Main menu

“মুসলমানী বাঙ্গালা” কি? – আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

This entry is part 8 of 22 in the series লেখার ভাষা

১৯২০/৩০ এর দিকে (আগে বা পরেও) এই তর্কগুলা খুব চলতো যে, মুসলমানরাও বাঙালি কিনা বা কেমনে তাদেরও কন্ট্রিবিউশন আছে বাংলাভাষায়। এইটা আরো জোরদার হইছিল দীনেশচন্দ্র সেনের পুরান পুঁথিগুলা আবিষ্কারের পরে। দেখা গেল, আরে, মুসলমানরাও তো বাংলাভাষায় লিখছে আগে! নতুন নতুন লিখতে আইছে – এইরকম তো না! চিটাগাংয়ের আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এই জায়গাটাতে আরো জোরদার কিছু তথ্য প্রমাণ হাজির করছিলেন যে, মুসলমানরাও বাংলাভাষায় লিখছেন![pullquote][AWD_comments][/pullquote]

তো, তখন রিলিভেন্ট তর্ক হাজির হইছিল যে, বাংলা-ভাষা কি হিন্দুয়ানি নাকি? বা মুসলমানী বাংলা তাইলে কি জিনিস? এখনকার সেক্যুলার দুনিয়ায় এইসব কোশ্চেন যতো ফানি-ই মনে হোক, এইসবকিছু নিয়া আলাপ হইতো বা হইছিল। এইটা এইরকমের একটা লেখা।

যেইখানে আবদুল করিম সাহেব এনকাউন্টার করতেছেন এই কোশ্চেনটারে। মাসিক সওগাতে কেউ একজন আলাওলদের লেখারে মুসলমানী বাংলা বানায়া বলতে চাইতেছিলেন যে উনাদেরকে ইগনোর করা হইতেছে। এই জায়গাতে আবদুল করিম বলতেছেন, অইগুলা মুসলমানী বাংলা না! ‘মুসলমানী বাংলা’ হইতেছে পশ্চিম-বাংলার আবিষ্কার। (খুবই ইর্ম্পটেন্ট কথা এইটা।) এই মুসলমানী বাংলায় বাংলাদেশের লোকজন তো দূর কি বাত, পশ্চিম-বাংলার মুসলমানরাও বাতচিত করে না। তাইলে এইটা আইলো কই থিকা? সাহিত্যবিশারদের দাবি, এইটা আসছে বটতলা থিকা। আর বটতলার বইয়ের পুপলারিটি ভাষার কারণে না, কাহিনির কারণে। এই  ভাষার যেহেতু কোন সাহিত্যিক ভ্যালু নাই আর সোসাইটিতে কোন চল নাই, এই সো-কল্ড মুসলমানী ভাষা টিইকা থাকার কোন কারণ নাই।

আমার ধারণা, এইখানে সংস্কৃত কলেজের বাইরে মাদ্রাসায় পড়া মৌলবীদের টেনডেন্সিটারে উনি পলিটিক্যালি সংস্কৃত-পন্ডিতদের কাউন্টার হিসাবে দেখতে রাজি হন নাই। মানে, মেনশন করছেন মুসলমানরে হিন্দু বানায়া দেয়ার ব্যাপারটা, কিন্তু অই জায়গাতে কোন কনফ্রনটেশনে যান নাই। ভাষারে শুদ্ধ বা সহি রূপেই এবং হিস্ট্রিক্যালিও একটা লিনিয়ার ফর্ম হিসাবেই দেখতে চাইছেন। যার ফলে ভাষার নানান রকমের টেনডেন্সিগুলারে এক রকমের ডিস্টরশন বইলাই ভাবছেন। তখনকার সেক্যুলার আইডিয়ায় ইউনিফর্মিটিরেই তো পূজা করা হইতো আসলে, একটা ডেফিনেশন দিতে পারাটারে, তো, সেই জায়গা থিকা স্পেশাল কোন সম্মান বা টিটকারি নিতে যে রাজি হন নাই সাহিত্যবিশারদ, সেইটাও পজিটিভ একটা ঘটনাই।  

ভাষার হিস্ট্রিক্যাল জায়গাগুলারে নজরে রাখার লাইগা এই রকমের ইস্যুগুলারে মনে না রাখতে চাওয়াটা দরকারি কোন জিনিস বইলা মনেহয় না। এই কারণে, আবার মনে করাইতে চাইলাম।

এই লেখাটা আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি থিকা ১৯৯৭ সালে ছাপানো আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচনাবলী ১ম খন্ড বই থিকা নেয়া হইছে। ৫৩০ টু ৫৩৫ নাম্বার পেইজে আছে।

/ই.হা.

… কলোনিয়াল কোলকাতায় কম্যুনাল এবং রেসিয়াল এজেন্ডা থিকা আজব একটা বাংলা পয়দা করছিল পণ্ডিত-মুন্সিরা, আমজনতার বাংলারে যেই বাংলায় ধরা হইছে ভালগার বা বিদেশি! আসল বাংলা আসলে যেন সংস্কৃত, সংস্কৃত না জাইনা বাংলা জানতে পারেন না আপনে! পরে আরেক দল ঐ ঘটনার কম্যুনাল জবাব দিছেন, সংস্কৃতরে ফার্সি পিছায় খেদাইয়া! সেই ফ্যাসাদের আখেরি ফল এখন ফলতেছে, আরো সহি হইতে চাইয়া এখন ফার্সি খেদাইয়া দিতে চাইতেছে আরবীঅলারা!

এইটারে আমি কইতেছি কলোনিয়াল লিগেসি; এইটা এতোই পোক্ত যে, ঐ দুই-তিন দল তো যায়ই নাই, এমনকি মার্ক্সের তরিকার লোকেরাও বাংলার কম্যুনাল-রেসিয়াল বোঝাবুঝি উতরাইয়া আমজনতার কাছে যাইতে পারে নাই! বাংলা যে বাংলাই, সংস্কৃত বা ফার্সি বা ইংরাজি না জাইনাই তো আপনের বাংলা পারার কথা! ঐ কম্যুনাল-রেসিয়াল এজেন্ডার দখলে আপনের মন গেলে আপনে হয় সংস্কৃতরে ভাববেন দুশমন, বা ফার্সিরে বা ইংরাজিরে, ঘেন্নার চাষ হইতে থাকবে মনে! অথচ আপনে যদি আমজনতার বাংলা লন, গণতান্ত্রিক হন, দেখবেন, মানুষ আর আদম, পিছার লগে সাফ, নদী-আসমান-আকাশ-মেঘ-বিষ্টি-সাগর-মাছ-দরিয়া-তুফান-টেবিল-লেবার-আনারস-কুলা-হুদাই-ডিজিটাল-ঘাড়ত্যাড়া… এমন কত কত সোর্সের কত কত শব্দেরা বাংলার কানুনে নিজেদের সুরত বদলাইয়া পাশাপাশি শুইয়া আছে!

সো, আপনে যদি ঐ লিগেসিতে থাকেন, আমজনতার কাছে যাইতেই পারবেন না, আপনের গণতন্ত্রের খায়েশ স্রেফ নিজেরে ভুলাবার মায়া হইয়াই থাকবে!

ঐ লিগেসি আপনারে আরো একটা প্রিজুডিসের দিকে লইয়া যায় প্রায়ই, হামবড়া হইয়া উঠতে পারেন আপনে! এমন হামবড়া ভাবের আসল লসটা হইলো, সমাজের ভিতর থিকা কোন এলেম লইতেই পারবেন না আপনে!…

/৭জুন ২০১৮, রক মনু

…………………………………………………………….

বাঙ্গালার প্রাচীন মুসলমান সাহিত্যের এক সুবৃহৎ অংশ “মুসলমানী বাঙ্গালা” (সাহিত্য) নামে অভিহিত হইয়া থাকে। হিন্দু কি মুসলমান — যিনিই এই নাম করুন না কেন – ভাষার দিক দিয়া বলতে গেলে, এই নামের অন্বর্থতা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এই “মুসলমানীবাঙ্গালা” কি জিনিস,  সে সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষিত সমাজের অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারণা আছে বলিয়া বোধ হয় না। একটা দৃষ্টান্ত দিয়া পাঠকবর্গের নিকট কথাটা খোলসা করিতেছি। ১৩৪৭ সনে ফাল্গুন মাসে্র “সওগাতে” জনৈক মুসলমান লেখক “মর্সিয়া সাহিত্য” নামক প্রবন্ধে লিখিয়াছেন —“শেখ ফয়জুল্লাহ  … শমসের আলী প্রমুখ প্রখ্যাত নামা কবিগণের অক্লান্ত সাধনায় বাঙ্গালা সাহিত্যের ভাণ্ডার হইয়াছে সমৃদ্ধ। তাঁহাদের রচিত সাহিত্যকে কোনো স্বতন্ত্র নামে অভিহিত করা সঙ্গত নহে। * * * * কিন্তু বিশুদ্ধ ভাষা ও সুঠাম বর্ণনা-ভঙ্গীর দিক দিয়া কাজী দৌলৎ, সৈয়দ আলাওল প্রভৃতি ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের হিন্দু কবিগণ হইতে কোন অংশে ন্যূন নহেন।  একটু নমুনা দেই –

‘যৌবনকালেতে কন্যা বড় চিন্তা পায়।
অনঙ্গ-ভুজঙ্গ-বিষ সর্বাঙ্গে বেড়ায়।।
সে বিষ নামাতে নাহি ওঝার শক্তি।
স্বামী সে চিকিৎসা – হেতু ঔষধ সুরতি।।’

(দৌলতকাজী—‘লোরচন্দ্রানী)

‘দ্বিতীয়ার চন্দ্র জিনি ললাট শ্রীখণ্ড।
ত্রিভঙ্গ-ভঙ্গিম ভুরু কামেরকো দণ্ড।।
সুকোমল করতল পদ্মনাল-তুল।
চম্পক-কলিকা যিনি সুন্দর আঙ্গুল।।’

(ছৈয়দআলাওল—‘পদ্মাবতী)

এই ভাষাকে ‘মুসলমানী বাঙলা’ বলিয়া সাহিত্যের আসর হইতে দূরে ঠেকাইয়া রাখিবার প্রচেষ্টা কোনোদিন সমর্থনীয় হইতে পারে না।”

আধুনিক সাহিত্য উজাড় করিয়া কিছুদিন হইতে এই লেখক প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি সুনজর দিয়াছেন এবং নিত্য নূতন নূতন অথ্যাবিষ্কার করিয়া পাঠকসমাজে পরিবেশন করিতেছেন। আলাওল ও দৌলত কাজীর ভাষাকে “মুসলমানী বাঙলা”র নমুনারূপে প্রচারও যে একটা নূতন আবিষ্কার, সে বিষয়ে সন্দেহ করিবে কে?

এইত গেল এক পক্ষের কথা। অপর পক্ষে বটতলার পণ্ডিতেরা বিজ্ঞাপন দিয়া প্রচার করিতেছেন, “শ্রীযুক্ত ছৈয়েদ আলাওল সাহার কৃত এই পদ্মাবতি পুস্তক পারশি অক্ষরে চট্টগ্রামি ভাষায় ছিল।” এরকম দুইপক্ষের হেঁচকা টানে বেচারী বাঙ্গালা সাহিত্য একবারে লবে-জান!

এখন যদি ইহাদের উক্তরূপ সিদ্ধান্তকে “পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক” বলি, তাহাতে সত্যের অপলাপ হইল বলিয়া বিবেকে বাধে; আর যদি “মূর্খতার পরাকাষ্ঠা” বলি, তাহাতে “সুরুচি”র আইনের কবলে এবং তরুণদের রোষানয়নে পড়ি। কারণ আমাদের তরুণদের কেহ কেহ সত্য কথা বলিতে ও শুনিতে একান্ত নারাজ। সত্যকথা শুনিলেই তাহারা ক্ষেপিয়া যান এবং কুকুর লেলাইয়া দিয়া বিরুদ্ধবাদীকে দংশন করাইতে উদ্যত হন। কাজেই দুর্লভ পৈতৃক প্রাণটার মায়ায় সে বিষয়ে কোন অভিমত প্রকাশ না করিয়া “মুসলমানী বাঙ্গালা” কাহাকে বলে, আমরা পাঠকগণের নিকট তাহাই নিবেদন করিতেছি।

বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের সর্বপ্রধান ঐতিহাসিক স্বর্গীয় ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন মহোদয় “মুসলমানী বাঙ্গালা”র যে স্বরূপ ব্যাখ্যা করিয়া গিয়াছেন, প্রথমে পাঠকগণকে তাহাই দেখাইতেছি :–“মুসলমানী বাঙ্গালা’ বলিয়া এক প্রকার উৎকট বস্তু বাঙ্গালা সাহিত্যের এক কোণে একটা বিরাট স্তুপের মত পড়িয়া আছে। তাহার ভাবার্থ মৌলবীরা বুঝিবেন। বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান তাদের মাতার মুখে যে ভাষা শুনিয়া কথা বলিতে শিখিয়াছেন, এ ভাষা তাহা নহে। ইহার একটি উদাহরণ দিতেছি – ‘শাহাজাদি সখিসোনা সোনার মধ্য হইতে পয়দা হইবার বিবরণ, উজির নন্দনের মানিক পয়দা হইবার বয়ান, বাদশাহ ও উজির ফরজন্দের মুখ দেখিয়া খুসির মজলেছ করে এবং পীরের দোয়ায় মানুষ জিন্দা হয় ও দোবারা মালিনীর হাতে আফতে গিরিবার বয়ান।“

(মোহাম্মদ কোরবান আলী কৃত  ‘সখীসেনা‘)

“মুসলমানী বাঙ্গালা” কি, তাহা সম্যগ রূপে বুঝিবার পক্ষে দীনেশবাবুর প্রদত্ত একটি মাত্র উদাহরণ যথেষ্ট নহে। এজন্য এখানে আমি আরও কয়েকটি নমুনা প্রদর্শন করিতেছি :-

(১) “জঙা পাহালওন যে মালেক নামদার।
আরবি ছেফাই সঙ্গে হৈল নমুদায়।।
ময়দানে জঙ্গ দেখে কাফেরের সাতে।
আসিয়া পৌঁছিল মর্দ গের্জ লিয়া হাতে।।
এক হামলাতে মর্দ মালেক সর্দার।
সেকেস্ত করিয়া দিল লস্কর বাদসার।।
মালেকের দস্ত বাজু দেখে খাওয়রান।
আপনার মনে বাদসা হৈল পেরেসান।।
ময়দান উপৱে আলি যেন সের নর।
তাহাকে দেখিয়া বাদসা হইল ফাপর।।
সেতাবি ডাকিয়া এক কাছেদের তরে।
পাঠাইয়া দিল হায়দারের বরাবংগনামা।।

(দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী কৃত “খয়বরের জঙ্গনামা”)

(২) “এখাতেরে জবে সেই লাড়কা্র উম্মর।
গণনায় হইলেক পরের বচ্ছর।।
তখন আপনি সাহা উজিরের সাথ।।
পুসিদায় মছলত করিল এছা ভাত।
লাড়কা আক্যেলমন্দ হইল জেছাই।
তাহাতে দেশের হবে অনেক ভালাই।।
এখাতেরে লাজেম হতেছে এইক্ষণ।
তক্ত তাজ সুপী তায় করিয়া জতন ৷।
উজীর কহেন সাহা হও খবরদার।
পহেলাতে সাদি দাও আপন লাড়কার।।
তারপর সুপিও মুলুক তক্ত তাজ।
দস্তুর আছয় জাহা দুনিয়ার মাঝ ৷৷
এত শুনে সা জামান বাদসা নামদারে।
এৎবার করিল নিজ দেলের মাঝারে ৷৷
ভাবিল উজীর জেই কহিতেছে বাত।
সেইত মছলত নেক হতেছে নেহাত।।”

(হরিবল হোছেন কৃত “আলেফ লায়লা”)

 

(৩) “বিপদে পড়িলে মুঝে করিও এয়াদ।
তখনি হাছেন তেরা হইবে মোরাদ ৷৷
এয়ছাই আল্লার দোস্ত আছিল আমির।
যার সাথে সাথে ফেরে খোওয়াজ খেজির।।
ভেদ বাত পেয়ে মর্দ আমির জাহান।
দেওকে মারিতে তীর খেঁচিল কামান।।”

(গরীবউল্লা কৃত “আমির হামজা”)।

 

(৪) “তামাম আরব্ব লোকে গাওলঙ্গি লিয়া।
চলিল আপন ডেরে খোসাল হইয়া।।
মজলেছ করিয়া সবে তাজিমে বসায়।
খানাপানি মাঙ্গাইয়া সবাকে খেলায়।।
আপন ফরজন্দ লেকে লিল বোলাইয়া।
দামাদ সমেত দিল আমিরে শুপিয়া।।
সবাকারে নেওজিয়া রাখেন আমির।
লস্কর সমেত রহে খোসাল খাতির।।

(ছৈয়দ হামজা কৃত “আমীর হামজা”)

 

(৫) পরীর লস্কর ছেড়ে তক্ত এক লিয়া।
বাগান তরফে আসে হাওয়া উড়িয়া।।
লস্কর দেখিয়া ডর হইল দেলেতে।।
এক হাতে তেগ লিনু ঢাল আর হাতে।
রহিনু এরূপে আমি মজবুত হইয়া।
বাগানে উতারে পরি কুরছি লইয়া।।
বৈসে সেই কুরছির পরে এক পরিজাত।
দেখিনু জেওর পিন্দে আছে জওহেরাত।।
লেকেন ছুরত তার এয়ছাই ছাফাই।
দুনিয়াতে তেয়ছা রূপ চক্ষে দেখি নাই।”

(আয়েজদ্দিন আহমদ কৃত “গোল আন্দাম”)

আর বেশী নমুনা দেওয়া অনাবশ্যক।

প্রকতপক্ষে এই ভাষাই “মুসলমানী বাঙ্গালা” নামে পরিচিত এবং এই ভাষায় যে বিরাট সাহিত্যে গড়িয়া উঠিয়াছে, তাই বঙ্গসাহিত্যে “অপাংক্তেয়” বিবেচিত হয়ে থাকে। মোল্লা মৌলবীদের মুখে ভিন্ন এই ভাষা বাঙ্গালার মুসলমান সমাজে কোথাও প্রচলিত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং হিন্দু-মুসলমান সেবিত বাঙ্গালা সাহিত্যের আসর হইতে এই ভাষাকে “অপাংক্তেয়” করিয়া রাখার চেষ্টা কিছু অন্যায় বলা যায় না।

পূর্বে আলাওল ও দৌলত কাজীর রচনা হইতে উদ্ধৃত যে ভাষাকে “মুসলমানী বাঙ্গালা”র নমুনা হিসাবে দেখান হইয়াছে, তাহা কদাপি “মুসলমানী বাঙ্গালা” নহে এবং ঐরূপ ভাষাকে “মুসলমানী বাঙলা” বলিয়া সাহিত্যের আসর হইতে দূরে ঠেকাইয়া রাখিবার প্রচেষ্টা কোনদিন কেহ করে নাই এবং করিলেও তাহা সমর্থনীয় হইতে পারে না নিশ্চয়ই।

এই “মুসলমানী বাঙ্গালার” জন্ম পশ্চিম বাঙ্গালায়। কতকগুলি উর্দু-ঘেঁসা মোল্লা-মৌলবী জুটিয়া এই ভাষার সৃষ্টি করিয়াছেন এবং “উর্দুর আবর্জনা আনিয়া বাঙ্গালা সাহিত্যের এই দুর্গতি করিয়াছেন।“ বাঙ্গালা ভাষায় উপযুক্ত দখল না থাকার ফলে তাঁহাদের ভাষা না-বাঙ্গালা না-উর্দু – উভয়ের সংমিশ্রণজাত একটি মেরুদণ্ড-বিহীন খিচুড়ী ভাষা। এই ভাষায় বাঙ্গালা শব্দগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে সংখ্যা লঘিষ্ঠদের ন্যায় উর্দ্দু-পারসী শব্দগুলোর নিকট নিতান্ত আড়ষ্টভাবে বিদ্যমান।

বাঙ্গালী মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের কোন স্তরের সহিতই এই ভাষা খাপ খায় না। ভাষার যে একটা মোহিনী শক্তি আছে – যে শক্তি বলে ভাষা “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া” প্রাণ আকুল করিয়া তোলে, এই ভাষার সে শক্তি নাই। এই ভাষা কতকগুলি মোল্লা-মৌলবীর ভাষামাত্র, এমনকি পশ্চিম বাঙ্গালার মুসলমান সাধারণেরও দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য ভাষা ইহা নহে।

এই খিচুড়ী ভাষার অসংখ্য পুথি বটতলা হইতে প্রকাশিত হইয়াছে এবং এদেশে সেদেশে তাহার পাঠকসংখ্যাও অনেক, একথা অবশ্যই স্বীকার্য কিন্তু তাহা পঠিত হয় ভাষার আকর্ষণে নহে —প্রধানত বিচিত্র গল্পের মোহেই। এই বিরাট সাহিত্যে খাঁটি কবিত্বের অধিকারী কবির সংখ্যা মরুভূমির মধ্যে ওয়েসিসের মত অতি স্বল্প। কিন্তু এসব কথা বলিবার জন্য আজ এ প্রবন্ধের অবতারণা নহে তাই তৎসম্বন্ধে এখানে আর বেশি কিছু বলিতে চাহি না।

দৌলত কাজী, আলাওল প্রভৃতি অসংখ্য পূর্ববঙ্গীয় কবির ভাষা , (পারিভাষিক শব্দগুলি বাদ দিলে) হিন্দু কবির ভাষার ন্যায় শুদ্ধ সাধুভাষা। সেই ভাষা “মুসলমানী বাঙ্গালা”ও নহে, অথবা বটতলার পণ্ডিতদের কথিত মত “চট্টগ্রামী ভাষা”ও নহে। চট্টগ্রামী লোকেরা দৈনন্দিন জীবনে পরস্পরের মধ্যে যে ভাষায় কথোপকথন করে, তাহাকেই “চট্টগ্রামী ভাষা” বলে। পাঠকগণের নিকট সেই ভাষার কতকটা নমুনা দিয়া আমর প্রবন্ধের উপসংহার করিতেছি :-
“ফোজদার হাডর পছিমদি যেই রাস্তাউয়া সিধা দর্গার কুল উজু গেইয়ে গৈ, ঠিক হেই রাস্তাউয়ার মাঝামাঝি ডেন কিনারে যেই বড় বাড়ীয়ান আছে, হিয়ান হৈল দে কালা মিঞা মুন্শীর বাড়ী। তারঅ বাড়ীর লয় লাগাইয়া উত্তর বাডীয়ান হৈল দে হাসিমারঅ বাড়ী। হাসিমার মা বাপ কেঅ নাই। ভাই বন্ধুঅ কেঅ নাই। তার মা মরিবার থোরা দিন আগে তে বিয়আ গরি রঙ্গুম গেইয়ে। রঙ্গুম যাই কাট্টলীর তার খালাত ভাইয়ের ধরি পোট কমিশনার অফিসত পোঁদরঅ টেআর দরে এক্কান পিয়নি চাঅরি পাইএ। * * * * উন্দি তার বউএ বুয়ত বালুস লই গুনগুনাই গীত গায়  –

“ছোড কালে বিআ গরি রঙ্গুম গেলা ভাই।
কনে খাইত রঙ্গুমর কামাই
তুলার বালুস বুকে করি
সোয়ামী বুলি রে মন বুঝাই
রস্যা বঁধে গেল ছাড়িরে
সাদা দিলে মোরে দাগ লংগাই।”

এই ভাষাই “চট্টগ্রামী ভাষা।” সাধু ভাষায় উদ্ধতাংশ এরূপ দাঁড়াইবেঃ-

“ফৌজদার হাটের পশ্চিম দিকে যেই রাস্তাটি সোজা দরিআর কুল সোজা গিয়াছে ঠিক সেই রাস্তাটির মাঝামাঝি দক্ষিণ কিনারে যেই বড় বাড়ীখানা আছে সেইখান হইল যে কালামিঞা মুন্‌শীর বাড়ী। তার বাড়ীর লগে (সঙ্গে)  সংলগ্ন উত্তর বাড়ীখানা হইল যে হাসিমাদের বাড়ী। হাসিমার মা বাপ কেহ নাই। ভাই বন্ধুও কেহ নাই। তার মা মরিবার থোরা (অল্প) দিন আগে সে বিবাহ করিয়া রেঙ্গুন গিয়াছে। রেঙ্গুন যাইয়া কাট্টলী গ্রামের তার খালাত (মাসতুত) ভাইকে ধরিয়া পোর্ট কমিশনার অফিসে পনর টাকার দরে একখান পিয়নী চাকরী পাইয়াছে। * * * ঐদিকে তার বউ বুকে বালিস লইয়া গুন গুন করিয়া গীত গায়  –

“ছোটকালে বিহা করি রেঙ্গুন গেলা ভাই।
কোনে খাইত রেঙ্গুনের কামাই (রোজগার)
তুলার বালিস বুকে করি
স্বামী বলিয়া রে মন বুঝাই
রসিক বন্ধুএ গেল ছাড়িরে
সাদা দিলে মোরে দাগ লাগাই।”

 

মাসিক মোহাম্মদী, পৌষ ১৩৪৮

Series Navigation<< আমাদের ভাষাসমস্যা – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৯১৭)বাঙ্গালা বানান সমস্যা (১৯৩১) – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ >>
The following two tabs change content below.

বাছবিচার

এডিটর, বাছবিচার।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →