দীপেশ চক্রবর্তী’র জনজীবনে ইতিহাস
‘উপনিবেশ-উত্তর তত্ত্বকার’ আর ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসকার’ হিসাবে মশহুর দীপেশ চক্রবতীরে নয়া হালখাতায় চিন-প্যাহচানের জরুরত আলবৎ নাই বইলেই মানি। তাহার লিখা Provincializing Europe (২০০২) তো এই সেদিন জর্মন তক তর্জমার দখলে পড়ছে। তো, কথা হইলো, আৎখা, তার লিখা তাওয়া গরম একখান কিতাব হাতে পড়লো। উল্টায়-পাল্টায় দেখলাম। দেখতে দেখতে নিজের ভেতরেও থোরা থোরা ওলট-পালট ঘটতে শুরু করলো। ভাবলাম, হাজির হওয়া ভাব অক্ষরে অক্ষরে জাহির থাকুক। [pullquote][AWD_comments][/pullquote]
দীপেশ চক্রবর্তীর বাংলায় লিখা পহিলা কিতাব ‘ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ’। দীপেশের তিন মাস্টার বরুণ দে, অশোক সেন আর রনজিৎ গুহরে উৎসর্গ করা বহিখানা চিন্তায় বড় হলেও আকারে বেশ চিকনাই কওয়া যেতে পারে। i
কৃতজ্ঞতাস্বীকাররে বাদ দিলে পরে কিতাবের পহিলা প্রবন্ধ: “ভূমিকা: ইতিহাসের দীক্ষা”। এইখেনে লেখক আপনকার কাটানো কাল লয়া আলাপের সুতায় সুতায় ইতিহাস লইয়া এই-ওই বাঙাল পাড়ার দেখনদারির তুলনামূলক আলোচনা সারিয়াছেন। ইতিহাস কারে কওয়া যায়- এই সওয়ালের ধার দীপেশ ধারেন নাই। সুদু, ইতিহাস ব্যবসায় করবার গিয়া এইকালে মানে দোসরা মহাগন্ডোগলের ইস্ পাড়ের লোকেরা আর ওই পাড়ের মানে দোসরা মহাগন্ডোগলের উস্ পাড়ের লোকেরা কি কি কেতায় আপন আপন চরিত্রের বাড়া খাড়া করিয়াছে – তাহারই সন্ধান সলুক করিয়াছেন।
এইকালের ইতিহাসকারের যে সুদু ইতিহাসের জমিনে খাড়ায়া থাকিলেই চলিতেছে না, আর আর জমিন- সাহিত্য, দর্শন মায় বিজ্ঞান তক- তার আপন এলেকা বানানির জরুরত- এই কথা দীপেশ ডর্ হীন, ক্রমে থিকা ক্রমান্বয়ে কয়া যান। আরো কয়া যান যে, অক্ষর নির্ভর ইতিহাসকলার দুদর্শা টের পাওনের বাজিমাত সময়ে দাড়ায়াই এর বাহিরের ইতিহাসকলার দিকে নজর হররোজ বাড়িতেছে। এই’ই সুখের কথা।
দোসরা প্রবন্ধ: ‘নিজেরই মূদ্রাদোষে’ ভরিয়া কোষে কোষে মানুষের আত্মরতির নমুনা বিস্তার। টমাস লক্যরের ২০০৩ ইসায়ীতে বাজারে আসা কিতাব ‘Solitary Sex: A Cultural History of Masturbation‘র আলাপ পাড়িতে গিয়া দীপেশ ইতিহাসের ভারত/বাঙলা বা বাঙলা/ভারতের ইতিহাসের ভাঙ্গা বেড়া দিয়া মাথা বাড়াইয়াছেন। এবং দেখিতে পাইয়াছেন যে, আধুনিকতা মালখানি আত্মরতির ইতিহাসরে (স্বমেহন/হস্তমৈথুন/মাস্টারবেশন বা হাত-মারা যার যা ইচ্ছা নামে ডাকা যাউক) আড়ালে রাখিয়া পাঠ করা কতক না-ইনসাফির কবলে পড়া হয়। মাস্টারবেশন কেবল ধর্মীয় দিক থিকা ‘ বীর্যের বাজে খরচে’র খাতাতেই তোলা থাকে না। বরং, এর সাথে এনলাইটেনমেন্টের যুগে সামাজিক মানুষের আত্ম (ব্যক্তি) আবিস্কারের ইতিহাসও জড়াজড়ি করিয়া থাকে।
কথায় কথায়, রশুনের তিন কোয়া এক জায়গায় আসিয়া মিশিয়াছে। আত্মরতি, নবেল আর ফাটকা ব্যবসায় নামের তিন কোয়া মিশিয়াছে আত্মমগ্নতার নেশায়। সূত্র হিসেবে টমাস লক্যরকে সাক্ষী মানিয়া দীপেশ দেখাইতেছেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর ‘আলোকপ্রাপ্তির যুগের চিন্তার কল্পনা বা Imagination-এর ধারণা”। আর এইখেন থিকাই কি করিয়া ঐ সময়কার চিকিৎসা বিজ্ঞান আর মনোচিকিৎসকরা মিলিয়া মিশিয়া আত্মরতীর ‘গভীর নির্জন পথ’ আবিস্কারে ব্রতী হইয়াছিলেন তার মনোগ্রাহী বর্ণনা দেন দীপেশ।
এই জায়গায় এইসে দীপেশের কথা হইলো এই পাড়ার আত্মরতির জবানির লগে ঐ এয়ুরোপীয় পাড়ার বেশ বড় রকমের ভজঘট রহিয়াছে। দীপেশের কথা হইলো, এয়ুরোপে আত্মরতী পহিলা বিমার আকারে নাজেল হয়। এরপর দুই-আড়াই শো বছরেই এই বিমার আর বিমার থাকে না। তাহা মানুষের স্বাধীনতার ছপ্পর নামে হাজির হয়। এর পেছনে চিকিৎসা-বিজ্ঞানসহ আরো ম্যালা কিছু যুক্তি-বুদ্ধির মোলাকাত আছিলো। কিন্তু, এই বাঙাল মূলুকে দীপেশের কথা ধার করিয়া বলি-“অজস্র পরস্পরবিরোধী ধারণা পাশাপাশি ভীড় করে থাকতো, তার কিছুটা আধুনিক শরীরবিজ্ঞান, কিছুটা আর্য়ুবেদিক, কিছুটা ক্রিশ্চান পাপবোধ, কিছুটা হেকিমি, কিছু আবার নিম্নবর্গের জীবন থেকে উঠে আসা ফকিরি, জলপড়া, স্বপ্নাদিষ্ট, মায়ের প্রসাদ, সবই।”
লিখা নম্বর তিন কিতাবের আপন সুরতের নামেই: ‘ইতিহাসের জনজীবন’। গণশিক্ষার লগে একাডেমিক বিদ্যাচর্চার ফারাক লইয়া এই প্রবন্ধ ফাদিয়াছেন দীপেশ। ইতিহাসকার যদুনাথ সরকারের মারাঠা ইতিহাসে শিবাজী’র ভূমিকার ধোয়া তুলিতে গিয়া দীপেশ রবীন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার মেৌত্রেয়, প্রবোধচন্দ্র সেন, সরদেশাই সহ তাবড় তাবড় বুদ্ধিজীবির নাম এস্তেমাল করিয়াছেন। দীপেশ জানাইতেছেন, এইসব ইতিহাসকারেরা ইতিহাস গবেষণা আর গনের সাধারন ইতিহাস-শিক্ষারে এক ও অবিচ্ছেদ্য জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভাবিতেন। রবীন্দ্রনাথসহ আর আর ইতিহাসকারের নেশন ধারনার ফাকিটাও দীপেশ ধরাইয়া দেন অতি অনায়াসেই। তাহারা সকলেই জন বলিতে নেশন বা জাতি বুঝিতেন। গণ বা mass বুঝিতেন না। ফলে গোল বাধিত। আন্ধার রাইতের সমস্ত গাভীর লাহান সমস্ত ভারতবর্ষীয়রাই এই নেশন ধারনার আড়ালে এক রঙ্গা হইয়া উঠিতো। উনিশশত বিশের, ত্রিশের দশকে কি করিয়া ইতিহাস-উৎসাহ ইতিহাস-যুদ্ধের রুপ নেয় তাও পষ্ট হইয়া ওঠে এইখেনে। আর এই ইতিহাস যুদ্ধ কেবল নিম্নবর্গের অশিক্ষার ফলে-কুশিক্ষার ফলে হইয়াছে কহিয়া দায় সাড়া হইবার চাহিলে চলিবে না। ইহার সুর তোলা আছে অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। আর প্রবন্ধের গোড়ায় দীপেশের মত হইতেছে, আজিকার নেশন কেবল কিতাবে লিখা ভালা ভালা বাতচিতের সুরসুরিতেই ফুরাইবে না। ইহার অন্য সাধনার জরুরত রহিয়াছে। কালের কল্লোলে সাড়া দিয়া টেলিবিশন, ইন্টারনেট, সিনেমা প্রভৃতি কলাকে আকড়াইবার সময় সমাগত। নয়া জাতীর পরিচয়ের কুলুজি এইখেনেই রহিয়াছে।
এর পরের প্রবন্ধ ‘শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র: ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারী ও জনসংস্কৃতি’ নামে। মেলা পরিশ্রমে এই প্রবন্ধের শরীর গড়িয়া তোলা হইয়াছে। অনেকগুলা ভাগে ভাগ করে বেশ আটঘাট বাধিয়াই নামিয়াছেন দীপেশ। প্রবন্ধখানা জরুরীও বটে। কলেরা, প্লেগ, মহামারী ইতিআদী সকল রোগের আলাপ করতে করতে ভারতের এই আধুনিক চেহারা গড়িবার তলে দিয়া যে জাতীয়তাবাদী চৈতন্য স্ববিরোধী জমিনে দাড়ায় আছিলো আর এর নির্মানে ঔপনিবেশিক শক্তি যে আপন স্বার্থেই পাবলিকের শরীর-স্বাস্থ্য লইয়া মাতিয়াছিলো- এই ঘরের খবর খুব্বি গল্প-কাতরতায় জানাইয়া দেন দীপেশ। বুজোর্য়ার দিক থিকা মানুষের শরীরের (নাকি শরীল?) গুরুত্ব আর প্রাক ধনতান্ত্রিক দশায় শরীরের (দীপেশের ভাষায় সামাজিক শরীর) গুরুত্ব সাপে নেউলে। একটায় দরকার সামাজিক যুথবদ্ধতা আর অপরটায় ব্যক্তির একক বিকাশ। ফলে, ‘আধুনিক’ পুজিবাদী রাষ্ট্র গড়িতে হইলে সমাজ-নমাজ দোমড়াইয়া-মোচড়াইয়া একাকার করা লাগে। তো, এই শরীর, স্বাস্থ্যনীতি, জনস্বাস্থ্য কি করিয়া সরকারী ভাবনায় কাজ করে, কি করিয়া আম পাবলিকরে নিয়মের শাসনে বাধিবার অস্ত্র আকারে হাজির হয় তাহা খোলাশা করিয়াছেন দীপেশ। এই প্রবন্ধটা কওয়া যায় এই কিতাবের একখানা অন্যতম জরুরী সম্পদাকারে বিরাজিছে। প্রবন্ধের শেষে আসিয়া দীপেশরে বহুত চক্ষুস্মান লাগে যখন কিনা দীপেশ বলিয়া ওঠেন, ‘শেষ বিচারে মানুষের মুক্তি রাষ্ট্রের অবলুপ্তিতে ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে, তাই রাষ্ট্রের ক্ষমতার চরিত্র বোঝা দরকার। এবং তেমনি বোঝা প্রয়োজন ইতিহাসে রাষ্ট্র-বিরোধিতার সূত্রগুলো কোথায়, কারণ একদিন আবার মানুষের মুক্তির কাহিনির সূত্রপাত সেই সব জায়গা থেকে করতে হবে।’
রাস্তার রাজনীতি আর মিছিল-মিটিং-বনধ লইয়া ঐতিহাসিক জমিনে খাড়াইয়া আগামীর তুলোধুনা সারিয়াছেন দীপেশ পরের প্রবন্ধে। এরপর আসিয়াছে পশ্চিমের লগে বাংলার বায়োগ্রাফি চর্চার সামাজিক অবস্থার খবর। অতি সুস্বাদু লাগিয়াছে প্রবন্ধখানা। এনেকডোটের ধুয়া তুলিয়া অরাল ট্রাডিশনের নাম পাড়িয়া দীপেশ বাংলার মায় এশীয় আর এয়ুরোপীয় দুনিয়ার জীবনী বা স্মৃতিকাতরতার জবানী তুলিয়া ধরিয়াছেন। সবখানেই দেখিতেছি শেষবিচারে আধুনিকের মামলা মূলত: মিথোস আর লোগসের লড়াইয়ের মামলাই। দীপেশের মতে, ভূগোলের এই এলেকায় লিখিত জীবনী আর কথিত জীবনীর হেরফের খুব্বি কম। যাহা কথিত, তাহাই ইতিহাসকে টেক্কা মারিয়া লিখিত হইবার পারে। আবার উল্টাটাও ঘটিয়া থাকে।
জামিল আহমেদ
Latest posts by জামিল আহমেদ (see all)
- ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (১৯১১ – ১৯৮৪) – খুশবন্ত সিং - এপ্রিল 15, 2022
- দীপেশ চক্রবর্তী’র জনজীবনে ইতিহাস - নভেম্বর 25, 2016
- জোসেফ কুদেলকার লগে মোলাকাত - সেপ্টেম্বর 19, 2016