ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী সাহেবের মৃত্যু – শাহেদ আলী
[পোস্টের হেডলাইন দেইখা অনেকেই একটু কনফিউজড হইতে পারেন। এই হেডলাইনটা হইতেছে ফিকশন রাইটার শাহেদ আলী’র অটোবায়োগ্রাফি “জীবন কথা” বইয়ের একটা চেপ্টারের নাম। উনি ১৯৫৪ সালের ইলেকশনে সুনামগঞ্জের আসনে খেলাফতে রব্বানী পার্টি থিকা এমপি হিসাবে ইলেক্টেড হইছিলেন। অই ইলেকশনে রব্বানী পার্টির একমাত্র কেন্ডিডেট উনি, যিনি ইলেকশনে জিতছিলেন। মুসলিম লীগ থিকা বাইর হয়া আইসা আবুল হাশিম রব্বানী পার্টি তৈরি করছিলেন। যুক্তফ্রন্টের সাথে জোট বাইন্ধা ইলেকশন করতে চাইছিলেন, কিন্তু যুক্তফ্রন্টের অন্য শরিকরা তাদেরকে নিতে রাজি হয় নাই। তখন রব্বানী পার্টি ১০টা সিটে কেন্ডিডেট দিছিল। অই ১০ জন থিকা শাহেদ আলী ইলেকশনে জিতছিলেন। কিন্তু উনি এরপরে বেশিদিন এক্টিভ রাজনীতিতে থাকেন নাই। মাস্টারির পেশাতে ফেরত গেছিলেন।
আর যেই শাহেদ আলী’র মারা যাওয়ার কথা উনি লেখছেন, তার পরিচয় লেখাটা পড়লেই জানতে পারবেন। ]
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে তখন আতাউর রহমান খান প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা। আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা হলেও স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার উভয়ই শেরেবাংলা এ কে এম ফজলুল হকের কৃষকশ্রমিক পার্টির। স্পিকার ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী ও সুসাহিত্যিক আবদুল হাকিম সাহেব । প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন লোকটি। তিনি তাঁর স্বাধীনমতো পরিষদ পরিচালনা করতেন। ক্ষমতাসীন পার্টির ইচ্ছেমতো কাজ করতেন না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবদুল হাকিম সাহেবকে নিয়ে খুব অসুবিধায় পড়ল। তারা তাদের মনের মতো করে তাদের পরিষদ চালাতে পারছিল না।
ডেপুটি স্পিকার কুমিল্লার জনাব শাহেদ আলী পাটোয়ারীও কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য। কৃষক শ্রমিক পার্টির আমলেই তাঁরা স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। জনাব শাহেদ আলী আইনজীবী ছিলেন। তিনি একটু নরম ও সরল মেজাজের লোক ছিলেন।
আওয়ামী লীগ তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করতে চায়। স্পিকারের স্বাধীনতা তারা মানে না। তারা চায় যে স্পিকার তাদের ইচ্ছে ও হুকুমমতো কাজ করবে। কিন্তু আবদুল হাকিম কারও হুকুম শোনার লোক নন। তিনি কবি, সাহিত্যিক ও আইনজীবী। তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান, তাঁর কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করুক, তা তিনি চান না। নীতি ও কঠোর ন্যায়বিচারের পক্ষপাতী। কে খুশি হলো আর কে নাখোশ হলো—এই নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচি কার্যকর করার জন্য উদ্গ্রীব, কিন্তু অ্যাসেম্বলির ভেতরে স্পিকার আবদুল হাকিমের অনমনীয় দৃঢ়তার জন্য তারা অসহায় বোধ করছে। এই সময় স্পিকার আবদুল হাকিমের জন্য আমেরিকা থেকে দুই মাসের জন্য দাওয়াত আসে। সেই দাওয়াত পেয়ে আবদুল হাকিম সাহেব চলে গেলেন আমেরিকায়। ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী স্পিকারের দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা এটাকে মনে করলেন মহা সুযোগ। তাঁরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে স্থির করলেন আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর স্পিকারকে আর তার পরিষদে ওই আসনে বসতে দেবেন না। সরল সাদাসিদে শাহেদ আলী পাটোয়ারীকে তাঁরা স্পিকার করবেন। তিনি যদিও কেএসপিএ-র লোক। আওয়ামী লীগের সাংসদদের এই প্রলোভনে পড়ে শাহেদ আলী পাটোয়ারী আওয়ামী লীগের পরামর্শ অনুযায়ী পরিষদের কার্যক্রম চালাতে লাগলেন। এর মধ্যে আমেরিকা থেকে আবদুল হাকিম ফিরে এলেন। এসে তিনি পরিষদে ঢুকতে চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু তখন অ্যাসেম্বলির সব দরজাই বন্ধ। তিনি অ্যাসেম্বলিতে ঢুকতে পারলেন না। কেননা তাঁর আসার আগেই খবর পেয়ে তাঁর জন্য ঢোকার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অ্যাসেম্বলির ভেতরের খবর হলো স্পিকার সাহেব এসেছেন। কিন্তু তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কিছুদিন আগেই পরিষদ ভবনের জন্য সার্জেন্ট অব আর্মসের এক বিশেষ পুলিশ বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। তারা অ্যাসেম্বলির চারদিকে পাহারা দিতে থাকে। যাতে কেউ ঢুকতে না পারে, এজন্য তারা অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।
ট্যুর পুরো হওয়ার আগেই আবদুল হাকিম সাহেব যে ফিরে আসবেন, আওয়ামী লীগ কর্তৃপক্ষ তা কোনো দিন আশা করেনি। ফিরে এসেছেন শুনে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে এবং বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা শুরু হয়ে গেল। আওয়ামী লীগ তখন স্থির করে স্পিকার সাহেবকে পদচ্যুত করার এবং তাঁর জন্য তারা একটা মৌখিক প্রস্তাব আনে। প্রস্তাবটি হলো, এই স্পিকার আবদুল হাকিমের মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। পরিষদের কার্যক্রম চালাবার মানসিক ভারসাম্য তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। কাজেই তাঁর দ্বারা পরিষদের কার্যক্রম এবং স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তাকে এই কারণে অপসারিত করা হলো এবং তাঁর স্থানে জনাব শাহেদ আলী পাটোয়ারীকে স্পিকার নিয়োগ করা হলো। এই ধরনের একটা প্রস্তাব আনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মারমুখী হয়ে ওঠে বিরোধী দল। জনাব আবু হোসেন সাহেব হাত জোড় করে অনুরোধ করলেন, ‘এই কাজটি হতে দেবেন না। আপনি সরে পড়ুন। আবদুল লতিফ বিশ্বাস, নান্না মিয়া, ইউসুফ আলী চৌধুরী এবং আরও অনেকেই সামনের সারিতেই ছিলেন। রিপোর্টার এবং স্টেনোগ্রাফাররা যেখানে বসে কাজ করে সেখানে ঢুকে হইহুল্লা করতে লাগলেন আর দুহাত তুলে তাঁদের দলের লোক শাহেদ আলী পাটোয়ারীকে সরে পড়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু শাহেদ আলী সাহেব কিছুতেই নড়তে রাজি নন। এই সময়ে কেউ-কেউ দূরের গ্যালারি থেকে খাতাপত্র, ডাস্টার, সদস্যদের টেবিলে রাখা কাঠের প্লেট ছুড়ে মারতে লাগলেন ডেপুটি স্পিকারের দিকে। ইউসুফ আলী চৌধুরী রাগের চোটে আছড়িয়ে মাইক ভাঙতে শুরু করলেন। এদিকে শেখ মুজিবও তাঁর নিজের আসনে দাঁড়িয়ে উত্তেজনা প্রকাশ করতে লাগলেন।
এই হট্টগোলের মধ্যে শোনা গেল আবদুল হাকিম আর স্পিকার নেই, শাহেদ আলী স্পিকার। আরও শোনা গেল ডেপুটি স্পিকারের গায়ে আঘাত লেগেছে। আওয়ামী লীগের সদস্যরা শাহেদ আলী সাহেবকে বাঁচাতে চারপাশে ঘিরে ধরে তাঁকে আড়াল করে রেখেছেন এবং চেয়ার তুলে ধরে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিরোধী দলের ক্রোধ তখনও সমানভাবে চলছে। শাহেদ আলী সাহেব পরিষদ-অভ্যন্তরে মারাত্মকভাবে আহত হন।
এমন সময় দেখা গেল কয়েকজন আওয়ামী সদস্য শাহেদ আলী পাটোয়ারীকে ধরে ধরে তাঁর চেম্বারের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। হেঁটে হেঁটে গেলেন শাহেদ আলী সাহেব।
এতক্ষণে পূর্বদিকের একটি দরজা খুলে পুলিশের আইজি আবুল হাসনাত ঈসমাইল অনেক সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে ঢুকে পড়লেন এবং ঘোষণা করলেন, ‘Now I am the lord of the house. Vacate at once’… সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাসেম্বলির ভেতরে বিরোধীদলীয় সদস্যরা ক্রুদ্ধ গর্জনে ফেটে পড়লেন, “তুমি কে? কোন্ অধিকারে তুমি এখানে ঢুকলে? শিগগির বের হও এখান থেকে।’ তারপর শুরু হলো ধস্তাধস্তি। আবদুল লতিফ বিশ্বাস পড়ে গেলেন ফ্লোরে। তাঁকে পায়ে ধরে টেনে আর্মস ফোর্সরা দুই সারি গ্যালারির মধ্য দিয়ে টেনেহিঁচড়ে বারান্দায় নিয়ে যায়। ইউসুফ আলী চৌধুরীর পিঠ থেকে কামড় দিয়ে মস্ত বড়ো একদলা গোস্ত বের করে নেয় এক পুলিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাসেম্বলির হল খালি হয়ে গেল । স্পিকার আবদুল হাকিম এভাবেই স্পিকার পদ থেকে পদচ্যুত হলেন। আর এভাবেই আওয়ামী প্রলোভনে পড়ে সরল, সাদাসিদা মানুষ শাহেদ আলী পাটোয়ারী স্পিকার নির্বাচিত হলেন এবং ২৬ সেপ্টেম্বর জানা গেল, শাহেদ আলী পাটোয়ারী ঢাকা মেডিক্যালে ইন্তেকাল করেছেন।
শাহেদ আলী সাহেবের মৃত্যুর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর পরিষদের অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করা হয় এবং ৭ অক্টোবর দেশব্যাপী সামরিক শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রাদেশিক পরিষদের যবনিকাপাত ঘটে। স্পিকার শাহেদ আলী সাহেবের মৃত্যুকে ভুল করে আমার মৃত্যু মনে করে চারদিকে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন অ্যাসেম্বলির মেম্বার। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের বহু স্থান থেকে আমার বন্ধুবান্ধব আমার স্ত্রী ও শ্বশুরের কাছে আমার মৃত্যুতে কন্ডোলেন্স জানিয়ে টেলিগ্রাম করলেন। মধ্যনগর বাজারে গলহার হরেন্দ্র কুমার রায় চিৎকার করতে লাগলেন। এত বড়ো একটা সর্বনাশ হলো, এখনও হরতাল হলো না, শোকমিছিল হলো না!
১৯৫৭ সালে আমার স্ত্রী চেমন আরা নারায়ণগঞ্জের অদূরে নবীগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলে হেড মিস্ট্রেস পদে যোগ দিয়েছিল। আমি অধিবেশনের মুলতুবি হওয়ার পর কিছুদিন ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনে সম্পাদকীয় বোর্ডে কাজ করি মতিন সাহেবের আহ্বানে। মতিন সাহেবের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় আমি নবীগঞ্জে চলে গেলাম এবং ওখানে কিছুদিন নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত তোলারাম কলেজে স্বল্প সময়ের জন্য অধ্যাপনা করি। চট্টগ্রামে প্রথম মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে (বর্তমান নাসিরাবাদ মহিলা কলেজ) আমার স্ত্রী চেমন আরা সেখানে বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে চট্টগ্রামে চলে যায়। আমিও তার সঙ্গে আমার ঠিকানা পরিবর্তন করি।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫ - মার্চ 17, 2024
- বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক - ফেব্রুয়ারি 26, 2024
- ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুৎমার্গের কোন স্থান নেই – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ - ফেব্রুয়ারি 21, 2024