বই থেকে: টিয়াদুর – ইচক দুয়েন্দে
[ইচক দুয়েন্দের লেখা ‘টিয়াদুর’ বইটা ছাপা হইছে বাংলা ১৪২৮ সনে। বইয়ে ৪৩টা অধ্যায় আছে। বই থিকা ২৭ নাম্বার চ্যাপ্টারটা আমরা এইখানে ছাপাইতেছি।]
…
অধ্যায় ২৭
চিঙ্ক দাপ্রি
আজ ভোরে চিঙ্ক দাপ্রি’র ঘুম ভাঙে স্বপ্নে দুই জোড়া গরুর বাছুর দেখে। এক জোড়া বাছুর ধূসর-সাদারঙা, আরেক জোড়া খয়েরি-গোলাপিরঙা। সবগুলি বাছুরই চিকন, গাছের মোটা পাতার মতন। বাছুর দুটো চিকন হওয়ায় সে একটু উদ্বিগ্ন । নইলে স্বপ্নটা ভাল ।
ভাল স্বপ্নের পরে আজ সকালে পরীর মেলার পথে চিঙ্ক দাপ্রির দেখা হয় জ্ঞানী মামা হিদ্র পুনের সাথে। চিঙ্ক দাপ্রি মামাকে জানায় নিজ গ্রাম চকবিরহী ছেড়ে সে চলে যাচ্ছে চিরতরে । এখন থেকে থাকবে শ্বশুরালয়ে। বিদায় বেলায় সে তার মামা হিদ্র পুনের কাছে উপদেশ চায়। জ্ঞানী মামা বলেন:
তুমার কথা তুমার জবান তুমার দুশমন
ভাবিয়া চিন্তিয়া কথা বলিবা
কথা দিলে কথা রাখিবা
ভালবাসিবা মাটি গাছপালা পশুপকি।।
পরীর মেলায় শাক বিক্রির সাফল্যের জন্য সে তার মামার উপদেশকে ধন্যবাদ দেয়। চিঙ্ক দাপ্রির মাথায় তার মামার বলা কথাগুলো বারবার গুঞ্জন করে।
চিঙ্ক দাপ্রি উড়ে চলে। পরীর মেলা শেষ। একটা মেঠো পথে নামে সে। কিছুদূর যাবার পর এক বিশাল পুকুর, থামে সেখানে। বসে, পানি খায়। তার থলেতে দশ টাকার নোট। সে বের করে। তাকায়। কতো ছবি। কতো লিখা। চোখ ফাটিয়ে খুঁটিয়ে সে দেখে। মুগ্ধ বিস্ময়াবিষ্ট। ভাবে দশ টাকা ভেঙে কড়ি নিলে পাওয়া যাবে কতো কড়ি? হাজার হাজার কড়ি। লাখলাখ কড়ি। সেই কড়িগুলো রাখতে লেগে যাবে একটা দুটো ঘর।
এক বছর আগে চিঙ্ক দাপ্রি’র নজরি চন্মন হয়েছে। নজরি চন্মনের পর কনের বাড়িতে গত এগার মাসে এগার রাত কাটিয়েছে। শীঘ্রই চিঙ্ক দাপ্রি সন্তান আশা করছে। তার বিশ্বাস কন্যা সন্তান হবে। চিঙ্ক দাপ্রি’র মনে হয় সে পেয়ে গেছে সাত রাজার ধন। এখন পেতে যাচ্ছে রাজকন্যা।
আজ সন্ধ্যায় চিঙ্ক দাপ্রি’র বিয়ের অনুষ্ঠান।
চিঙ্ক দাপ্রি উড়ে যায় রসুনদিঘির হাটে। হাট সেদিন জমে নাই। সব মানুষ গেছে পরীর মেলায়। দোকানিরা চিঙ্ক দাপ্রিকে পেয়ে উল্লাস করে। সে মিঠেকাঁকন গ্রামের জামাই। তাই সে তাদেরও জামাই। হাটের কোনো দোকানি তার দশ টাকার নোট ভাঙাতে পারে না। তাতে তার কেনাকাটা থামে না। তার সর্বমোট খরচ হয় চার আনা। যা পরে দিলেই চলবে।
নদী বারনয় পার হবার সময় মাঝি হাইলে জব্বার বলে, “খবর কিছু জানেন নাকি ভাইজান? পেরকাণ্ড একখান বাজ পড়ে পরীর মেলা পুড়ে হল খাক?’
হতভম্ব চিঙ্ক দাপ্রি নিরুত্তর থাকে। মাঝি হাইলে জব্বার বলে চলে, ‘এই দুনিয়ায় এক কিছিমের মানুষ আছে, যারা ঘরে থাকিয়াও ঘরের খপর রাখে না। তারা কী করিয়া মেলায় গিয়া মেলার খপর রাখবে?’
চিঙ্ক দাপ্রি অনেকক্ষণ মেলা ছেড়ে এসেছে। এর মধ্যে সে অনেক বাজ পড়ার শব্দ শুনেছে। পরীর মেলা বড় জায়গা। সেখানে পড়তে পারে বড় বাজ। করতে পারে বড় খাক। তখন চিঙ্ক দাপ্রি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। পরীর মেলার দয়ালু রূপবান কন্যাটি পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে কল্পনা করে।
ঘাটে নামতেই বৃদ্ধ সুনজ সুপ্তি তাকে সংবর্ধনা জানান। তিনি চিঙ্ক দাপ্রি’র কাছে দেড়শত বিঘা জমি বিক্রয় করতে চান। জোনাকির বিলে একশ বিঘা জমি, এক ফসলি, হিদাদিঘার ধান বোনা আছে। ফালগুন মাসে নৌকায় গিয়ে শীষ কেটে আনলেই হবে, পাওয়া যাবে হাজার মণ ধান। সে ধান পেয়ে যাবে চিঙ্ক দাপ্রি।
তারপর ঐ জমিতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে লাঙল দিয়ে শক্ত পলিমাটিতে আঁখর তুলে বুনতে হবে ধান। বাকি পঞ্চাশ বিঘা জমির কিছুটা দুফসলি, কিছুটা তিন ফসলি। সেখানে করতে পারবে আউশ ও আমন ধান, আর মশুর মুগ জব বুট ও সরিষার মতো রবিশস্য। না তার পুকুর নেই। জমি আছে, খুঁড়ে নিতে কতক্ষণ! ছেলেমেয়ে সব মারা গেছে ওলাওঠায়। বলতে গেলে তাদের গোটা পাড়াটাই ওলাওঠায় গেছে উচ্ছন্নে। তার বউ আছে। তবে অচল। হাতপুড়িয়ে তাকেই করতে হয় রান্না। জমির খাজনা বাকি পড়েছে সাতবছর। সুদটুদ দিয়ে হবে তিন কী চার টাকা। নিলামে উঠল বলে। খাজনা দিতে হবে চিঙ্ক দাপ্রিকে অবিলম্বে। জমির দাম হিসেবে সে চায় পাঁচ টাকা। তাড়া নেই, প্রতি মাসে বারটা করে কড়ি দিয়ে পরিশোধ করলেই চলবে। মামা হিদ্র পুনের কাছ থেকে পাওয়া উপহার ৩৬টি কড়ির মধ্য থেকে ১২টি দিয়ে প্রথম কিস্তি পরিশোধ করে জমিটা কিনে নেয় চিঙ্ক দাপ্রি। পারের নৌকার মাঝি হাইলে জব্বার এই ক্রয়বিক্রয়ের সাক্ষী হয়।
সন্ধ্যা হয় হয়। মিঠেকাঁকন গ্রামে পৌঁছায় চিঙ্ক দাপ্রি। বৃষ্টি ঝরছে। আকাশে মেঘের দল বেড়াতে বের হয়েছে। একটু শনকা শনকা ঠাণ্ডা। শ্বশুরবাড়ির পথে অন্ধকারে আভাসে সে দেখে এক যুবক ও এক যুবতী কথা বলছে।
যুবকের বাম হাতে একটি ছোট মাটির পাত্রে আগুন । কচু পাতায় ঢাকা। বৃষ্টির পানিকে রুখবার জন্যে। তার সামনে এক যুবতী দাঁড়িয়ে। যুবকের হাত থেকে যুবতী সানন্দে গরম মাটির পাত্র নেয়।
‘তোঁর পেঁটত আর ছাঁ, তুই আঁক ছাঁড়ি যা,’ যুবক বলে ।
‘আঁই এঁটিত থাঁকিচ্ছ, তোঁর কাঁছি, উঁয়া তোঁ ঘঁ জাঁওই,’ যুবতী বলে ।
‘তুই কঁথা দিল্ কেঁওন?’ যুবক বলে ।
‘মাঁও কঁয়েল,’ যুবতী বলে ।
‘তুই আঁক কঁরতু,’ যুবক বলে ।
‘হেঁত, চিঁনপঁচিতের মঁদি বিয়া হঁয় না,’ যুবতী বলে ।
‘কঁতো হঁই,’ যুবক বলে ।
হুঁ বিয়াঁ কিছু লঁয়। আঁই তুঁর। কাঁঠাল বনি নটির ঝুঁপি বঁসি শিস দিবি। আঁই যাঁবি। আঁই তুঁর, কথার শেষে যুবতীর গলা ভার হয়ে আসে। সে ছুটে চলে যায়।
যুবকযুবতীর কণ্ঠস্বর চেনাচেনা ও অচেনা লাগে চিঙ্ক দাপ্রি’র কাছে। ওদের সামনে গিয়ে পরিচয় উদ্ঘাটনের কথা ভাবে। তারপর অধিক কৌতূহলের খারাপ পরিণতি চিন্তা করে যুবকযুবতীকে পেছনে ফেলে হাঁটতে হাঁটতে নিকটের কুঁড়েঘরের আঙিনায় গিয়ে দাঁড়ায়। চিঙ্ক দাপ্রি বাঁশিতে সুর তুলে প্রকাশ করে যে সে এসেছে। চৌদ্দভুজ কুঁড়েঘরের আঙিনার নিমগাছে বসে থাকা একজোড়া শালিক তাকে স্বাগত জানায়।
লুসি তিয়া গিয়ে নিয়ে আসে জামাই চিঙ্ক দাপ্রিকে। হেঁসেলে খেজুর পাটিতে বসতে দিয়ে লুসি তিঁয়া তাকে পিহতি পাতার সরবত খেতে দেয়। স্বাদে আত্মহারা চিক্ক দাপ্রি । জ্বলজ্বল করে তার চোখ ।
কনে তুসি তিঁয়া’র খেলার সাথী মনো টিয়া আসে এক জোড়া বনমোরগমুরগি নিয়ে। বনেবাদাড়ে অনেক চেষ্টার পর সে তাদের ধরেছে। বিয়ের জন্য দরকার। মনো টিয়া চৌদ্দটি ব্যাঙ দেখতে পায় চিঙ্ক দাপ্রি’র পেছনে। সে তাদের তাড়া করতে উদ্যত হয়। কারণ ব্যাঙের পেছন পেছন সাপ আসে।
চিঙ্ক দাপ্রি বেদনামাখা হাসিমুখে বলে, ‘ভাইজান, উনারা আমার বিয়ার বরযাত্রী। উনাদের তাড়ায়েন না।’
চৌদ্দভুজ কুঁড়েঘরের ভেতর তুসি তিঁয়া সাজে। সে পরে হলদেবরণ লালপাড় শাড়ি। চুলে করে বেণি। পায়ে পরে মলমল। হাতে ঝলমল চুরি। গলায় মালা। ছোট্ট এক আয়নায় নিজের সৌন্দর্য দেখে চোখ আটকে যায়। তারপর সে অঝোর কাঁদে। কান্না তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। চিঙ্ক দাপ্রি’র পাশে গিয়ে বসে তুসি তিঁয়া। মনো টিয়া দেখে বরকনেকে। তার দুই চোখের ভেতর কোণে এক ফোঁটা করে অশ্রু বিন্দু স্থির হয়ে থাকে।
লুসি তিঁয়া চোখ বন্ধ করে বিয়ের মন্ত্র পড়ে।
বঁ কি বঁ কি
বঁ কা বুঁ ত বুঁ ন
গী তিঁ গী তিঁ
গঁ তা গঁ ত গুঁ ন
মন্ত্র পড়া হয়ে গেলে কনে তুসি তিঁয়া লালঝুঁটি বনমোরগ আকাশে উড়িয়ে দেয়। বর চিঙ্ক দাপ্রি ওড়ায় মুরগি।
চিঙ্ক দাপ্রি বিষম আনন্দে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। তারপর চোখ খুলে সাজসজ্জা করা তুসি তিঁয়াকে দেখে তার মনে হয় অচেনা কেউ। কাছে বসে থাকা মনো টিয়াকে মনে হয় চেনা কেউ। তারপর তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ আগে এই কুঁড়েঘরের কাছে কথোপকথনরত যুবকযুবতীকে সে চিনতে পারে। সে সঙ্কুচিত বোধ করে। তারপর বিয়ের আনন্দে তার মন হয়ে ওঠে প্রসারিত ঝলমল ।
…
“ক্যুরিয়ারে ‘টিয়াদুর’ বইটি পাবার জন্য bkash করুন ৪৫০ টাকা 01715209987 নম্বরে এবং bkash নম্বর নাম ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর পাঠান।”
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫ - মার্চ 17, 2024
- বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক - ফেব্রুয়ারি 26, 2024
- ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুৎমার্গের কোন স্থান নেই – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ - ফেব্রুয়ারি 21, 2024