ফাইজলামির পলিটিক্যাল ইকোনমি
মনে করা যাক, আপনার মন খারাপ। খুব মন খারাপ। বিষাদমাখা একটা স্ট্যাটাস দিলেন। দেখতে চাইলেন বন্ধুরা সিম্প্যাথেটিক কিনা আপনার প্রতি। হইলেও কতটুকু।
অথবা এসব কিছু না ভেবেই এমনি বিষণ্ণ কিছু লিখলেন।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
অনেকে কৌতূহলী কমেন্ট করলো। কেউ জানালো সমবেদনা।
কিন্তু এগুলার মধ্যে যেইটা আপনার নজরে বিশেষভাবে পড়বেঃ বন্ধুদের মধ্যেই কেউ হয়তো কমেন্ট করে বসলোঃ
দোস্ত, হালকা মুতে শুয়ে পড়!
কী করবেন আপনি?
কিংবা ধরেন, , সিরিয়াস কোনো বিষয়ে আপনি অনেক পরিশ্রম করে একটা লেখা লিখলেন।
জনৈক কমেন্ট করলোঃ
অসম্ভব ভালো লিখেছেন। এক কথায় অনবদ্য। বহুদিন পরে একটা ভালো লেখা পড়লাম। রবীন্দ্রপরবর্তী যুগে এরকম লেখা আর আসেনি। উত্তরাধুনিক ভাবসম্পন্ন এই লেখাটি শুধু যে মৌলিক, প্রাসঙ্গিক ও সময়-উপযোগী তা-ই নয়, একেবারে সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন।
তৃতীয বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আমরা যখন সাম্রাজ্যবাদীদের চোখ রাঙ্গানো আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শিকার হয়ে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে; ঠিক তখনি, ঠিক সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আপনার এই পোস্টের মাঝে আমি খুঁজে পাচ্ছি অন্ধকার ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি সম্ভবনা আর বিদেশী বেনিয়াদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব গ্রহন করার বিপক্ষে একটি সুক্ষ্ম বার্তা। ( বাংলায় এই ভারবোজ রেডিমেড কমেন্টগুলি নতুন ঘটনা না , গুগল করে দেখলাম সবচেয়ে পুরনোটা অন্তত ২০০৮ সালের আগে। এই কমেন্টের স্রষ্টার একটা পুস্কার পাওয়া ফরজ)
তখন আপনার কেমন লাগবে?
বিরক্তি, রাগ, ক্রোধ যাই হোক না কেন আপনাকে হজম করতে হবে। দুইটামাত্র অপশন আছে আপনার হাতে।
এক, হে হে করে, ইমো দিয়ে আপনিও মজা পেয়েছেন এমন একটা ভঙ্গি নিতে পারেন।
দুই, চুপ মেরে যেতে পারেন।
এর বাইরে কিছু করতে গেলে নিজেকেই বিব্রত করে ফেলবেন। ফাইজলামিকে গাম্ভীর্য বা কোনো প্রকার র্যাশনাল আর্গুমেন্ট দিয়ে মোকাবেলা করা যায় না।
ফাইজলামির একটা সীমা আছে, – খুবই কমন একটা কথা। বলা হয় সাধারণত ফাইজলামিতে বিরক্ত হয়ে। কিন্তু বাস্তবে, ফাইজলামির কোনো সীমা পরিসীমা নাই।
দুঃখের আছে, শোকেরও। তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের ধারণা, শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর। ফাইজলামির কোনো সীমা নাই। বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূল্য আছে ফাইজলামির।
ফাইজলামি শব্দটারে প্রশস্ত অর্থেই ব্যবহার করতেছি আমি। ননসিরিয়াস, হিউমারাস, ঠাট্টামূলক এক্সপ্রেশন ইত্যাদি অর্থের ক্লাস্টার হিসেবে ফাইজলামি শব্দটাকে ধরে নিতেছি।
এমনকি খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে, ‘ফাইজলামি’ শব্দটাই ‘ফাজলামি’ বা ‘ফাজলামো’ শব্দের চাইতে একটু হলেও বেশি ‘ফাইজলামি’-বোধ সম্পন্ন! মানে হালকা। কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্যলেস। যেমন, ‘হোসাইন’ নাগরিক কানে ‘হোসেন’-এর চেয়ে একটু হলেও স্মার্ট মালুম হয়। যেমন হাছান এর চেয়ে হাসান বানানটা স্মার্ট লাগে।
ফাইজলামির যে আর্থো-রাজনৈতিক মূল্য আছে, বুঝতে পারবেন যখন শুনবেন সিআইএ-রও অফিসিয়াল টুইটার একাউন্ট আছে এবং প্রথম সেলফ-ডেপ্রিসিয়েটিং টুইটটা হলোঃ
We can neither confirm nor deny that this is our first tweet.
যারা দুনিয়ায় গুম খুন করতে ওস্তাদ, শত্রুদের নিকেশ করে দেয়ার চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত, তাদেরকেও ফাইজলামির সুর ধরতে হয়। সিরিয়াসনেসরে চেপে রেখে হিউমারাস একটা ভয়েস আরোপ করতে হয়। তাহলে বোঝেন আমি এই নন-সিরিয়াসনেস, যাকে আমি বলতেছি ফাইজলামি, কতখানি গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠছে।
একসময় ছিল অনেক কমেডিয়ান, এস্টাবলিশমেন্ট, ক্ষমতাবান, টাইর্যান্টদের বিরুদ্ধে রেবেলিয়াস হিউমার ব্যবহার করতো। অনেকে জেল খেটেছেন। লেনি ব্রুস, জর্জ কার্লিনের মতো কমেডিয়ানরা।
সেদিন হয়েছে বাসি। কমেডির মোজেজা টের পেয়ে গেছেন আধিপত্যের প্রভুরা। এখন হিউমার জাস্ট একটা অস্ত্র। যে যার সাধ্যমত এই অস্ত্রের ব্যবহার করে।
এজন্যে বোঝা দরকার ফাইজলামি কিভাবে কাজ করে , কত রকম কাজ করে। ফাইজলামিযুক্ত এক্সপ্রেশন গুলার স্বভাবচরিত্র কেমন।
ফাইজলামির সীমা নাই কারণ এ জিনিস একবার শুরু হইলে থামার চান্স নাই। তখন এন্টি-হিউমারের মতো, গম্ভীর বা সিরিয়াস হওয়াটাও এক ধরনের ফাইজলামি!
ফাইজলামিসুলভ এক্সপ্রেশন বেশ কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা দেয় যা অন্যকোনো ভাবে পাওয়া যায় না।
১.
কিছু বলে একইসাথে আবার ডিনাই করা।
আপনি যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়েন যখন, কিছু বলতেও হয়, আবার বলা রিস্কও, বললেও আবার অস্বীকার করতে হয়, (হ্যা এই মহানকালে জটিল জীবনে এইরকম সিচুয়েশনে বহুবার পড়তে হয়) তখন ফাইজলামিকে কাজে লাগান। হাসির ইমোটিকন দেওয়া অনেক মেসেজ বা কমেন্ট দেখলে এখন থেকে একটু সময় দিয়ে পড়েন। পাইলেও পাইতে পারেন প্রফুল্ল বেদন!
২.
যেকোনো আবহাওয়ারে হালকা ও ঝাপসা করে দেওয়া।
বেফাঁস বা কাউকে হার্ট করার মতো কিছু বলে ফেললে, আপনি যে হে হে করে হেসে পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করেন, যদিও অসচেতনভাবেই হয়ত করেন, পেছনের মেকানিজম হইতেছে ডিফেন্স মেকানিজম। খুব খিয়াল কইরা।
ভুলভাল কিছু বলার পরে, জাস্ট কিডিং বা ফান করতেছি টাইপের বাক্য বেশ ভালো কাজে আসে।
৩.
বিশেষত, ফেস-টু-ফেস আলাপে, ফাইজলামির সামনে সমস্ত আর্গুমেন্ট, প্রমাণ সাক্ষীসাবুদ, ভালনারেবল হয়ে পড়ে। আপনি তর্কে হেরে যাইতেছেন, কোনোভাবেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারতেছেন না। কোনো মজার জোক, বা হাসির এনেকডোটকে আপনার যুক্তির পক্ষে প্রজেক্ট করুণ। অপোনেন্ট ধরাশায়ী। তৎক্ষণাৎ।
৪.
যেখানে আপনার কোনো সামর্থ নাই, ক্ষমতা নাই, যুক্তি নাই। সেখানেও আছেন জনাব আক্রমণাত্মক ফাইজলামি । মকারি। অব্যর্থ জিনিস। এই জিনিস, একেবারে, গ্রুদেবের ভাষায়, ‘মরমে গিয়া পশে’।
অবশ্য মকারি সবাই করতে পারে দূর্বল যেমন করে সবলও করে। সবল বেশি করে।
৫.
এমন বক্তব্য যা অন্যকে আহত করতে পারে, বা রুড বলে মনে হইতে পারে, ফাইজলামির সুরে বলেন, প্রশমিত হয়ে যাব অনেকখানি।
ইন্ট্রেস্টিং হওয়ার দৌড়ে যখন সবাই ছুটতেছে, তখন এইসবক্ষেত্রে সচেতন থাকা ভালো।
অবস্থা এমন যে সিরিয়াস এমনকি স্বাভাবিক কথাবার্তা বললেও পরমুহূর্তেই ইমোসহ আবার বলতে হয়, খুব জ্ঞান দিয়ে দিলাম! উলটা দিকে, আবেগের কথা বললে, সঙ্গে সঙ্গে বলতে হয়, যেন কারেকশন দেওয়া হইতেছে, ‘খুব আবেগ ঢেলে দিলাম!’ এইটা হয়তো সেন্টিমেন্টাল ট্যাগ খাওয়ার ভয় থেকে।
আধুনিক, রোমান্টিক হতে চাওয়া কিন্তু আবার সেন্টিমেন্টাল হবার আতঙ্ক। জ্ঞানী কিন্ত খুব ফানি পারসোনা চাই- কিন্তু আবার চটুলও না, যাতে ব্যক্তিত্ব ধ্বসে না পড়ে। একইসাথে কোনো কিছুতে এক্সপার্ট হবো কিন্তু গিক হওয়া যাবে না। এইরকম মনোজাগতিক কনফিউশন থেকেই হয়তো এই এক্সপ্রেশনগুলার জন্ম।
অবশ্য এইক্ষেত্রেও একটা প্যারাডক্স আছে, যেইখানে কমবেশি সবাই ইন্ট্রেস্টিং হওয়ার দৌড়ে রত, সেখানে কখনো কখনো ইক্সেন্ট্রিক, নার্ড বা আনকুল হওয়াটাও এক অর্থে ইন্ট্রেস্টিং হওয়া। যেহেতু ভিড়ের মধ্যে আলাদা হওয়া যায় তাতে। ইউনিকনেস আবার মজার লোকদেরই বৈশিষ্ট্য। সো, কায়দা মতো বিহেভ করেন।
কি লেখতে গিয়ে কোথায় আসলাম!
যা হোক, একটা গল্প বলে শেষ করি।
অনেক সময় পরিস্থিতি বুঝতে তত্ত্ব বা সফিস্টিকেটেড আর্গুমেন্টের চাইতে একটা মেটাফোর বা গল্প বেশি সহায়ক হইতে পারে। কমিনিউকেশন তাত্ত্বিকরা যারে বলেন, ইনডিরেক্ট কমিউনিকেশন।
গল্পটা আমার না, কির্কেগার্দের। আমার মতো করেই বলি। সম্ভবত ‘আইদার-অর’ বইয়ে পড়ছিলাম। ঠিকমতো মনে নাই। গুগল স্মৃতিশক্তি ড্যামেজ করে দিতেছে আমাদের। ১৪শো বছর আগে গুগল থাকলে, এতো এতো কোরানে হাফেজ তখন আমরা পাইতাম না। অবশ্য, সিআইএ’র টুইটের মতো করে বলতে পারিঃ We can neither confirm nor deny that it was written by Kierkegaard.
আনন্দময় অগ্নিকান্ড
থিয়েটারে, পেছনের মঞ্চে আগুন লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত জায়গায় আগুণ ধরে যেতে পারে এমন সিচুয়েশন।
ক্লাউন বাইরে চলে আসছে দর্শকদের জানাইতে। তারা ভাঁড়ামি মনে করে হর্ষধ্বণি করে উঠল, মুখে আঙুল দিয়া শীস বাজাইলো। ক্লাউন যতই মুখ গম্ভীর করে, সিরিয়াসলি তাদের বলতে চায় আগুণ লাগছে, পালান, দর্শকরা তত বেশি মজা পায়।
এই হলো পরিস্থিতি। নৈরাশ্যবাদী কির্কেগার্দ লিখছেনঃ
‘তাই আমি বিশ্বাস করি, সমস্ত বোধশক্তি থেকে পৃথিবী সাধারণ হর্ষধ্বণির মধ্যে লীন হবে, তারা ভাববে এটা একটা কৌতুক।‘
আমি কির্কেগার্দের মতো এতটা নৈরাশ্যবাদী না। ফলে, এই লেখাটাকেও আপনি জাস্ট কৌতুক হিসেবে বিবেচনা করতেই পারেন।
বিঃদ্রঃ
এই লেখাটা যদি সম্পূর্ন পড়ে থাকেন, আপনাকে অভিনন্দন। আপনি বোকা কিসিম ফেইসবুকার। দীর্ঘ পোস্ট পড়া বোকামি।
এতক্ষণে অনেকগুলা লাইক, কমেন্ট দিতে পারতেন বিভিন্নজনকে। দীর্ঘমেয়াদে যা আপনার ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কিং ও ফেবু পারসোনারে স্ট্রং করতো।
ভেরি স্যাড। আপনাকে দিয়ে কিস্সু হবে না জনাব।
০৬. ০১. ২০১৭
কে এম রাকিব
Latest posts by কে এম রাকিব (see all)
- বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ – অমর্ত্য সেন (পার্ট ১) - জানুয়ারি 25, 2024
- পলিটিক্স যা করে সাহিত্য তার চাইতেও দীর্ঘস্থায়ী বিষয়ের মামলা – মারিও বার্গাস ইয়োসা - অক্টোবর 3, 2023
- উডি এলেনের ইন্টারভিউ: সমস্যা হইতেছে ক্রিয়েটিভ হওয়ায় কিছু গ্ল্যামার আছে - জুন 2, 2022