কেচ্ছা কাহিনি (১)
এখন না স্ক্রীণশট (মেসেঞ্জার, ভাইবার বা হোয়াটসঅ্যাপে’র) দিয়া সিক্রেট জিনিস’রে পাবলিক করার একটা তরিকা বাইর হইছে, কিন্তু তারপরও, কেচ্ছা-কাহিনি জিনিসটা তার ভিজিবিলিটি’র উপরই বেইজ করে না। বরং বলা’টা অনেকটা একতরফা টাইপের ব্যাপার; পাবলিকলি, প্রাইভেটলি বা সিক্রেটলিই ঘটুক। আর এই ঘটনাগুলি কেচ্ছা-কাহিনি হিসাবে কওয়ার রেওয়াজ আছে ওয়ান টু কথা-বার্তা, আড্ডাতে বা পাবলিক আলাপেও। স্ক্যান্ডালও কওয়া যায় কিছু ঘটনা’রে। কিন্তু ডিটেইলগুলি খুব স্ট্রং কোন রেফারেন্স দিয়া প্রমাণ করা’টা টাফ। এইরকম সোশ্যাল, পলিটিক্যাল, আর্ট-কালচারের কিছু কেচ্ছা-কাহিনি এই সিরিজে রাখার ইচ্ছা আছে আমরা’র।
——————————————————————–
লাঁকা আর দেল্যুজ
জিল দেল্যুজ (১৯২৫-১৯৯৫) মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে, আরেক ফরাসী দার্শনিক Didier Eribon তারে জিগাইছিলেন লাঁকা’র (১৯০১-১৯৮১) লগে উনার যোগাযোগ কেমন আছিলো। দেল্যুজ তারে তখন একটা কাহিনি শোনাইছিলেন, যেইটা ছিল, এইরকম:
‘লাঁকা আমার একটা বই (মাসোইজম: কোল্ডনেস এন্ড ক্রুয়েলিটি, ১৯৬৭) নিয়া আলোচনা করছিলেন উনার এক সেমিনারে। লোকজন আমারে এইটা নিয়া কইছিলো, যদিও আমি এর চাইতে বেশি কিছু জানতাম না যে, উনি আমার বই নিয়া এক ঘন্টারও বেশি সময় কথা কইছিলেন। এরপর তিনি লিয়েনে একটা সেমিনারে আইছিলেন, যেইখানে আমি তখন পড়াইতাম।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
ওইখানে উনি একটা সিরিয়াস ওয়াজ করলেন… উনি উনার বিখ্যাত ফর্মূলার কথা কইলেন যে, “সাইকোঅ্যানালাইসিস সবকিছুই করতে পারে, খালি একটা ইডিয়টকে বুদ্ধিমান বানানো ছাড়া।” সেমিনারের পরে উনি আমরা’র লগে ডিনার করতে আইছিলেন। যেহেতু উনি খুব দেরি কইরা ঘুমাইতে যাইতেন, অনেক লম্বা সময় উনি আছিলেন। আমার মনে আছে, যখন মাইঝ রাত পার হইয়া গেছে তখন উনার একটা স্পেশাল হুইস্কি খাওয়ার বাই উঠলো। বিলিভ মি, ওইটা একটা ভয়াবহ রাত আছিলো।
উনার লগে ওয়ান টু ওয়ান দেখা হওয়ার ঘটনাটা ঘটছিলো এন্টি-অডিপাস পাবলিশ হওয়ার পরে। আমি শিওর আছিলাম যে, উনি এইটা ভালোভাবে নেন নাই। উনি চেতছিলেন আমার এবং ফেলিক্সের উপ্রে। কিন্তু এর কয়েকমাস পরে উনি আমারে খবর পাঠাইলেন, দেখা করার লাইগা। আর অন্য কোন কথা কন নাই। খবরটা হইলো, ‘উনি আমারে দেখতে চান’। তো, আমিও গেলাম। উনি আমারে উনার ওয়েটিং রুমে বসায়া রাখলেন।
ঘরটাতে আরো অনেক মানুষজন আছিল, আমি জানতাম না উনারা কি রোগী, ভক্ত না সাংবাদিক। উনি আমারে অনেক সময় ধইরাই অপেক্ষা করাইলেন। মানে, বেশ একটু বেশি সময়ই, মানে একই তো ব্যাপার। শেষে উনি আমারে ভিতরে ডাকলেন। উনি তার সব ভক্তদের একটা লিস্ট দিলেন আর কইলেন যে, অরা সবাই হইতেছে আকাইম্মা (একমাত্র জেঁকুইস-এলান মিলারকে নিয়াই উনি কোন বাজে কথা কন নাই)। আমার হাসি পাইলো, কারণ Binswangerও আমারে এইরকম একটা ঘটনার কথা কইছিলেন: ফ্রয়েড বাজে কথা কইছেন জোনস, আব্রাহাম এদের সর্ম্পকে এবং Binswangerও বুঝছিলেন যে, ফ্রয়েডের সামনে না থাকলে উনি তারে নিয়াও এইসব কথা-ই কইবেন। তো লাঁকা কথা কইতেছিলেন আর সবাইরে দোষী করতেছিলেন, এক মিলার’রে ছাড়া। আর তারপর উনি আমারে কইলেন যে, “আমি এখন তোমার মতো কাউরে চাই।” ’
লাঁকা’র এই প্রেম প্রস্তাবে দেল্যুজ কোন সাড়া দিছিলেন কিনা জানা নাই। কারণ এরপর লাঁকার সাথে দেল্যুজের যোগাযোগের কথা কোথাও শুনি নাই।
[ইন্টারনেটে কোন এক ব্লগে এই জিনিস পাইছিলাম, ২০০৭/৮-এর দিকে। লিংক সেইভ করা হয় নাই।]
রবার্ট ফ্রস্ট আর ট্রুম্যান ক্যাপোটি
এই কাহিনি’টা কয়েকটা সোর্সে পাওয়া যায়, ট্রম্যান কেপোটি’র একটা ইন্টারভিউ’র বইয়েও আছে। মানে, কেপোটি’র ভার্সনটাই জানা যায়, ঘটনার।
ট্রুমান ক্যাপোটি দ্য নিউ ইয়ার্কার-এ কপি রাইটারের কাম করতেন। তো, উনি ভেরমন্টে গেছেন ছুটি কাটাইতে। যেই হোটেলে উঠছেন সেইখানে রবার্ট ফ্রস্ট আসছেন কবিতা পড়তে। ক্যাপোটি’র তখন জ্বর। কিন্তু হোটেলের ম্যানেজার যেহেতু জানেন যে, ক্যাপোটি নিউ ইয়র্কারে কাম করেন, উনারে কইলেন প্রোগ্রাম দেখতে আইতে। ক্যাপোটি গেলেন, কিন্তু যাওয়ার পরে মনে হইলো বেশি অসুস্থ লাগতেছে। তখন উইঠা চইলা আইলেন। আর তখন রবার্ট ফ্রস্ট কবিতা পড়তেছিলেন। উনার কবিতা পড়ার টাইমে কেউ উইঠা চইলা যাইতে পারে! উনি খুবই চেইতা গেলেন। পরের দিন নিউ ইয়র্কারে’র ফোন দিয়া কইলেন, ‘তোমার এই ক্যাপোটি’টা কেডা?’
এই ঘটনার কারণেই নাকি ক্যাপোটি’র চাকরি চইলা যায়। আর ক্যাপোটি রবার্ট ফ্রস্টের পোর্টেট করছেন এইরকমভাবে: ‘the meanest man who ever drew breath, an old fake dragging around with a shaggy head of hair and followed by pathetic old ladies from the Middle West.'”
ফজিলাতুন্নেসা আর কাজী নজরুল ইসলাম
এই কাহিনি’টা পাওয়া যায় কাজী মোতাহার হোসেনের ‘স্মৃতিকথা’ [নবযুগ প্রকাশনী, এপ্রিল ২০০৪] বইয়ে। বইয়ের লেখাটাই পড়তে পারেন, কাজী মোতাহার হোসেন যেমন কইছেন কাহিনি’টারে :
যতদূর মনে পড়ে ১৯২৮ সালে নজরুলের দ্বিতীয়বার ঢাকা আগমনে কুমারী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় নিয়ে একই ধরণের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়। ফজিলাতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীণানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম.এ. এবং একজন উঁচুদরের বাকপটূ মেয়ে। তিনি আমার বান্ধবী ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে শুনেছিলেন যে কবি একজন সৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্করেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেইসঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষীর মত সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন। ঘণ্টাখানেক পরে আমরা ফিরে এলাম। রাত্রে খাবার পর প্রতিদিনকার অভ্যাসমত আমরা শুতে গেলাম। তখন রাত প্রায় এগারোটা হবে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর হওয়ার আগে জেগে উঠে দেখলাম নজরুল নেই। বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম নজরুল কোথায় যেতে পারে। সকালে নাস্তার সময় তিনি ফিরে এলেন এবং তাঁর অমনভাবে অদৃশ্য হওয়ার কারণ বললেন:
রাত্রে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখলাম একজন জ্যোতির্ময়ী নারী তাকে অনুসরণ করার আমাকে ইঙ্গিত করছে। কিন্তু জেগে উঠে সেই দেবীর পরিবর্তে একটা অস্পষ্ট হলুদ আলোর রশ্মি দেখলাম। আলোটা আমাকে যেন ইঙ্গিতে অনুসরণ করতে বলে, আমার সামনে সামনে এগিয়ে চলছিল। আমি বিস্ময় ও কৌতুহল নিয়ে কিছুটা অভিভূত হয়ে সেই আলোকরেখার অনুসরণ করছিলাম। মিস ফজিলাতুন্নেসার গৃহের কাছে না পৌঁছান পর্যন্ত আলোটা আমার সামনে চলছিল। তাঁর বাড়ীর কাছে পৌঁছতেই আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি দেখলাম একটি ঘরের মধ্যে তখনও একটি মোমের বাতি জ্বলছে। রাস্তার ধারের জানালার কাছে সম্ভবতঃ পথিকের পায়ের শব্দ শুনে গৃহকর্ত্রী এগিয়ে এসে ঘরের প্রবেশ-দরোজা খুলে দিলেন এবং মিস ফজিলাতুন্নেসার শয়ন-ঘরের দিকে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। কুমারী নেসা তাঁর শয্যার উপর গিয়ে বসলেন আর আমি তাঁর সামনে একটি চেয়ারে বসে তাঁর কাছে প্রেম যাচনা করলাম; তিনি দৃঢ়ভাবে আমার প্রণয় নিবেদন অগ্রাহ্য করলেন।
এই হচ্ছে সামগ্রিক ঘটনা – একে মানসচক্ষে নিয়ে আসা কিংবা এর রহস্যোদঘাটন করা অত্যন্ত কঠিন। সূর্য ওঠার পর কোথায় ছিলেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: ঐ ঘটনার পর নিরতিশয় ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ি; তাই ভোর বেলা রমনা লেকের ধারে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিলাম।
…ঐদিন দুপুরে লক্ষ করলাম ফজিলতের গলার লম্বা মটর-মালার হারটা ছিঁড়ে দুখান হয়ে গিয়েছে। পরে সেটা সোনারুর দোকান থেকে সারিয়ে আনতে হয়েছিল। অত্যন্ত কাছ থেকে জোরাজুরি ছাড়া এমন একটা কান্ড কেমন করে ঘটতে পারে আমার পক্ষে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। নজরুল ইসলাম আমার কাছে ও ফজিলাতুন্নেসার কাছে যেসব দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় এমন অঘটন কিছু ঘটেছিল যাতে ফজিলতের হৃদয় তিনি জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ঐসব চিঠিপত্র নজরুলের হৃদয়ের গভীর হাহাকার ব্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের সত্যতা সম্বন্ধে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। এক্ষেত্রে নোটের ব্যাপারে যেমনটি ঘটেছিল ফজিলতে ব্যাপারেও ঠিক তা-ই ঘটেছিল।
আমার বন্ধু নজরুল: তাঁর গান (প. ১১৩ – ১১৪)
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- ঢাকা শহরের বইয়ের দোকান - ডিসেম্বর 4, 2023
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৩ - সেপ্টেম্বর 28, 2023
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৯) - জুলাই 28, 2023