একজন দুধ-খামারীর বাড়িতে। উনি মজা করে বলতেছিলেন – একদিন ভোর পাঁচটার সময় উঠে দেখেন যে বাড়ীর কর্তা, তার স্ত্রী আর পাঁচ বছর বয়েসী শিশু – তিনজন মিলে খামারের সবগুলি গরুর বাটে দুধ সংগ্রহের যন্ত্র স্থাপন করলেন। দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে দুধ সংগ্রহ শেষ হলে পরে উনারা গ্যালন গ্যালন দুধ কন্টেইনারে ভরে উনাদের ট্রাকে উঠালেন, আর তারপর অন্যত্র ডেলিভারি দিতে নিয়ে গেলেন। তো, তাঁদের দুধ ডেলিভারির জন্যে এইরকমের দুই তিনটা ট্রাক আছে – যেগুলি হলো সব দামী দামী মডেলের। মার্সিডিজ, ভলভো ইত্যাদি -এইসব। দুধ খামারীর থাকবে মার্সিডিজ ট্রাক – এইটা আমাদের জন্য অকল্পনীয়।
.
এইছাড়াও – আমি নিজে নিজে কয়েক মাসের মধ্যে একটা তূলনা চিন্তা করলাম। দেখলাম, ধরা যাক ঢাকা শহরে একজন শ্রমিক যে পরিমাণ টাকা আয় করেন – হয়ত তিন থেকে ছয় মাসে, খরচের পরে অল্প অল্প করে জমালে উনি নিজের গ্রামের বাড়ি একবার ঘুরে আসতে পারবেন, বাসে বা লঞ্চে করে যাতায়াত করবেন। কিন্তু একইভাবে মেলবোর্ন শহরে যদি কোনো বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করে থাকেন, তাইলে সেই একই সময় – অর্থাৎ তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে, একবার ঢাকা ঘুরে যাওয়ার মতো টাকা উনি জমাইতে পারবেন। কিন্তু উনার যাওয়া আসা হবে এরোপ্লেনে। অর্থাৎ দুই জায়গাতে বিষয়টা একই, দুইজনই শ্রমিক, কিন্তু এক জায়গাতে অর্থের যোগান অনেক বেশি।
.
ওই দেশের সরকার বা সমাজ, সমাজের নানা শ্রেণীর মধ্যে অর্থের সুচারু ডিস্ট্রিবিউশনের দিকে অনেক আগে থেকেই মনোযোগ দিছেন, এবং ক্রমান্বয়ে এতদিনে এসে সফলকাম হইছেন। শ্রম-নির্ভর মানুষদের রীতিমতো ভালোভাবে খেয়ে পরে থাকার ব্যবস্থা করে দিছেন।
.
এই কারণেই, মোটা দাগে হয়ত বলা যায়, শ্রমজীবিরা ঐ দেশে হয়ে উঠছেন মধ্যবিত্ত।
.
উচ্চবিত্তও আছে। সংখ্যায় কম। আমার একজন ফ্ল্যাট-মেট – মহারাষ্ট্রের সাচিন – চমৎকার মানুষ – আমার কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়া গেছে – ফলে তার অভিজ্ঞতা বেশি। একদিন গল্পচ্ছলে বলল – “তুমি বিশ্বাস করবা না রাদ – এই দেশের বড়লোকদের সন্তান আছে কিছু – তারা দিনের পর দিন – কোনোরকম কাজ না করে বাপ মায়ের বাড়িতে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে সময় কাটিয়ে দেয়।” – আমি বুঝলাম এই বিষয়টি বিশেষভাবে আমাদের নজরে পড়ে – কারণ পক্ষান্তরে আমরা, স্টুডেন্ট অথবা অন্যান্যরা, এক টানা মাত্র তিন দিন যদি কাজ না করি – তাইলে চাউল কেনার টাকা পর্যন্ত হাতে থাকে না। কাজের ভিতরে থাকলে পর্যাপ্ত টাকা আছে, কাজ না থাকলে অবস্থা শোচনীয়।
.
এই কথা থেকে যেই বিষয়টা টেনে বের করতে চাই – সেটা হলো – উচ্চবিত্ত ঐ দেশে নাই – সেইটা না – উচবিত্ত-ও আছে – যাদের জীবনযাপন নব্বই ভাগ মানুষের সাথে মিলবে না। অন্যান্য দেশের উচ্চবিত্তের মতই। অর্থাৎ, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত – এই শ্রেণীগুলির অস্তিত্ব আছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত যেন সংখ্যাগুরু। আর,ঐ দেশের শ্রমিক আর কৃষকেরাও, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হইল, এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই অন্তর্গত।
.
***
.
আরেক ভাবে এপ্রোচ করা যায় বিষয়টার দিকে। রুচি, টেইস্ট বা সংস্কৃতির দিক থেকে। একটা দেশ বা সমাজের সংস্কৃতি, জ্ঞান, গরীমা, সভ্যতা নির্ধারণ, লালন আর প্রচার করে থাকেন তাদের দেশের মধ্যবিত্ত – এইটা অনেকে বলেন।
.
এই যে আমরা নিজ দেশে বসে পশ্চিমা পপ বা অন্যান্য Genre-র গানগুলি শুনে পুলকিত হতেছি – সেই গানগুলিকে কিন্তু লালন করছে, বাঁচিয়ে রাখছে, ইনোভেট করতেছে ঐ দেশের সংখ্যাগুরু মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষেরাই। ঐ দেশের কৃষক আর শ্রমিকেরা যেই শ্রেণীর অন্তর্গত।
.
রুচি বা সংস্কৃতির বিষয়টা আসছে বলেই তাদেরকে পুনরায়, জোরালোভাবে ‘মধ্যবিত্ত’ তকমা দিতে চাইতেছি।
.
আমার নিজের অভিজ্ঞতা মতে, ধরা যাক, প্রতি তিন কি চার (অথবা সাত) বছরে একটা করে নতুন বাংলা গান আবির্ভূত হতেছে আমাদের দেশে – যেটা সত্যিকারভাবে উন্নতমানের কিংবা স্বকীয়। আমি বলব – সেইরকমের স্বকীয় আর উন্নত মানের ইংরেজি গান ওই দেশে প্রতি সপ্তাহে এক থেকে তিনটা করে জেনারেট হতেছে। (ছয় সাত বছরে ওসব গানের মধ্যে থেকে অল্প একটা কি দুইটা গান, নানা হাত ঘুরে আমাদের দেশের শ্রোতামণণ্ডলীর কাছে আসত ইন্টারনেট যূগের আগে)। শুধু অস্ট্রেলিয়া না, অন্যান্য ইংরেজি ভাষাভাষী দেশ – কানাডা (আংশিক যদিও। ফ্রেঞ্চের সাথে সমান তালে), ইউকে, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড – এইসব দেশে প্রতি সপ্তাহে উৎপন্ন শয়ে শয়ে নতুন গান নানা ভাবে স্ক্রিনিং হয়ে হয়ে (রেডিওতে, নিজের লোকালিটিতে) শেষপর্যন্ত ওদের সাপ্তাহিক চার্ট গুলিতে উঠে আসে (বিলবোর্ড ও অন্যান্য চার্ট), এবং সেইসব চার্টের টপ টেনে নিঃসন্দেহে দুই কি তিনটা নতুন গান পাওয়া যাবে যেগুলির মেকিং, ইনোভেশন, অরিজিনালিটি – চমৎকার আর মানোত্তীর্ণ। ওদের সংস্কৃতি জীবন্ত, আর এটাকে চালু রেখেছে সেই মধ্যবিত্তই। পুনরায় বলতে চাই, শ্রমজীবিরা যার অন্তর্গত।
.
***
.
আমাদের এদিকে কী? কৃষক বা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচলিত অরিজিনাল গান আমাদের মধ্যবিত্ত লেভেলে ঠাঁই পেতেছে না। কবিদের লড়াইয়ের গান – আধ্যাত্মবাদ নিয়ে লড়াই – চমৎকার তাল, সুর , গায়কী, চলতেছে দুই গায়কের মধ্যে – একটা সস্তা, ছাপরা চায়ের দোকানে শুনতে পেয়েছি সেদিন কাওরান বাজারের কাঠপট্টিতে। – একটা সিডি প্লেয়ার জাতীয় যন্ত্রে বাজতেছিল। এই গান আমাদের মধ্যবিত্ত নিয়ন্ত্রিত টিভি বা এফ এম চ্যানেলে জীবনেও শোনা যাবে না। একই ধরণের আরেকটা গান – ‘রাত্র অধিক হইল/ কেহ না সঙ্গে ছিল/ করিতে গেলেন নবী ইসলাম জারি/ আবু জেহেলের বাড়ি’ – এই চমৎকার এন্টারটেইনিং গান, বুদ্ধিদীপ্ত ছন্দের মিলের গান কয়জন শুনছেন?
.
আমরা ফিউশন করতেছি অবশ্য। সেখানেও অনুকরণ। খারাপ না, তবে অনুকরণ করলে তো ভালো ভাবে করতে হবে। ভালোটাও শিখে নেওয়া দরকার। বিদেশি স্টেজ পারফরমেন্সে যদি ‘কয়ার’ গায়িকা থাকে – অর্থাৎ ঐ যে পিছনে তিন কি পাঁচজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে গানের কলির রিপিট করে থাকেন অথবা হারমোনাইজ করার জন্য ভিন্ন সুরে গেয়ে উঠেন ব্যাকগ্রাউণ্ডে – তাদের প্রত্যেকটা মুভমেন্ট সিনক্রোনাইজড থাকে। অর্থাৎ, গানের সাথে সাথে যে হালকা মুভমেন্ট বা নাচ তারা করে থাকেন – সেগুলি প্রত্যেকের একেবারে একই সাথে ঘটে থাকবে। ডানে হেললে সবাই ডান, বামে হেললে সবাই বাম। এটা দর্শকদের জন্য একটা চোখের তৃপ্তি, এটা পুরা পরিবেশনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের এদিকে অধুনা টিভিতে পপুলার কয়ার-সমৃদ্ধ ফিউশন গানে নানা জন নানা দিকে দুলতে থাকে।
.
আমাদের এইদিকে মধ্যবিত্ত যেন জনবিচ্ছিন্ন -এইরকম বলতে চাইতেছি। শ্রমিক বা কৃষকশ্রেণীর মানুষেরা এখনও সম্পূর্ণ মধ্যবিত্ত হয়ে উঠেন নাই। এই দেশের যাত্রাশিল্প – বা অন্যান্য লোকশিল্প – ধুকপুকানো, মৃত্যুপথযাত্রী। অথচ – যাদের দ্বারা প্রভাবিত হতেছি – তারা কিন্তু সেই লোকশিল্পকেই ক্রমাগত শক্তিসালী করে করে আজকের পর্যায় নিয়ে আসছে। অর্থ বিনিয়োগ করছেন লোকজ ব্যবসায়ীরা। শিল্পীরা নানারকম ইনপুট দিছেন যুগে যুগে। মানুষের জন্যে এন্টারটেইনিং করে তুলছেন পরিবেশনাগুলা।
.
একটা হালকা উদাহরণ দেয়া যায়। নিচের গানটি দেখা যেতে পারে। ‘O sole mio’ নামে পুরনো গান। (এই গানের সুর নিয়ে পরবর্তীতে এলভিস প্রিসলি তাঁর পপুলার ‘It’s now or never’ গানটা গাইছিলেন)।
.
মূল পুরনো ইতালীয় (প্রকৃতপক্ষে Neapolitan) গানটা ওদের অধুনা তিনজন শিল্পী স্টেজে এসে গাইছেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে ওদের অঙ্গভঙ্গী দেখা যাক। পরস্পরের সাথে খুনশুটি। এই আচরণগুলিও পরিবেশনার অংশ। এই আচরণ – বা শৈল্পিক কায়দার মূল বা শিকড় ধরে নেয়া যেতেই পারে ওদের লোক-কালচার থেকে টেনে নিয়ে আসা। মধ্যযূগে প্রচলিত স্ট্রিট পারফর্মেন্স থেকে।
.
.
তাদের গায়ের চোস্ত জামাগুলি, এবং স্টেজের অন্যান্য উপকরণগুলি দেখা যেতে পারে – কিরকম দামী, সুন্দর, খানদানী। তাদের দর্শকদের মান বা শ্রেণী সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে। কিরকম অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আর ভালোবাসা পেয়েছেন শিল্পীরা।
.
মোট কথা, মেঠো সংস্কৃতিতে, যুগে যুগে ক্রমাগত অর্থ, ভালোবাসা আর সম্মান বিনিয়োগ করে করেই সম্ভবত এইরকম একটা পারফর্মেনন্স-এ উপনীত হওয়া যায়। শক্তিসালী সংস্কৃতি গড়া যায়। আমাদের দেশেও হয়ত হবে একসময়, দুর ভবিষ্যতে। তবে ‘কলকে’টা দিতে হবে এখন যারা দরিদ্র – তাদের হাতে। শ্রমজীবিরা মধ্যবিত্ত হয়ে উঠুক।
রাদ আহমদ
Latest posts by রাদ আহমদ (see all)
- দুধ খামারীর মার্সিডিজ ট্রাক - জুন 25, 2022
- ঢাকা ডায়েরি (১৬.১২.২০২২) - জানুয়ারি 18, 2022
- ঢাকা ডায়েরি - অক্টোবর 10, 2021