Main menu

লুঙ্গি পইরা লিটফেস্টে… ।। কে এম রাকিব ও তুহিন খান ।।

লুঙ্গি কি নিষিদ্ধ পরিধেয় এই দেশে? 

কে এম রাকিব

আজকে লিটফেস্টে চমকপ্রদ ঘটনা ঘটছে।

এইবার লিটফেস্টের আগের দিনগুলিতে যাইতে পারি নাই। আজকে শেষ দিনে ভাবলাম যাই একবার। কয়েকজন ডিসাইড করলাম লুঙ্গি পরে গেলে কেমন হয়?

যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমরা কয়েকজন লুঙ্গি পরে চলে গেলাম। এবং গিয়া বুঝলাম লুঙ্গি না পরে গেলে শিল্প-সাহিত্য-শ্রেণি-রাজনীতির অনেক কিছুই বোঝা বাকি থাকতো, কাগু!

আমাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় নাই। যদিও সরাসরি বলা হয় নাই যে লুঙ্গির কারণে আপনাদের ঢুকতে দিবো না, কিন্তু আচরণে সেইটাই বুঝায়ে দেওয়া হইছে।

ঘটনা বিস্তারিয়া বলি।

আমরা আনুমানিক ছোয়া ছয়টার দিকে বাংলা একাডেমির গেটে যাই। আমরা কয়েকজন লুঙ্গি পরা ছিলাম। আমাদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার ঠিক পূর্বমুহূর্তেও লোকজন ঢুকতেছিলো!

তখন গেটের দায়িত্ব থাকা পুলিশ কর্তৃপক্ষের অজুহাত দিছে। এই এক আজব এক অজুহাতের সিলসিলা দেশে আছে! এক কথা কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে/ কর্তৃপক্ষ বলছে। অথচ সময়মতো কর্তৃপক্ষ খুজে পাওয়া যায় না। আজকেও আমরা ওখানে দায়িত্বরত ব্যক্তি বা ভলান্টিয়ার বা পুলিশ কারো কাছে জিগায়েও জনাব ‘কর্তৃপক্ষ’র দেখা পাইলাম না।

বরং পাইলাম ভলান্টিয়ার ও পুলিশের আমাদের লুঙ্গির দিকে অদ্ভুত চোখে তাকানো। যেন ‘এই প্রাণীগুলা কই থিকা আসছে?’

আবার গেটের বাইরে কয়েকজন পুলিশ দায়িত্বে ছিলো। আমাদের দেখে তারা নিজেদের মধ্যে বললো, আমরা চা খায়া আসি। বলে তারা গেট থেকে সরে গেছে। গেটের কাছে ভেতরে সিভিল পোষাকে এক জন ছিলো। ‘আমি কিছু জানি না’ বলে সেও বিরক্তি নিয়া ভেতরে চলে গেছে।

এমনকি সাউন্ড সিস্টেমের একজন লোক, তার কার্ড দেখানোর পরেও, লুঙ্গি পরা আমরা তার পাশে ছিলাম বলে তাকেও ঢুকতে দেওয়া হয় নাই।

‘কেন ঢুকতে দেওয়া হবে না’র ব্যাপারে একজন পুলিশ কথা বললেন পরে। সেই পুলিশ জানাইছে, কর্তৃপক্ষ বলছে সাড়ে ৬ টায় বন্ধ করতে।

অথচ আমরা সোয়া ছয়টায় গেটে ছিলাম!

ঢাকা লিট ফেস্টের ব্যানার, উনাদের ওয়েবসাইট থিকা নেয়া।

ঢাকা লিট ফেস্টের ব্যানার, উনাদের ওয়েবসাইট থিকা নেয়া।

 

আমাদেরকে এক গেট থেকে অন্য গেটে পাঠানো হয়। সেই গেট থেকেও ঢুকতে দেওয়া হয় নাই। আবার আগের গেটে ফেরত পাঠানো হইছে।

কয়েকটা প্রশ্নঃ

যদি রেজিস্ট্রেশন করতে দেওয়া হইলো, কিন্তু ঢুকতে দেওয়া হয় নাই। তাহলে রেজিস্ট্রেশন বুথ কেন বন্ধ হয় নাই বা সেখান থেকে কেন বলা হয় নাই যে এখন ঢুকতে দেওয়া হবে না? রেজিস্ট্রেশন বুথ খোলা ছিলো সাড়ে ৬টা পর্যন্ত।

যদি লুঙ্গি পরে ঢুকতে দেওয়া না-ই হবে সেইটা আগে কেন জানানো হবে না?

লিটফেস্টে নির্দিষ্ট ড্রেস কোড জাতীয় কোন কিছু যদি থেকে থাকে, তা থাকতে পারে, (ব্রিটিশ আমল যেমন ক্লাবের সামনে নোটিশ থাকতোঃ নেটিভ আর কুকুরের প্রবেশ নিষেধ) তা আগে জানাবে না কেন?

সবার জন্যে উন্মুক্ত একটা আয়োজনে এমন আচরণ কেন?
আর জনাব ‘কর্তৃপক্ষ’ কী করতেছিলেন? তার দেখা পাওয়া যায় নাই কেন?

আর সবচাইতে জরুরি যে প্রশ্ন তা হইতেছেঃ

লুঙ্গি জিনিসটা ‘ছোটলোক/গরিব’-এর পরিধেয় হিসাবে ট্যাগ খাওয়া নিষিদ্ধ পোষাক নাকি এই দেশে?

যদি নিষিদ্ধই হয় কারা ঠিক করলো যে এই দেশে লুঙ্গি নিষিদ্ধ পরিধেয়?

জাস্ট ইম্যাজিন, ভিতরে বাউলদের গান হইতেছিলো, লোক সংস্কৃতি -মংস্কৃতি হইতেছিলো।

অথচ বাংলার সবচাইতে পরিচিত পরিধেয় লুঙ্গি পরা ছিলাম বলে আমাদেরকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নাই! এর চাইতে আইরনিক ব্যাপার আর কি হইতে পারে?

 

লুঙ্গি পইরা লিটফেস্টে যাওয়া যাবে না কেন?

তুহিন খান

লুঙ্গি পরা নিয়া এই দেশে অনেক ঘটনাই তো ঘটলো। সেইগুলা আমরা প্রত্যক্ষ করি নাই। কিন্তু এই দেশে লুঙ্গি পরা যে কত বড় বালা, আজকে কিছুটা প্রত্যক্ষ করা গেলো।

ঘটনা তেমন কিছুই না। লিটফেস্টের শেষের দিন আমরা কয়েকজন ভাবলাম যে, আজকে লাস্ট সেশনে বাউল গান হবে, হালকা কইরা ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ চর্চা-টর্চা হবে, তো আমরাও হালকা বাঙালি ড্রেসে যাই না কেন! এইরকম ভাইবা, আমরা কয়েকজন গেলাম লুঙ্গি পইরা।  রেজিস্ট্রেশন কইরা সোয়া ছয়টায় সবাই গেটে যাই। আমরা যাওয়ার আগ পর্যন্তও লোকজন ঢুকতেছিল, কিন্তু আমরা যাওয়ার সাথেসাথেই গেট বন্ধ। ভালো কথা। আমাদের বলা হইলো, এক্সিট গেটে যান, ওইখান দিয়া ঢোকেন। গেলাম এক্সিট গেটে। কিন্তু সেইখানে মোটামুটি দাঙ্গা লাগার মত অবস্থা। মুহুর্মুহু পুলিশের বাঁশিতে এলাকায় ছোটখাটো একটা আতঙ্ক ছড়ায়ে গেলো। আমরা আবার ফিরা আসলাম প্রথম গেটে। সেই গেট ততক্ষণে ফুল বন্ধ। বাইরে ডিউটিরত পুলিশেরা ‘চল আমরা চা খাইয়া আসি’ বইলা চইলা গেলেন। ভলান্টিয়াররা আমাদের পরিধেয়র দিকে কড়া কড়া লুক দিয়া ‘ইটস নট আওয়ার বিজনেস’ বইলা স্থান ত্যাগ করলেন। গেটের ওইপাশের দারোয়ান তার রুমে ঢুইকা দরজা আটকায়ে দিলেন। আলাপ-আলোচনা করার মত কেউ তখন আর গেটে নাই।

অবশেষে, চিন্তিত ও বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়া এক পুলিশ অফিসার আগায়ে আসলেন। তিনি আমাদের বললেন যে, সাড়ে ছয়টা, আই মিন, ৬:৩০-এ গেট আটকায়ে দিতে বলা হইছে। আমরা সাড়ে ছয়টার আগেই আসছি জানাইলে তিনি বলেন, ‘এইটা আমি জানি না, কর্তৃপক্ষ জানে।’ এই কর্তৃপক্ষ আসলে কে বা কারা তা আর আমরা খুঁইজা পাই নাই। এর মধ্যে মোটামুটি সব ক্লোজ কইরা ফ্যালা হয়। ইভেন, ওইসময়, লিটফেস্টের সাউন্ড ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা একজন তার কার্ড দেখায়ে ভেতরে ঢুকতে চাইলেও তারে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় নাই। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার!

এখন, আমাদের প্রশ্ন এই যে:

১/ যদি সাড়ে ছয়টার পরে গেট অফ করার বিধান থাকে, তাইলে রাত সাতটা-সোয়া সাতটা পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন বুথ খোলা রাইখা, লম্বা লাইন ধরায়া লোকজনরে রেজিস্ট্রেশন করতে দেওয়ার মানে কী? এই রেজিস্ট্রেশন কি তারা আগামী বছর কাজে লাগাবে?

২/ সাড়ে ছয়টায় গেট বন্ধ করার নিয়ম, ভালো কথা। কিন্তু আমরা গেছি এপ্রোক্সিমেটলি ৬:২০-এ। এবং আমাদের যাওয়ার একটু আগ পর্যন্তও লোকজন ঢুকতেছিলো। তাইলে, আমরা কি এইটারে কেবল লুঙ্গির কারিশমাই ধইরা নেব? নিলে কি খুব গুনাহ হবে?

৩/ পুলিশ গেল চা খাইতে। ভলান্টিয়াররা বলেন, ‘নান অব মাই বিজনেস’। দারোয়ান রুমে ঢুইকা দরজা লাগায়ে দ্যায়। অফিসার বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ’। এতগুলি মানুশ যদি কিছুই না বলতে বা করতে পারে, তাইলে এদের রাখার দরকার কী? কে সেই কর্তৃপক্ষ, যে খোদার মত অদৃশ্য আসমানে বইসা এদের পুতুলের মত সাজায়ে রাখছে? নাকি, আসলে সবই এই লুঙ্গির ‘কেরামতি’?

৪/ আমাদের এক গেট থেকে আরেক গেটে পাঠানো, সেই গেট থেকে আবার প্রথম গেটে পাঠানো, এগুলি সন্দেহজনক। সরাসরি না করলেই তারা পারতেন। এই ধরণের ঘোরানো-প্যাঁচানো আমাদের সন্দেহরে গাঢ় কইরা তোলে।

৫/ লিটফেস্টের কোন ড্রেসকোড আছে বইলাও তো আমরা জানি না। তাইলে, কেন কর্তৃপক্ষের এই রহস্যময় আচরণ?

নাটকের লাস্ট সিনটা মজার। ভেতরে তখন তুমুল আওয়াজে চলতেছে শহুরে এলিটদের সংস্কৃতিচর্চার করুণ ব্যবস্থা–‘ফোক’গান। আর বাইরে আমরা কয়েকজন মানুশ, সম্ভবত লুঙ্গিপরার ‘অপরাধ’-এ সেই গানের আসরে অংশী হইতে পারতেছি না। কারণ, কর্তৃপক্ষ চান না যে, আমরা লুঙ্গি পইরা ফোকগান শুনি। হাফপ্যান্ট পইরাও লোকে ঢুকতে পারে, কিন্তু লুঙ্গি পরলে বিপদ। কেন? আমরা জানি না। হাজার বছরের আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির ‘কর্তৃপক্ষ’ জানে। কী এক ‘কর্তৃপক্ষ’র দেশে আমাদের করুণ লুঙ্গিপরিহিত বসবাস!

 

45949452_310027376392966_6492126385421680640_n

The following two tabs change content below.

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →