Main menu

আমার বন্ধু নজরুল : তাঁর গান – কাজী মোতাহার হোসেন [কিস্তি ১]

ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা ইংরেজী প্রবন্ধ Nazrul Islam : The singer and writer of songs  লেখার তরজমা এইটা। নজরুল-ভক্ত বিদেশী বন্ধুদের একটি মুশায়েরায় পড়বার জন্য তাঁর এক ছাত্রের অনুরোধে তিনি এই এসে লেখেন। লেখাটা নজরুল একাডেমী পত্রিকা ৪র্থ বর্ষ, ১ম (গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত ১৩৮১) সংখ্যায় ছাপানো হয়। তরজমা করছিলেন শাহাবুদ্দিন আহমদ।

১৯১৯ সালে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের “বাউণ্ডেলের আত্ম-কাহিনী” মাসিক “সওগাতে” প্রকাশিত হয়। আমি তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। সেই তরুণ বয়সে আমার সাহিত্যজ্ঞান তখন কতটুকুই বা। একজন মুসলমানের, যাঁর আবার পদবী কাজী, বাংলা ভাষায় তাঁর দখল দেখে আমি রীতিমত উল্লসিত হয়ে উঠি । মনে মনে এই অদেখা বন্ধুটিকে আমার নিজের সম্প্রদায়ভুক্ত বলে অনুপ্রাণিত হলাম। তারপর ১৯২০ সাল থেকে “মোসলেম ভারত” পত্রিকায় একের পর এক তাঁর উদ্দীপনাময় কবিতাগুলি প্রকাশিত হতে লাগল । এই ঘটনা স্বপ্নের মত রোমাঞ্চকর বলে মনে হত আমার কাছে। ঐ কবিতাগুলির মধ্যে অনেকগুলোর প্রচলিত ধর্ম-নীতি বিরুদ্ধ কথাবার্তা যেমন আমি মেনে নিতে পারতাম না, তেমনি ধর্মাদর্শে সংরক্ষণশীল হয়েও সেগুলোকে যা-তা বলে উড়িয়েও দিতে পারতাম না । ফলে আমার আবেগ ও যুক্তির মধ্যে একটা তোলপাড় লেগে যেতো ।

বাংলা সাহিত্যাকাশের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটির সঙ্গে দেখা করতে আমি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। শীগগীরই একটা সুযোগ এসে গেলো। আমার কলেজের সহপাঠী কাজী আকরম হোসেনের আত্মীয়-পরিবারের একটি মেয়ের সঙ্গে ১৯২০ সালের ১০ই অক্টোবর কলকাতায় আমার বিয়ে হয় । আমার শ্বশুর বাড়ী ছিল ১১ নং ওয়ালীউল্লাহ লেনে ওয়েলেসলি- -স্কোয়ারের পূর্ব দিকের গেটের দক্ষিণ কোণ বরাবর । তারিখটা ঠিক কবে এখন সঠিক মনে করতে পারছি না— তবে ১৯২০ কিংবা ২১-এর মধ্যে কোনো একদিন হবে। আকরম (আমার স্ত্রীর ইনসান মামু) ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে নিয়ে যান। তাঁর ঘরের সিঁড়িতে পৌছবার সরু গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নজরুল যে-ঘরে থাকেন সেই বাড়ীর দু’তলা থেকে আমরা তাঁর হাঃ হাঃ হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। ঘরের মধ্যে ৬/৭ জন আগন্তুক পূর্বাহ্নেই উপস্থিত ছিলেন— কবি তাঁর স্বভাবগত প্রাণের উদ্বেল স্পর্শে সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রেখেছিলেন। ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দু’হাত বাড়িয়ে আমাদের দিকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। এবং আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস আমরা কাজী কি কৈবর্ত তা নিয়ে তিনি আদৌ মাথা ঘামান নি। কিন্তু আমরা দু’জনই প্রফেসর –একজন কলেজের, অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইংরেজীর, অন্যজন ফিজিক্সের (তখনকার দিনে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-কোনো শিক্ষককে প্রফেসর বলা হত) শুনে তিনি সত্যিই খুশী হলেন। আমি লক্ষ করলাম যে প্রফেসরদের প্রতি বিশেষ করে মুসলমান প্রফেসরদের প্রতি তাঁর একটা অবিচল শ্রদ্ধা আছে— সে সময় যাঁদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য ছিল। বস্তুতঃ আমাদের এক কাপ করে চা এবং কয়েকটি সঙ্গীত দিয়ে আপ্যায়ন করা হ’ল । নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে নজরুল গান করলেন । অপূর্ব নিখুঁত ভঙ্গিতে তিনি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন; এবং সেইকালে যখন বাঙালী মুসলমান সমাজে সঙ্গীত হারাম না হলেও মকরুহ্ ছিল ।

২.
প্রায় প্রতি বৎসর গ্রীষ্ম কিংবা হেমন্তের ছুটিতে সস্ত্রীক অথবা একা— যদি আমার স্ত্রী কলকাতায় থাকতেন কলকাতায় যেতাম। গেলেই “বিদ্রোহী” কবির সঙ্গে দেখা করাটা আমার যেন ফরজ ছিল। প্রতিদান স্বরূপ কবিও আমার শ্বশুর বাড়ীতে আমাদের দর্শন দিতেন। শীগগীরই আমি আবিষ্কার করলাম কবি একজন সুদক্ষ হস্ত রেখাবিদ। একবার ওয়ালিউল্লাহ লেনে (তালতলায়) তিনি আমার এবং আমার শ্যালকদের হাত দেখলেন। আমার বারো বছরের দ্বিতীয় শ্যালক খলিলুর রহমানের হাত দেখে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। যে সে বিদেশে যাবে । আমার নয় বছরের ৩য় শ্যালক সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, অতি অল্পকালের মধ্যে সে অনেক অনেক দূরে যাত্রা করবে, কোথায় তা কেউ জানে না। ঘটনা অবিকল তাই হয়েছিল। পরবর্তীকালে খলিলুর রহমান উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যাণ্ডে যায়, এবং লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রীসহ বি.এ. পাশ করে ও পি. এইচ. ডি লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান সমেত অন্যান্য আরও অনেক দেশে ইউনেস্কোর এডুকেশন অফিসার হিসাবে চাকরি করে । আর আমার তৃতীয় শ্যালক বদরুল আলম এমন এক দুশ্চিকিৎস্য রোগে আক্রান্ত হয় যে কোনো ডাক্তার, কবিরাজ কিংবা হেকিম সে-রোগ নির্ণয় করতে পারেন না। সুতরাং বছর তিনিকের মধ্যে সে এমন এক অজানা দেশে চলে যায় কোন পথিক যেখান থেকে আর ফিরে আসে না। আর আমার সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে আমার ভাগ্যে সমুদ্র যাত্রা ঘটবে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে আমার ভাগ্যে প্রভূত সম্মান জুটবে। আমি অবশ্যই বলতে পারি না যে তেমন সৌভাগ্য আমার হয় নি।

৩.
আমার মনে হয় কবির সঙ্গে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে দু’চার কথা বলা আবশ্যক। ১৯২৫ সালে কলকাতায় ভারতব্যাপী একটি দাবার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগীদের মধ্যে একজন অসুস্থ হয়ে পড়েন, সুতরাং তাঁর স্থানে আর একজন প্রতিযোগীর প্রয়োজন পড়ে। আমি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দিই। সবাই বিস্ময় অনুভব করেন, কিন্তু অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিযোগীরা খুব খুশী হন। ব্যাপার হ’ল নজরুল ছিলেন একজন কল্পনা শক্তিসম্পন্ন আক্রমণ প্রিয় দাবাড়ে। দারুণ রকমের কুশলী খেলোয়াড় যদিও তিনি ছিলেন না, তবু মধ্যম শ্রেণীর খেলোয়াড় হিসেবেও তিনি মাঝে মাঝে বিস্ময়ের সৃষ্টি করতেন। প্রতিযোগিতার ফল হয়েছিল ভারী মজার। হাঙ্গেরীয় একজন অতুলনীয় দাবা খেলোয়াড় রবার্ট পিকলার ৯ পয়েন্টের সব কটিই জিতেছিলেন, কলকাতার চ্যাম্পিয়ান এস. সি. আড্ডি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন ৮ পয়েন্ট পেয়ে, নজরুল ইসলাম ১১%, পয়েন্ট এবং “কিংসপন” পেয়ে শেষ-বিজয়ী হন। আর আমি ৭ পয়েন্ট পেয়ে হই তৃতীয়। নিতান্ত অবহেলা করে আমি যদি একটি পয়েন্ট না ছাড়তাম তো মিস্টার আড্ডির সঙ্গে ৮ পয়েন্ট পেয়ে আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতাম। এই একটি পয়েন্ট হারবার অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি বুঝলাম যে দাবা প্রতিযোগীতায় দুর্বলতম প্রতিযোগিটিকেও অবজ্ঞা করা চলে না। এখানে অবশ্যই এ কথাটুকু আমি উল্লেখ করবো যে প্রতিদিন আমরা রাত্রি ৯-৩০ টায় প্রতিযোগিতা শুরু করতাম আর শেষ করতাম পরদিন বিকেল ২-৩০ টায়। প্রত্যেক প্রতিযোগী অপর প্রতিযোগীর সঙ্গে একটি করে গেম খেলেছিলাম। যে-কদিন প্রতিযোগিতা চলেছিল সে ক’দিন নজরুল ইসলাম ওয়ালীউল্লাহ লেনে এসে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে খেলার স্থান ষ্টেটসম্যান বিল্ডিং-এ যেতেন এবং মধ্য রাত্রিতে তাঁর গাড়ীতে করে আমার বাসায় পৌছিয়ে দিতেন। এখানে বলা আবশ্যক তিনি গাড়ী কিনবার পর পূর্বের ট্রামে চড়বার অভ্যাস ত্যাগ করেছিলেন। বলাবাহুল্য রাত্রি দ্বিপ্রহরে কলকাতায় ট্রাম পাওয়া যায় না।

8.
একবার এক ব্যাপার ঘটল। স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায় খুব দাবা খেলা পছন্দ করতেন। তিনি একদিন নজরুল ইসলামকে, আমাকে ও মিঃ আড্ডিকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেতে বললেন আমাদের খেলা দেখবেন বলে। সুতরাং নজরুল ইসলাম মিঃ আঙ্গিকে তাঁর নেবুতলা এ্যাভেনিউ (বউ বাজার)-এর বাড়ী থেকে এবং আমাকে তালতলা থেকে তাঁর গাড়ীতে তুলে নিলেন গোধূলি-সন্ধ্যায় ঢাকুরিয়া লেক এরিয়া থেকে অর্ধ-মাইল দূরে অবস্থিত। শরৎচন্দ্রের শরৎচন্দ্র এভিনিউয়ের বাসায় পৌঁছলাম। আমরা দেখলাম বৃদ্ধ ঔপন্যাসিক একটি দাবার ছকের সামনে বসে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। আমরা এক মুহূর্ত দেরী না করে খেলায় বসে গেলাম এবং রাত্রি সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একটানা খেললাম। গৃহকর্তা শরৎচন্দ্র ও নজরুল সারাক্ষণ বসে খেলা দেখছিলেন আর নজরুল ইসলাম ও অতিথি খেলোয়াড়দের প্রচুর পান ও চা জোগাচ্ছিলেন। খেলার ফলাফল হয়েছিল সমান সমান। খেলার পর পূর্ব-ব্যবস্থা অনুযায়ী কিছু খানাপিনা হ’ল। তারপর নজরুল ইসলামের গাড়ীতে করে আমরা ঘরে ফিরে এলাম।

আড্ডি এবং আমি উভয়েই প্রায়ই নজরুলের বাড়ীতে যেতাম; এবং গৃহকর্তারও বাড়ীতে অবশ্য নির্দেশ দেওয়া থাকত যে, কবি বাড়ীতে উপস্থিত নেই, এমন মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে যেন আমাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া না হয়। ব্যাপার হ’ল অনাহূত আগুন্তুকেরা এসে কবিকে বিরক্ত করতো বলে উদ্দেশ্যজনকভাবে তিনি তাঁর বাড়ীর প্রবেশ পথের উপর একটি “বাড়ী নেই” বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে রাখতেন। আমার মনে হয়, দাবা খেলোয়াড় হিসাবে নজরুল বড় জোর কলকাতার মাঝারি খেলোয়াড়দের সমান ছিলেন। সুতরাং ১৯২৫-এ কলকাতার দাবা প্রতিযোগিতায় তাঁর অন্তর্ভুক্তি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়, যদিও আমি ছাড়া অন্য একজন সাধারণ প্রতিযোগী থেকে অর্ধেক পয়েন্ট তিনি জিতে নেন ।

৫.
১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ”-এর প্রথম বাৎসরিক সভায় বিশিষ্ট সম্মানীয় অতিথি হিসাবে নজরুল ইসলাম আমন্ত্রিত হন। বিশেষ করে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে এবং “মুসলিম সহিত্যসমাজের তরুণ সদস্যদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিতে। গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জে আসার পথে “খোশ আমদেদ” (স্বাগতম) নামে উদ্বোধন সঙ্গীতটি তিনি রচনা করেন। করতালির মধ্য দিয়ে গানটি এইভাবে শুরু হয় :

আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালী! ও চরণ ছুঁই কেমনে দুইহাতে মোর মাথা যে কালি!!

এখানে নজরুল অতিথিদের যে-কথা বলে সম্বোধন করেন বাঙালী মুসলমান সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় প্রবাদ অনুযায়ী তার তাৎপর্য হ’ল একটি নতুন শিশুর বেহেশত থেকে দুনিয়ায় আসা মানে এক অবিনশ্বর (অতীত) কাল থেকে অন্য অবিনশ্বর (ভবিষ্যৎ) কালে যাওয়ার পথ পরিক্রমামাত্র। ঢাকার প্রগতিশীল তরুণ-তরুণীদের প্রতি এটি ছিল তাঁর আন্তরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। রাষ্ট্র অথবা আভিজাত্যের দ্বারা শোষিত নিষ্পিষ্ট সাধারণ মানুষের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য, মুক্ত ও উদারনৈতিক চিন্তাধারার জন্য ভবিষ্যতের দিকে উন্নত আদর্শে বলীয়ান হয়ে কুসংস্কারকে পদদলিত করতে তাঁর এই শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। তরুণদের প্রশংসা করে এমন প্রাণমন মিশিয়ে আবেগ-উদ্দীপনার সঙ্গে গানটি তিনি গাইলেন যে সমস্ত দর্শক তো বটেই এমন কি গানকে দু’চোখে যারা দেখতে পারতেন না এমন দু’চারজন লোক, যারা সভা পণ্ড করতে এসেছিলেন, তাঁরাও কথা ও সুরের মাদকতায় বিহ্বল হয়ে পড়লেন ।

৬.
বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, উক্ত সভায় আমি “সঙ্গীতে মুসলমানের অবদান” শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করি। অধিকাংশ দর্শকের মতে আমি নাকি একটা বিস্ময়কর তথ্য উদ্‌ঘাটন করেছিলাম। আমার সৌভাগ্য এই যে, আমাকে কোনো বিক্ষোভের সম্মুখীন হ’তে হয়নি । এটা অত্যন্ত স্পষ্ট, যা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, নজরুলের সঙ্গে কমপক্ষে তিনটি ব্যাপারে আমার সাধারণ মিল ছিল। প্রথমতঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম পর্যায়ে আমাদের জন্ম দ্বিতীয়তঃ দাবা খেলার প্রতি ঝোঁক এবং তৃতীয়তঃ সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্তি। যতটা মন পড়ে ১৯২৭ সালে নজরুল যখন ঢাকাতে আসেন তখন তিনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি কক্ষের নীচের তলার পুর্বদিকের অর্ধাংশে আস্তানা গাড়েন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে উক্ত গৃহের বাসিন্দা ছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বড় ডাইনিং হলে সাহিত্য সমাজের প্রথম অধিবেশন বসে। যা হোক, সভাশেষে নজরুলের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ সাধারণ পরিচয় থেকে বন্ধুত্বে পরিণত হয়। ঢাকাতে সে যাত্রা তিনি তিনদিন অবস্থান করেন। ঐ সময় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার জগন্নাথ হলে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কবি সেখানে তাঁর কতকগুলি জনপ্রিয় গান পরিবেশ করেন। যার একটি হল :

কে বিদেশী বন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে ?

৭.
১৯২৮ সালে সাহিত্য-সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মিলনীতে তিনি আবার আমন্ত্রিত হন— তাঁর উদ্দীপনামূলক সঙ্গীত ও বক্তৃতা দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য। এই সময় তিনি তাঁর বিখ্যাত মার্চ সঙ্গীতটি গেয়েছিলেন—যার শুরুটা হল এমনি :

নিম্নে উতলা ধরণী- – তল
চল্‌ চল্‌ চল
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
অরুণ প্রাতের তরুণ-দল
চলরে চলরে চল্ ॥

এগিয়ে চলার এই অগ্ন্যুদ্দীপক আহ্বান বাঙালীর গোটা ইতিহাসকে পুনর্জাগরণের মন্ত্রে উদ্বোধিত করে তুলেছিল। সভাশেষে কবির নিকট আমন্ত্রণ এল বুড়িগঙ্গা তীরের জমিদার রূপবাবুর বিশাল অট্টালিকা থেকে, পুরানো হাইকোর্টের অঙ্গনে অবস্থিত অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের গৃহ থেকে এবং আরও বহু বুদ্ধিজীবি কৃষ্টিবান নাগরিকদের কাছ থেকে, বিশেষ করে কবির কল্লোল-গোষ্ঠীর বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে, যাঁদের মধ্যে প্রধানতম উদ্যোক্তা ছিলেন বুদ্ধদেব বসু।

এই সময় নজরুল ইসলাম বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমী) নীচের তলায় আমার সঙ্গে একসঙ্গে থাকতেন। আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসাবে তখন ওখানে বাস করছিলাম। এই সব নিমন্ত্রণে অধিকাংশ সময়েই আমি নজরুলের সঙ্গে যেতাম এবং তাঁর গান ও কথাবার্তা উপভোগ করতাম।

রূপবাবুর বাড়ীতে তিনি অনেকগুলি গান গেয়েছিলেন কারণ ঐ সময় ঢাকার সকল অভিজাত ব্যক্তিরাই সেখানে জমা হয়েছিলেন। গানটি হল :

বসিয়া নদী কূলে এলোচুলে কে উদাসিনী।
কে এলে পথ ভুলে এ অকূল বন-হরিণী ॥
কলসে জল ভরিয়া চায় করুণায় কুলবধূরা।
কেঁদে যায় ফুলে ফুলে পদমূলে সাঁঝ-তটিনী ॥ হারালি গোধুলি-লগনে, কবি কোন নদী কিনারে,
এ কি সেই স্বপন চাঁদ পেতেছে ফাঁদ প্রিয়ার সঙ্গিণী।

বুড়িগঙ্গার বাড়ীতে ঐ গান প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে এক আশ্চর্য সঙ্গতির সৃষ্টি করেছিল। আরও যে একটি গান তিনি গেয়েছিলেন সেটি হল :

জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত।
যত অত্যাচারে আজি বজ্ৰহানি
হাঁকে নিপীড়িত জনমন মথিত বাণী
নব জনম লভি অভিনব ধরণী
রে ঐ আগত ॥

এটা তাঁর কাব্যের একটি প্রধানতম বিষয় যা নজরুল ইসলামকে কাব্যরাজ্যের রাজসিংহাসনে বসিয়েছিল ।

৮.
[ঢাকার ত্রয়ী : ১, নোটন; ২. রানু এবং ৩. লোটন]

ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র একজন ভাল কবি ছিলেন। তিনি অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর সনেট ও গান লিখেছিলেন। খুব ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতে পারতেন তিনি। তাঁর স্ত্রী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েট ছাড়াও একজন চিত্রশিল্পী ও পিয়ানো-বাজিয়ে ছিলেন। তাঁদের একমাত্র কন্যা কুমারী উমা মৈত্র ওরফে নোটন সেতার ও পিয়ানোর একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। সে সময় তিনি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই. এস. সি পরীক্ষায় পাশ করে বেরিয়ে এসেছেন এবং দাবা খেলায় মোটামুটি শিক্ষালাভ করেছেন। বলাবাহুল্য লন টেনিস খেলাতেও তিনি তখন চমৎকার পারদর্শিতা লাভ করেছেন । কিন্তু কোন রহস্যজনক কারণে জানি না তাঁকে বি. এ. কিংবা বি. এস. সি. পড়তে দেওয়া হয় নি, অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত) ছিল কলেজ রোড নামক প্রধান সড়কের অপর পাশে।

প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায় এবং প্রফেসর সত্যেন বসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যক্ষ) এই পরিবারের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। দিলীপ রায় ঘন কলকাতা থেকে ঢাকাতে আসতেন এবং নোটনকে শুধু ব্রহ্মসঙ্গীতই নয় তার নিজের লেখা এক ধরনের উচ্চাঙ্গ রাগ সঙ্গীতও শেখাতেন। মৈত্র পরিবারটি ছিল সবদিক দিয়ে উদার; এবং তাঁদের কাছে হিন্দু-মুসলমান বলে কোন কথা ছিল না। উভয় সম্প্রদায়ের সুধীজনেরা তাঁদের বন্ধু ছিলেন। যেমন উদাহরণতঃ প্রফেসর সত্যেন বোস (একজন হিন্দু), অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন (একজন মুসলমান), প্রফেসর বঙ্কিমদাস ব্যানার্জি (অঙ্কের প্রফেসর, ইন্টারমিডিয়েট কলেজ চালু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বদলী হয়ে তিনি সেখানে যান) এবং শহরের অনেক গুণীজ্ঞানীজন অধ্যক্ষ মৈত্রের বাড়ীতে উদার অভ্যর্থনা পেতেন। পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও খেলাধূলা ও সঙ্গীতের প্রতি অধ্যক্ষ মৈত্রের বিশেষ অনুরাগ ছিল। আমিও সময় সময় হাইকোর্টের অন্তর্গত অধ্যক্ষের পারিবারিক লনে আমার প্রফেসর বঙ্কিম বাবু, তাঁর ছেলে অজিত, অন্য একজন প্রফেসর সুরেন ঘোষ (পদার্থ বিদ্যা) এবং তাঁর দুই ছেলে ডাকু ও টুকুর সঙ্গে টেনিস খেলতাম। দিলীপ রায় দাবা খেলতে ভালবাসতেন এবং তিনিও আমার একজন দাবা খেলার বন্ধুত্বে পরিণত হন। আমি নোটনকে দাবা খেলা শিখিয়েছিলাম। দিলীপ রায়ও নোটনের সঙ্গে মাঝে মঝে দাবা খেলতেন। বিখ্যাত ওস্তাদ হায়দার খান নোটনকে তিন-চার বছর ধরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখান। নোটন তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ সঙ্গীত গাইতেন এবং সাথে সাথে সেতারও বাজাতেন। তাঁর মাতাপিতা এই কুমারী কন্যাটিকে কতটা স্বাধীন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন উপরের বর্ণনাটি তারই মোটামুটি খসড়া।

১৯২৮ সালে নজরুল যখন ঢাকায় আসেন প্রিন্সিপাল মৈত্র তাঁর গান শোনেন। একজন উঁচুদরের সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তিনি বুঝতে পারেন যে, নজরুলের গানের একটা পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিভিন্ন অলঙ্কার মীড়, গমক, বঁদ, মুর্ছনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধ্বনিব্যঞ্জনা সেতারে এবং কণ্ঠ সঙ্গীতে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারে নোটনকে সাহায্য করতে তিনি নিয়মিত নজরুলকে তাঁর বাড়ীতে আমন্ত্রণ জানান। নোটন সেতার বাজাতেন অপূর্ব সুরের দ্যোতনা ফুটিয়ে, এবং নজরুল অর্গানের রিডে সুনিপুণ আঙুলের মৃদু স্পর্শে সূক্ষ্মতম সুরের ব্যঞ্জনা, ফুটিয়ে,— নোটনের পক্ষে সেতারে যা ফোটানো সম্ভব হত না— কণ্ঠ মিলিয়ে গান করতেন, আর মিস্টার ও মিসেস মৈত্র সেই অপূর্ব সঙ্গীতের শিল্প সুষমার মাধুর্য তন্ময়চিত্তে উপভোগ করতেন। নজরুল যতদিন ঢাকায় ছিলেন তিনি নিয়মিত প্রতিদিন প্রায় দু’ঘণ্টা করে মনোরম সঙ্গীত চর্চায় নিমগ্ন থাকতেন। নজরুল জানতেন দিলীপ কুমারও নোটনকে তাঁর নিজস্ব ঢঙে বাংলা গানের কায়দা-কানুন শিখিয়েছেন। ঐসব গান ছিল খানিকটা টপ্পার ধাঁচে লেখা বিশেষ ধরনের ঠুংরী— পিঝাকাটোর নোটের গিরগিটি কিংবা “প্যাসেজে” এর দ্রুত লয়সম্পন্ন। দিলীপকুমারকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেন নজরুল এবং সিদ্ধি লাভও করেন। ভারতীয় এই দুই সুপরিচিত সঙ্গীত শিল্পী সঙ্গীতাঙ্গনে সঙ্গীত শিক্ষাদানের কৌশলে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতেন। বিশেষ করে শিক্ষার্থীটি যদি হতেন প্রিয়দর্শিনী। কুমারী মৈত্র নিঃসন্দেহে ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী এবং অভিজাত মহিলা। স্বভাবে তিনি ছিলেন খুবই শান্তশিষ্ট এবং যে কোনো ওয়ার্ডস্বার্থের চোখে কাব্যপ্রেরণাদায়ী আনন্দের নির্ঝরিণী — Phontom of delight, নজরুল তাঁর গানগুলিকে যে গভীর আবেগে মূর্ত করে তুলতেন তারই পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর “চক্রবাক” কাব্যের ‘গানের আড়াল’ কবিতায়

তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কণ্ঠের গান —
এইটুকু অধু রবে পরিচয়? আর সব অবসান?
অন্তরতলে অন্তরতর যে-বাধা লুকায়ে রয়,
গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়?
হয়তো কেবলি গাহিয়াছি গান, হয়ত কাহিনী কথা,
গানের বাণী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা?
হৃদয়ে কখন জাগিল জোয়ার, তাহারি প্রতিধ্বনি
কণ্ঠের তটে উঠেছে আমার অহরহ রণ রণি, –
উপকূলে বসে শুনেছ সে-সুর, বোঝ নাই তার মানে?
বেঁধেনি হৃদয়ে সে-সুর, দুলেছে দুল হয়ে শুধু কানে?
হায় ভেবে নাহি পাই—
যে-চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই।
সাগরের সেই ফুলে ফুলে কাঁদা কূলে কূলে নিশিদিন?
সুরের আড়ালে মূর্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ?

১০.
কিন্তু নোটনের কাছ থেকে কোনো রকম সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় নি। তাঁর মুখের ভাবে স্বীকৃতির বিন্দুমাত্র চিহ্ন ফুটে উঠেনি কখনো। যেন দা ভিঞ্চির মোনালিসার মত তিনি ছিলেন সকল ধরা-ছোঁয়ার বাইরের এক মূর্তিমতী রহস্য। কারও কারও হয়ত মনে হতে পারে উল্লিখিত কবিতাটি প্রতিভা সোম ওরফে রানুকে উপলক্ষ করে লেখা; কিন্তু আমার আদৌ- সন্দেহ নেই যে কবি তাঁর কাব্যপ্রেরণাদাত্রীর পরিচয়টিকে যথাসাধ্য গোপন করার চেষ্টা করেছেন। কেবল নোটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অন্তরঙ্গতার জন্য নির্বাক আবেদনের যতটা প্রয়োজন ছিল অন্যের বেলায় ততটা ছিল না। কেননা অন্য মেয়েদের সঙ্গে মিশতে কবির স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশী ।

রানুর সঙ্গে পরিচয়ের ভূমিকা-স্বরূপ শুধু এইটুকু বলতে পারি : রেনুকা সেন নাম্মী টিকাটুলির এক কুমারীর সঙ্গীত শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন দিলীপ রায়, গ্রামোফোন রেকর্ডে অতুলপ্রসাদ সেন লিখিত “পাগলা মনটারে তুই বাঁধ” গানটি গেয়ে তখন রেণুকা দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তিনি দিলীপের শিক্ষকতার গুণে এই দুর্লভ খ্যাতিলাভ করেন। এই সময় “শনিবারের চিঠির সম্পাদক রসিক সজনীকান্ত দাস দিলীপ ও রেণুকার সম্বন্ধের বিকৃত রূপ দান করে দিলীপের নাম দিলেন “কানুরে”। নজরুল তাঁর শিষ্যা রানুকে দিয়ে রেণুকার চেয়েও সুন্দরভাবে তাঁর স্বরচিত গান রেকর্ড করবার সংকল্প করেন। কারণ এমনিতেই রানুর কণ্ঠ ছিল অত্যন্ত সুরেলা, চড়া পর্দাতেও তাঁর গান খুবই মিষ্টি শোনাত। [রানুর বাবা, মা, অধ্যক্ষ সুরেন মৈত্র, প্রফেসর সত্যেন বোস আমাদের বাসায় প্রায়ই আসা যাওয়া করতেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য প্রফেসর সত্যেন বোস কেবল একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন না, একজন সুদক্ষ বেহালাবাদকও ছিলেন।] যা হোক, পরে ফিরে আসা যাক নজরুলের সঙ্গীত ভাণ্ডারে সুরের রাগরাগিনীর যত গভীর সূক্ষ্ম কলা-কৌশল ছিল রানুর কণ্ঠে তা তুলে দিতে তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন। এই উপযুক্ত শিক্ষার্থিনীটি তাঁর সকল বিখ্যাত গানকে সে সময় আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশেষ করে রানুর কণ্ঠে নিম্নলিখিত গানটি (মিশ্র ভৈরবী ও আশাবরী) অপূর্ব দ্যোতনায় রূপলাভ করত :

কে বিদেশী বন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে। সুর-সোহাগে তন্দ্রা লাগে কুসুমবাগের গুলবদনে।।
* **
সহসা জাগি আধেক রাতে শুনি সে বাঁশী বাজে হিয়াতে।
বাহু-সিখানে কেন কে জানে কাঁদে গো পিয়া বাঁশীর সনে।।
বৃথাই গাঁথি কথার মালা লুকাস কবি বুকের জ্বালা
কাঁদে নিরালা বনশীওয়ালা তোরি উতালা বিরহী মনে।।

তাঁর কণ্ঠে পিলুতে (কাহারা দাদরা) গাওয়া আরেকটি নজরুল-গীতি উল্লেখযোগ্য :

ভুলি কেমনে আজো যে মনে বেদনা-সনে রহিল আঁকা
আজো সজনী দিন রজনী সে বিনে গণি তেমনি ফাঁকা।
আগে মন করলে চুরি মর্মে শেষে হানলে ছুরি,
এত শঠতা এত যে ব্যথা তবু যেন তা মধুতে মাথা॥
চকোরী দেখলে চাঁদে দূর হতে সই আজো কাঁদে, আজো বাদলে ঝুলন ঝোলে তেমনি জলে চলে বলাকা॥
বকুলের তলায় দোদুল কাজলা মেয়ে কুড়োয় লো ফুল,
চলে নাগরী কাঁখে গাগরী চরণ ভারি কোমরে বাঁকা।।
তরুরা রিক্ত পাতা আসলো লো তাই ফুল-বারতা, ফুলের গলে ঝরেছে বলে ভরেছে ফলে বিটপী-শাখা ॥
ডালে তোর হালে আঘাত দিস রে কবি ফুল-সওগাত,
ব্যথা-মুকুলে অলি না ছুঁলে বনে কি দুলে ফুল-পতাকা ॥

১১.
এমন অবস্থায় ‘শনিবারের চিঠি’র রসিক সম্পাদক সজনীকান্ত কেমন করে আর নীরব থাকেন? এই যে দিন নেই, রাত নেই, সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই— গভীর মনযোগের সঙ্গে নজরুল প্রতিদিন রানুকে সঙ্গীতের পাঠ দিয়ে চলেছেন, এতে সজনীর মত ব্যক্তির পক্ষে স্থির থাকা কেমন করে সম্ভবপর? একি দিলীপ রেণুকার সম্পর্কের চেয়ে আরও গায়ে জ্বালা ধরানোর মত মারাত্মক ব্যাপার নয়? এমনি জল্পনা-কল্পনায় উত্তেজিত হয়ে নজরুলকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি উপযুক্ত রকমের একটি প্যারোডি লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। যে-গানটির প্যারোডি লেখা হয় উপরে তার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে— “কে বিদেশী বন-উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে”। সজনীকান্তের প্যারোডিটি এখানে উদ্ধৃত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কিন্তু প্যারোডিটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিণতির ফল শীগগীর পাওয়া গেল। একদিন রাত্রি ১১টা পর্যন্ত আমাদের অতিথি নজরুল ইসলামের জন্য আমরা বর্ধমান হাউসে অপেক্ষা করছিলাম। আরও আধঘণ্টা খানেক পর আমরা সিঁড়িতে দ্রুত মনুষ্য পদধ্বনি শুনতে পেয়ে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম না তাঁর ঘরে ঢুকছেন হাতে একটি নতুন পাঠি, শায়ের কুর্তায় রক্তের দাগ এবং শরীরে লাঠির আঘাতের চিহ্ন। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর এবং কোনরকমে ক্ষতস্থানে পরিয়ানি লাগানোর পর তার কাছ থেকে নিম্নোক্ত ঘটনা শোনা গেল:

সোম মশায়ের বাড়ী থেকে আমি কেবল বেরিয়ে এসে পথে নেমেছি এমন সময় জনের একটি যুবকের দল আমাকে চারদিক থেকে আক্রমণ করলো। প্রথমটা আমি হকচকিয়ে গেলাম কিন্তু পর মুহূর্তেই একজনের হাত থেকে এই বেতের ছড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে কেমন করে আঘাত ফিরিয়ে দিতে হয় তা একটু তাদের বুঝিয়ে দিলাম। আমার কাছাকাছি যে দু’তিন জন ছিল ঐ হায়দরী মায়ের দু’চারটা খেয়ে সেখানেই সুরে পড়ল। অবস্থা বেগতিক দেখে এবং কাছের নবাবপুর স্ট্রীটের পাহারাদার পুলিশের আগমন ভয়ে তারা সব দ্রুত পালিয়ে গেল।

ঘটনাটা ঘটেছিল বনগ্রাম লেনে। এই গলির উপরেই ছিল সোম মশায়ের বাড়ী। স্থানীয় হিন্দু-যুবকেরা সজনীকান্তের প্যারোডিটি সম্ভবতঃ পড়েছিল। এতে তাদের মনে সন্দেহ বিগুণ হয়ে ওঠে। তারা একটা কেলেঙ্কারীর কথা আঁচ করে তার একটা বিহিত করার চেষ্টা করেছিল। রানু হিন্দুর মেয়ে আর নজরুল মুসলমানের ছেলে। সুতরাং তাদের হিন্দু-রক্ত এই সম্পর্কটিকে একেবারে সহ্য করতে পারছিল না। এ যেন ছিল তাদের পৌরুষের উপর আঘাত।

যাহোক ঐ গল্পের ঐখানেই শেষ। এর দু’একদিন পরে নজরুল আমাকে তাঁর সেই ঐতিহাসিক ছড়িটা উপহার দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। আট ন’বছর যাবৎ ছড়িটা আমার সঙ্গেই ছিল । দুর্ভাগ্যবশতঃ রাঁচী থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত লোহার দাগা নামক এক জায়গায় আমার ঢাকা কলেজের সহপাঠী রুক্ষিনীর বাড়ীতে এক সাপ মারতে গিয়ে ছড়িটি ভেঙ্গে যায়। ঘরের মেঝেতে শুয়ে আমরা দুই বন্ধু ঘুমাচ্ছিলাম এমন সময় সাপটি আমাদের দু’জনের উপর দিয়ে চলে যায়। রুক্ষিনী আমাকে জাগিয়ে দিয়েছিল; ঝক ঝকে মেঝের উপর শুয়ে থাকা সাপটিকে মারা আমার পক্ষে তেমন কঠিন হয় নি।

ফজিলাতুন্নেসা

যতদূর মনে পড়ে ১৯২৮ সালে নজরুলের দ্বিতীয়বার ঢাকা আগমনে কুমারী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় নিয়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়। ফজিলাতুন্নেসা অসামান্যা সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীণানিন্দিত মঞ্জুভাষিণী’ও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম.এ. এবং একজন উঁচুদরের বাকপটু মেয়ে। তিনি আমার বান্ধবী ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে কবি একজন সৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্করেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেইসঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষীর মত সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন। ঘন্টাখানেক পরে আমরা ফিরে এলাম। রাত্রে খাবার পর প্রতিদিনকার অভ্যাসমত আমরা শুতে গেলাম। তখন রাত প্রায় এগারোটা হবে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর হওয়ার আগে জেগে উঠে দেখলাম নজরুল নেই। বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম নজরুল কোথায় যেতে পারে। সকালে নাস্তার সময় তিনি ফিরে এলেন এবং তাঁর অমনভাবে অদৃশ্য হওয়ার কারণ বললেন:

রাত্রে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখলাম একজন জ্যোতির্ময়ী নারী তাকে অনুসরণ করার জন্য আমাকে ইঙ্গিত করছে। কিন্তু জেগে উঠে সেই দেবীর পরিবর্তে একটি অস্পষ্ট হলুদ আলোর রশ্মি দেখলাম। আলোটা আমাকে যেন ইঙ্গিতে অনুসরণ করতে বলে, আমার সামনে সামনে এগিয়ে চলছিল। আমি বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে কিছুটা অভিভূত হয়ে সেই আলোকরেখার অনুসরণ করছিলাম। মিস ফজিলাতুন্নেসার গৃহের কাছে না পৌঁছান পর্যন্ত আলোটা আমার সামনে চলছিল। তাঁর বাড়ীর কাছে পৌঁছতেই আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি দেখলাম একটি ঘরের মধ্যে তখনও একটি মোমের বাতি জ্বলছে। রাস্তার ধারের জানালার কাছে সম্ভবতঃ পথিকের পায়ের শব্দ শুনে গৃহকর্ত্রী এগিয়ে এসে ঘরের প্রবেশ-দরোজা খুলে দিলেন এবং মিস ফজিলাতুন্নেসার শয়ন-ঘরের দিকে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ফজিলাতুন্নেসা তাঁর ঘরের দরোজা খুলে আমাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। কুমারী নেসা তাঁর শয্যার উপর গিয়ে বসলেন আর আমি তাঁর সামনে একটি চেয়ারে বসে তাঁর কাছে প্রেম যাঞ্চা করলাম, তিনি দৃঢ়ভাবে আমার প্রণয় নিবেদন অগ্রাহ্য করলেন।

এই হচ্ছে সামগ্রিক ঘটনা— একে মানসচক্ষে নিয়ে আসা কিংবা এর রহস্যোদ্‌ঘাটন করা অত্যন্ত কঠিন। সূর্য উঠার পর কোথায় ছিলেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : ঐ ঘটনার পর নিরতিশয় ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ি; তাই ভোর বেলা রমনা লেকের ধারে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিলাম।

এটা অবশ্য একটা যুক্তিসঙ্গত বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার। কেননা নজরুল রমনার লেক ভালবাসতেন এবং লেকের ধারে সাপের আস্তানা আছে জেনেও সেখানে ভ্রমণ করতে যাওয়া তাঁর পক্ষে আদৌ অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আরও একটি বিস্ময়ের ব্যাপার তখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঐদিন দুপুরে লক্ষ করলাম ফজিলতের গলার লম্বা মটর-মালার হারটা ছিড়ে দু’ খান হয়ে গিয়েছে। পরে সেটা সোনারুর দোকান থেকে সারিয়ে আনতে হয়েছিল। অত্যন্ত কাছ থেকে জোরাজুরি ছাড়া এমন একটা কাণ্ড কেমন করে ঘটতে পারে আমার পক্ষে তা বুঝে উঠা মুশকিল। নজরুল ইসলাম আমার কাছে ও ফজিলাতুন্নেসার কাছে যেসব দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় এমন অঘটন কিছু ঘটেছিল যাতে ফজিলতের হৃদয় তিনি জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ঐসব চিঠিপত্রে নজরুলের হৃদয়ের গভীর হাহাকার ব্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের সত্যতা সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এক্ষেত্রে নোটনের ব্যাপারে যেমনটি ঘটেছিল ফজিলতের ব্যাপারেও ঠিক তাই-ই ঘটেছিল।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →