আমার জীবনানন্দ অবলোকন
উৎপলকুমার বসু কোথাও লিখছিলেন যে তার মনে হয় জীবনানন্দের উপর সাইলেন্ট সিনেমায় দেখানো ল্যান্ডস্কেপের প্রভাব আছে। জীবনানন্দ ওগুলি প্রচুর দেখতেন। আমার কাছে এইটা সমর্থনযোগ্য মনে হইছে। কবি জীবনানন্দ, দৃশ্যাবলোকনের যে মধুর প্যারাডক্স, তার ভিতর চক্রাকারে ঘুরতেন বইলা আমার মনে হয়। কিন্তু দৃশ্য যে দেখতেছে, সেই অবলোকনকারীর অবস্থানকে বাস্তবে চিহ্নিত করতে উনি প্রায় নারাজ ছিলেন বলা যায়। এই ‘ওনলি স্পেকটেটরশিপ’ নিয়া পরে কখনো আমি কিছু লিখব। এখন বরং আমার কাছে কবি হিসাবে তার আগমন ও বিদায়ের গল্পটুকু অল্পে বইলা রাখি।
আমাদের বাসায় জীবনানন্দ দাশ সমগ্র একটা ছিল। রণেশ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, প্রথম দিকের এডিশন। আমি যখন তা পড়তে শুরু করি, তখন আমার কোন্ ক্লাস চলে মনে নাই। তবে তারও আগেই আমার জীবনানন্দের রূপসী বাংলা পর্বের কবিতার সাথে পরিচয় ঘটে কখন ও কীভাবে, সেইটা মনে আছে।
একদম ছোট থাকতে, টু-থ্রিতে পড়ি তখন বাসায় একটা ক্যালেন্ডার আসলো একবার, কোনো ব্যাংকের হবে। ছয় পাতার দেয়াল ক্যালেন্ডার, প্রত্যেক পাতায় একটা কইরা সাদাকালো ফোটাগ্রাফ। ঋতূ অনুযায়ী প্রকৃতির ছবি সেগুলা, খুব ভাল কিছু নয় বোধহয় যা মনে পড়তেছে, এখন যেগুলিকে ‘এস্থেটিক’ বইলা আমি ব্যঙ্গ করি সেইধরনের। আর এরসাথে প্রত্যেক পাতায় কবি জীবনানন্দ দাশের কয়েকটা লাইন ছিল। ছবির নিচে সম্ভবত। সবই রূপসী বাংলা থেকে।
ততদিন পর্যন্ত আমার যতটুকু পঠিত জগত, সেইখানে জীবনানন্দের এই বর্ণনামূলক কবিতাংশগুলি ছিল একদমই অন্যরকম। বলা ভাল, ঐ লাইনগুলির সৌন্দর্য্য সত্যিই আমার অন্তর্জগতে একধরনের ইয়ে তৈরি করত। ইংরেজিতে বলে লংগিং। তারই কোনো একটা শিশুতোষ সংস্করণ হবে।
পরবর্তীতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার আগেই আমি অসংখ্যবার জীবনানন্দ খতম দিই এবং হাফেজ হয়ে উঠি। তার অনুকরণে দুই তিনটা কবিতাও লিখি এবং পরিচিত কামেল কবিতাপ্রেমীদের পড়তে দিই। তারা জীবনানন্দ মনে কইরা পড়া আর প্রশংসা করার পরে আমি দাঁত বাইর কইরা হাসি দিয়া বলি -আমি লিখছি।
(বিনয় মজুমদারের অনুকরণ কইরাও এমন একটা লিখছিলাম ও পড়াইছিলাম।)
তবে ধীরে ধীরে, বামপন্থীদের সাথে ওঠাবসা, মেট্রোপলিটনে স্থানান্তর এবং জীবনবাদী স্বচ্ছ কবিদের পড়তে যেয়ে, (যেমন কফিল আহমেদ) আমি জীবনানন্দের কবিতাবিশ্বের প্রতি ক্রিটিকাল হইতে থাকি। জীবনানন্দের ভিতর যে জীবন-আনন্দ-বিনাশী ঝামেলা আছে তা সনাক্ত করতে সক্ষম হই। সভ্যতার উপরে এর ইমপ্যাক্ট বিচার করার জায়গাটুকু বাদ দিয়া, আমি তখন বরং যে কবিতাগুলিতে তিনি সবথেকে নেগেটিভ, কোনো প্যাঁচগোচ ছাড়া, সেগুলিকেই তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসাবে মাইনা নিই। যেমন ‘শীতরাত’।
…
শীতরাত
এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।
শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে —
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।
এদিকে কোকিল ডাকছে – পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব’লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে।
সিংহ হুঙ্কার ক’রে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক — আফিমের সিংহ — অন্ধ — অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে
যায় সব।
সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ’শে খ’শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ,— তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।
(মহাপৃথিবী, ১৯৪৪)
…
আমার মনে আছে, তখন ঢাকা থেকে ছুটিতে রংপুর গেলে, শীতের রাত্রে বিছানায় শুয়ে আমি শব্দ কইরা এই কবিতাটা পড়তাম। এখানে বর্ণিত সার্কাসের সিংহের কথা পড়তে গিয়া, এমনও হইছে, আমাদের বাসার পাশের চিড়িয়াখানা থেকে সিংহের ডাক শোনা গেছে। এগুলি আমার জীবনের প্রায়-অলৌকিক-মনে-হওয়া সাধারণ অভিজ্ঞতা। একদম শেষের দিককার লাইনগুলি পড়ার সময় মাঝেমাঝে আমার চোখ দিয়া পানি পড়ত।
কালক্রমে জীবন আমাকে এই প্রত্নতাত্ত্বিক হাহুতাশ থেকে বাইর কইরা আনতে সক্ষম হইছে। আধুনিকতাবাদী আরো অজস্র মেধাবী কবিসাহিত্যিকদের পাশাপাশি জীবনানন্দের কবিতাও আমি এখন পড়ি না বললেই চলে। যেহেতু তা পড়তে আমার ভাল লাগে না বা ওগুলার ভিতর নিজের জন্যে কিছু পাই না আমি। যদিও জীবনানন্দ বহুমুখী কবি এবং নিশ্চয়ই তার অনেকগুলি কবিতাই মর্ডানিজমের দার্শনিক মর্বিডিটিকে অতিক্রম কইরা অক্ষয় সৌন্দর্য্য হয়ে থাকতে পারবে।
যেমন অবজেক্ট এবং লাইট সম্বন্ধে জীবনানন্দের অসাধারণ কিছু অবজার্ভেশন আমি এখনো কাজে লাগাই। সাংসারিক জগতের ভিতর মহাজাগতিক শান্তিকে অনুভব করার প্রক্রিয়া নিয়েও তার সুন্দর সব কথা আছে। কিন্তু তার হিউম্যান একজিস্টেন্সের গুণাগুন সম্পর্কিত চক্রাকৃতি নেতিবাচকতা আমার পোষাইলো না। তাই মাল্যবান পড়িবার আগেই আমার জীবনানন্দ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটিল। ‘মাল্যবান’ আর আমি পড়িতে গেলাম না। তা আতঙ্কবশতই হউক। বা করুণাবশত।
আমার বাসার কাছেই রোডস এন্ড হাইওয়েজের কলোনি আছে। সেইখানে বড় গাছপালা আছে, পুকুর আছে। একতলা ঘরবাড়ি, মাঠ, সব মিলায়ে একটা সুন্দর ব্যাপার। সন্ধ্যার পরে, কোথাও না গেলে আমি মাঝেমধ্যে ঐখানে হাঁটতে যাই। অপ্রয়োজনীয় আলো না থাকায় বা কম থাকায় আপনি চাইলে অনেক্ষণ শান্তমনে হাঁটতে পারবেন। গত সেপ্টেম্বর বা আগস্টের এক সন্ধ্যায় এইরকম হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমার মনে পড়ল কবি জীবনানন্দ দাশের কোনো একটা কবিতার শুরুতে ছিল ‘হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি’ কিন্তু কোথায় যেন হাঁটিতেছি বলা ছিল তা আর কোনোভাবেই মনে পড়ল না। হাজার বছর ধরে কোথায় যেন বা কীসের জন্যে যেন হাঁটিতেছি?
বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করলাম, কিন্তু হতবাক হওয়ার মত ব্যাপার, কোনোভাবেই আমার মনে পড়ল না এর পরে কী লেখা ছিল ঐ কবিতাটায়। বা কী যেন নাম ছিল এই বিখ্যাত কবিতাটার। প্রথমে অত্যন্ত বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ বোধ করলাম আমি। নিজের স্মরণশক্তির গুস্টি তুইলা গালাগালি করলাম মনে মনে। কিন্তু কোনো কাজ হইল না। একটু শান্ত হওয়ার পরে ধীরে ধীরে আমার অনুভূতির পার্সপেক্টিভ বদলাইতে শুরু করল এবং আমি খুশি হইতে শুরু করলাম। কারণ আমি বুঝতে পারলাম যে অবশেষে আমার মাথা থেকে জীবনানন্দের এইসব সুবিখ্যাত লাইনগুলিও মুছে যাইতেছে। ব্যক্তিগতভাবে যা আমার জন্যে আনন্দের সংবাদ। যেহেতু আমি জীবনানন্দীয় এই ক্লান্তিকর অনুভূতিগুলি থেকে নিজেকে বিযুক্তই রাখতে চাই।
অবশ্যই পরের লাইনগুলির কিছু-কিছু পরবর্তীতে আমার মনে আসে। কিন্তু ততক্ষণে সেগুলি খবরের কাগজে পড়া ভাষার মতই তথ্যমূলক ব্যাপার মনে হইতেছিল আমার কাছে। নিজেরই ভিতর থেকে বলা কোনোকিছু নয়।
২৪/৯/২২
…
জীবনানন্দ দাশ নিয়া আরো কয়েকটা লেখা পড়তে পারেন:
জীবনানন্দ দাশ পাঠে যেধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বা ঘটেঃ কয়েকটা নমুনা – তাসনিম রিফাত
পাবলিক ডায়েরি ।। জীবনানন্দ দাশ ।। – রক মনু
‘অদ্ভুত আঁধার এক’: জীবনানন্দ দাশ ।। বিনয় মজুমদার (১৯৬৬)
জীবনানন্দ দাশের ‘সমারূঢ়’ নিয়া – ইমরুল হাসান
মনজুরুল আহসান ওলী
Latest posts by মনজুরুল আহসান ওলী (see all)
- সোলায়মান কবীর ঋষি - এপ্রিল 26, 2023
- আমার জীবনানন্দ অবলোকন - অক্টোবর 25, 2022