কবিতার বই থেকে কবিতা: দুই আনা সফর
কলাপাতার মতন লম্বা সকালে
~
একটা গান ছাড়া তুমি আর কী পারো দিতে?
একটা গান—
যেখানে ইতস্তত চুমুরা
সুরভিত মনে একজিমা ছড়ায় আমাদের গালে..
দিনগুলা এমন খুদকুড়ার মতন যে—
আমাদের মোতায়েজ করেই চলা লাগে রুটিনভর।
তুফানে বাবুই পাখির বাসার মতন
দুলতে থাকা মনে
সিলসিলা ছাড়াই
একটার পর একটা পাতা তখনও
উড়ে যাইতে থাকে তোমার টানে।
যদিও একটা বন্ধ সিমেই
যেন বারবার কল দিতেছি আমরা—
যেন একটা নারকেল গাছ
চোখের পানি বুকে নিয়ে দাঁড়ায়ে আছে—
চুলায় পাতিল চড়ায়ে দিনের পর দিন
যারা রানতেছে ক্ষুধা, তাদের—
চড়ুইয়ের ঝাঁকের ভিতর যে কথা হারায়ে গেছে
সে কথা আর বলা হবে না।
তাও লাগে যে, যা কিছু উহ্য ছিল এতদিন
গাছের পাতার মতন উলতে থাকবে একে একে।
কোন বিমর্ষ সকালে অফিসগামি মুখগুলা
দেখতে থাকব কলাপাতার ফাঁকে।
আঞ্চলিকতার মতন ফুরফুরে হাওয়ায়
আগের রাতের নকশা আরো বেশি মনে পড়বে।
কোথাও কোন প্রজাপতি
কিংবা মৌমাছি না থাকলেও
ঘন জঙ্গলের সবুজমায়ায়
কেবল একগুচ্ছ ফুল
সাদা রঙের শুচিতা মেখে
দুলতে থাকবে হাওয়ায়।
কোথাও বাসি তেলে ভাজা হবে পরোটা,
নুডলসের বাটিতে ঝিমাবে মাছি।
হঠাৎ মৃত্যুর খবরে ভাত পড়ে যাবে
বেসিনে—কাটা কাটা সবজির মতন
টুকরা কথারা সিদ্ধ হবে ভাঁপে!
শোকের বাতাসে
এমন—মৌ মৌ ঘ্রাণে
সরিষার তেলে উপচানো ফেনার মতন
তোমার সকালের ঘুম আরো উম পেলে
মাছের কাঁটার মতন বজায় রাখব দরকারি দূরত্ব।
আর কলাপাতার মতন এমন লম্বা সকাল
জানলা ধরে বসে থাকতে থাকতেই হয়ত শেষ করে ফেলব আমি। বিষ্টি পড়তে পড়তে হয়ত
রুটির হিসাবের ভিতরেই বদলে যাবে পরিচয়।
যেখানেই যাই মাছিদের উৎপাত আমাকে স্মরণ করাবে গলিত স্মৃতিগন্ধার কথা।
কোন ফুলের পতন কিংবা রঙ
এতটাই বিষণ্ন করবে আমাকে
হয়ত লিখতে পারব মনে ধরার মতন একটা কবিতা।
নিজের খুশিটুকু কবিতায় ফুটাতে চাইব! অথচ লিপিস্টিকমাখা ঠোঁটের মতন
অপরিচিত লাগার ভয়ে
এইসব খুশিও শাড়ির কুচিতে লুকায়ে হাঁটব— কল্পনায়
ঘুম ঘুম চোখে যেন কবিতারা ঘুমায়ে থাকবে আমার কোলে।
কলাপাতায় বিষ্টি পড়ার মতন মায়া নিয়ে—সারাদিন এমন এম্বুল্যান্সের শব্দ শুনব
যেন আসমান চোখে কানতেছে কোন ভাইহারা বোন…
নাম
~
গাছ আর গাছের নাম
পাশাপাশি রেখেই
মনে হয়, লিখে ফেলি নতুন কবিতা—
একটা জঙ্গলে যেমন
পাখিরা আসে, গাইতে
তুমিও আইসো, টানে;
গাছের নাম না জানলে—তাও
কিংবা না বুঝলেও কবিতার মানে।
শ্যাওলা রঙের বাড়ি
~
কতদিন পর
তুমি কল দিতেই বিষ্টি পড়া শুরু হলো যেন।
কবিতা পড়ার মতন মোহে
আমি শুনতেছিলাম, কথা না কম্পন—
অবিরাম, রুমঝুম, ঝুমঝুম…
একই ঘটনা আগেও একবার—এমন সন্দেহে—
সেই যে কারেন্ট গেল—
অথচ গাড়ির হেডলাইটে বিষ্টিদের নাচন এত স্মুথ—যেন ইউরোপ।
বিষ্টির পরে বাইরে এত শিহরণ
বয়োঃসন্ধির কথা মনে পড়ে যায়!
তখনো প্রিয়জন হারানো শোক—
একটা শ্যাওলা রঙের বাড়ি যেন, নিশ্চুপ।
চর্চার বাইরে থাকা শব্দের মত
আমিও যদি মনে আর না পড়ি কখনো,
মুছে যাই যদি অজ্ঞাতে—
কিংবা গরম সিঙ্গারা প্লেটে রেখেও যদি না জমে আড্ডা—
সেদিনের কথা ভেবে এখনই এমন
মানবা কেন—
ঝিনুকের মতন ঢাকনা আঁটা?
জিয়ারত
~
মাড়ভাঙা শাড়ির মতন পড়ে আছি।
যেন ভালো আছি বলার মতন সহজ নয়, থাকা।
চাহনি দেখে মনে হয়, দুঃখগুলা যেন শরতের মেঘ—
উড়ে-টুরে-ঘুরে-ফিরে, শুধু ঝরে যাইতে চায়।
প্রেম যেন দড়িতে মেলা কামিজ—উড়ে গেছে ঝড়ে;
সেই কবে—
গেয়ে ওঠা গান থেকে থেকে কানে বাজে তাও।
মনে হয়, আসবা, এমনভাবে হাসবা—
যেন কত কত কথা শুকায়ে আছে ঠোঁটে।
হতে পারে কোন কথাই আর বাকি নাই;
তবু জিয়ারত করা—
পুরনো কোন গাছ ও বিবিধ স্তব্ধতা।
করাতকল
~
তুমি কাছে থাকলে মনে হয়,
মেহগনিবনে পাতা ঝরতেছে!
যেন পাতারা আরো কাছে চায় বলে
এক দুই তিন করে ঝরতেছে সুফি গানের তালে।
কখনো বা
মসজিদের বারান্দায়
নিরালে যেন কোরান পড়তেছি;
ভাবালুতায়
সমস্ত শীতলতা ভর করলে পায়ের পাতায়—
আঙুলে আঙুলে শিশিরে নুয়েপড়া ঘাসের মতন জড়তা নিয়ে
কোথায় যে খুঁজি এমন পথ—
কথা ছিল হাঁটবো,
চোখ বুঁজে সেখানেই—
অথচ যেন খোর্মার দেশে একা ঘুরতেছি মরুচারী;
যেন মাটির পুতুল হয়ে মেলায় বসে আছি;
এত মানুষ চারপাশে—
তবু লাগে যে, বরফের পাহাড়—
আশ্বিনের হাওয়া যেন আমাদের ভিতর
গাইতেছে কীত্তন, কেউ কারোটা শুনি না;
সারারাত করাতকলে কাটতে থাকি মাথা।
রইদের চিকমিকি
~
কথারা কানে বাজে, সুরহীন, ঝিমঝিম
শিশুমন যেরকম আধোবোলে কথাদের গুনগুনায়
দূর থেকে কত কী মনে হয়, আসলে, কিছুই নয়;
এমনই ঘোরে কেটে গেলো দিন—
এতগুলা দিন
একই খাদে
সবই আছে, তবু কিছু নাই, এমনই নিরস—
কী যে চাই বলা হবে না।
গাছেরা ঝিমায়ে পড়ছে
পাতারা ঝরতেছে
পোকারা গুটিশুঁটি নিজের ভিতরে
এখনো আমি কী যে ভাবি, জানতে পারি নি।
সারাদিন মেঘলা, ঝিরঝির এন্টেনা…
কখন যে ঘুমায়ে পড়লাম, ঘুমে আমি আর কারা সারাবেলা শাপলা তুললাম, দাদীর লগে লগে পাতিলও মাজলাম (হা হা)।
ছিলাম তো ব্যাঙাচি, কখন যে ব্যাঙ হয়ে গেছি— পাতিলের তলার মতন ডার্কনেস তবু আমাকে ছাড়ে না।
ইদানীং নিজের দিকেই তাকায়ে থাকি।
নিজেরে একমাত্র আয়নাতেই ভালো লাগে।
আর যখনি দেখি, মনে হয়, আমার কিছু লেখার আছে, যেখানে সাজানো শব্দের চাইতে নিজেকে জানাটা বেশি জরুরী।
হয়ত স্বপ্ন কোন, যেখানে
তোমার বন্ধুরাই আমার সাথে ঘোরে পাহাড়ে, জঙ্গলে,
আর আমি তোমারই গল্প করি, যেকোন চিহ্নে—
যেন কুয়াশার ভিতরে রইদের চিকমিকি দেখে
ঘুমের স্বপ্ন যেমন মুছে যায়, ধীরে
আমিও মেবি মুছে যাইতেছি নিজের ভিতরে…
তোমার উসিলায়
~
নিজেরে যত গুঁজাতে চাই
বয়ঃসন্ধির ব্রণের মতন তবু—
ফুটে ওঠি!
কাওয়ালি গানের মতন সংসার—
আমারে ঘাড়ে করে নাচাইতেছে।
তাল রাখতে গিয়ে
কথারা এত ছোট আর মুখস্ত হয়ে গেছে
ভিতরের বাতাসটুকু ভিতরেই থেকে যায়।
কখনো তোমার উসিলায় জানালা খুললে, ভুলে
নতুন বাতাস আসে—
যেন ভাইয়ের খোঁজে হাঁটার মতন কম্প
লোমে লোমে শব্দের তীব্রতা খোঁজে।
যে শব্দরা খরচ হয় নি এখনো
তাদের তুলে আনতে চাই
কবরের মাটির মতন।
ভিতরে যেন সারাদিন এক আজান
আব্বুর ছায়ার মতন স্থির—
বনের সবুজ হয়ে জাগায়ে রাখে আমার চোখ…
বাদামের খোসা
~
কথা কইতে নিলেই যেন ভীমরুলের কামড়
ফুলে ওঠে সারাগায়ে।
কাঁটা নাই, অথচ কাঁটার ব্যথা নিয়েই
চড়ুইভাতি খেলি।
কথার কারিশমাহীনতায়
কেবল সুরের গুনগুনই আমার কাজে তাল দেয়।
প্রয়োজনের মুখে এতটা বেদরকারী এখন ভাব আর ভঙ্গিমা—
মাঝে মাঝে আত্মীয়দের মুখ দেখা জরুরী;
তার চেয়েও যেন গাছের পিলপিলানো পাতা
একটা টলটলা পুকুর
বা খোলামাঠ—
শীতের দিনে যাবতীয় ব্যথারা জমজম করে বুকে।
আর তখন জখমের পাশে একটা সুঁই খুঁজি। যেমন ফসলি খেতের পাশে নদী।
যদিও
ভুলে গেছি মনে হয়, নিজস্ব ফোঁড় ও ফোঁড়ন—
যেন বাদামের খোসার ভিতরেই থাকে আমাদের দ্বিবীজপত্রী মন…
ফুসকুড়ি
~
সিদ্ধ শীমের মতন এই জ্বরাক্রান্ত শরীর;
যেন লবণমাখা মাছ, ক্রমে
ভ্যাটকাই যাইতেছি;
যেন পরিত্যক্ত ভবন কোন—
খুলে খুলে পড়তেছে পলেস্তারা।
তবুও জরুরী কাজে সে
নাম ধরে ডাকলে লাগে যে,
সারাবাড়ি আমের বউলের ঘ্রাণে মউতি যাইতে পারে!
পর্দা সরায়ে বারান্দায় বসলে
উঠতে পারে কুমড়া ফুলের মতন রইদ!
সন্ধ্যার লালিমা
~
কথারা ভিতরে এমন কাইকুই করতেছে,
কোন্ ফর্মে যে তোমারে পাঠাই!
বোরকার ভিতরে যেন সাজানো কার্ভ—
বুঝলেই হলো, যদি কিছু নাও বুঝাই।
তোমারে দৃশ্যের ভিতর চাই না আটকাতে।
কেবল দেখাতে চাই, কিভাবে সামান্য মাছিও ছড়াতে চায় জীবাণু
আর কিভাবে পোড়া শরীরে জমতে পারে পুঁজ…
আচার খাইতে গিয়েও যদি তোমারে মনে পড়ে,
অনেক দূরে হুদহুদ পাখিরা যেখানে সন্ধ্যা নামায়—
বনে পাতার পরে পাতা যেমন জমতে থাকে
সন্ধ্যার লালিমা যেন লেপ্টে থাকে আমাদের ঠোঁটে।
আমরা চোখ বুঁজে মনকলা খাইতাম, এখনও খাই।
চাষের গরুর মতন আমরা নাইবা থাকলাম একই জোয়াল কাঁধে,
রসুনের কোয়া হয়ে নাইবা থাকলাম গা ঘেঁষে—
থাকলাম, একটা টলটলা পুকুরে যেমন বিচিত্র ঐ আকাশ ভাসে!
সুরের সরলতা
~
একটা নামের সুর ধরে তুমি পিঁপড়ার মতন পিলপিল করে আগায়ে আসতেছো…
যেখানে পাতার পরে পাতা তোমারে বেহুশ করে দিতে পারে।
একটা পরিত্যক্ত ট্রেন আমি—পড়ে আছি জঙলায়।
তুমি চাইলে নানাজাতের ফার্নে জড়ায়ে বরং আরেকটু ন্যাচারাল করতে পারো।
অথচ নিশি রাইতে
সারাগেরাম মাথায় করা ইটবাহী ট্রাকের মতন হয়ে গেলো তোমার অনুপ্রবেশ—
যেন কোড়ানি দিয়ে কোড়াইলা নাইরকল।
খড়খড়ে পাপড়িদের খয়রি রঙে যেন লেপ্টায়ে দিলা কনসেন্টসংক্রান্ত ক্যাচাল;
শুনশান অপারগতার ভিতর
একটা ফল হইতে না পারা ফুলের সৌরভের মতন যেখানে এতকাল কোকড়ায়ে ছিল প্রেম—
অথচ তুমি এমন সরলতা দেখাইলা
যেন তুলতুলে ব্যথায় ফেলে
সাধারণ দুধদাঁতের মতন সরে গেলা মাড়ি থেকে!
বিরামহীনতা
~
তোমার অনীহা কাটা যাবে এমন বটি কী আর আছে!
বটির বক্রতা ছাড়ি সেই কবে ছুরির সহজতা নিছি।
চাই সূতার মিহিনতা হয়ে তোমারে জড়াই
সেলাই হয়ে থাকার কায়দা তালাশ করে গেলাম
তাও ভালো মাথায় কিছু উঁকুন দিতে পারছি
আমার ভিতরে কুটকুটানো আরো কিছু পোকা তোমারে দিতে চাই।
কী এক সান্ত্বনায় পাখিমন
মধুমাসের ফল খেয়ে তুলে রাখি বীজ
যেখানে মাটি পাব ছড়ায়ে দিব।
সব গাছ কাটা হয়ে গেলেও তবু কিছু আগাছার আশা হয়ে
চাই তুমিও থাকো, কাঙ্ক্ষিত, যেমন মৌসুমী বাতাস।
সোনাঝুরি বন
~
ভিজা রেলিংয়ে হাতবুলানো মেয়ে
যেন হাসতে হাসতে ঝরতে থাকা বটকড়ইয়ের ফুল
চোখদুটা হয়ে আছে টলটলা তালপুকুর
জানলার পাশে খালি জমিতে
এত পাখি আসে—
বিষ্টির পরে পোকামাকড়—
এত এত আগাছা—
সবুজ হয়ে গেছে সবটা।
মেঘের ডাকে আম্মা বুঝান,
কান্দন চাপি রাইখো না, মনি
কান্দন আইলে শব্দ করি কাইন্দো!
অথচ
বৃষ্টি নামলো আর আমি গাছের মতন দাঁড়ায়ে থাকলাম।
কেউ কথা শুনে না দেখে
ঘোলাপানিতে মাছ ধরেন আম্মা।
পুরাতন ভয়গুলা তার ভিতরে ডালপালা ছড়ায়।
আম্মার পা ধরে টানতে থাকে অতীত।
আম্মা যে কই কই চলে যান—
কথারা যেন ছিঁড়াবিড়া রুটি!
ঘোলাপানিতে থৈ থৈ আম্মা—
উজাইন্যা কইয়ের মতন খলবলায়ে হাসেন!
আম্মা গান ধরেন।
অল্প তেলে ভাজতে থাকা সরপুঁটি আর
ঝিঁঝিঁর মতন বাজতে থাকা গানে
আমাদের ছেলেবেলা—
যেন সোনাঝুরি বন
যেন মেঘের কোলে মেঘ
মহাবিপদসংকেত—
কী বলব কারে!
আজ আম্মার ছুটি।
কুমকুম
~
তোমার না আসা ঘুমের পাশে
একটা সান্ত্বনা হয়ে পড়ে থাকলাম আমি,
একটা নয়নতারা গাছ হয়ে ফুটাতে থাকলাম ফুল
তোমার না কাটা ঘোরের জঙ্গলে
কোমল বাতাস হয়ে দোল দিলাম,
আঙুলের আগায় লোমে লোমে পেলবতা ছড়ায়ে
দিলাম কৈশোরের কুমকুম
তুমি ঘুমাতে পারলে আমারেও দিও কিছু ঘুম।
ফুল্লরা
Latest posts by ফুল্লরা (see all)
- কবিতার বই থেকে কবিতা: দুই আনা সফর - জুলাই 3, 2024
- মরম আল মাসরী’র কবিতা - মার্চ 12, 2024
- ফোরো ফারোখজাদের কবিতা ২ - অক্টোবর 21, 2023