আমি কেন লিখি? – গোলাম মোস্তফা
আমি কেন লিখি?
প্রশ্নটার জবাব দেওয়া কঠিন। সেই ১৯১৩ সালে আমি যখন Class X এ পড়ি—তখন থেকে এ-তক (হিসেব করে দেখুন কতো বছর হবে) লিখেই চলেছি। কিন্তু একদিনের তরেও প্রশ্নটা কেউ তো কোনোদিন করেনি, অথবা নিজেও ভাবিনি যে আমি কেন লিখি। পরিণত বয়সে এই প্রশ্নটা তাই আত্মদর্শনের সুযোগ দিল। জীবনের অতল গহনে তলিয়ে গিয়ে আজ এ প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে হবে ।
একজন বিখ্যাত লেখককে এই প্রশ্নটাই করা হয়েছিল। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন: “I write for myself” (অর্থাৎ আমি আমার নিজের জন্যই লিখি।) কথাগুলির মধ্যে গভীর সত্য নিহিত রয়েছে। আমারও এই উত্তর — আমি আমার নিজের জন্য লিখি। সমাজ বা পাঠক আমার লেখা থেকে কতোটুকু আনন্দ পাবেন বা উপকৃত হবেন সে কথা ভেবে লিখি না, না লিখে থাকতে পারি না তাই লিখি। লেখার ভিতরে একটা সৃষ্টির উল্লাস আছে এবং আত্ম-প্রকাশের তাকিদ আছে। লিখলে আমি আনন্দ পাই এবং আমার কল্যাণ হয় — এইটেই হলো আমার লেখার মূল প্রেরণা। দেহের ক্ষুধার জন্য যেমন খাই, আত্মার ক্ষুধার ও বিলাসের জন তেমনি লিখি। কোনো কিছু লেখার পূর্বে আমি যা থাকি, লেখার পরে আমি তার চেয়ে উন্নততর হই, অধিকরত জ্ঞানী হই; সমুখের পানে, অজানার সন্ধানে এক কদম এগিয়ে যাই। লেখার আগে আমার দৃষ্টিতে আমার ধ্যান-ধারণায় যা অস্পষ্ট থাকে, লেখার পরে তা মার্জিত ও পরিচ্ছন্ন হয়। কোথা হতে যেন একটা নূতন আলো এসে আমার অন্তলোককে উদ্ভাসিত করে দিয়ে যায়। আমার সব লেখাই তাই আত্মকেন্দ্রিক। আমাকে কেন্দ্র করেই নানা শাখা-প্রশাখায় আমার লেখা পল্লবিত হয়ে আছে। অন্য কথায়, আমিই নানা ছন্দে নানা গানে বিকশিত হই। আমার আত্মা- আমার খুদাই হলো তাই আমার লেখার উৎস-মূল। আমার লেখার উদ্দেশ্য তাই যতোটা না সত্য প্রকাশ, ততোটা আত্ম-প্রকাশ। আমার লেখার তাই আমি প্রকাশিত হবো, নানা বৈচিত্র্য নানা রসে নানা ছন্দে নানা আমি স্পন্দিত হবো, নিখিল মনে আমাকে নিয়ে জাগবে বিস্ময়, জাগবে কৌতূহল, জাগবে নব নব জিজ্ঞাসা – এই বিপুল আরচেতনা ও অহমিকা থেকেই আমার সব লেখা উৎসারিত হয়।
দেহের প্রয়োজনে ভাত খাই, আত্মার প্রয়োজনে লিখি । নিজের জন্য প্রত্যেকেই লেখে। বড় বড় কবি-দার্শনিকরা নিজেকেই তো প্রকাশ করে গেছেন। শিল্প-সাহিত্যে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মূল্যই বেশি। বিশ্বমনের সমীকরণের মধ্যে কোনো চমৎকারিত্ব নাই। ব্যক্তিগতভাবে কে কেমন করে জীবন ও জগতকে দেখেছেন, সেইটে জানাই বড় কথা। কবি হাফিজের মনে কী রং লেগেছিল, চোখে কী স্বপ্ন নেমেছিল, মিলন ও বিরহকে কিভাবে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সেই কথা জানতেই তো আনল। তাঁর ‘দিওয়ান’ তো সেই জন্যই আমাদের ভালো লাগে। শেখ সাদী, ওমর খৈয়াম, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল প্রত্যেকের বেলাই এ-কথা খাটে। বস্তুতঃ বিশ্বসাহিত্য কেউ জোর করে লিখতে পারেনা। আত্ম-সাহিত্যই সত্য হলে বিশ্বসাহিত্যে রূপান্তরিত হয়।
কথাটা নিতান্ত স্বার্থপরের মতোই শোনাচ্ছে, না? কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যতো খারাপ মনে হচ্ছে ততো নয়।
মানুষ সামাজিক জীব। তার দুটো জীবন: ব্যক্তি-জীবন আর সমাজ-জীবন। ঘরের কোণে তাকে যখন দেখি, তখন মনে হয় যে একা; কিন্তু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যাবে বিশ্ব-মানুষেরই সে একজন। কবির জীবন তাই ব্যক্তি জীবনও বটে, সমষ্টি-জীবনও বটে। আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া চাই, আমাদের ভিতরকার ঘুমিয়ে থাকা সেই বৃহত্তর সত্তাকে জাগিয়ে দেওয়া। কবি-সাহিত্যিকেরা ব্যক্তিকে অতিক্রম করে সমষ্টির মধ্যে পরিব্যপ্তি হন। সমগ্র মানব-সমাজ তার মধ্য দিবে কথা কয়, তার চোখ দিয়ে দেখে, তার মন দিয়ে ভাবে। অন্য কথায় কবি শিল্পীরা সমাজ-মনের প্রতিনিধিত্ব করে। এক কবির লেখা পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আনন্দ পায়, তার অর্থ কি? তার অর্থ হলো: কবির কাব্যে নিখিল মনের ছায়া পড়ে নিখিলের স্বপ্ন তাঁর চোখে ঘনিয়ে আসে।
কবি-সাহিত্যিকেরা যে নিজের লেখা জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করে, তার উদ্দেশ্য শুধু চিত্ত-বিনোদন বা প্রসংশা অর্জন নয়। মানুশ যে-কোনো মূল্যবান সম্পদ তার কোনো নিরাপদ স্থানে সঞ্চয় করে রাখতে চায়। কবি যে-সম্পদ তার মানস-গহন থেকে উদ্ধার করে আনে, তা সে রাখবে কোথায়? নিজের মধ্যে ধরে রাখা সে নিরাপদ মনে করে না। জীবন শেষ হলে তার সম্পদও নিশ্চিষ্ট হয়ে যাবে। তাই সে খোঁজে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কোনো স্থান বা স্থায়ী আশ্রয়। সেই আশ্রয় হচ্ছে মানব-সমাজ। তার লেখা জনসাধারণে প্রকাশ করে তাই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
লেখকের সঙ্গে তাই সমাজের নিবিড় সম্বন্ধ আছে। সমাজের কথা তাকে ভাবতে হয়। লেখকের ভাব ও চিন্তাধারা যদি সমাজ-মনে সংক্রমিত না হয়, নিখিল বিশ্বে তার ঠাঁই না মেলে, তবে সেও মরে যায়, তার সৃষ্টিও মরে যায়। এই জন্যই তাকে সমাজ-সচেতন হতে হয়।
আমার লেখায় এই নীতিই আমি অনুসরণ করি। ব্যক্তি-সত্তাকে বর্জন করিনা, সমাজসত্তাকেও অস্বীকার করিনা। ব্যক্তিসত্তাকে ভালোবাসি বলেই সমাজসত্তাকে ভালোবাসি। কারণ সমাজ-চেতনা আত্ম-চেতনারই ব্যাপক রূপ।
এলান, ১৯৫৩
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫ - মার্চ 17, 2024
- বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক - ফেব্রুয়ারি 26, 2024
- ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুৎমার্গের কোন স্থান নেই – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ - ফেব্রুয়ারি 21, 2024