দা ডেথ অফ দা মথ – ভার্জিনিয়া উলফ
যে মথগুলা দিনের বেলা উড়ে ওইগুলারে মথ বলা ঠিক উচিত হবে না। আমরা পর্দার ছায়াতে হাল্কা হলুদ পাখাওয়ালা মথগুলারে দেইখা আন্ধার শরতের রাত বা আইভির ফুলের কথা মনে করি, কিন্তু এই মথগুলা আমাদের সেই সেইম ফিলিংস দেয় না। এরা হাইব্রিড- না প্রজাপতির মত চিয়ারফুল, না নিজেদের জাতের মত ডার্ক। যাইহোক, সামনে যেই খড় কালারের পাখা আর লম্বা লেজওয়ালা পোকাটা দেখতেছি, তারে দেইখা মনে হইতেছে সে জীবন নিয়া খুশি। সকালটা খুবই সুন্দর- সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, হাল্কা গরম পড়ছে, তাও সামারের মাসগুলার চাইতে একটু শান্তির। জানালার অপজিটে অলরেডি লাঙল দিয়া জমিতে টান দেয়া শুরু হইছে। যেখানে যেখানে লাঙ্গলের দাগ পড়ছে, মাটি একদম সমান হয়া ভেজা অবস্থায় চকচক করতেছে। এমন সিন দেখে বইয়ের উপর চোখ রাখতে পারতেছিলাম না। কাকগুলাও তাদের রিচুয়াল মত গাছের উপর এমনে উড়তেছিল যেন কেউ আকাশে হাজার হাজার কালো গিটওয়ালা জাল ছুঁইড়া মারছে। এই জাল কিছুক্ষণ পর গাছের উপর নাইমা আসে, তখন দেইখা মনে হইতে পারে গাছের প্রত্যেকটা ডালে একটা কইরা কালো গিট্টু লাইগা আছে। আবারো এই জালরে আকাশে আরো বড় কইরা ছুড়া হবে, কাকগুলা সাথে জোরে চিল্লাবেও, যেন এই আকাশে ভাসা আর গাছে নাইমা আসা বিরাট এক্সাইটিং কোন এক্সপিরিয়েন্স।
এই কাক, লাঙ্গলটানা মানুষ, ঘোড়া, এমনকি মাঠের এই কালারফুল এনার্জিতে মথ পোকাটা আমার জানালার এক পাশ থেকে অন্য পাশ উড়াউড়ি করতেছিল। তারে না দেইখাও পারতেছিলাম না। একটা অদ্ভুত ধরণের করুণা ফিল হইতেছিল। ওই সকালে এঞ্জয় করার মত কত কিছু ছিল! কিন্তু দুনিয়ার এইসব এঞ্জয়মেন্টে একটা দিনের বেলায় উইড়া বেড়ানো মথ তার লাইফটা কাটায়ে দিছে একটা মথের যা করতে হয় তা দিয়া। তার কপাল তো এরকমই টাফ। সে এইরকম ছোট্ট, লিমিটেড সময়ের একটা লাইফ নিয়া এত যে জানপ্রাণ দিয়া লাইফরে এঞ্জয় করার চেষ্টা করতেছে, এই ব্যাপারটা খুবই প্যাথেটিক। জানালার একটা কম্পার্টমেন্টে সে খুব জোশ নিয়া উইড়া আসলো। তারপর এক সেকেন্ড অপেক্ষা কইরা উইড়া অন্য কম্পার্টমেন্টে গেলো। খালি বাকি থাকলো থার্ড আর ফোর্থ কর্নারে উড়া। সে এইটুকুই করতে পারত। যদিও বাইরে টিলা আছে, বিশাল বড় আকাশ আছে, দূরের বাসাবসতি আছে, আর সাগরে ঘুইড়া বেড়ানো স্টিমারের রোমান্টিক ডাক আছে- সে এই এক জানালার কম্পার্টমেন্টেই উড়াউড়ি করতে পারত। আর সে যা পারত, তাই করছে। তারে দেইখা মনে হইতেছিল যে পুরা দুনিয়ার এনার্জির একটা সুতার মত অংশ সে তার ছোট্ট নাজুক শরীরে ক্যারি করে। যতবারই সে এক পাল্লা থেকে আরেক পাল্লায় যাইতেছিল, আমি কল্পনায় দেখতেছিলাম তার সাথে এনার্জির সেই অংশটা চিকন আলোর সুতার মত দেখা যাইতেছে। দুনিয়ার বাকিসবের কাছে সে বা তার শরীর ছিল খুবই ছোট, বলতে গেলে কিছুই না, তারপরও তার মধ্যে লাইফ এনার্জি দেখা যাইতেছিল।
এত ছোট একটা পোকা, এত সিম্পল একটা এনার্জি ফর্ম নিয়া খোলা জানালায় ঘুরপাক খাইতেছিল, আমার মত মানুষের মনের আনাচেকানাচে, চিপাচুপায় ঢুকে পড়ছিল। ব্যাপারটা একসাথে প্যাথেটিক আবার সেরা। যেন কেউ পিওর লাইফের একটা ছোট্ট পুতির মত অংশ নিয়া ঐটারে পালক দিয়া হাল্কাভাবে সাজাইছে, আর আমাদেরকে লাইফের আসল নেচার দেখানোর জন্য ওইটারে এদিক ওদিক উড়তে আর নাচতে পাঠাইছে। মথের এই এনার্জি দেইখা অদ্ভুত লাগছে। যখন লাইফ প্যারা দিয়া রীতিমত পিষতে থাকে তখন তো লাইফরে ভুইলা যাওয়াটা স্বাভাবিক। যদি এই পোকাটা অন্য শেপে পয়দা হইত, কত কী করতে পারত – এমন চিন্তাভাবনা থেকে যে কেউই তার সিম্পল কাজকামরে একরকম করুণা দিয়া দেখত।
মেইবি নাচতে নাচতে টায়ার্ড হয়া সে কিছুক্ষণ পরে সূর্যের আলোতে জানালার ধারে বসলো। নাচানাচি থাইমা গেছে দেইখা আমিও তার ব্যাপারটা ভুইলা গেছিলাম। বই পড়তে পড়তে হঠাৎ কইরা আমার চোখ তার দিকে গেছে। সে আবার নাচার চেষ্টা করতেছিল। কিন্তু এইবার সে এমন শক্ত আর অকওয়ার্ড হয়া ছিল যে কেবল জানালার নিচেই ভাসতে পারতেছিল। ওইটা পার করতে গিয়াও পারলো না। আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা ছিল। আমি অত ডিপলি না ভাইবা তার এই চেষ্টাগুলা দেখতেছিলাম, আনকনশাসভাবে অপেক্ষা করতেছিলাম কখন সে আবার উড়বে। একটা মেশিন যেমন হুট কইরা বন্ধ হয়া গেলে কেন বন্ধ হইছে, ওইটা বের না কইরা একজন ওইটা একা একাই সারার অপেক্ষা করতে থাকে, পোকাটারেও আমি তেমন একটা মেশিনের মতই দেখতেছিলাম। মনে হয় সাতবার চেষ্টা করার পরে সে পাখা ঝাপ্টাইতে ঝাপ্টাইতেই জানালার কিনারা থেকে পইড়া গেলো। তার এই হেল্পলেস অবস্থা আমার মনোযোগ কাইড়া নিলো। বুঝতে পারলাম সে বিপদে পড়ছে, নিজে থেকে উঠতে পারতেছে না। তার পাগুলা বেহুদা স্ট্রাগল করতেছিল। আমি তারে উঠানোর জন্য একটা পেন্সিল বাড়াইতে গেছিলাম। এইসময় খেয়াল হইলো যে এই ফেইলিওর, এই অকওয়ার্ডনেসটা মইরা যাওয়ার শুরুওয়াত। পেন্সিলটা তাও বাড়াইলাম।
পাগুলা আবার নইড়াচইড়া উঠলো। কোন শত্রুর এগেইনস্টে সে এমনে স্ট্রাগল করতেছে? দরজার বাইরে তাকালাম। কী হইছে সেইখানে? দুপুর হয়া গেছিল, খেতের কাজ শেষ হয়া গেছিল। আগে যেখানে কাজ চলতেছিল সেইখানে এখন একদম একটা আওয়াজও নাই। পাখিগুলা নদীর দিকে খাইতে গেছিল। ঘোড়াগুলা দাঁড়ায়া ছিল। কিন্তু সেই এনার্জি একই ছিল, বাইরে ইনডিফারেন্ট, কেয়ারলেস হয়ে, কোনকিছুর উপর ফোকাস না কইরা। কোনভাবে এই লাইফ এনার্জিটা খড় কালারের ছোট মথটার সাপোর্টে ছিল না। সে কিছুই করতে পারতেছিল না। আমি তাকায়া তাকায়া দেখতেছিলাম কেমনে তার ছোট পাগুলা বাঁচার জন্য লইড়া যাইতেছিল। কিন্তু মরণ এমন, চাইলে পুরা শহররে শেষ কইরা দিতে পারে। কোনকিছুই মরণের উপরে না, কোনকিছুরই মরণের সাথে জিততে পারে না। টায়ার্ড হয়া কিছুক্ষণ থাইমা থাকার পর মথটার পাগুলা আবার নড়তেছিল। এই লাস্ট প্রোটেস্টটা সেরা ছিল, আর সে এত ডেস্পারেট ছিল যে শেষমেশ উঠতে পারছিল। অবশ্যই আমি চাইছিলাম পোকাটা বাঁচুক। মথটা তার সেই লাইফের জন্য বিরাট একটা ফাইট দিছে, যেই লাইফ আর কেউ অ্যাপ্রিশিয়েট করে না, বা থাকলো কি না থাকলো কেয়ার করে না। যদিও কেউ জানবে না বা পাত্তা দিবে না, এই ফাইট দেইখা আমার কেমন জানি লাগতেছিল। আবার কোনভাবে আমি তার মধ্যে লাইফ দেখলাম, পিওর একটা পুতির মত। আবারো পেন্সিলটা উঠাইলাম। কিন্তু পেন্সিলটা উঠানোর পরপরই তার মধ্যে মরণের নিশানগুলা দেখলাম। পোকাটা তার গা রিল্যাক্স কইরা সাথে সাথেই ছাইড়া দিলো। এতক্ষণের স্ট্রাগল শেষ হয়া গেল। ছোট্ট আনইম্পর্ট্যান্ট পোকাটা মইরা গেল। মরা পোকাটার দিকে তাকাইলাম, মরণের মত বিরাট ফোর্স এমন “ভয়াবহ” ভিলেন একটা পোকার এগেইন্সটে জিইতা গেল – এই বিষয়টা আমারে ভাবাইলো। কিছুক্ষণ আগে যেমনে লাইফ আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছিল, এখন ডেথও তেমন অদ্ভুত লাগতেছে। একটু আগেও ফড়ফড় করা মথটা এখন শান্ত হয়া শুইয়া আছে। সে যেন বলতে চাইতেছে, “হ্যাঁ, ডেথ আমার চেয়ে অনেক পাওয়ারফুল।”
(১৯২৭ এর কাছাকাছি সময়ে লেখা)
রপকথা নাওয়ার
Latest posts by রপকথা নাওয়ার (see all)
- নারী আর ফিকশন – ভার্জিনিয়া উলফ - অক্টোবর 8, 2023
- দা ডেথ অফ দা মথ – ভার্জিনিয়া উলফ - আগস্ট 21, 2023
- একটা নভেলে যদি লিটেরারি ট্রুথ থাকে ওইটার আর কিছু লাগে না – এলেনা ফেরান্তে - মে 4, 2023