Main menu

আর্টের স্বরূপ – গোলাম মোস্তফা (১৯২৬)

[লেখক-সাহিত্যিক হিসাবে কবি গোলাম মোস্তফা’র (১৮৯৭ – ১৯৬২) তেমন কোন নাম-ডাক-পরিচয় বাংলাদেশের সাহিত্য-সমাজে এখন আর তেমন একটা নাই। ইন ফ্যাক্ট উনি মারা যাওয়ার পর থিকা, এবং পাকিস্তান-আমল শেষ হওয়ার পরে উনার নাম নেয়ার প্রাকটিস নাই। উনারে বরং অনেকে উনারে চিনতে পারেন পাপেটিয়ান মুস্তফা মনোয়ারের বাপ হিসাবে। এমনিতে উনার “বিশ্বনবী” বাংলা-ভাষায় সিরাতের বইগুলার মধ্যে ওয়ান অফ দ্য বেস্ট, যেইখানে হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনের ঘটনাগুলাই উনি মেনশন করেন নাই, তার নিজের কিছু আলাপ-আলোচনাও তৈরি করছেন। উনার কবিতা পুরাপুরি ইরিলিভেন্ট হয়া উঠলেও উনার গদ্যগুলা যে খুবই পাওয়ারফুল জিনিস ছিল, সেইটা আমার ধারণা, এখনো টের পাওয়া যাইতে পারে।

মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে, ১৯৬২ সালে, “আমার চিন্তাধারা” নামে বইয়ে উনার নন-ফিকশন লেখাগুলা উনি একসাথে কইরা ছাপাইছিলেন। উনার লেখাগুলারে দুইটা চ্যাপ্টারে ভাগ করছিলেন – পাকিস্তানের আগে ও পাকিস্তানের পরে। উনার লেখালেখি-তে ইসলাম সবসময় একটা সেন্টার পয়েন্ট হিসাবে ছিল। পলিটিকালি পুব-পাকিস্তান যে সম্ভব হয়া উঠছিল তার পিছনে গোলাম মোস্তফা’র সাহিত্যিক কন্ট্রিবিউশন আছে। আইডিয়া হিসাবে জায়গাটারে যারা কন্সট্রাক্ট করতেছিলেন বাংলা-ভাষার ভিতরে, উনিও তাদের মধ্যে একজন। যার ফলে পলিটিকাল পাকিস্তানের প্রতি উনাদের এক রকমের রেসপন্সিবিলিটি ছিল। যেইটা সাহিত্যের জায়গা থিকা উনারা ড্রাইভ করার কোশিশ করছেন, কিন্তু ইতিহাস তো সাক্ষী তো দেয় যে, উনারা পলিটিকাল জায়গাটাতে ফেইল করছিলেন; কিন্তু একইসাথে আজকের বাংলাদেশের যে সাহিত্যিক-আইডেন্টিটি, সেই বেইজটাও তৈরি করছিলেন।

এই পলিটিকাল কারণেই গোলাম মোস্তফার নাম নেয়াটা হারাম না হইলেও কিছুটা তো মাকরুহ-ই আসলে। তো, এইখানে আমার কথা হইতেছে যে, গোলাম মোস্তফার নন-ফিকশন লেখাগুলার রিলিভেন্স এখনো আছে, একটা সময়ের সাহিত্যিক-চিন্তা হিসাবে। উদাহারণ হিসাবে এই লেখাটা পড়তে পারেন।

ই.হা.]

আধুনিক সাহিত্যে ‘আর্টের’ আলোচনা প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। গল্পে, উপন্যাসে, কাব্যে, কবিতায়, চিত্রে, নাটকে, সঙ্গীতে— আর্ট এমন ভাবেই প্রভাব বিস্তার করিয়া বসিয়াছে যে, তাহাকে এড়াইয়া ঐ সব বিষয়ে কোনো কথা বলা আজকাল একরূপ অসম্ভব ব্যাপার। সাহিত্যের বাজারে যাঁহারা বিকিকিনি করেন, তাঁহারাও এ-সম্বন্ধে খুবই সজাগ। তাই দেখিতে পাই, কোনো একখানি উপন্যাস বা কাব্য প্রকাশিত হইলে সেখানি আর্টের দিক দিয়া সার্থক হইল, কিংবা ‘একেবারে মাটি হইয়া গেল’, মাসিক সাহিত্যের সমালোচক সে কথা উল্লেখ করিতে ভুলেন না। কেননা এ কথা তাঁহার বেশ ভালো রকমই জানা আছে যে, ঐ শ্রেণীর কোনো পুস্তক-সমালোচনায় আর্টের উল্লেখ না করিলে সমালোচনা বা সমালোচকের মূল্য বাড়ে না। যে কোনো একখানা উপন্যাস বাহির হইলেই তাহার বিজ্ঞাপনে লেখা হইয়া থাকে– “আর্টে ও মনস্তত্বে অনুপম”, “ফরাসী আর্টের নিপুণ নিদর্শন” ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ আর্ট লইয়া তর্ক-বিতর্কও নিতান্ত কম হয় না। কেহ বলেন- “Art for art’s sake”, কেহ বলেন — “আর্ট ধর্মনীতি বা সভ্যতার কোনে৷ তোয়াক্ক৷ বাখে না।” কেহবা বলেন “গুরু মহাশয়-গীরি করা আর্টের কাজ নয়,”—এইরূপ ধরনের অনেক কথাই শুনা যায়।

বস্তুতঃ আর্ট সম্বন্ধে অনেকের ধারণাই পরিচ্ছন্ন নয়। বর্তমান প্রবন্ধে আমি তাই আর্ট সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব।

আর্ট কী?

এই প্রশ্নের উত্তর আর্ট-প্রেমিকগণ যতো সহজ মনে করিয়া বসিয়া আছেন, প্রকৃতপক্ষে কিন্তু ততো সহজ নয়। আর্টবাদী হয়তো এক কথায় ইহার উত্তর দিবেন– ‘সৌন্দর্য সৃষ্টিই আর্ট। কিন্তু এ উত্তরে মোটেই সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। আর্ট যদি সৌন্দর্য সৃষ্টিই হয়, তবে সৌন্দর্য জিনিসটা কি? সেটা তো আমাকে আগে বুঝিতে হইবে। কাজেই আর্ট কি, এই প্রশ্নের পূর্বে সৌন্দর্য কি, ইহাই সর্বাগ্রে আমাদিগকে মীমাংসা করিতে হইবে ।

সৌন্দর্য কি?

এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন । কতকগুলি মৌলিক বিষয় আছে, যাহাদের কোনো সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া চলে না। গন্ধ কি, আস্বাদ কি, এসব প্রশ্নের কোন সংজ্ঞা নাই। তবে পারিপার্শ্বে র অবস্থা বর্ণনা দ্বারা এই সব বিষয়ের একটা মোটামুটি ধারণা দেওয়া যাইতে পারে। অতি প্রাচীন কাল হইতেই সৌন্দর্য সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ পরিলক্ষিত হইয়া আসিতেছে এবং এই কারণেই আর্টের সংজ্ঞাও বিভিন্ন হইয়া পড়িয়াছে।

প্রাচীনকালে সৌন্দর্য সম্বন্ধে কাহারও কোনো সঠিক ধারণা ছিল না বা এ সম্বন্ধে কোনো দার্শনিক কোনো গবেষণাও করেন নাই। গ্রীস দেশের পণ্ডিত সক্রেটিস, প্লেটো, এরিষ্টটল প্রভৃতির মতে, ‘যাহাই কার্যকরী তাহাই সুন্দর’। অর্থাৎ তাঁহারা সৌন্দর্যকে মঙ্গল হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখেন নাই। কথিত আছে, সক্রেটিসের নাসারন্ধ্র ও মুখ-গহ্বর অতিমাত্রায় প্রশস্ত ও কদাকার হইলেও তিনি উহাদিগকেই অপেক্ষাকৃত সুন্দর বলিতেন, কেননা, বাতাস ও খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের পক্ষে উহারাই অধিকতর কার্যকরী ছিল। সৌন্দর্য সম্বন্ধে প্রাচীন কালের প্রায় সকল দার্শনিক ও পন্ডিতই এই মত পোষণ করিতেন। শুধু প্রাচীন যুগ কেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কেহই কোনো আলোচনা বা গবেষণা করেন নাই। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে (১৭১৪-১৭৬২) জার্মানীতে বগার্টেন (Baumgarten) নামক জনৈক খ্যাতনামা দার্শনিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে সুশৃঙ্খলার সহিত আলোচনা আরম্ভ করেন। আধুনিক সৌন্দর্য-বিজ্ঞানের (Aesthetics) তিনিই একরূপ জন্মদাতা। তাঁহার মতে সৌন্দর্য অনুভূতির বিষয়ীভূত। চিন্তা (thinking) দ্বারা সত্য, ইচ্ছা (will) দ্বারা মঙ্গল এবং অনুভূতি (feeling) দ্বারা সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা যায়। সত্য, মঙ্গল এবং সুন্দরের মূলাধারা হইতেছে—সেই একমাত্র খোদাতালা। চিন্তার ভিতর দিয়া, নৈতিক ইচ্ছার ভিতর দিয়া এবং সৌন্দয়ানুভূতির ভিতর দিয়া তিন উপায়েই তাঁহাকে লাভ করা যায়। সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা করিতে যাইয়া তিনি বলেন, “অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরস্পরের মধ্যে এবং প্রত্যঙ্গ ও সমগ্রের মধ্যে সামস্য বিধানই সৌন্দর্য।” (A correspondence of the parts in their mutual relation to each other and in their relation to the whole.) সৌন্দর্যের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তিনি বলেন – আনন্দ-দান এবং অন্তরে কোনো একটা কামনার উদ্রেক করাই সৌন্দর্যের উদ্দেশ্য। আর্ট সম্বন্ধে তাঁহার মত— সৌন্দর্য সৃষ্ট করাই আর্টের প্রধান লক্ষ্য, তবে প্রকৃতির ভিতর হইতেই আর্টের উপাদান সংগ্রহ করিতে হইবে, কেননা সেই চরম ও পরম অশরীরী সৌন্দর্য (Absolute Beauty) প্রকৃতির ভিতর দিয়াই সর্বাপেক্ষা বেশী পরিমাণে আত্মপ্রকাশ করিতেছে।

অতএব বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে, বমগার্টেনের মতে সৌন্দর্যের একটা অন্যনিরপেক্ষ মৌলিক রূপ (Absolute Beauty) আছে; সৌন্দর্যের সহিত আনন্দ ও আকাঙ্খার সম্বন্ধ আছে এবং সৌন্দর্যই আর্টের প্রাণ।

বনগার্টেনের অব্যবহিত পরেই সুলজার, মেন্ডেলসোহন, মরিজ প্রভৃতি লেখকবৃন্দ আর এক নূতন মত প্রচার করেন। তাঁহারা বলেন — আর্টের লক্ষ্য সৌন্দর্য নয়, মঙ্গল। নৈতিক সুসম্পন্নতাই (moral perfection) আর্টের উদ্দেশ্য।

কিন্তু পরবর্তী কালে উইলকেনম্যান উপরোক্ত উক্তির বিরুদ্ধে এই মত প্রচার করেন যে, শুধু সৌন্দর্যই আর্টের লক্ষ্য; তাহার সহিত মঙ্গল ভাবের কোনোই সম্বন্ধ নাই। লেসিং, হার্ডার, গ্যেটে প্রভৃতি অনেকেই এই মত পোষণ করেন। অবশেষে খ্যাতনামা দার্শনিক ক্যান্ট (Kant) সৌন্দর্য ও আর্ট সম্বন্ধে আর এক নূতন কথা বলেন। তাঁহার মত এইরূপ–মানুষ যে নিজে প্রকৃতির মধ্যে রহিয়াছে এবং তাহার বাহিরেও যে প্রকৃতি রহিয়াছে এ জ্ঞান তাহার আছে। বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে সে সত্যের সন্ধান করে এবং নিজের মধ্যে সে মঙ্গলের সন্ধান করে। চিন্তা ও ইচ্ছাশক্তির দ্বারা এই দুই উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে। কিন্তু চিন্তা ও ইচ্ছা ছাড়া মানুষের আরও একটি অনুভূতি আছে – যাহা চিন্তা বা ইচ্ছার কোনোই ধার ধারে না। সে হইতেছে সৌন্দর্যানুভূতি। কাজেই ক্যান্টের মতে চিন্তা বা ইচ্ছার উদ্রেক না করিয়া এবং মঙ্গলামঙ্গলের সঙ্গে কোনোই সম্বন্ধ না রাখিয়া যাহাই আনন্দ দান করে, তাহাই সৌন্দর্য। অন্য কথায়, সৌন্দর্য তাহাকেই বলা হইবে, যাহা দেখিলে আনন্দ পাওয়া যাইবে বটে, কিন্তু লাভ-লোকসানের কোনোই কথা উঠিবে না। আর্টের ধারণাও তাঁহার এইরূপ। তাঁহার মতে আনন্দ দানই আর্টের উদ্দেশ্য।

ক্যান্টের পরবর্তী লেখকগণের মধ্যে হেগেলের (Hegel) নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সৌন্দর্যকে তিনি আর একভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন – খোদাতালা দুই উপায়ে আত্মপ্রকাশ করেন, (১) ভাবরূপে (subjectively) এবং (২) বস্তুরূপে (objectively)। বস্তুর ভিতর দিয়া সেই ভাবময়ের উচ্ছ্বল বিকাশই সৌন্দর্য। আত্মাই প্রকৃতপক্ষে সুন্দর; বাহিরের এই সৌন্দর্য সেই আত্মার সৌন্দর্যেরই বহির্বিকাশ। হেগেলের মতে সত্য এবং সুন্দর একই বস্তু। তফাৎ এই – সত্য হইতেছে সেই ভাবময়ের আসল বস্তুবিহীন রূপটি (Idea) – যাহা শুধুই চিন্তা ও ধারণার বিষয়; আর সৌন্দর্য হইতেছে সেই সত্যেরই বাস্তব বিকাশ। সত্য যখন বাহিরে রূপ পরিগ্রহ করে, তখন ইহা শুধু সত্য নয়, সুন্দর হইয়াও দেখা দেয়।

‘শিলার’ নামক আর একজন খ্যাতনামা দার্শনিক বলেন — সসীমের মধ্যে অসীমের অনুভূতিই হইতেছে সৌন্দর্য এবং হৃদয়ে এই অনুভূতির উদ্রেক করাই আর্টের কার্য ।

এইরূপভাবে ফিকটে, হারবার্ট, প্রভৃতি বহু খ্যাতনামা দার্শনিক সৌন্দর্য ও আর্ট সম্বন্ধে নানাভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করিয়া গিয়াছে। কিন্তু কেহই কোনো সৰ্ববাদী সম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছিতে পারেন নাই।

উপরোক্ত মতবাদগুলিকে মোটামুটিভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়— (১) সৌন্দর্যের একটা স্বাধীন অশরীরী সত্তা (Absolute Being) আছে; (২) সৌন্দর্য বলিয়া আসলে কিছুই নাই, যাহাই আনন্দ দান করে, তাহাই সৌন্দর্য ।

বলা বাহুল্য, উপরোক্ত মতদ্বয়ের কোনোটাই সন্তোষজনক নহে। প্রথমটি শুনিতে খুব গুরুগম্ভীর হইলেও উহা নিতান্তই হেঁয়ালীপূর্ণ, দুর্বোধ্য এবং ধারণাতীত। উহার দ্বারা সৌন্দর্য সম্বন্ধে মনের মধ্যে কোনো ধারণাই জমাট বাঁধিয়া উঠে না। দ্বিতীয়টি সহজবোধ্য হইলেও নিতান্তই ভ্রমপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ । কেননা, যাহাই আনন্দ দান করে, তাহাই যদি সৌন্দর্য হয়, তবে সৌন্দর্যের কোনোই আদর্শ (standard) থাকে না। একই বস্তু একজনের নিকট সুন্দর এবং অন্য জনের নিকট অসুন্দর বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে, কারণ সৌন্দর্যানুভূতি সকলের সমান নহে। ঠিক একই কারণে এহেন অনিশ্চিত ভিত্তির উপর দন্ডায়মান আর্টেরও কোনো স্থিরতা থাকে না; আর্টের নামে স্বেচ্ছাচার আরম্ভ হয়।

অতএব দেখা যাইতেছে, আর্টকে সৌন্দর্যের ভিত্তির উপর দাঁড় করাইয়া ব্যাখ্যা করিতে গেলে প্রকৃতপক্ষে কোনো ব্যাখ্যাই করা হয় না; উহা এক হেঁয়ালী হইতে আর এক হেঁয়ালীতে লইয়া যায় মাত্র।

আর্ট তবে কী? আমার মতে টলষ্টয় যে সংজ্ঞা দিয়াছেন, তাহাই ঠিক। তিনি বলেন, আর্টকে সম্যকরূপে বুঝিতে হইলে সর্বপ্রথম কর্তব্য এই হইবে যে, আনন্দকে বাহিরে রাখিয়া আর্টকে দেখিতে হইবে। অর্থাৎ সৌন্দর্য ও আনন্দের সহিত আর্টকে যোগ-সম্বন্ধ ভাবে দেখিতে হইবে না। আর্ট মানব জীবনেরই একটি ক্রিয়া বা অবস্থা; মানুষের মনোভাবের পরস্পর আদান প্রদানেরই ইহা অন্যতন উপায় স্বরূপ। বাকশক্তি যেমন মানুষের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার বিষয় অপর সকলের নিকট পৌঁছাইয়া দেয় এবং পরস্পরের মধ্যে একটা যোগস্থাপনা করে, আর্টও তদ্রূপ মানুষের অন্তরের অব্যক্ত অনুভূতিকে অপর হৃদযে পৌঁছাইয়া দেয়। মানুষ যাহা চিন্তা করে বা দেখে তাহা কথার দ্বারা অনায়াসে সে অপরের নিকট ব্যক্ত করিতে পারে; কিন্তু অন্তরের অন্তস্থলে সে যাহা অনুভব করে তাহা সাধারণ কথার দ্বারা সম্যক প্রকাশ পায় না; সেইখানে আর্টের প্রয়োজন হয়। সুতরাং আর্টকে অনুভূতির ভাষা বলা যাইতে পারে। নিজ অন্তরে যাহা অনুভব করা যায় অপর হৃদয়ে তাহাই অবিকল পৌঁছাইয়া দিবার কলা-কৌশলই আর্ট। টলষ্টয় বলেন:-

“Art is a human activity, consisting in this, that one man consciously, by means of certain external signs, hands on to others, feelings he has lived through and that others are infected by these feelings and also experience them.”

অর্থাৎ আর্ট একটি মানবীয় ক্রিয়া যদ্দারা কোনো মানুষ সজ্ঞানে কতিপয় প্রক্রিয়া দ্বারা নিজের মনের অনুভূত কোনো ভাবকে এমনভাবে অপরের মনে পৌঁছাইয়া দেয় যে, অপরের মন সেই ভাবে সংক্রমিত হইয়া নিজেই উহা উপলব্ধি করিতে পারে।

কতিপয় দৃষ্টান্ত দেওয়া যাউক :—

একটি অনাথিনী বিধবা তাহার একমাত্র পুত্রের মৃত্যুশোকে নিশীথ রাত্রে করুণ কন্ঠে এমন ভাবে কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাহার মনের ব্যথা বাহিরে ব্যক্ত করিতেছে যে, শ্রোতার মনেও সেই বেদনা সঞ্চারিত হইয়া গেল। এইখানে বলা যাইতে পারে যে, সেই ক্রন্দনের ভিতরে আর্ট আছে। স্বদেশ-স্বজাতির লাঞ্ছনা ও দুর্দশায় ব্যথিত হইয়া কোনো দেশনেতা স্বদেশবাসীর সম্মুখে এমনভাবে বক্তৃতা দান করিলেন যে, বক্তার মনের ব্যথা ও ভাব শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়েও ছড়াইয়া গেল এবং সকলেই বক্তার সহিত একমত হইয়া দেশের কার্যে আত্মনিয়োগ করিল। এখানেও আর্ট ক্রিয়া করিল। কোনো লোক জঙ্গলের মধ্যে বাঘের কবল হইতে রক্ষা পাইয়া আসিয়া তাহার বন্ধুবান্ধবদিগের নিকট এমন ভাবে উহার বর্ণনা দিল যে, সকলেই যেন সেই ভাব ও অবস্থা আপন প্রাণের মধ্যে অনুভব করিতে লাগিল এবং চক্ষুর সম্মুখে যেন সেই দৃশ্যাবলী দেখিতে লাগিল। এখানেও বর্ণনাকারীর বর্ণনায় যথেষ্ট আর্ট প্রকাশ পাইল। কোনো ঔপন্যাসিক, কবি বা চিত্রশিল্পী কোনো একটি বিষয় আপন প্রাণে উপলব্ধি করিয়া, অথবা কোনো একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া উপন্যাসে কবিতায় বা চিত্রে তাহা এমন ভাবে ফুটাইয়া তুলিল যে, পাঠক বা দর্শক সকলেই সেই ভাবের ভাবুক হইয়া পড়িল। এখানে তাহাদের সৃষ্টিতে আর্ট আসিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যাইতে পাবে আরব্যোপন্যাসের কথা। কাহিনীগুলি আর্টে পরিপূর্ণ, কারণ ঐ সমস্ত গল্প পড়িতে পড়িতে পাঠক একেবারে তন্ময় হইয়া যায়, লেখকের প্রাণে যে ভাবরাশি খেলা করিয়াছে, পাঠকও ঠিক সেই ভাবরাশি আপন প্রাণে অনুভব করিতে পারে ।

অতএব দেখা যাইতেছে, অনুভূতির আন্তরিকতা এবং সংক্রামকতাই আর্টের প্রধান লক্ষণ। সে অনুভূতি সুখের হউক, দুঃখের হউক, সৌন্দর্যের হউক, কুৎসিতের হউক, আনন্দের হউক, বেদনার হউক তাহাতে কিছু যায় আসে না। অনুভূতিবিহীন রং-চং সাজ-সজ্জা, শব্দালঙ্কার বা অভিনয় আর্ট নহে – তা সে যতই সুন্দর হউক না কেন। প্রকৃত আর্ট-সৃষ্টির মূলে সত্যানুভূতি (Sincerity of feeling) থাকা চাই, আর তার প্রকাশ-ভঙ্গী বা বহিঃসৌষ্ঠব (technique) এরূপ হওয়া চাই যেন তাহার ভিতর দিয়া আর্টিস্টের মনের আসল ভাবটি অপর হৃদয়ে সংক্রমিত হইয়া পড়ে। যে আর্টিস্টের অনুভূতি যতো গভীর হইবে এবং প্রকাশভঙ্গী যতো সহজ ও সুন্দর হইবে, তাহার আর্টও ততো পরিমাণে সার্থক ও সুন্দর হইবে ।

এ স্থলে বলিয়া রাখা ভালো, কোনো লোক হাসিতে হাসিতে অপর সকলকে হাসাইলে বা হাই তুলিয়া অপরকেও হাই তুলিতে বাধ্য করিলে, তাহা আর্ট হইবে না। ব্যাঘ্র-কবলে পতিত কোনো লোকের ভীতিসঙ্কুল মুখাকৃতি বা প্রাণভয়ে পলায়ন ও ভয়ার্ত চীৎকার আর্ট নহে। ফটোগ্রাফিও আর্ট নহে। আর্ট কতকটা সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস। আগে কিছু প্রাণ দিয়া অনুভব করা চাই, পরে তাহাই বিশ্বস্ত ভাবে প্রকাশ করা চাই, তবেই সেখানে আর্ট ফুটিবে। কোকিলের কুহু কুহু ডাকটিই আর্ট নহে; কিন্তু যদি কোনো ছেলে মেয়ে অবিকল কোকিলের মতো করিয়া ডাকিতে পারে, তবেই সেখানে আর্ট আসিল। আর্ট স্বভাব নহে,— স্বভাবের অনুকরণ (a representation, ond not a reality.)।

উপরে যাহা বলা হইল, উহাই আর্ট সম্বন্ধে টলষ্টয়ের অভিমত এবং আমার বিশ্বাস, এই মতই ঠিক। বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আর্ট-সমালোচক বিখ্যাত ইটালীয়ান দার্শনিক রেনেডেটো ক্রোস (B. Croce) – যিনি সৌন্দর্য বিজ্ঞানকে এক স্বজ্ঞ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, তিনিও আর্টের যে সংজ্ঞা দিয়াছেন, তাহাও টলষ্টয়ের সংজ্ঞার সহিত অবিকল মিলিয়া যায়। ক্রোস বলেন— “Art is expression of impression”, অর্থাৎ অনুভূতির প্রকাশই আর্ট। টলষ্টয়ও তো এই কথাই বলিতে চাহিয়াছেন। এ পর্যন্ত যাহা বলা হইল, আশা করি আর্টকে চিনিবার পক্ষে উহাই যথেষ্ট। কিন্তু আর্টকে আরও ব্যাপকতর ভাবে বুঝিতে হইলে আর্টের সহিত সত্য, মঙ্গল ও সুন্দরের কি সম্বন্ধ, তাহাও আমাদিগকে জানিতে হইবে।

আর্ট ও সত্য

উপরে বলা হইয়াছে যে, স্বভাব বা সত্যের অনুকরণই হইতেছে আর্ট। সুতরাং সত্যই হইতেছে আর্টের প্রাণ। সত্য ছাড়া আর্ট বাঁচিতেই পারে না। আর্টিস্টের সৃষ্টি বাস্তবতার কতো কাছাকাছি, তাহাই দেখিয়া তাহার সফলতার বিচার করিতে হইবে। দৃশ্যচিত্রে বা অভিনয়ে অস্বাভাবিকতা আসিলেই তাহা একেবারে ব্যর্থ হইয়া যায়। ধরুন রঙ্গমঞ্চে সীতা অভিনীত হইতেছে। সীতা যদি হাল ফ্যাশানের বেশভূষা করিয়া আসিয়া দাঁড়ায়, রাম যদি হ্যাট-কোট পরিয়া সিংহাসনে উপবেশন করে, শিল্পী যদি ইডেন গার্ডেনের এক কুঞ্জবনের অনুকরণে বাল্মিকীর তপোবন অঙ্কিত করিয়া দেখায়, এবং অভিনয়ে যেখানকার যে ভাবটি সম্যকরূপে ফুটিয়া না উঠে, তবে যে অভিনয় দেখিনা কি কেহ মুগ্ধ হইতে পারে। কখনোই না। অভিনয় তখন একটি প্রহসনে পরিণত হয় মাত্র।

অতএব দেখা যাইতেছে, অস্বাভাবিকতাই আর্টের মৃত্যুর কারণ। যাহাই অঙ্কিত করিতে চাহেন না কেন, প্রকৃতির ভিতরে থাকিযাই তাহা করিতে হইবে। অস্বাভাবিক বা অতিপ্রাকৃতিক কোনো কিছুই তিনি অঙ্কিত করিতে পারেন না, করিলে তাহা আর্ট হিসাবে ব্যর্থ হইয়া যায়। গ্রীষ্মকালের একটি চিত্র অঙ্কিত করিতে হইলে প্রকৃতির গুমট ভাব, গরমের জ্বালায় মানুষের অস্থিরতা; গায়ের কাপড় ফেলিয়া দিয়া বা শিথিল করিয়া পাখা দিয়৷ বাতাস খাওয়া ইত্যাদি ভাবই ফুটাইয়া তুলিতে হইবে; কারণ ইহাই সত্য বা স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা যতো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জীবন্ত করিয়া ফুটাইয়া তুলা যাইবে, আর্টিস্টের সৃষ্টি ততোই সুন্দর বলিয়া বিবেচিত হইবে। গল্পে উপন্যাসে কাব্যে সর্বত্রই এই একই নিয়ম। স্বভাবকে অতিক্রম করিয়া কোনো আর্টিস্টই চলিতে পারে না।

সত্য বা স্বাভাবিকতাই যখন আর্টের প্রাণ এবং এই সত্যের মূলে যখন সকল সত্যের মূলাধার সেই খোদাতালা, তখন এ কথা অনায়াসেই বলা বাইতে পারে যে, সকল আর্টের মূলই হইতেছে সেই সত্যময় খোদাতালা। তিনিই আর্টের কেন্দ্রস্বরূপ; তাঁহাকে ঘিরিয়াই সমস্ত আর্ট প্রকাশ পায়।

এইখানে একটা সমস্যা উঠিতে পারে। স্বাভাবিকত্ব রক্ষা করাই যদি আর্টের প্রধান লক্ষ্য হয়, তবে অনেক অশ্লীল বা কুৎসিত ভাবের চিত্রকেও আর্ট বলিয়া স্বীকার করিতে হয়, কারণ সেগুলিও স্বভাবতঃ সত্য। কুৎসিতের মধ্যেও যে আর্ট আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু আর্ট হইলেই তো হয় না। প্রত্যেক জিনিসেরই ভালো-মন্দ তো আছে। আর্টের ভিতরেও এই শ্রেণীর আর্ট নিতান্ত জঘন্য আর্ট, ইহাদিগকে বর্জন করিয়া চলা সর্বতোভাবে আমাদের কর্তব্য। ‘বাতাস আমাদের জীবন ধারণের উপায় – এ কথা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিলেও আমরা যেমন প্রাণনাশক দূষিত বাতাসকে বর্জন করিয়া অক্সিজেনপূর্ণ বিশুদ্ধ বাতাসেরই সন্ধান করি, আর্টের বেলায়ও অবিকল এইরূপ। আর্টে সত্য ও স্বাভাবিতা রক্ষা করিয়া চলিতে হইবে বলিয়া যে নির্বিচারে যে-সে সত্য ঘটনাকেই আর্ট-সৃষ্টির উপাদান বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে, এমন কোনো কথা নাই। বাস্তবতাকে এই অর্থে গ্রহণ করিলে ভুল করা হইবে। এই শ্রেণীর আর্টকে নিছক (realistic art) বা প্রত্যক্ষ-দ্যোতক আর্ট বলে। যাহাই প্রকৃতিতে আছে, নির্বিচারে তাহাই অঙ্কিত করিয়া লোক-চক্ষুর সম্মুখে ধরা এই আর্টের কর্ম। বর্তমানে এই শ্রেণীর আর্টবাদীর সংখ্যাই বেশী। তাহারা জীবনের আস্তাকুঁড়ে হইতে কুৎসিৎ পচা জিনিস তুলিয়া আনিয়া realistic art এর নামে চালাইতে চান। গল্পে উপন্যাসে কাব্যে ও চিত্রে এই মনোভাব অধিকাংশ লেখকদিগের মধ্যে দেখা যাইতেছে। তাঁহারা সত্য বা স্বাভাবিকতাকে অনুকরণ করিতে চান করুন, ইহা খুব ভালো কথা। কিন্তু তাঁহারা যাহা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতেছেন, তাহা সত্য সত্যই সত্য কিনা, সেটুকু তো চিন্তা করিয়া দেখিতে হইবে।

নিত্য যাহা চোখের সামনে ঘটিতে দেখিতেছি, অনেক সময় তাহা সত্য হয় না। বাস্তবতার মধ্যেও যে মিথ্যা লুকাইয়া আছে, এ সত্য তাহাদিগকে বুঝিতে হইবে। টলষ্টয় ঠিকই বলিয়াছেন :

“Truth will be known not by him who knows only what has been, is and really happens, but by him who recognises what should be according to the will of God”.

অর্থাৎ যাহা ঘটিয়া গিয়াছে, ঘটিতেছে বা ঘটে, তাহাই যে সত্য বলিয়া জানে, যে প্রকৃত সত্যকে চিনে নাই। খোদাতালার ইচ্ছা অনুসারে কি ঘটা উচিত তাহাই যে উপলব্ধি করিতে পারে, সে-ই সত্যকে চিনিয়াছে।

আর্টস্টের সত্য-সাধনা এইরূপই হওয়া উচিত। অন্ধ realist না হ‍ইয়া তাহাকে idealist বা আদর্শবাদীও হইতে হইবে। কোনো লম্পট-প্রকৃতির ধনী যুবক সমাজ শাসন ও নীতিধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়া বিলাসব্যাসনে মহান সুখে কালাতিপাত করিতেছে দেখিয়া যদি কেহ মনে করেন যে, সে প্রকৃতই সুখী, তবে তিনি ভুল করিবেন। প্রকৃত সুখী সে নয়, কেননা খোদাতালার বিধানে ঐরূপ জীবনের মধ্যে সুখ নিহিত নাই। পক্ষান্তরে “হিতোপদেশ” বা “ঈশপের গল্প” সমূহ সত্য না হইলেও সত্য, কেননা খোদাতালার ইঙ্গিত যে কোনদিকে, তাহা ঐ সব গল্পে পরিষ্কারভাবে দেখানো হইয়াছে।

অতএব স্বাভাবিকতার খাতিরে অতিস্বাভাবিকতা ভালো নয়। স্বাভাবিক সত্যের সহিত আদর্শ সত্যের যোগ থাকা চাই, নতুবা কোনো শিল্পীর আর্টই সার্থক হইবে না। স্বাভাবিক সত্যের মধ্যে যাহা অসত্য, তাহা বর্জন করিতে হইবে এবং অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা স্থান বিশেষে আদর্শ সত্যেরও সৃষ্টি করিতে হইবে।

আর্ট ও সৌন্দর্য

টলষ্টয় আর্টের যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং আমরাও যাহা সমর্থন কবিযা আসিয়াছি, তাহাতে হয়তো অনেকে মনে করিতে পারেন, আর্টের সহিত সৌন্দর্যের বুঝি কোনোই সম্বন্ধ নাই। এ ধারণা ভুল। সৌন্দর্যের সহিত যে আর্টের কোনোই সম্বন্ধ থাকিবেনা, টলষ্টয় এমন বলেন নাই।

সৌন্দর্য ও আনন্দ হইতে আর্টকে বিচ্ছিন্ন করিয়া তিনি উহার সঠিক স্বরূপ দেখাইয়াছেন মাত্র। পূর্বে লোকের ধারণা ছিল, সৌন্দর্য ও আনন্দ যাহার মধ্যে আছে, তাহাই আর্ট। টলষ্টয় এই ধারণাকে ভাঙিয়া দিয়া আর্টকে জীবনের মধ্যে সহজভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। যাহাই সুন্দর ও আনন্দ দায়ক, তাহাই আর্ট — এ কথার তিনি প্রতিবাদ করিয়াছেন বটে, কিন্তু যাহাই আর্ট তাহাই যে সুন্দর ও আনন্দদায়ক হইবে না, তাহা তো তিনি বলেন নাই। বস্তুতঃ আর্টের সহিত সৌন্দর্যের কোনো বিরোধ তো নাই-ই, বরং ঘনিষ্ট সম্বন্ধ রহিয়াছে। সত্য যেমন আর্টের প্রাণ, সৌন্দর্য তেমনই আর্টের পরিচ্ছদ। সৌন্দর্য ছাড়া আর্ট বাহিরে আসে না। সৌন্দর্যের সহিত আর্টের এতই ঘনিষ্টতা যে বাহিরের লোক তাহার এই উজ্জ্বল বহিরাবরণ দেখিয়া মনে করিয়াছে, সৌন্দর্য ও আর্ট একই বস্তু।

উপরে রঙ্গমঞ্চের দৃষ্টান্তে দেখানো হইয়াছে, অভিনয় ও দৃশ্যাবলী যতো পরিমাণে স্বাভাবিক বা সত্য হয়, ততো পরিমাণে উহা সুন্দর দেখায়। সুতরাং দেখা যাইতেছে সৌন্দর্যের সহিত সত্যের সম্বন্ধ আছে। সত্য যেখানে পরিষ্কারভাবে বাহিরে আত্ম-প্রকাশ করে, সেখানে তাহা সুন্দর না হইয়াই পারে না। ইহা খোদাতালারই বিধান। তিনি যেমন সত্য ও মঙ্গল স্বরূপ, সেইরূপ সুন্দবও। বিশ্ব-প্রকৃতিতে তাই এত রূপের লীলা। বস্তুতঃ সৃষ্টির দুই মূলীভূত উপাদানই হইতেছে সুর আর রূপ। একটু সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে সুরও দূরীভূত হইয়া যায়, থাকে কেবল রূপ; কেননা বাহা সুর তাহাও রূপ। রূপের অন্তরালে ‘অরূপ রতন’ বিরাজিত রহিয়াছে বটে, কিন্তু তাহাকে পাইতে হইলে এই ‘রূপ-সাগরেই’ ডুব দিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই ঠিকই বলিয়াছেন– “রূপ-সাগরে ডুব দিয়েছি, অরূপ রতন আশা করে।”

মানুষ এই রূপের মধ্যেই ডুবিয়া আছে। সুতরাং তাহার নিজস্ব সৃষ্টিতে যে রূপ বিদ্যমান থাকিবে, ইহা স্বাভাবিক।

সৌন্দর্যের সহিত আর্টের এই প্রানের যোগ, ইহা আর্টেরই বিশিষ্ট প্রকৃতি। বিজ্ঞান বলো, দর্শন বলো, প্রত্যেক বিষয়েরই একটা স্বতন্ত্র প্রকৃতি বা মেজাজ আছে। বিজ্ঞান ও দর্শনের মূল লক্ষ্য সত্য উপলব্ধি হইলেও, প্রত্যেকের গতিপথ স্বতন্ত্র। বিজ্ঞান যে-পথ দিয়া চলে, দর্শন সে-পথ দিয়া চলে না; সে চলে আর এক নূতন পথ দিয়া। সেইরূপ আর্টের পথও বিভিন্ন। তার পথ ইইতেছে সৌন্দর্যের মধ্য দিয়া। এই পথ দিয়াই সে আমাদিগকে সত্যের সন্নিধানে লইয়া যায়। অতএব দেখা যাইতেছে আর্টের সহিত সৌন্দর্যের ঘনিষ্ট সম্বন্ধ আছে। সৌন্দর্য ছাড়া আর্ট বাহিরে প্রকাশ পাইতেই পারে না।

আর্ট ও মঙ্গল

সত্য যদি আর্টের প্রাণ হইল, সৌন্দর্য যদি তাহার পরিচ্ছদ হইল, তবে লক্ষ্য তাহার কী হইবে? কোথায় কোন্ উদ্দেশ্যে যে যাত্রা করিবে?

আর্টের লক্ষ্য হইবে মঙ্গল। এই ‘মঙ্গল গ্রহের’ দিকেই তাহাকে ছুটিতে হইবে। বিশ্ব-মানুষের কল্যাণ সাধনই হইবে তাহার চরম লক্ষ্য।

আর্ট ও নীতি

এখানেই আর্টের সহিত নীতির (morality) কথা আসিয়া পড়ে। এই প্রশ্ন লইয়া যথেষ্ট মতভেদ দেখা যায় । একদল বলেন, আর্টে ভালো নন্দ বিচার করিতে হইবে, নতুবা আর্টের নামে স্বেচ্ছাচার আরম্ভ হইবে। আর একদল বলেন—ওরূপ নৈতিক বিচার (moral judgment) আর্টের বেলায় খাটিবে না। একদল বলেন—নৈতিক সুসম্পন্নতাই (moral perfection) আর্টের উদ্দেশ্য। অন্য দল বলেন – নিছক আনন্দ দানই আর্টের উদ্দেশ্য; ভালোমন্দ বা মঙ্গলামঙ্গলের সে কোনো ধার ধারে না। আর্টিস্টের সৃষ্টিতে সৌন্দর্য ও আনন্দের সন্ধান পাওয়া গেল কি না, তাহাই শুধু বিচার্য ! নীতি বা মঙ্গলের অনুশাসন মানিয়া চলিলে আর্টিস্টের সৃষ্টি পদে পদে বাধা প্রাপ্ত হয়, কোনো নূতন সৃষ্টি সম্ভবপর হয় না।

এই মতদ্বয়ের কোনটি সত্য? আমার মনে হয়, আর্ট যে নীতির গণ্ডীর বাহিরে, ইহা হইতেই পারে না। কোনো বাধাবদ্ধ নাই, শাসন-শৃঙ্খলা নাই, সংযম-গুচিত৷ নাই, —- আর্টিস্ট বাহা খুশী তাহাই করিয়া চলিবেন, আর তাহাই আর্টের নামে কাটিয়া যাইবে, ইহা বাতুলের উক্তি। ইহার নাম স্বাধীনতা নয়, উচ্ছৃঙ্খলতা। “গুরু মহাশয়গিরী করা আর্টের কাজ নয়”— ইহা না হয় স্বীকার করিলাম; কিন্তু তাই বলিয়া আর্টে যে কোনোই সংযম-শাসন থাকিবে না, এ কেমন কথা? আর্ট মানব জীবনে এমন কী এক দুর্লভ পদার্থ, যার জন্য নীতিধর্ম ও মঙ্গলকে জলাঞ্জলি দিয়া তাহার সেবায় আত্ম-নিয়োগ করিতে হইবে? আর্ট এমনই বা কী বস্তু, যাহার নামে অকল্যাণ ও দুর্নীতিকে অকাতরে জীবনের মধ্যে বরণ করিয়া লইয়া অধোগতির পথে যাইতে হইবে? মঙ্গল ও সুনীতির নামে এত কেন আপত্তি? ‘নূতন সৃষ্টির ব্যাঘাত ঘটিবে, তাই? সৌন্দর্য ও আনন্দকে স্বাধীনভাবে উপভোগ করা বাইবে না, তাই? কতোটুকু ব্যাঘাত ঘটিবে? কতোটুকু লোকসান হইবে? আমার তো মনে হয় আর্টের নামে যাঁহারা স্বাধীনতার দাবী করেন, তাঁহারা হয়তো এ সব লাভ-লোকসানের বিষয় আদৌ চিন্তা না করিয়াই একে অপরের দেখাদেখি প্রচলিত ধুয়ার প্রতিধ্বনি করেন মাত্র, নয় তো তাহারা আসলেই অতি বদ, তাহাদের মতলবও নিতান্ত খারাপ। নৈতিক চৌহদ্দী বজায় রাখিয়া কি সম্ভব নয়? বরং সৃষ্টির এক প্রধান সত্যই হইতেছে নিয়ন্ত্রণ।

আর্টিস্টের সৃষ্ট নৈতিক বিচারের গণ্ডীর মধ্যে আসিবে না কেন? যখন একটি মানবীয় ক্রিয়া (human activity), এবং মানুষ যখন একটি সামাজিক ও নৈতিক জীব (social and moral being ), তখন তার সৃষ্টিতে বা শিল্পকর্মে ভালোমন্দের বিচার যে চলিবে, ইহা তো নিতান্তই স্বাভাবিক। যে কার্যের ভিতর কোনো উদ্দেশ্য (intention) নিহিত আাছে, তাহা যে নৈতিক গণ্ডীর ভিতরে আসিবে, নীতি-শাস্ত্রের ইহা তো খুবই সোজা কথা। শিল্পী যখন কাব্যে উপন্যাসে বা চিত্রে কোনো সুন্দর বা কুৎসিৎ ভাব অঙ্কিত করিয়া জনসাধারণের সম্মুখে তুলিয়া ধরেন, তখন তার মধ্যে কোনো-না-কোনো একটা উদ্দেশ্য তো থাকেই। তার সৃষ্টি সকলে দেখুক এবং তাহাকে সুখ্যাতি করুক—এ উদ্দেশ্য প্রত্যেক শিল্পীর অন্তরেই বিরাজিত। অন্ততঃ তার সৃষ্টিকে বাহিরে প্রকাশ করিবার আনন্দটুকু উপভোগ করাও তো একটা উদ্দেশ্য। যদি কোনো উদ্দেশ্যই না থাকিবে, তবে শিল্পীরা আপন আপন সৃষ্টিকে সাধারণ্যে প্রচার করিতে এত ব্যগ্র কেন? আপনার সৃষ্টি আপনারই আত্মতৃপ্তির জন্য গোপন করিয়া রাখিলেই তো চলিত। তাহা যখন দেখি না, তখন নিশ্চয়ই বুঝিতে হইবে, আর্টিস্টের সৃষ্টি উদ্দেশ্য বিহীন নহে।

আর্টিস্ট যাহাই বলুন না কেন, তার সৃষ্টি যখন জনসমাজে প্রচারিত হয়, তখন নিশ্চয়ই তার একটা প্রভাব আছে। কাজেই সে প্রভাব ভালো কি মন্দ সে বিচার সমাজ করিবেই। “আর্টের খাতিরে আর্ট”, “নীতি-ধর্মের সহিত আর্টের কোনো সম্বন্ধ নাই” –ইত্যাদি বলিয়া শত চীৎকার করিলেও কোনো ফল হইবে না। সামাজিক জীব হিসাবে আমার যেমন কতকগুলি ব্যক্তিগত অধিকার (rights) আছে, সেইরূপ কতকগুলি কর্তব্য-বন্ধনও (duties and responsibilities) আছে। আপন বাড়ীতে স্বাধীন ভাবে কাজকর্ম করিবার আমার পূর্ণ অধিকার থাকিলেও আমি যখন-যাহা-খুশি – তাহাই করিতে পারি না। প্রতিবেশীর তাহাতে অসুবিধা ও আপত্তি যাছে কিনা, তাহার প্রতি আমার লক্ষ্য রাখিতে হয়, নতুবা আইন আমলে আসে। সেইরূপ আর্টিস্টের সৃষ্টিও যখন সমাজের সংস্পর্শে আসিতে বাধ্য, তখন সমাজের কল্যাণ-অকল্যাণের দিকে আর্টিস্টের লক্ষ্য রাখিতেই হইবে। আর্টিস্ট যদি সমাজ-গণ্ডীর বাহিরে এক জনহীন “Palace of Art”-এ বাস করিয়া “Art for art’s sake” ইত্যাদি বুলি আওড়াইতেন এবং যাহা-খুশী-তাহাই করিতেন, তবে তাঁহার উপর কোনো বিচারই চলিত না। কিন্তু যতক্ষণ তিনি সমাজের সহিত সম্বন্ধ রাখিয়া কোনো কার্য করিবেন – তা সে আর্টই হউক আর অপর কিছুই হউক – ততক্ষণ তাঁহাকে ভালোমন্দের বিচারাধীন থাকিতেই হইবে।

আর্ট ও মনোবিজ্ঞান

মনোবিজ্ঞানের দিক হইতে দেখিলেও আর্টকে নৈতিক গণ্ডীর মধ্যে ফেলা যায়। মানব মনের মাত্র তিন অবস্থা :-thinking, feeling, willing, অর্থাৎ হয় সে চিন্তা করিবে, নয় সে অনুভব করিবে, নয় সে কিছু ইচ্ছা করিবে। এই তিন মনোবৃত্তির বাহিরে মানুষ থাকিতেই পারে না। সত্য ও জ্ঞান চিন্তা-সাপেক্ষ, সৌন্দর্যানুভূতি, প্রেম প্রভৃতি অনুভূতি-সাপেক্ষ এবং মঙ্গলামঙ্গল ইচ্ছা-সাপেক্ষ। অন্য কথায় ‘সত্য’ ‘সুন্দর’ ও ‘মঙ্গলের’ মূল ভিত্তিই হইল thinking, feeling এবং willing. এই তিনটি মনোবৃত্তি পরস্পর স্বতন্ত্র — এমন কি স্থানে স্থানে বিরোধী হইলেও, পরস্পরের মধ্যে মিলও কিন্তু যথেষ্ট। অন্তরে যখন প্রেম জাগ্রত হয়, চিন্তা বিবেক বা মঙ্গলামঙ্গলের কথা তখন দূরে থাকে। চিন্তা করিতে গেলে অনেক স্থলে হয় তো প্রেম করাই হয় না। আবার কার্যক্ষেত্রে নামিয়া কবির মতো শুধু ধ্যান করিতে গেলে, হয় তো সে কার্যই পন্ড হইয়া যায় । যে মানুষ ডুবিয়া মরিতেছে, তাহাকে দেখিয়া যদি যুক্তিতর্ক দ্বারা কর্তব্য স্থির করিতে যাই, তবে সে বেচারার আর উদ্ধার নাই। ইহা দ্বারাই বুঝা যাইতেছে, এই তিনটি মনোবৃত্তি পরস্পর কতো স্বতন্ত্র। কিন্তু অনেক স্থলে ইহাদের মধ্যে পরস্পর মিলও যথেষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। জ্ঞান জন্মিলেই অনুভূতি জন্মিতে পারে, এবং পরে তাহা হইতে কর্মপ্রবৃত্তি জাগিয়া উঠে। স্বদেশ বা স্বজাতির লাঞ্চনা ও দুরবস্থার কথা যখন জানিতে পাবি, তখন অন্তর তলে বেদনার অনুভূতি আপনা-আপনিই জাগিয়া উঠে এবং সেই অনুভূতি হইতেই দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করিবার প্রবৃত্তি জন্মে। অনুভুতি হইতেও অনেক সময় জ্ঞানে পৌঁছিতে পারি। এইরূপে জ্ঞান, অনুভূতি এবং কর্মস্পৃহা পরস্পর পরস্পরকে অনেক সময় সাহায্য করিয়া প্রত্যেকের গতিপথ নিয়ন্ত্রিত করিয়া দেয়। পরস্পর স্বতন্ত্র হইলেও কেহই স্বাধীন ভাবে চলে না। প্রেম, ক্রোধ প্রভৃতি অনুভূতি-প্রধান মনোবৃত্তিগুলি যখন স্বাধীন ভাবে কাজ করে, তখনই জগতে মহা অনর্থ সাধিত হয়। কিন্তু তাহারা যখন বিবেক বা জ্ঞানের শাসন মানিয়া চলে, তখনই তাহারা সুন্দর ও সার্থক হয়।

আর্টও যখন এই feeling-এর অন্তর্ভুক্ত, তখন সেও একেবারে বিবেক ও নীতির বাহিরে থাকিতে পারে না। সত্য ও মঙ্গলের দ্বারা সংযত হইয়া চলিলেই সে প্রকৃতপক্ষে সুন্দর হয়।

আর্ট ও প্রকৃতি

উপরে বলা হ‍ইয়াছে, আর্ট হইতেছে স্বভাবের অনুকরণ। সুতরাং এইবার আমরা বিবেচনা করিয়া দেখিব, স্বভাবের মধ্যে কোনো মঙ্গলভাব বা নৈতিক প্রভাব নিহিত আছে কি না। যদি থাকে, তবে আমাদের আর্টেও উহা স্বতঃসিদ্ধ ভাবে থাকিবে ।

স্বভাব বা প্রকৃতির অনুকরণ করাই আর্টের কাজ। প্রকৃতিকে ছাড়িয়া আর্ট দাঁড়াইতেই পারে না। প্রকৃতিই হইতেছে আর্টের প্রতিষ্ঠাভূমি। কিন্তু এই প্রকৃতি নিজেই একটি আর্ট — স্বয়ং খোদাতালা ইহার শিল্প। কাজেই দেখা যাইতেছে, মানুষের আর্ট হইতেছে খোদার আর্টের সন্তান। অর্থাৎ আমাদের আর্টের অবস্থা ঠিক যেন নাতী-নাতনীর অবস্থার ন্যায়। Dante তাই বলিয়াছেন :–

“Nature takes its method and its ends
From God, Whose mind in
skill and art is shown,
Your Art, as far as may be, close behind
Follows, as scholars near their teacher tread;
So in your Art we may
God’s grandchiled find.”

এখন দেখা যাউক, খোদার আর্টের মধ্যে—অর্থাৎ এই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে খোলতাল৷ কোনো মঙ্গলভাব নিহিত রাখিয়াছেন, না তিনিও “Art for art’s sake” নীতির অনুসরণ করিয়াছেন। একটু চিন্তা করিলেই দেখিতে পাওয়া যায়, এই যে নানা বর্ণে নানা বৈচিত্র্যে প্রকৃতি আমাদের সম্মুখে নিত্য নব নব মূর্তিতে প্রকাশ পাইতেছে, ইহা কোনো খেয়ালী বিধির সৃষ্টি নয়, ইহার মধ্যে মঙ্গলভাব ওতপ্রোতভাবে নিহিত রহিয়াছে। বসন্তের দখিন হাওয়ায়, কুসুমের হাসির হিল্লোলে ভরা-বাদরের-জল-কল্লোলে, চন্দ্র-সূর্যের আলোক-পাতে – ফুলে ফলে বর্ণে, গন্ধে,— সর্বত্রই কার যেন মঙ্গল হস্তের সুখ-স্পর্শ অনুভব করি। প্রভাতে অরুণ কিরণ বিচিত্র বর্ণাছটায় কি অপরূপ শোভাই না ফুটাইয়৷ তোলে! কিন্তু সেই শোভা ও সৌন্দর্যের মধ্য দিয়া নিখিল বিশ্বের সুপ্ত প্রাণে যে নব-জীবনের পুলক-স্পন্দনও আনিয়া দেয়। ফুল-শাখায় দোলা দিয়া, কচি ধানের বুকের উপর ঢেউ খেলাইয়া, বাতাস বাহিয়া যায়। কিন্তু তার মধ্য দিয়া যে মানুষের ঘরে-ঘরে সঞ্জীবনী সুধাও দান করিয়া চলে। অন্ধকার রাত্রিতে তারকা-বালারা মিষ্টি চোখে মুচকি হাসি হাসিয়া ধরার মানুষকে শুধু পাগলই করে না, ধ্রুবতারা হইয়া তাহারা কতো দিগ্‌- ভ্রান্ত পথিকের পথ-নির্দেশও করিয়া দেয়। কতো বর্ণে, কতো গন্ধে পুষ্প বিকশিত হইয়া উঠে, কিন্তু তারাও মানুষের অশেষ কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে। ফল হইয়া মানুষের কাজে লাগাই হইতেছে ফুলের জীবনের গোপন সাধনা এবং যতক্ষণ এই সাধনা সিদ্ধ না হয়, ততক্ষণ যেন তার সৌন্দর্য সার্থক হইয়া উঠে না। নদনদী শুধু প্রকৃতির আনন্দ ও শোভা বৰ্দ্ধনই করে না, জনপদের ভিতর দিয়া দিকে দিকে প্রবাহিত হইয়া সে মানুষের বহু কল্যাণ সাধনও করিয়া থাকে। বস্তুতঃ যেদিকেই দৃষ্টিপাত করি, সেই দিকেই দেখিতে পাই—সৌন্দর্য ও আনন্দের মধ্য দিয়া জগতের মঙ্গল- সাধনই প্রকৃতির উদ্দেশ্য।

খোদাতালার আর্টের ইহাই যখন লক্ষ্য তখন মানুষের আর্টে কেন ইহার ব্যতিক্রম হইবে? সত্য বটে, প্রকৃতিতে অসুন্দরের বা অমঙ্গলেরও অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে। ঝড় ভূমিকম্প অনাবৃষ্টি বন্যা প্রভৃতিও প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাই বলিয়া উহারাই প্রকৃতির চরম সত্য নয়। আর ঐগুলি যে প্রকৃতই অমঙ্গল, তাহারও কোনো নিশ্চয়তা নাই। আমাদের জ্ঞান নিতান্তই সসীম। এই সসীম জ্ঞান লইয়া অসীমের লীলা কি করিয়া আমরা বুঝিব? তাই দেখিতে পাই, আমাদের নিকট যাহা অমঙ্গল বলিয়া অনুভূত হয়, প্রকৃতপক্ষে তাহা অমঙ্গল নয়। অতি উর্ধ্ব হইতে দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যায়, তথাকথিত অনেক অমঙ্গলই তার এক বৃহত্তর মঙ্গলের কারণ স্বরূপ। সুতরাং এ কথা আমরা অনায়াসে বলিতে পারি যে, খোদাতাল৷ তাঁহার সৃষ্টিতে সর্বত্রই মঙ্গল-ভাব নিহিত রাখিয়াছেন।

এখানে একটা কথা উঠিতে পারে যে, প্রকৃতিতে যাহা অমঙ্গল বলিয়া মনে হয়, তাহা যদি প্রকৃত অমঙ্গল না হয়, তবে মানুষের সৃষ্টিতেও যাহা আমরা অমঙ্গল বলিয়া মনে করি, তাহাও তো প্রকৃত অমঙ্গল হইতেও পারে! পরিণামে সব অমঙ্গলই তো মঙ্গলপ্রসূ হইবে। এ কথা অনেকটা সত্য বটে। কিন্তু মানুষের কৃত অমঙ্গলকে মঙ্গলে পরিণত করিতে প্রকৃতি এত দীর্ঘ সময় প্রশ্ন করে যে, তাহার ফল ভোগ করিবার পূর্বেই বহু লোক ধ্বংস মুখে গিয়া পৌঁছে। বহিঃপ্রকৃতির অমঙ্গল ভাব অপেক্ষা মানুষের অমঙ্গল তার দ্রুত কার্যকরী, মানুষের কাজ মানুষের উপর সহজেই প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। কাজেই কোনো মানুষকেই দুর্নীতি বা অমঙ্গল ভাব প্রচার করিতে দেওয়া নিরাপদ নয়।

অনেকে বলেন, আর্টে নীতি ও নঙ্গলের শাসন চলিলে আর্টিস্টের সৃষ্টি ব্যাঘাত প্রাপ্ত হয়, স্বাধীন সৃষ্টি অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়। ‘স্বাধীন সৃষ্টির’ দ্বারা তাঁহারা যে কি বোঝেন, বুঝি না। মানুষের স্বাধীন সৃষ্টি অর্থ কী? তার সৃষ্টি স্বাধীন হইতে পারে কি? কখনই নয়। মানুষের শক্তি সীমাবদ্ধ, সে অন্য নিরপেক্ষ নয়, সুতরাং স্বাধীন সৃষ্টি তাহার হস্তে কি করিয়া সম্ভব? একমাত্র খোদাতালাই স্বাধীন সৃষ্টি করিতে সক্ষম, কেননা তাঁহার সৃষ্টি অন্য কাহারও অপেক্ষা রাখে না। ইচ্ছা করিলেই তিনি যাহা খুশী তাহাই করিতে পারেন। এ হেন স্বাধীন সৃষ্টি মানুষ কি করিয়া আশা করিতে পারে? কাজেই মানুষের স্বাধীন সৃষ্টির কোনো অর্থই হইতে পারে না। তাহাকে কোনো না কোনো নিয়মের অধীন হইয়া সৃষ্টি করিতেই হইবে। অতএব স্বাধীন সৃষ্টির নামে নীতি ও মঙ্গলকে দূরে ঠেলিয়া ফেলা তাহার পক্ষে নিতান্তই ধোকাবাজী।

তবে এখানে এইটুকু বলিতে পারি যে, “সদা সত্য কথা বলিবে”, চুরি করা বড় পাপ” ইত্যাদি ধরনের নীতিবাক্যই যে বাছিয়া আর্টে ফুটাইয়া তুলিতে হইবে তাহা নহে। আর্টিস্টের নীতি-শাস্ত্র একটু স্বতন্ত্র ধরনের। নীতি-শাস্ত্রের গণ্ডীর মধ্যে রাখিয়াও তাহাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া যাইতে পারে। পদে পদে পথ-নির্দেশ করিতে গেলে তাহার সৃষ্ট ব্যাহত হয় বটে, কিন্তু এমনও তো হইতে পারে যে, একটা ব্যাপক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়াও সে স্বাধীনভাবে বিচরণ করিতে পারে। স্বভাবের সৃষ্টিতেও তো এমন একটা ব্যাপক বাউন্ডারী লাইন আছে।

এত বিধি-নিষেধ, এত সীমানা-নির্দেশ মোটেই দরকার হয় না — আর্টিস্ট যদি প্রকৃতপক্ষেই খাঁটি আর্টিষ্ট হন। যার মধ্যে প্রতিভা আছে, সত্য সাধনা আছে, অন্তর্দৃষ্টি আছে, হৃদয় যাহার পবিত্র, উদ্দেশ্য যাহার সাধু, সেই আর্টিস্টকে সমস্ত বাধা-বন্ধন হইতে একেবারে মুক্ত করিয়া দিলেও তাহার সৃষ্টি কিছুতেই সৎ ছাড়া অসৎ হইবে না। কুশ্রী জিনিসও তাঁহার তুলিকার যাদুস্পর্শে সৎ ও সুন্দর হইয়া দেখা দিবে। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি বিহীন কোনো লোক আর্টিস্ট সাজিলেই সে কেবলই তর্ক করিবে এবং আইনের ফাঁক খুঁজিয়৷ নিজের প্রবৃত্তিকে সমর্থন করিবার চেষ্টা করিবে। এত তর্ক, এত আলোচনা – এ শুধু তাহাদের জন্য। সাদী, হাফেজ, রুমী, মাইকেল এঞ্জেলো, ব্যাফেল প্রভৃতির জন্য নয়।

উপরে যাহা বলা হইল, আশা করি তাহা দ্বারাই স্পষ্ট বুঝা যাইবে যে, কোনোদিক দিয়াই আর্টের আঙিনা হইতে আমরা নীতি ও মঙ্গলকে গলাধাক্কা দিয়া বাহির করিয়া দিতে পারি না।

আর্ট ও মানব-জীবন

আর্টের চরম সার্থকতা মানুষের আপন জীবন। আর্টের ক্ষেত্র শুধু কাব্য-উপন্যাসই নয়, আর্টের ক্ষেত্র সুবিস্তীর্ণ মানব-জীবন। তুলি দিয়া, রং দিয়া বাইরে কোনো শিল্পবস্তু সৃষ্টি করিলেই আর্ট পূর্ণবিকশিত হয় না; আপন-আপন জীবন-পটে শিল্প রচনা করিতে পারিলে তবেই আর্টের চরম সদ্ব্যবহার করা হয়। ম্যাডোনা, মোনালিসা শিল্প হিসাবে যতো সার্থক-সৃষ্টিই হোক — তাহারা প্রাণহীন নির্জীব। জীবন্ত ম্যাডোনা বা জীবন্ত মোনালিসা বিশ্বধরার স্তরে স্তরে সজ্জিত থাকিলে কি অধিকতর সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক হয় না? কি পুরুষ, কি নারী, পৃথিবীর যাবতীয় মহৎ ও সুন্দর মানব চরিত্রগুলিকে আর্টের আলোকে এইরূপে ব্যাখ্যা করা যায়। বলা যায় প্রত্যেকে তারা আর্টিস্ট এবং প্রত্যেকে তারা নিজের জীবন-শিল্পকে সুন্দর করিয়া রচনা করিয়াছে। জীবনের মাঝে আর্টকে এই ভাবে গ্রহণ করিলে তখন আর “Art for Art’s sake” থাকে না, তখন হয় “Art for Man’s sake”. আর্টের এই প্রয়োগই চরম প্রয়োগ এবং এখানেই তার সার্থকতা।

আর্টের সার্বজনীনতা ও সহজবোধ্যতা

এই স্থানে আর একটি প্রশ্নের মীমাংসা করিতে হইবে। শ্রেষ্ঠ আর্টের নিদর্শন কী? সত্য সুন্দর ও মঙ্গল তিনই না হয় বিদ্যমান রহিল, কিন্তু ইহা সত্ত্বেও এমনও তো হইতে পারে যে, কোনো আর্ট সহজেই লোকের বোধগম্য হইতে পারে, কোনো আর্ট বা নিতান্ত দুর্বোধ্য ও সাধারণের উপভোগের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হইতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোন শ্রেণীর আর্টকে শ্রেষ্ঠ বলা যাইবে? যাহা আপামর সকলেই বুঝিতে পারে তাহাই, না যাহা কতিপয় মুষ্টিমেয় লোককেই কেবল আনন্দ দেয়, তাহাই।

টলষ্টয় বলেন, যাহা সর্বসাধারণেই উপভোগ করিতে পারে, তাহাই শ্রেষ্ঠ আর্ট। আর্টিস্ট যখন কোনো একটা নুতন ভাব আপন প্রাণে উপলব্ধি করিয়া জনসাধারণে তাহা প্রচার করিয়া দিবার উদ্দেশ্যেই তাঁহার আর্ট সৃষ্টি করেন, তখন তাহা যতো সহজে লোকের বোধগম্য হইতে পারে, ততোই সুন্দর বলিয়া মনে করিতে হইবে। লোকে যদি কিছু নাই বুঝিল, তবে সে আর্টের সার্থকতা কোথায়? হজরত ইব্রাহিমের পুত্র-কোরবানি, ইউসুফ- জুলেখার প্রেম-কাহিনী, রাম-লক্ষ্মণ ও সীতার উপাখ্যান প্রভৃতিই টলষ্টয়ের মতে শ্রেষ্ঠ আর্ট, কারণ উহাদের অন্তর্নিহিত ভাবনিশ্চয় সহজেই লোকে গ্রহণ করিতে পারে ।

কিন্তু বর্তমান আর্টবাদী ও সমালোচকবৃন্দ টলষ্টয়ের এই উক্তি হয়তো মানিতে চাহিবেন না। তাঁহারা বলিবেন, ওরূপ ভাবে আর্টের বিচার করিলে নিতান্ত নিম্নস্তরের আর্টকেই শ্রেষ্ঠ আসন দিতে হয়। শিক্ষা, সাধনা বা মাজিত রুচির কোনোই মূল্য থাকে না। পাঁচালি, জারি, গ্রাম্য কবি-গান, বটতলার পুঁথি, রাধাকৃষ্ণের চিত্রাবলী, এই সমস্তকেই তাহা হইলে রুমি, হাফেজ, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির উপরে আসন দিতে হয়।

এই দুই মতের কোনটি সত্য? আমার মনে হয়, দুই দিকেই সত্য নিহিত আছে। টলষ্টয়ের মতকে নির্বিচারে মানিয়া লইলে বাস্তবিকই মুড়ি-মিছরী সব এক দর হইয়া যায়। এ কথা সর্ববাদিসম্মত যে, শিক্ষা সত্যতা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা মানুষের রুচি ও বোধশক্তি উন্নত ও মার্জিত হয়, সাধারণ লোক যাহা বুঝিতে না পারে বা তাহার নিকট যাহা ভালো না লাগে, কোনো শিক্ষিত লোকের নিকট তাহা সহজবোধ্য ও আনন্দদায়ক হইতে পারে। একজন অশিক্ষিত স্থূলরুচিবিশিষ্ট গ্রাম্য লোক একজন সুশিক্ষিত মার্জিত রুচি-সম্পন্ন ভদ্রলোকের সহিত কোনো উন্নত ভাবকে সমভাবে গ্রহণ করিতে পারিবে, এরূপ আশা করা নিতান্তই অসঙ্গত। প্রকৃতির মূল মর্ম শিক্ষিত ও উন্নতমনা ব্যক্তির নিকটেই সমধিক বোধগম্য, কোনো নিরক্ষর অজ্ঞ লোকের নিকট নয়। কাজেই দেখা যাইতেছে, সর্বসাধারণের বোধগম্য কবিয়া আর্ট রচনা করিতে গেলে আনিকে অনেকখানি নীচে নামিয়া আসিতে হয়; উন্নত ও সৌন্দর্যানুভূতিকে আশ্রয় করিয়া আর কোনো আর্ট রচনা সম্ভবপর হয় না।

কিন্তু অন্য দিকেও বলিবার যথেষ্ট আছে। আজকাল এক শ্রেণীর তথাকথিত আর্টিস্টের আবির্ভাব হইয়াছে, তাঁহারা আর্টের নামে তাঁহাদের ভাবকে এমন ঘোরালো-পেঁচালো করিয়া প্রকাশ করা আরম্ভ করিয়াছেন যে, সাধারণ লোকে তো তার মাথামুন্ডু কিছু বুঝিতেই পারে না। মেটারলিঙ্ক ভাবলেন প্রভৃতি ফরাসী কবিগণ হেঁয়ালি সৃষ্টির উদ্দেশ্য লইয়াই কবিতা রচনা করিয়া গিয়াছেন। এখনো অনেক ফরাসী কবির মত এই যে, কবিতায় একটা না একটা কিছু হেঁয়ালি বিদ্যমান থাকা চাই-ই, নতুবা উহা কবিতাই হইবে না। সম্ভবতঃ এই মনোভাব লক্ষ্য করিয়াই টলষ্টয় উপরোক্ত মত ব্যক্ত করিয়াছিলেন। আর্টের নামে ভাবহীন রচনা বা প্রাণহীন দেহ যে উচ্চ মূল্যে বিকাইয়া যাইবে, ইহাও তো ঠিক নয়।

এখন এ সমস্যার সমাধান হইবে কিরূপে? আর্টকে সহজবোধ্য করিতে গেলেও অনেক উন্নত ভাব আর্টে ধরা পড়ে না, আবার উন্নত ভাবের সমাবেশ করিতে গেলেও অনেক স্থলে ভাবহীন হেঁয়ালির সৃষ্টি হইয়া পড়ে। কোন্ পথ অবলম্বনীয়?

আমার মতে দুই-এর কোনোটিকেই একক ভাবে গ্রহণ করা সমীচীন হইবে না। আর্টিস্টকে দুই কুলই রক্ষা করিতে হইবে। মার্জিত রুচি-সম্পন্ন ব্যক্তিদিগের জন্য যেমন উন্নত ভাবের আর্ট চাই, সাধারণের জন্যও সেইরূপ সহজবোধ্য আর্ট চাই। সাধারণের উৎপন্ন দ্রব্যে যেমন কবি, সাহিত্যিক, আর্টিস্ট ও বড় লোকদের অধিকার আছে, সাহিত্যিক ও আর্টিস্টদের উৎপন্ন দ্রব্যেও সাধারণের তেমনই একটা দাবী আছে। এই গণতন্ত্রের যুগে সাহিত্যে ও ললিত কলায় পূর্বের আভিজাত্য রক্ষা করিতে গেলে চলিবে না। সকলেরই ন্যায্য দাবী বুঝিয়া দিতে হইবে। শিল্পীদের শ্রেণী বিভাগের তাই প্রয়োজন আছে।

আর্টের খাতিরে আর্ট

“Art for art’s sake” এই কথাটি প্রায়ই যার-তার মুখে শুনা যায়। আর্টে নীতির প্রশ্ন উঠিলেই অনেক এই একটি কথার দ্বারা নীতিবাদীর মুখ বন্ধ করিয়া দেন। যেন এ কথাটা কেহই জানে না, একমাত্র তিনিই ইহার মর্ম বুঝেন। কিন্তু এত আদরের এই বাঁধা বুলিটার অর্থ যে কি, তাহা যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, তবে অনেকেরই কিন্তু চক্ষুস্থিরর হইযা পড়িবে! “আর্টের খাতিরে আর্ট” এ কথাটা কোথা হইতে আসিল এবং ইহার তাৎপর্যই বা কি? ইহা দ্বারা আনন্দমূলক আর্টবাদী কী যে বুঝেন, বুঝি না! আর্টকে আর্টের মতো করিয়াই সেবা করিতে হইবে, নীতি, ধর্ম, সমাজ বা অন্য কোনো কিছুর সহিত জড়িত করিয়া দেখিতে হইবে না, ইহাই যদি ইহার অর্থ হয়, তবে এ কথার ভিতর নূতনত্ব কী রহিল? আর নূতন যুক্তিই বা এমন কি দেখানো হইল যার জন্য নীতি বা মঙ্গলের প্রবেশ একদম নিষিদ্ধ হইয়া গেল? “খাওয়ার খাতিরে খাও”, “ধর্মের খাতিরে ধর্ম করে৷”, “কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য করো” ইত্যাদি কথার যাহাই অর্থ হউক না কেন, ইহাদের উদ্দেশ্যের কথা তো কিছুতেই ধুইয়া মুছিয়া যায় না। তুমি খাও, কেন খাও? – খাবার খাতিরে খাও। – এর কি কোনো একটা সঙ্গত অর্থ হয়? খাবার খাতিরে যদি খাও, তবে ছাই-ভস্ম গু-গোবর খাও না কেন? তাহা হইলে নিশ্চয়ই বুঝা যাইতেছে, খাবার খাতিরে খাইলেও তোমার অন্তরে একটা কিছু উদ্দেশ্য লুক্কায়িত আছে। সেই উদ্দেশ্য সাধন করিবার পক্ষে যেসব জিনিস উপযোগী, তাহাই তুমি খাও, আর যেগুলি উপযোগী নয়, তাহা খাও না। সেইরূপ “কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য” করিলেও তার একটা উদ্দেশ্য তো থাকিবেই। আর কিছু না থাকুক, অন্ততঃ কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য করিতে প্রবৃত্ত হওয়ার যে আনন্দ, তার উপভোগটুকুও তো একটা উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য বিহীন কোনো কাজ জগতে আছে কি? বাতুল যাহারা, একমাত্র তাদের কাজই উদ্দেশ্যবিহীন। কাজেই উদ্দেশ্য যদি থাকিল, তবে তাহার উপর বিচারও চলিবে।

বস্তুতঃ ইহা একটা যুক্তিও নয়, নূতন তথ্যও নয়। সংসারের সমস্ত সম্বন্ধ হইতে মুক্ত হইয়া কেহই কোনো কাজ করিতে পারে না। পরিপার্শ্বের সহিত যোগ-সম্বন্ধ ভাবেই আমাদিগকে সমস্ত করিতে হয়। আর্টকেও আমরা কোনো মতে তার পরিপার্শ্ব হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিতে পারি না। “লাট সাহেবের বাড়ী” অঙ্কিত করিয়া দেখাইতে হইলেও পরিপ্রেক্ষণার ভিত্তিতে (perspective view) আনিয়া উহাকে অঙ্কিত করিতে হইবে। অর্থাৎ উহা যে কোথায় অবস্থান করিতেছে, উহার চতুষ্পার্শ্বে গাছ-পালা, বাড়ী-ঘর, রাস্তা-ঘাট কোথায় কি আছে, তাহা দেখাইতে হইবে, নতুবা কিছুই বুঝা যাইবে না! কাজেই দেখা যাইতেছে আর্টকে উহার পরিবেশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া সেবা করিবার উপায় নাই। সেরূপ করাও যা, মাছকে পানি হইতে পৃথক করিয়া দেখাও তাই। “আর্টের খাতিরে আর্ট” চর্চা করিতে গেলে আর্টের মৃত্যু অনিবার্য।

এই মারাত্মক কথাটি কোথা হইতে আমদানী হইল, তাহার সন্ধান করিতে গেলে আমাদের দাসমনোভাবই মূর্ত হইয়া ধরা দিবে। পশ্চিম হইতে আমদানি করা এই কথাটি কিরূপ নির্বিচারেই না আমরা গ্রহণ করিয়াছি। অর্থ জানি না, তাৎপর্য বুঝি না, কবে কোথায় কিরূপ অর্থে কে ইহা প্রথম বলিয়াছিল তাহার খবর রাখিনা, অথচ হরদম বলিয়া চলি, “Art for art’s sake”! “Art for art’s sake”!

কথাটার উৎপত্তি কোথা হইতে হইল, তাহা অনেক অনুসন্ধান করিয়াও নিশ্চিতরূপে স্থির করিতে পারি নাই। সম্ভবতঃ জার্মান দেশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে August Wilhelm Schlegel নামক এক ব্যক্তি এই মতবাদ প্রথম প্রচার করেন। যে যুগে এই কথা প্রচার করা হইয়াছিল, জার্মানির পক্ষে সে যুগ বিশ্লেষণের যুগ। সমস্ত জিনিসকে তন্ন তন্ন করিয়া বিশ্লেষণ করিয়া দেখাই সে যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল। তা ছাড়া ধর্ম ও নীতির বন্ধনও তখন শিখিল হইয়া পড়িয়াছিল। কাজেই আর্টকে কোনো লোক হয়তো বিশ্লেষণের দৃষ্টিতেও দেখিয়া থাকিবে। অথবা নীতিধর্মবর্জিত আনন্দ-মূলক আর্টবাদ (Aesthetic hedonism) হইতেই এই কথার উদ্ভব হইয়া থাকিবে। ইহা ছাড়া ইহার অন্য কোনো ব্যাখ্যা নাই।

পরবর্তী কালে Whistler নামক জনৈক আমেরিকান আর্টিস্ট ‘Art for art’s sake’–এই নীতি খুব জোরে-শোরে প্রচার করিতে আরম্ভ করেন। কিন্তু তিনি কিরূপ প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাহা একটু জানিলেই তাঁহার মতের কতোখানি মূল্য তাহা বুঝা যাইবে। তিনি ছিলেন একজন মাথা-পাগলা লোক। অর্টিস্ট যাহাই ভালো বুঝিবে তাহাই করিবে এবং সাধারণ লোক ও সমালোচকদিগের আর্ট বুঝিবার কোনো ক্ষমতা নাই ইহাই ছিল তাঁহার ধারণা। ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে তিনি বিখ্যাত ইংরাজ আর্ট-সমালোচক রাস্কিনের বিরুদ্ধে এক মানহানির মোকদ্দমা দায়ের করেন, কারণ তিনি তাঁহার চিত্রাবলীকে “এক কৌটা রং সাধারণের মুখের উপর ছুড়িয়া ফেলা হইয়াছে” (a pot of paint flung on public face), এই বলিয়া সমালোচনা করিয়াছিলেন। বিচারে তিনি রাস্কিনের বিরুদ্ধে এক ফাদ্দিং ক্ষতিপূরণ পাইয়াছিলেন। (Vide Encyclopaedia Britannica)

Whistler-এর দেখাদেখি ইংরাজ-লেখক Oscar Wilde-ও “Art for art’s sake” নীতি অনুসরণ করিয়া জীবন যাপন করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন। তিনিও অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি তাঁহার গৃহ ময়ূরপুচ্ছ, লিলি ফুল প্রভৃতি দিয়া সাজাইয়া রাখিতেন এবং উহাদের মতো করিয়া জীবন যাপন করিতে প্রয়াস পাইতেন।

এইরূপ ধরনের লেখক দ্বারাই “Art for art’s sake” মতবাদ উদ্ভূত হইয়াছিল। উহারই ঢেউ আসিয়া বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রকে প্লাবিত করিয়াছে।

আর্টের ভবিষ্যৎ

আর্টের এই বিকৃত রূপ বেশীদিন থাকিবে বলিয়া মনে হয় না। ইহার প্রতিক্রিয়া অনিবার্য। যৌন আবেদন লইয়া আর্ট রচনা করিলে সে আর কতোদিন মানুষের তৃপ্তিসাধন করিতে পারিবে? উহা একঘেঁয়ে না হইয়াই পারিবে না। নব নব ভাব (fresh feeling) না দিতে পারিলে সে আর্ট মানুষকে বেশী দিন আনন্দ দান করিতে পারে না। তা ছাড়া মানুষ তাহার জীবনে শুধু যৌন সম্বন্ধকেই বড় করিয়া দেখে নাই। যৌন সম্বন্ধ ছাড়া তাহার আরও মহত্তর উদ্দেশ্য আছে। তাই শুধু যৌন ক্ষুধার খোরাক দ্বারা তাহার আত্মা বাঁচিতে পারে না, আরও কোনো উন্নত খোরাক তাহার চাই। আর্টের মধ্য দিয়া সেই খোরাক তাহাকে দিতে হইবে। আর্টে ভালো-মন্দ — দুইই যুগে যুগে ছিল, আছে এবং থাকিবে। আলোকের পাশে যেমন অন্ধকার আছে, সত্যের পাশে যেমন মিথ্যা আছে, সৎ আর্টের পাশে তেমনই অসৎ আর্টও থাকিবে। দেহ যতোদিন আছে, দেহের ক্ষুধাও ততোদিন থাকিবে। ইহা প্রকৃতিরই নিয়ম। এ নিয়ম হাজার চেঁচামেচি করিয়াও কেহ খন্ডন করিতে পারিবে না। সুতরাং কোন্ আর্ট থাকা উচিত আর কোন্ আর্ট থাকা উচিত নয়, তাহার আমাদের প্রশ্ন নয়; আমাদের প্রশ্ন হইতেছে—কোন্ আর্ট আমাদিগের গ্রহণ করা উচিত।

উপসংহার

আর্টের নানা দিক তো আমরা দেখিলাম। এখন আমাদের প্রশ্ন এই — কিরূপ আর্ট আমাদের চাই? তদুত্তরে আমি বলিব – আমাদের আর্ট সঙ্কীর্ণ হইবে না। আমরা সত্য সুন্দর এবং মঙ্গল—তিনজনকেই চাই। যে আর্টে এই তিনেরই অনুরণন থাকিবে, তাহাকেই আমরা শ্রেষ্ঠ আর্ট বলিব। আমাদের মনের ভিতর যখন সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের মৌলিক উপাদান রহিয়াছে, তখন একটাকে ছাড়িয়া একটাকে গ্রহণ করা সঙ্গত হইবে না। সৌন্দর্য এবং আনন্দকে আমরা বয়কট করিতে চাই না; কিন্তু তাহার সহিত সত্য ও কল্যাণকে সঙ্গে করিয়া আনিতে বলি।

খোদাতালার আর্টকে আমরা সম্পূর্ণরূপে অনুকরণ করিতে চাই। তাঁহার আর্টে আমরা যেমন সত্য সুন্দর ও মঙ্গল – তিনেরই সমাবেশ দেখি, আমাদের আর্টেও সেইরূপ সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলকে প্রতিষ্ঠিত দেখিতে চাই। তাঁহার আর্টের প্রতি চাহিয়া থাকিলে কলুষ ভাব না আসিয়া প্রাণে যেমন অব্যক্ত পুলকের সঞ্চার হয়, সসীমের মধ্যে অসীমের অনুভূতি লাভ করি, আমাদের আর্টেও সেই সত্য, সুন্দর ও আনন্দের স্পর্শ আমরা চাই।

মাসিক মোহাম্মদী
১৯২৬

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →