ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (১৯১১ – ১৯৮৪) – খুশবন্ত সিং
কলেজে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ আমার বছর দুয়েকের বড় ছিলেন এবং আমার স্ত্রীর থেকে বছর পাঁচকের বড়। তিনি মাস্টার্সে পড়ছিলেন — লাহোরে, ইংরেজি এবং আরবীতে। যদিও ছাত্র ছিলেন তবুও ইতিমধ্যেই ‘লাহোর এস্থেটিক ক্লাবে’র মোহে পড়ে এদের সাথে জুড়ে গিয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রফেসর এ.এস.বোখারি (পাত্রাস), ইমতিয়াজ আলী তাজ, মুহাম্মদ দিন তাসির এবং সুফি তাবাসসুমের মতো মানুষজনও ছিল। উঠতি তরুন কবি হিসাবে তাঁর খ্যাতির কারণে এটা হয়েছিল।
ষোল বছর বয়স থেকেই ফয়েজ কবিতা লিখতে শুরু করেন। শিয়ালকোটের মারে কলেজের একটি মুশায়রায় (যেখান থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছিলেন), তার প্রথম প্রকাশ্যে কবিতা পাঠের আসরে একটি দ্বিপদী শুনিয়ে তিনি তার জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন:
হে সাকি,
ঠোট বন্ধ হয়ে গেছে তো কি, আমার চোখকে করাও পান
না চাইতেই যে সরাব আছে তাই না হয় হোক আজ দান।
কয়েক বছর পরে আমি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসি এবং লাহোরে বাসা বানিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করি। তখন থেকে আবার ফয়েজের সাথে আমার যোগাযোগ হতে শুরু করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশ অনুসরণ করে, ফয়েজ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং অফিসারের উর্দি পরতেন। এই সময়েই অ্যালিস— যার বড় বোন তাসিরকে বিয়ে করেন— হরকিরাত সিংকে (উনি পরে একজন জেনারেল পদে পদোন্নতি পান) বিয়ে করতে ভারতে আসেন। উনার সাথে অ্যালিস স্যান্ডহার্স্টে ক্যাডেট থাকাকালীন সময়ে বাগদান করেছিলেন। ততদিনে অবশ্য ভারতে হরকিরাত সিং এক শিখ মেয়েকে বিয়ে করে বসেছিলেন। অ্যালিসের হৃদয় ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে যায়। প্রত্যাবর্তনের কালে, তিনি ফয়েজকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুটি কন্যা সন্তান হয়-সেলিমা এবং মুনিজা।
ফয়েজ কোনো রমনীরঞ্জক কেষ্টঠাকুর ছিলেন না। ছোটখাট একজন মানুষ তিনি— যার গায়ের রং এমন গাড় বাদামী ছিল যেন দেখে মনে হতো এই মাত্র তেল মালিশ করা হয়েছে তার গায়। স্বল্পভাষী কিন্তু বুলিতে মধুমাখা এবং নিরাবেগ একজন মানুষ। তার আড্ডা-আলাপ বা কথোপকথন নয়, তার কবিতাই তাকে প্রতিটি আসরে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করত। তার দ্যুতিময় প্রতিভা ছাড়াও, তিনি যেকোন ধরনের কুসংস্কার থেকে সাতিশয় মুক্ত ছিলেন — তা সে হোক জাতিগত বা ধর্মীয়। হিন্দু এবং শিখদের মধ্যে তার বহু দোস্ত-বন্ধু ছিল। ছোট করে ঠিকঠাকভাবে প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয় তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। তার চরিত্রে অনেক স্ববিরোধিতা ছিল। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন কিন্তু পুঁজিবাদীদের মধ্যে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি ঈশ্বরকে অস্বীকার করতেন কিন্তু একইসাথে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরুও তিনিই ছিলেন। তাঁর লেখায় সবসময় দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের কথা তুলে ধরতেন; কিন্তু তার জীবনযাপনের ধরন ছিল একজন অভিজাতের মতো: দৈনিক যে টাকার প্রিমিয়াম স্কচ এবং আমদানি করা সিগারেটের খরচ হতো তার, তা দিয়ে একজন শ্রমিকের পরিবার এক মাসের খাবারের বন্দোবস্ত করতে পারত। বিভাজন-পরবর্তী পাকিস্তানে, কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ তিনি গ্রেফতার হন। জেলে বন্দি থাকেন। সেখানে তাকে রেশন হিসেবে শুকনো রুটি এবং সাদা পানি দেয়া হত। আদর্শের কারনে তিনি খুব সহজেই তার জীবনের সহজ বিলাসিতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছিলেন।
ভারত ভাগ ফয়েজের মনে গভীর ক্ষত রেখে যায়। যদিও তিনি যে দেশে জন্ম নিয়েছেন সে দেশেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারপরেও তিনি জনগণকে ভাগ করে ফেলা মেনে নিতে পারেন নি, অস্বীকার করেছিলেন: পাঞ্জাবি অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তান তার পূর্ব অংশের সাথে যে আচরণ করেছিল তাতে তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ভুট্টো যেভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে এবং জেনারেল টিক্কাখানের বদমায়েশ সেনাবাহিনীকে অসহায় বাঙালিদের উপর লেলিয়ে দিয়েছিলো তাতে তিনি বেজায় অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি তার জীবনের শেষ পর্যন্ত একইসাথে পাকিস্তানী, ভারতীয় এবং বাংলাদেশী ছিলেন। জাতিগত বা ধর্মীয় বিষয়ে তিনি যতটা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন, জাতীয় বিভাজনের প্রতি তার ততটা ধৈর্য ছিল না।
https://www.youtube.com/watch?v=vxfT152LFeo
কবি হিসেবে ফয়েজের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো হয়েছে তার গরাদের ভেতর থাকা সময়টুকুতেই। তার মুখের বুলিতেই যদি বলি তো বলতে হয়: কারাগারে থাকা আবারও প্রেমে পড়ার মতোই ব্যাপার।
কারাগারের জানলা বন্ধ হলে পরে, হৃদয় ভেবেছে
তোমার সিথিঁ বুঝি তারায় তারায় ঝলমল, একি!
চমকে উঠেছে যখন শেকল, তখন জেনেছি আমি
প্রভাতের আলোয় আলোকিত তোমার মুখ দেখি!
এতে আমার সামান্যই সন্দেহ আছে যে, ফয়েজ মৃত্যুর আগে আগে টের পেয়ে গিয়েছিলেন, পূর্বাভাষ পেয়েছিলেন। তা যদি না-ই হয় তো তার লেখা শেষ কবিতার ব্যাখ্যা কেউ কিভাবে করবে?
মরনেরও আছে আপন কিছু নিয়ম
জানিনা তালিকায় আজ কার নাম, জানে কেবল যম।
ফয়েজ জন্মেছিলেন কালা কাদির গ্রামে। এখানেই তিনি তার জীবনের শেষ দিনগুলিও কাটাতে চেয়েছিলেন। গ্রামের নাম বদলে নিজের নামে ‘ফয়েজ নগর’ রেখেছিলেন। ফয়েজের কাছে দুনিয়াতে এর চেয়ে দস্তুর জমিন আর হতেই পারে না।
[অনুবাদ: জামিল আহমেদ,
লালবাগ, এপ্রিল, ২০২২]
জামিল আহমেদ
Latest posts by জামিল আহমেদ (see all)
- ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (১৯১১ – ১৯৮৪) – খুশবন্ত সিং - এপ্রিল 15, 2022
- দীপেশ চক্রবর্তী’র জনজীবনে ইতিহাস - নভেম্বর 25, 2016
- জোসেফ কুদেলকার লগে মোলাকাত - সেপ্টেম্বর 19, 2016