তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো (পার্ট ওয়ান)
- তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো (পার্ট ওয়ান)
- তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো (পার্ট টু)
- তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো (পার্ট থ্রি)
- তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (পার্ট ফোর)
- তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (লাস্ট পার্ট)
মিশেল ফুকো এবং নোম চমস্কি’র মধ্যে এক ঘণ্টা দশ মিনিটের এই আলাপটা ডাচ টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয় ইংরেজী ১৯৭১ সনে। বাংলায় এই টেক্সটটা অনূদিত হওয়ার পর বই আকারে প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সালে। ছাপাইছিল রোদ প্রকাশনী, রাজশাহী থিকা। অনুবাদকের অনুমতি নিয়া সেই তর্কের বাংলা-অনুবাদ বাছবিচারে কয়েকটা পর্বে আপলোডিত হবে।
১৯৭১ নাগাদ ভাষাতত্ত্বে চমস্কি’র গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলা প্রকাশিত হইছে এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের এগেনেইস্টে অ্যাক্টিভিজমের কারণে উনি আম্রিকার বুদ্ধিজীবিতার জগতে পরিচিত ফিগার তখন আর ফুকো’র ক্ষমতা-কেন্দ্রিক বিশ্লেষণগুলা উনারে তত্ত্বজগতে প্রায় আন-কোশ্চেনেবল একটা অবস্থানে নিয়া গেছে এবং ১৯৬৮’র মুভমেন্টে পাবলিক প্রেজেন্স উনারে এক ধরণের রাজনৈতিক মর্যাদাও দিছিলো। মানে, যখন তর্ক করতে বসছিলেন, তখন উনারা উনাদের ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত দশায় ছিলেন। এইটা ছাড়া উনাদের মধ্যে আর কোন কনর্ভাসেশনও প্রচারিত হয় নাই; যার ফলে, একমাত্র।
মূল টেক্সটের ব্যাকগ্রাউন্ড হিসাবে নোম চমস্কি এবং মিশেল ফুকো’র কাজ সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছেন বাংলা অনুবাদক; সেইখান থেকে চমস্কি’র অংশটা এই পোস্টে দেয়া হইলো।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
তো, এই চমস্কি-পরিচয় এর সাথে চমস্কি-বিচার নিয়াও কয়েকটা কথা প্রচার করা যাইতে পারে।
জনসমাজে নোম চমস্কি মেইনলি দুইটা কারণেই পরিচিত – ভাষা-বিজ্ঞানী এবং পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। ভাষার গঠনের একটা পদ্ধতি হিসাবে সিক্সটিইজে জেনারেটিভ গ্রামারের ধারণা উনার অন্যতম আবিষ্কার; যদিও উনি কইছেন যে এইটা নতুন কিছু না, আধুনিক সেন্সে পাণিনি’র (খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক) সংস্কৃত ব্যাকরণেই এইটা প্রথম দেখা যায়। (পাণিনি আস্তিতদায়া’তে ৩৯৫৯টা সূত্র দিয়া ভাষার গঠনরে ব্যাখ্যা করেন।) এই জেনারেটিভ গ্রামার’রে নাইনটিসে উনি এক্সটেন্ড করছেন মিনিমালিস্ট প্রোগ্রামে, যেইটা একটা ধারণাগত কাঠামো, ব্যাকরণ তত্ত্বরে আরো গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করার। সকল ভাষার পাটাতন এক – এইকথারে তিনি তাত্ত্বিকভাবে মোর বিশ্বাসযোগ্য কইরা তোলছেন। ভাষারে এইভাবে কয়েকটা সূত্র দিয়া ব্যাখ্যা করতে পারার সক্ষমতা একদিয়া ভাষারে অল্টারনেটিভগুলার মধ্যে সীমাবদ্ধ করার সম্ভাবনার মধ্যেও থাকার কথা এবং একস্ট্রিম পর্যায়ে একটামাত্র বৈশ্বিক ভাষা’র কল্পনাতে গিয়া ঠেকতে পারে। কারণ ব্যাপারটা কখনোই একতরফা না; যে, নিয়ম আবিষ্কৃত হইতেছে; বরং ঘটনাগুলা নিয়মের লিমিটগুলা দিয়া কনফাইন্ড হওয়ার মধ্যেও থাকে। এনলাইটমেন্টের ধারণা যেইভাবে ইউরোপরে দায়িত্ব দিছিলো দুনিয়ার অনান্য মানুষদেরকে মানুষ বানানোর, একটা জাস্টিফিকেশন দিছিলো উপনিবেশের; বৈশ্বিক ব্যাকরণের অনুমানও একইভাবে ভাষা-সক্ষমতারেই মানুষ ভাবার পারমিশন দেয়, এক্সক্লুশনরেই জারি রাখে একভাবে।
অন্যদিকে, উনার মিডিয়া বিশ্লেষণ পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিজমেরই একটা অংশ। মনে হইতে পারে পুঁজিবাদ যেন প্রপাগান্ডা’র জোরেই টিইকা আছে। জনগণরে অনায্যতার ঘটনাগুলা খালি ক্লিয়ারলি জানাইতে হবে এবং যেহেতু উনার পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিজম এইটা ধইরাই নেয় যে কি করিতে হইবে সেইটা জনগণের জানা আছে, ফলে পুঁজি’র নিউ এক্সপ্লোরেশনের বিশ্লেষণ সবসময়ই একটা অ-দরকারি পলিটিক্যাল অ্যাক্ট হিসাবে আবিষ্কৃত হইতে থাকে এবং একদিক দিয়া পুঁজিরে সেইফ রাখে।
যা-ই হোক, এইটা কয়েকটা আলাপের সম্ভাবনাই শেষ পর্যন্ত, যা বাংলাভাষায় নোম চমস্কি নিয়া আরো আলাপের সম্ভাবনারে বাড়াইতে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারবে।
__________________________________
ভূমিকার বদলে
নোম চমস্কি এবং মিশেল ফুকো: তাদের তাত্ত্বিক অবস্থান, তর্কের বিষয়বস্তু ও ভাবভাষান্তর প্রশ্নে
এক i
বছর তিনেক আগে ii নোম চমস্কি ও মিশেল ফুকোর এই বিতর্কটি আমার চোখে পড়ে। তখনই প্রবল আগ্রহ নিয়ে পাঠ করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আলোচিত ধারণাগুলোর কাঠিন্যের কারণে আমাকে বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে। প্রথম পাঠের সময়ই মনে হয়েছিল আমাদের সময় ও সমাজ, আমদের জ্ঞানবিদ্যার লক্ষ্য, মানব-অধ্যয়নে ফুকো ও চমস্কির মতো পন্ডিতের অবদান ইত্যাদি বুঝতে বিতর্কটি খুবই সহায়ক। সেকারণে ভাষান্তরের আগ্রহও জেগেছিলো বটে, ক্ষমতায় কুলোয়নি। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বহুবার এর ইংরেজি ভাষ্যটি পাঠ করেছি, বুঝার চেষ্টা করেছি। সেইসাথে চমস্কি ও ফুকোর বিভিন্ন লেখা ও সাক্ষাৎকার পাঠ করে তাদের বক্তব্য বুঝতে চেয়েছি। তারপরও, স্বীকার করতে দোষ নেই, তাদের বেশিভাগ লেখাই এখনও আমার পড়া হয়নি। তবে চমস্কি এবং ফুকোর কাজ নিয়ে অন্যদের বিশ্লেষণমূলক অনেক লেখা পড়েছি। শিক্ষকতাসহ অন্যান্য কাজ এবং অ-কাজের পাশাপাশি নোম চমস্কি ও এডেয়ার্ড এস. হারম্যানের ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনোমি অব দ্য মাস মিডিয়া গ্রন্থটি (২০০৬ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হাবে আশা করি) অনুবাদে ব্যস্ত থাকায়, এবং একইসাথে বিতর্কের বিষবস্তুর গাম্ভীর্য ও বাংলাভাষায় এটি রূপান্তরে নিজের দক্ষতা সম্পর্কে যথেষ্ট আস্থাশীল না-হওয়াই অনুবাদে হাত দিইনি। কিন্তু অবশেষে এবছর ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে দুরন্ত সাহসে, অনেকটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ধারণা সম্বল করে, বিতর্কটি অনুবাদ করতে শুরু করি।
প্রথম খসড়াটি হয়ে যাবার পরে কয়েকজন বন্ধুকে পড়তে দিয়েছিলাম। তাদের পরামর্শ নিয়েছি, সেইসাথে নিজের বিবেচনা যোগ করে বহুবার ঘষেমেজে বিতর্কের বক্তব্য ও ভাষা সহজবোধ্য করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আশঙ্কা কাটেনি। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় চমস্কি ও ফুকো অধ্যয়নের স্বল্পতার করণে এবং বিষয়ের জটিলতা ও আমার অদক্ষতার কারণে পাঠকের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হবে না হয়তো।
অনুবাদ করার সময় প্রথমে ভেবেছিলাম দার্শনিক হিসেবে চমস্কি ও ফুকোকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ক্ষুদ্র একটা ভূমিকা লিখেই কাজ শেষ করবো। কিন্তু পরে ভাবলাম, বিতর্কটি বুঝার জন্য চমস্কি ও ফুকোর সম্পূর্ণ কর্মপরিসর ধরে একটা আলোচনা এর সাথে যুক্ত করা অবশ্যই দরকার। ফলত, যে-শ্রমের বিনিময়ে অনুবাদটি করেছিলাম আবারও সেই পরিমাণ খাটুনি খেটে এই ত্রিশ পৃষ্ঠার ‘ভুমিকা’ নামক লেখাটি তৈরি করতে হলো।
দুই
নোম চমস্কি মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক এ্যক্টিভিস্ট। বিশ্বের জীবিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত অগ্রগণ্য। আধুনিক ভাষাতত্ত্বে বিপ্লব সৃষ্টিকারী ‘জেনারেটিভ গ্রামার’ এর উদ্ভাবক। জেনারেটিভ ভাষাতত্ত্বে তার কাজ আচরণবাদের (বিহেভিয়রিজম অর্থে) দাপট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এবং অবধারণ-বিজ্ঞানসমূহের (cognitive sciences) iii বিকাশের পথ সুগম করে দেয়। ভাষাবিজ্ঞানে বিপুল অবদান ছাড়াও চমস্কি সারাবিশ্বের সচেতন মানুষের কাছে পরিচিত নাম তার সমাজতান্ত্রিক-নৈরাষ্ট্রিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনামুখর অবস্থানের কারণে।
তাকে ভালোবাসতে পারেন বা ঘৃণাও করতে পারেন সেটা আপনার বিবেচনা, কিন্তু বিশ-একুশ শতকের চিন্তাভাবনার জগতে নোম চমস্কির মতো প্রভাব খুব স্বল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবীরই আছে। পশ্চিমা পুঁজিবাদী সমাজের প্রতি চমস্কির তীব্র সমালোচনাকে মূলধারার ইতিহাস যেভাবেই বিচার করুক না কেন ভাষাতত্ত্বে ও অন্যান্য অবধারণ বিজ্ঞানে তার অবদান অমোচনীয়।
চমস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৮ সালে। আট-নয় বছর বয়সে নোম চমস্কির প্রতি শুক্রবার রাত কাটতো হিব্রু সাহিত্য পাঠ করে। ভাষাতত্ত্বের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন তার হিব্রু বিশেষজ্ঞ বাবা উইলিয়াম চমস্কি।
ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়াতে চমস্কি পড়ালেখা করেন দর্শন ও ভাষাতত্ত্ব নিয়ে। ছাত্র অবস্থায়ই হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হার্ভাড জুনিয়র ফেলো’ মনোনীত হয়েছিলেন। এই সময়েই চমস্কি মূলত তার পিএইচডি’র বেশিরভাগ কাজ সম্পন্ন করেন এবং পরে ভাষাবিজ্ঞানী জেলিগ হ্যারিস-এর iv তত্ত্বাবধানে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়াতে থিসিস জমা দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন ১৯৫৫ সালে। তার বিষয় ছিল ‘ট্রান্সফর্মেশনাল এ্যানালাইসিস’। ভাষা সম্পর্কে চমস্কির তত্ত্বের কিছু কিছু ধারণা এই অভিসন্দর্ভটিতে প্রকাশ পায়। ১৯৫৫ সালেই চমস্কি ম্যাসাচুসেটস ইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র (এমআইটি) আধুনিক ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। ১৯৬১ সালে একজন পূর্ণ প্রফেসরের মর্যাদা পান এবং ১৯৬৬ সালে বিদেশী ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে সম্মানসূচক ‘ফেরারি পি.ওয়ার্ড’ পদে নিযুক্ত হন।
ভাষাতত্ত্বে চমস্কির বিপ্লব
মানব অধ্যয়নের শুরু থেকেই দুটো পরস্পরবিরুদ্ধ ধারা সক্রিয় আছে: একদল মনে করেন, প্রত্যক্ষগোচর মানব-আচরণ সূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সামনে এগোতে হবে। অন্যদল মনে করেন এধরনের পর্যবেক্ষণ কেবল তখনই তাৎপর্যময় হয়ে উঠতে পারে যদি তার মাধ্যমে গোপন রহস্যাবৃত্ত ভিত্তিমূলের বিধানগুলো শনাক্ত করা যায়, যা আংশিকভাবে ও মূলত বাঁকাচোরাভাবে প্রত্যক্ষযোগ্য মানব-আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড v ছিলেন দ্বিতীয় দলের লোক, কিন্তু অধিকাংশ মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী প্রথম শ্রেণীর বাসিন্দা।
তবে নোম চমস্কি ব্যতিক্রম, তিনি গোপন বিধান সন্ধানকারীদের দলে। তার মতে, প্রকৃত ভাষা আচরণ বা ভাষা ব্যবহার মানুষের ভাষা-সামর্থ্য (linguistic competence) নামক বিশাল প্রশ্নটির কেবল শীর্ষটুকু তার গভীরে লুকিয়ে আছে হীমশৈল্যের মতো গভীর ও গুরুতর প্রশ্ন। পদ্ধতি হিসেবে কেবল প্রত্যক্ষণযোগ্য ঘটনার মধ্যে গবেষণাকে সীমিত করার বিরুদ্ধে আবস্থান নিয়ে প্রত্যক্ষ ঘটনাকে শুধুই ইঙ্গিত হিসেবে ব্যবহার করে মনের গোপন অন্তঃস্থ বিধানগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করে চমস্কির ভাষাতত্ত্বে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। এছাড়াও, চমস্কি ভাষাবিষয়ে তার অনুসন্ধানলব্ধ ফলাফলকে ব্যবহার করে মানবমনের প্রকৃতি সম্পর্কে আচরণবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদবিরোধী একটা সাধারণ তত্ত্ব পেশ করেন।
থমাস কুহন vi স্ট্রাকচার্স অব সায়েন্টিফিক রেভুল্যুশন vii গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের যে সাধারণ ধরনের কথা বলেছেন চমস্কির আবিষ্কার সেই ছক মেনে চলে: ভাষাতত্ত্বের স্বীকৃত মডেল বা আদিকল্পটিকে (প্যারাডাইম অর্থে) চমস্কি অসংখ্য বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত তুলে ধরে ভুল প্রমাণ করেন এবং এই বিরুদ্ধ-দৃষ্টান্তগুলো একসাথে জড়ো করে অবশেষে তিনি সম্পূর্ণ নতুন একটা মডেল পেশ করেন।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অবস্থায় চমস্কি কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্বের (structural linguistics) পদ্ধতিটিকেই বাক্যপ্রকরণ (syntax) অধ্যয়নে প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি লক্ষ করলেন, ধ্বনিরীতি (phoneme) ও শব্দমূল (শব্দের অর্থপূর্ণ ক্ষুদ্রতম একক বা morpheme) অধ্যয়নের ক্ষেত্রে কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে ভালোভাবে কাজ করলেও বাক্যপ্রকরণ অধ্যয়নে কাজ করে না। প্রতিটি ভাষাতেই একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ধ্বনিরূপ থাকে এবং পরিমাণে ব্যাপক হলেও একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শব্দমূল থাকে। ধ্বনি ও শব্দমূলের একটা তালিকা প্রণয়ন করা তাই সম্ভব; কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে বিকশিত যেকোনো ভাষাতে বাক্যের সংখ্যা বস্তুত অসীম। নতুন বাক্য প্রণয়ন সংখ্যার ওপর কোনোরকম সীমা টানা যায় না এবং প্রতিটি বাক্য তা সে যতো দীর্ঘই হোক না কেন তার চেয়েও দীর্ঘতর বাক্য প্রণয়ন করা সম্ভব। যেকোনো ভাষায় অসীম সংখ্যক বাক্য প্রণয়ন করা যায় – কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্ব এমন প্রস্তাবনা ধারণ করতে পারে না।
তাছাড়া, শ্রেণীকরণের কাঠামোবাদী পদ্ধতিটি একটা বাক্যের অভ্যন্তরীণ সকল সম্পর্ক বা বাক্যগুলোর পরস্পরের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতেও অপারগ। চমস্কি এ-প্রসঙ্গে ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত একটা দৃষ্টান্ত পেশ করেন: ‘John is easy to please’ এবং ‘John is eager to please’ বাক্য দুটো দেখতে এমন যেন দুটো বাক্যের ব্যাকরণগত বিধান অবিকল একই রকমের। দুটো বাক্যই ইংরেজি ভাষার ‘নাউন-কপুলা-এ্যডজেক্টিভ-ইনফিনিটিভ ভার্ব’ পরম্পরার সমন্বয়। কিন্তু বহির্কাঠামোর এই সাদৃশ্য সত্ত্বেও দুটো বাক্যের ব্যাকরণ সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথম বাক্যটিতে উপরিতলের পদবিন্যাস থেকে যদিও স্পষ্ট বোঝা যায় না কিন্তু ‘জন’ বাক্যটিতে সরাসরি ‘তুষ্ট করা’ ক্রিয়ার বিধেয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায়: যে কারো পক্ষে জনকে তুষ্ট করা সহজ। কিন্তু অন্যদিকে দ্বিতীয় বাক্যটিতে ‘জন’ ‘তুষ্ট করা’ ক্রিয়াটির কর্তা হিসেবে কাজ করে। বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায়: জন কোনো একজনকে তুষ্ট করতে আগ্রহী। অর্থাৎ, এখানে ইংরেজি ভাষার এই দুটো বাক্যের পদযোজনা বিধানের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যা কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্বের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।
আবার বিশেষ কিছু অস্পষ্ট (ambiguous) বাক্য আছে, যেখানে বাক্যটির পদগুলো অস্পষ্টতার কারণ নয় বরং বাক্যরীতিগত কাঠামো থেকে অস্পষ্টতা তৈরি হয় – এরূপ অস্পষ্টতার কোনো ব্যাখ্যাও কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্ব দিতে পারে না। যেমন ইংরেজি ভাষায় ‘I like her cooking’ বাক্যটিতে কোনো অস্পষ্ট পদ (বা শব্দমূল) নেই এবং উপরিতলে খুবই সরল ব্যাকরণ কাঠামো ‘নাউন-ভার্ব-পজেসিভ প্রোনাউন-নাউন’ বিদ্যমান তবু এই বাক্যটির অর্থ গুরুতর রকমের অস্পষ্ট। এর অর্থ হতে পারে: ‘সে যেটা রান্না করছে আমি তা পছন্দ করি’; ‘সে যেভাবে রান্না করছে আমি সেই ধরনটি পছন্দ করি’; ‘সে রান্না করছে এই ব্যাপারটা আমি পছন্দ করি’; এবং এমনকি এর অর্থ এরকমও হতে পারে যে, ‘সে নিজে রান্না হচ্ছে এই ব্যাপারটা আমি পছন্দ করি’।
এরকম ‘বাক্যিক অস্পষ্টতা’ (Syntactically ambiguous) বাক্যপ্রকরণ তত্ত্বের সামনে গুরুতর প্রশ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয়। এগুলো অতি সাধারণ ইংরেজি বাক্য। তবু এই ধরনের বাক্যের ব্যাখ্যা প্রদান করা অত্যন্ত দূরুহ। কাঠামোবাদে বলা হয় ‘কোনো বাক্যের অর্থ নির্ধারিত হয় ব্যবহৃত পদসমূহ (বা শব্দমূলসমূহ) এবং বাক্যবিন্যাসের দ্বারা’। তাহলে এইরূপ বাক্য যেখানে অত্যন্ত স্পষ্ট শব্দ (বা শব্দমূল) থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বুঝায় সেটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? এরকম ক্ষেত্রে কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্বের কোনো ব্যাখ্যাই নেই বলা চলে, বিষয়টি পুরোপুরিই উপেক্ষা করা হয়। এই পরিস্থিতিতে চমস্কি দাবী করেন, এ-ধরনের বাক্যে বেশ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন বাক্যরীতিগত কাঠামো বিদ্যমান, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কাঠামোগুলোকে উপরিতলের সমরূপ কাঠামোটি গোপন করে রাখে। যেমন ‘I like her cooking’ বাক্যটির অভিন্ন বহির্কাঠামোটি বেশকিছু অন্তঃস্থ কাঠামোকে গোপন করে রাখে, যাকে চমস্কি ‘অন্তর্কাঠামো’ (‘deep structures’) বলে আখ্যায়িত করেন। বাক্যের ক্ষেত্রে অন্তর্কাঠামো ধারণাটির (যা সবসময় বহির্কাঠামোতে দৃশ্যমান হয় না) সংযোজন ভাষাতত্ত্বে চমস্কির বিপ্লবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান।
চমস্কির কাজের একটা বিশেষ গুণ হলো, তিনি অব্যাহতভাবে সেইসব হতবুদ্ধিকর বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন যেগুলো আমাদের কাছে কোনো জিজ্ঞাস্য বিষয় বলেই বিবেচিত হয় না এবং যেগুলো ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন আছে বলেও আমাদের কখনোই মনে হয় না। ‘আপেল মাটিতে পড়ে’ জাতীয় ‘অতি মামুলি নির্বোধোচিত’ প্রশ্ন থেকে যেমন পদার্থবিদ্যা নতুন যাত্রা শুরু করেছিল এবং ‘উদ্ভিদ ও প্রণীসমূহ নিজেদেরকে পুনরুৎপাদন করে’ জাতীয় ‘মামুলি’ প্রশ্ন থেকে যেমন জেনেটিক সায়েন্স বিকশিত হয়েছিল ঠিক তেমনই ভাষার কাঠামো অধ্যয়নবিদ্যা নতুন যাত্রা শুরু করে ‘I like her cooking’ বাক্যের বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয় বা ‘John is easy to please’ বাক্যের ব্যাকরণ-কাঠামো ‘John is eager to please’ বাক্যটি থেকে আলাদা – এরকম ‘ফালতু’ জিজ্ঞাসা থেকে। সবসময়ই আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় যে আমরা অবিরত নতুন কিছু বলছি ও শুনছি যেসব কথা আমরা আগে কখনো বলিনি বা শুনিনি; এবং যেকোনো ভাষায় বাক্যপ্রণয়ন সম্ভাবনা অসীম।
এরকম বাক্যরীতিগত প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যাদানে কাঠামোবাদী পদ্ধতির ব্যর্থতার কারণে চমস্কি কেবল এই পদ্ধতিটিকেই চ্যালেঞ্জ করেন না সেইসাথে কাঠামোবাদে ভাষাতত্ত্বের যে লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়েছিল তাও প্রতিরুদ্ধ করেন। চমস্কি দাবী করেন, ভাষাতাত্ত্বিক বর্ণনের লক্ষ্য হবে এমন একটা তত্ত্ব নির্মাণ করা যা প্রাকৃতিক ভাষার অসীম বাক্যপ্রণয়ন প্রপঞ্চটি ব্যাখ্যা করতে পারবে। এধরনের একটি তত্ত্ব দেখাতে পারবে কোন শব্দপরম্পরাগুলো বাক্য এবং কোনগুলো বাক্য নয়। সেইসাথে বাক্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাকরণগত কাঠামো ও পুর্বেল্লেখিত অস্পটতাকেও ব্যাখ্যা করতে পারবে। অর্থাৎ, এটা হবে একপ্রকার রূপগত অবরোহী তত্ত্ব (a formal deductive theory), যার অন্তর্গত একগুচ্ছ ব্যাকরণগত বিধান একটি ভাষার অসীম সংখ্যক বাক্য উৎপাদন করতে পারবে, বাক্য নয় এমন কিছু উৎপাদন করবে না এবং প্রতিটি বাক্যের ব্যাকরণগত কাঠামো বর্ণনা করতে পারবে। এই তত্ত্বকেই বস্তুত ‘জেনারেটিভ গ্রামার’ আখ্যায়িত করা হয়।
সিনট্যাক্টিক স্ট্রাকচার্স (১৯৫৭) গ্রন্থে চমস্কি বাক্যপ্রকরণ (সিনট্যাক্স) ব্যাখ্যা করাকে, অর্থাৎ বাক্য প্রণয়নের অন্তঃস্থ ব্যাকরণগত বিধানগুলো শনাক্ত করাকেই, মূলত ভাষাতত্ত্বের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। আসপেক্টস অব দ্য থিওরি অব সিনট্যাক্স (১৯৬৫) গ্রন্থে চমস্কির অধিকতর পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বে লক্ষ্যটা আরও উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে: একটা ভাষার ধ্বনি-ব্যবস্থা ও অর্থ-ব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান সবরকমের ভাষাতাত্ত্বিক সম্পর্কর ব্যাখ্যা প্রদান। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে, অর্থাৎ চমস্কির জবানীতে, ভাষার ‘পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ’-এর অবশ্যই তিনটা অংশ থাকতে হবে: প্রথমত, বাক্যপ্রকরণ বিধান – যা একটা ভাষার অসীম সংখ্যক বাক্য উৎপাদন করতে এবং সেই বাক্যগুলোর অন্তঃস্থ কাঠামো বর্ণনা করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ধ্বনিগত বিধান – যা উৎপাদিত বাক্যসমূহের ধ্বনিকাঠামো বর্ণনা করতে পারবে। তৃতীয়ত, শব্দার্থ বিধান – যা বাক্যগুলোর অর্থকাঠামো বর্ণনা করতে পারবে। চমস্কির মতে, এই ব্যাকরণের কেন্দ্রীয় বিষয় হলো বাক্যপ্রকরণ (সিনট্যাক্স); কেননা ধ্বনিরূপ (ফনোলজি) ও শব্দার্থ (সিম্যানটিক্স) পুরোপুরিই “ব্যাখ্যামূলক” অর্থাৎ এগুলো বাক্যপ্রকরণ দ্বারা উৎপাদিত বাক্যসমূহের ধ্বনিরূপ ও শব্দার্থ নির্ণয় করে বটে কিন্তু নিজেরা কোনো বাক্য উৎপাদন করতে পারে না।
চমস্কির বাক্যপ্রকরণ এর প্রথম কাজ হলো বাক্যসমূহের আভ্যন্তরীণ কাঠামো সম্পর্কে ব্যক্তির উপলব্ধিকে ব্যাখ্যা করা। বাক্য কোনো বিশৃঙ্খল শব্দসমগ্রক নয়, বরং শব্দ ও শব্দমূলগুলোকে বাক্যের কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া ইত্যাদি ভূমিকাপালনকারী গঠন-উপাদান হিসেবে বিন্যাস করা হয়। বাক্য প্রণয়নকারী এই আভ্যন্তরীণ কাঠামো সম্পর্কে বক্তার জ্ঞান যে বিধান দ্বারা পরিচালিত হয় চমস্কি তাকে বলেন ‘পদবিন্যাস’ (‘Phrase structure’ rules) বিধান। চমস্কির আগেও অনেকে এই বিধানের কথা উল্লেখ করেছেন। চমস্কি কাঠামোবাদকে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করেন এই দাবীর মাধ্যমে যে কেবলমাত্র ‘পদবিন্যাস’ বিধান নির্ভর ব্যাকরণ দ্বারা ‘I like her cooking’ কিংবা ‘John is eager to please’ জাতীয় সমস্যা ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ, প্রথমত এধরনের ব্যাকরণে বাক্যপ্রকরণজনিত অস্পষ্টতা, যেমন ‘I like her cooking’ বাক্যটি, ব্যাখ্যা করা যায় না। দ্বিতীয়ত এধরনের ব্যাকরণে বাক্যপ্রকরণজনিত পার্থক্য ধরতে পরা যায় না। যেমন ‘John is eager to please’ ও ‘John is easy to please’ বাক্য দুটির বহির্কাঠামো একই রকম হলেও বাক্যপ্রকরণ বিধান আলাদা। এখানে উপরিতলের সাদৃশ্য অন্তঃস্থ বাক্যপ্রকরণগত ভিন্নতাকে গোপন করে যা পদবিন্যাস ব্যাকরণ ব্যাখ্যা করতে পারে না।
এরূপ সমস্যা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে চমস্কি দাবী করেন, পদবিন্যাস বিধানগুলোর সাথে সাথে ব্যাকরণে আরও একধরনের বিধান থাকতে হবে: ‘রূপান্তরের বিধান’ (‘transformational rules’) যা কোনো উপাদান যোগ করে বা বিয়োগ করে বা স্থানান্তর করে একধরনের পদ-চিহ্নকে অন্যধরনে রূপান্তর করে। যেমন, চমস্কির রূপান্তরের বিধান প্রায়োগ করে আমরা কর্র্তৃবাচ্যের পদ-চিহ্ন কীভাবে ভাববাচ্যের ভিন্ন করমের পদ-চিহ্নে রূপান্তরিত হয় সেটা প্রদর্শনের মাধ্যমে কর্তৃবাচ্য ও ভাববাচ্যের সাদৃশ্য দেখাতে পারি। সুতরাং ‘পদবিন্যাস বিধানের’ দ্বারা দু’ধরনের বিচ্ছিন্ন পদ-চিহ্ন উৎপাদনের পরিবর্তে, কীভাবে একই অন্তঃস্থ পদচিহ্ন থেকে কর্তৃবাচ্য ও ভাববাচ্যের পদ-চিহ্ন তৈরি হতে পারে সেটা দেখিয়ে দিয়ে আমরা আরও সরল একটা ব্যাকরণ প্রণয়ন করতে পারি। আবার আমরা দেখেছি, ‘I like her cooking’ জাতীয় বাক্যের অন্তরে বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন বাক্য লুকিয়ে থাকে যাদের প্রতিটিরই অর্থ আলাদা এবং প্রতিটির পদ-চিহ্নও আলাদা রকমের। এসকল বিভিন্ন বাক্যের ভিন্ন ভিন্ন পদচিহ্নকে রূপান্তর করা সম্ভব ‘I like her cooking’ পদ-চিহ্ন সম্পন্ন বাক্যেটিতে।
রূপান্তরের বিধান সংযুক্ত করার কারণে চমস্কির এরকম ব্যাকরণকে রূপান্তরবাদী (‘transformational generative grammar’ বা কেবলই ‘transformational grammar’) ব্যাকরণ বলা হয়। ভাষার পদপ্রকরণের ক্ষেত্রে পদবিন্যাস বিধান ও রূপান্তরের বিধানসমূহের সাথে সমন্বিতভাবে থাকে ভিত্তি-উপাদান (base component) ও রূপান্তরকারী উপাদান (transformational component)। চমস্কির ব্যাকরণ অনুযায়ী, ভিত্তি-উপাদানের ভিতরে থাকে পদবিন্যাস বিধানগুলো যা প্রতিটি বাক্যের অন্তর্কাঠামো (ডিপ স্ট্রাকচার) নির্দিষ্ট করে দেয়; আর অন্যদিকে রূপান্তরকারী উপাদনটি বাক্যের অন্তর্কাঠামোকে পরিবর্তন ঘটায় পরিকাঠামোতে (সারফেস স্ট্রাকচার)। যেমন ‘I like her cooking’ বাক্যটিতে বেশ কয়েকটি অন্তর্কাঠামো রূপান্তরিত হয়েছে একটিমাত্র পরিকাঠামোতে। সংক্ষেপে বলা যায়, অন্তর্কাঠামো বাক্যের অর্থ নির্ধারণ করে আর পরিকাঠামো বাক্যের ধ্বনিরূপ নির্ধারণ করে দেয়। অর্থাৎ, পরিকাঠামো বাক্যের শরীরের সাথে এবং অন্তর্কাঠামো বাক্যের মনের সাথে জড়িত।
আসপেক্টস অব দ্য থিওরি অব সিনট্যাক্স প্রকাশের সময় মনে হয়েছিল বাক্যের শব্দর্থগত দিক নির্ধারণকারী অংশগুলো এবং বাক্যার্থ নির্ধারণকারী সকল বিষয় নিহিত থাকে অন্তর্কাঠামোর মধ্যে। পূর্বোল্লেখিত দৃষ্টান্তগুলো এর সাথে খাপে খাপে মিলে যায়। যেমন ‘I like her cooking’ বাক্যটির বিভিন্ন অর্থ হয় কারণ এর রয়েছে আলাদা আলাদা অন্তর্কাঠামো, যদিও পরিকাঠামো একটাই। কিন্তু ‘The boy will read the book’ এবং ‘The book will be read by the boy’ বাক্য দুটো পরিকাঠামোর দিক থেকে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও একই অর্থ প্রকাশ করে কারণ বাক্য দুটো একটামাত্র অন্তর্কাঠামো থেকে উৎসারিত। বাক্যপ্রকরণ এবং তার সাথে ধ্বনিরূপ ও অর্থের সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চমস্কি এভাবে একটি সংহত তত্ত্ব পেশ করেন।
অর্থগত সঙ্কট
কিন্তু সম্প্রতি চমস্কির বিপ্লবের ভিতরে আরেকটা বিপ্লব ঘটে চলেছে। চমস্কি বেড়ে উঠেছিলেন কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্বের ছায়াতলে। কাঠামোবাদের একটা ধারণা চমস্কিকে এখনও আশ্রয় করে আছে: শব্দার্থ (সিম্যানটিক্স) থেকে স্বাধীনভাবে বাক্যপ্রকরণকে (সিনট্যাক্স) অধ্যয়ন করতে হবে; অর্থাৎ ভাষার কাঠামোকে অধ্যয়ন করতে হবে ভাষার অর্থ ও ব্যবহারনিরপেক্ষভাবে। চমস্কির গভীর দার্শনিক বিশ্বাস, একমাত্র মানুষই হলো বিন্যাসক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী। মানুষের মস্তিষ্কের কাঠামো তার বাক্যপ্রকরণ কাঠামো নির্ধারণ করে দেয়। সুতরাং মানবমন অধ্যয়নের একটা পদ্ধতি, কিংবা বলা উচিত সবচে তাৎপর্যপূর্ণ পদ্ধতি বিবেচনা করা হয় বাক্যপ্রকরণ (সিনট্যাক্স) অধ্যয়নকে। চমস্কির মতে, মানুষ তার বাক্যপ্রকরণ উপদানগুলো ভাববিনিময়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলেও বাক্যার্থ বা শব্দার্থ বাক্যপ্রকরণ কাঠামোকে বিশেষত প্রভাবিত করে না। বাক্যপ্রকরণ কাঠামো ঘটনাক্রমে এর ব্যবহারের (ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ) সাথে সম্পর্কিত। এই জন্যই মূলত মানবমন অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটা রৌপ্যব্যবস্থা (formal system) হিসেবে ভাষা অধ্যয়ন করাটা চমস্কির কাছে একটা অসাধারণ পদ্ধতি বিবেচিত হয়।
চমস্কির বিচারে, ভাষা সংজ্ঞায়িত হয় বাক্যপ্রকরণ কাঠামো দ্বারা (যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার দ্বারা নয়) এবং বাক্যপ্রকরণ কাঠামো নির্ধারিত হয় মানবমনের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যসমূহ (innate properties) দ্বারা। এজন্যই আমরা দেখি, ভাষাতত্ত্বে চমস্কির অবদান মূলত বাক্যপ্রকরণ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে।
চমস্কির অনেক মেধাবী শিষ্য আজকাল ভাষা সম্পর্কে চমস্কির এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিযুক্ত মনে করেন না। তাদের মতে, বাক্যপ্রকরণ কাঠামো নির্ধারণে অর্থপ্রকরণ (সিম্যান্টিক্স) একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তাদের মতে, এমনকি ‘ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ’ বা ‘সুবিন্যস্ত’ বাক্য ব্যাখ্যার জন্যও অর্থগত ধারণার প্রয়োজন হয়। যেমন ‘খালেদা জিয়া বদরুদ্দোজাকে রাজাকার আখ্যায়িত করেছেন এবং অতপর বদরুদ্দোজা খালেদাকে অপমান করেছেন’ বাক্যটি কেবল তখনই একটা ‘সুবিন্যস্ত’ বাক্য বলে বিবেচিত হতে পারে যদি ধরে নেওয়া হয় যে ওই দুজনেই ‘রাজাকার’ বলাটাকে ‘অপমানজনক’ মনে করেন।
একসময় চমস্কি দাবী করেছিলেন যে কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্ব বাক্যপ্রকরণগত সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে না, তেমনই আজ জেনারেটিভ অর্থবিজ্ঞানীরা দাবী উঠিয়েছেন যে চমস্কির ব্যাকরণ বাক্যপ্রকরণের সাথে অর্থপ্রকরণের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারছে না। তাদের দাবী, বাক্যপ্রকরণকে (সিম্যান্টিক্স) সম্পূর্ণরূপে অর্থপ্রকরণ (সিম্যান্টিক্স) থেকে আলাদা করা যায় না; বাক্যপ্রকরণগত অন্তর্কাঠামো থাকতেই হবে এমন কথা নেই।
মানুষের সহজাত ভাষাক্ষমতা
ভাষাতত্ত্বে কাজের মাধ্যমে চমস্কি সবচে লক্ষণীয় যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন তা হলো, তার গবেষণালব্ধ ফলাফল দেকার্তে, লাইবনিজ ও অন্যান্য সপ্তদশ শতকীয় যুক্তিবাদী (র্যাশনালিস্ট) দার্শনিকদের প্রস্তাবনার-মানুষ সহজাত ভাবসম্পন্ন – যাথার্থ্য প্রমাণ করে। যুক্তিবাদীরা দাবী করেন, মানবসত্তা এমন কিছু জ্ঞানের অধিকারী যে-জ্ঞান কোনো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত নয় বরং তা সকল অভিজ্ঞতার পূর্ববর্তী, এবং অভিজ্ঞার মাধ্যমে কী-প্রকারের জ্ঞান অর্জন করা যাবে সেটা নির্ধারণ করে দেয়। অন্যদিকে দার্শনিক জন লক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের আচরণবাদী শিক্ষণ-তাত্ত্বিকসহ অভিজ্ঞতাবাদী (এম্পেরিসিস্ট) ধারার দাবী হলো, জন্মকালে মানুষের মন থাকে ফাঁকা স্লেটের (tabula rasa) মতো; অভিজ্ঞতা পূর্ববর্তী কোনো জ্ঞান সেখানে থাকে না। অভিজ্ঞাবাদীদের মতে, সকল জ্ঞান আসে অভিজ্ঞতা থেকে। আর যুক্তিবাদীদের মতে কিছু জ্ঞান মানুষের মনের মধ্যে সহজাতভাবেই বিদ্যমান থাকে।
চমস্কি আচরণবাদী-অভিজ্ঞতাবাদীদের প্রস্তাব খারিজ করে দেন এবং যুক্তিবাদীদের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করেন। চমস্কি এক্ষেত্রে যুক্তিবিন্যাস করেন মূলত শিশুর ভাষাশিক্ষার সহজাত সক্ষমতাকে কেন্দ্র করে।
চমস্কি যুক্তি দেখান যে, ভাষার ব্যাকরণ-কাঠামোর অন্তর্নিবিষ্ট রৌপ্য-বিধানগুলো (formal principles) বুঝতে পারার ক্ষমতা মানুষের সহজাত। প্রজাতিগত এই বৈশিষ্ট্যের সুবাদেই মূলত শিশুরা অতি অল্প বয়সে কেবলমাত্র বড়দের সাধারণ কথাবার্তা শুনেই অত্যন্ত জটিল ব্যাকরণগত বিধানগুলো চিনে নিতে সক্ষম হয় এবং পরবর্তীতে এই বিধানগুলো অভিনব কায়দায় ব্যবহার করে অসীম সংখ্যক ও প্রকারের অশ্রুতপূর্ব বাক্য প্রণয়নের ক্ষমতা অর্জন করে।
নিজের ভাষা সম্পর্কে মানুষের সহজাত ও অনেকাংশেই অজানা জ্ঞান বনাম বাস্তবে মানুষ যেভাবে তার ভাষা ব্যবহার করে এই দুইয়ের মধ্যে চমস্কি পার্থক্য করেন। সহজাত ও অজ্ঞাত জ্ঞানকে চমস্কি বলেন ‘সামর্থ্য’ (Competence), যার দ্বারা একজন শিশু ব্যাকরণসিদ্ধ সম্ভাব্য সকল প্রকার বাক্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। আর দৈনন্দিন জীবনে তার ভাষা ব্যবহারকে চমস্কি বলেন ‘কার্যকরণ’ (performance), যা ‘সামর্থ্য’কে রূপান্তর ঘটায় দৈনন্দিন বচনবাচনে।
একগুচ্ছ বিমূর্ত বিধানের সাহায্যে (অর্থাৎ, ভাষা সম্পর্কে মানুষের সহজাত ও অনেকাংশেই অজানা জ্ঞান) মানুষ অন্তর্কাঠামোর ভিতর থেকে পরিকাঠামোর জন্য পদ উৎপাদনের মাধ্যমে বাক্য সৃষ্টি ও ব্যাখ্যা করতে পারে। এই বিমূর্ত বিধানগুলো সংখ্যায় সীমিত হওয়া সত্ত্বেও অসীম বৈচিত্রপূর্ণ, এবং অশ্রুতপূর্ব বাক্য গঠনে মানুষকে সক্ষম করে তোলে। তবে, মানুষের জৈবিক ও অবধারণগত বেশিরভাগ বিধান সম্পর্কে যেমন আমরা অচেতন তেমনই এই বিমূর্ত ‘রূপান্তরের বিধান’ সম্পর্কেও আমরা অনেকটাই অচেতন। তিনি দাবী করেন, সকল ভাষাতে এই বিধানগুলো হুবহু একই রকমের এবং প্রজাতিগতভাবে সকল মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত সহজাত মস্তিষ্ক-কাঠোমোর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। এই বিধানগুলো মানুষের মধ্যে সর্বজনীন।
চমস্কির ব্যাকরণের সবচে দুর্বল দিক হলো এর অর্থগত উপাদান। তিনি নিজেও সেকথা বহুবার স্বীকার করেছেন। বাক্যের ধ্বনিরূপ ও অর্থগত রূপের মধ্যকার সকল সম্পর্ক এই ব্যাকরণে নির্ধারণ করা যায় না। বাক্যের অর্থ নিরূপনের যেকোনো উদ্যোগে অবশ্যই যোগাযোগে বাক্যের ভূমিকা বিচারে নিতে হয়। কিন্তু চমস্কি সেটা করেন না।
তবুও, ভাষাতত্ত্বে চমস্কির কাজ সাম্প্রতিককালের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন যা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাজের গুরুত্ব ও প্রভাবের সাথে তুলনীয়। তিনি কেবল ভাষাতত্ত্বে বিপ্লব ঘটাননি, বরং ‘জেনারেটিভ গ্রামার’ নামে ভাষা-অধ্যয়নের একটা নতুন জ্ঞানকান্ডের সৃষ্টি করেছেন এবং দর্শন ও মনস্তত্ত্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। চমস্কির সাথে যারা দ্বিমত পোষণ করেন তাদের কাছেও চমস্কির ভাষা-অধ্যয়ন-পদ্ধতি একটা শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃত। সর্বোপরি, মানুষ যন্ত্রিক নয়, মানুষ অন্য সকল প্রণী থেকে স্বতন্ত্র এবং সকল মানুষ সৃজনশীল – মানুষের অনন্যতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার এই ধ্রুপদি মূল্যচেতনা পুনরুদ্ধারে চমস্কি কাজ একটা তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
চমস্কির অপর বিপ্লব
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চমস্কির দৃষ্টিভঙ্গি ভাষা সম্পর্কে তার ধারণারই অনুগামী। ল্যাংগুয়েজ এন্ড রেসপনসিবিলিটি viii গ্রন্থে মিতসু রোনা’র ix সাথে আলাপচারিতায় চমস্কি বলেন, ‘রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যদি কোনো সম্পর্ক থাকেও তবে সেটা খুবই বিমূর্ত পর্যায়ের। … আমার রাজনৈতিক তৎপরতা, লেখালেখি ও অন্যান্য কর্মকান্ড এবং ভাষা-কাঠামো নিয়ে আমার কাজের মধ্যে প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই। তবে, মানবপ্রকৃতির মৌল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত আমার ধারণা-উৎস থেকেই বোধহয় এই দুই ধারার কাজ পরিচালিত’।
মার্কিন র্যাডিক্যালদের মধ্যে নোম চমস্কি সবচেয়ে পরিচিত। তিনি নৈরাষ্ট্রবাদী (এ্যনার্কিজম) রাজনীতির অনুসারী। সুনির্দিষ্ট করে বললে, তিনি নিজেকে নৈরাষ্ট্রবাদের শ্রমজীবীনির্ভর এনার্কো-সিন্ডিকালিস্ট ঘরানার লোক বলে মনে করেন। তার মতে, এই রাজনৈতিক দর্শন সকলপ্রকার ক্রমতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্যায্য অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্রমতন্ত্রগুলোকে উৎখাত করার পদক্ষেপ নেয়।
চমস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর ‘কর্পোরেট রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের’ ঘোর বিরোধী। উনিশ শতকের নৈরাষ্ট্রিক মতাদর্শের অন্যতম বিপ্লবী প্রবক্তা মিখাইল বাকুনিনের x অনেক ধারণা তিনি সমর্থন করেন। বাকুনিনের মতো তিনিও মনে করেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি শ্রমজীবীদের হাতে উৎপাদন প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণও থাকতে হবে; তাদের শাসনকারী মালিক ও ব্যবস্থাপকদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা চলবে না। তিনি এ-ধরনের ব্যবস্থাকে ‘প্রকৃত সমাজতন্ত্র’ বলে মনে করেন এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন স্টাইলের সমাজতন্ত্রকে মার্কিন ঘরানার পুঁজিবাদের মতো ‘সমগ্রতাবাদী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ‘প্রবল একনিষ্ঠ কোনো বিপ্লবীকেও যদি আজ নিরংকুশ ক্ষমতায় বসিয়ে দাও দেখবে বছর না ঘুরতেই সে খোদ জারের চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে উঠেছে’ – বাকুনিনের এই বক্তব্যের ওপর গুরুত্বারোপ করে চমস্কি বলেন যে সেভিয়েত পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল বলশেভিক রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ মতাদর্শর অনিবার্য পরিণতি। সোভিয়েত সাম্যবাদকে তিনি ‘ভন্ড সমাজতন্ত্র’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। তার মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে পুঁজিবাদের বিজয় নয় বরং ‘সমাজতন্ত্রের একটা ছোট্ট বিজয় হিসেবে’ পাঠ করতে হবে।
১৯৭৩ সালে ফর রিজন্স অব স্টেট গ্রন্থে চমস্কি যুক্তি দেখান যে ‘মজুরি দাসত্ব’-নির্ভর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিংবা সকলপ্রকার সিদ্ধান্ত প্রণয়নকারী কেন্দ্রীয়কমিটি-নির্ভর কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বাইরে এসেও একটা সমাজ চলতে পারে। তিনি মনে করেন, একটা জাতির সকল সদস্যের পছন্দমতো পেশা বেছে নেবার সুযোগ থাকতে হবে। স্বেচ্ছায় তারা যে-কাজ বেছে নেবে তা হতে হবে যুগপৎ তৃপ্তিদায়ক ও সামাজিকভাবে কল্যাণকর। সমাজ পরিচালনা হতে হবে শান্তিপূর্ণ নৈরাষ্ট্রিক শ্রমতন্ত্রের একটা ব্যবস্থার আওতায়, রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সরকারব্যবস্থা থাকবে না।
চমস্কির রাজনৈতিক কর্মকান্ড মূলধারার মিডিয়া (বিশেষত মার্কিন), তার কাঠামো, বড় ব্যবসা ও সরকারের সাথে স্বার্থগত সম্পর্ক ও মতাদর্শ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত। এডওয়ার্ড এস. হারম্যানের xi সাথে লিখিত ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল অব দ্য ম্যাস মিডিয়া (১৯৮৪) গ্রন্থে এবিষয়ে সবচেয়ে প্রণালীবদ্ধভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে বেশকিছু বিস্তারিত কেসস্টাডি তুলে ধরে তারা সংবাদমাধ্যম বিচারের ‘প্রচারণা মডেল’ পেশ করেছেন। [youtube id=”3AnB8MuQ6DU”] প্রচারণা মডেল মোতাবেক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অগ্রসর গণতান্ত্রিক সমাজে খুবই সুক্ষ ও অহিংস নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কায়েম করা হয়। স্বার্থগত কারণে মিডিয়া কাঠামোগতভাবেই প্রচারণাব্যবস্থার অংশিদার হয়ে ওঠে। ফলে সংবাদ-কাভারেজ পক্ষপাতহীন হয় না। মিডিয়া কন্ট্রোল গ্রন্থে এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ডান্ডা যে ভূমিকা পালন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রপাগান্ডাও সেইরকম ভূমিকা পালন করে’।
* আন্ডারলাইন করা অংশগুলা সম্পাদকের নোট।
আ-আল মামুন
Latest posts by আ-আল মামুন (see all)
- ফারুকীর টেলিভিশন, দূর-দর্শনের মিডিয়া এবং ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’ - নভেম্বর 3, 2016
- সিনেমা রেপ্রিজেন্টেশন: বোমা-জঙ্গি-মাদ্রাসা-ইসলাম এবং বাংলাদেশ - জুলাই 4, 2014
- তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (লাস্ট পার্ট) - মে 6, 2014