Main menu

পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ২ ।।

This entry is part 12 of 22 in the series লেখার ভাষা

।।

…………………………………

ভাষা তো পাওয়ারের লগে রিলেটেড একটা ঘটনা। ব্রিটিশ আমলে ইংলিশ যে সরকারি দফতরের ভাষা আছিল, সেইটা তো পাওয়ারের কারণেই। তো, ব্রিটিশরা যখন নাই তখন তো আরেকটা ভাষার দরকার।

ইন্ডিয়া চাইলো, হিন্দি ভাষারে এস্টাবলিশ করতে, না পাইরা ইংলিশটারে রাইখা দিয়া হিন্দিরেও প্রমোট করলো। এখন ইন্ডিয়াতে যতদিন হিন্দি চালু আছে ততদিন দিল্লীতে নর্থ ইন্ডিয়ানদের পাওয়ার কমার কোন কারণ আসলে নাই। (খালি ভাষাই না, ভাষার ভিতরে অ্যাকসেন্ট আর ডায়ালেক্টের ব্যাপারও আছে, কুষ্টিয়া-খুলনার দিকের কথারে যত বাংলা লাগে, সিলেট-চিটাগাংয়ের ডায়ালেক্টরে তো এতোটা লাগে না। এইরকমের ব্যাপারগুলা আছে।) আর এই পাওয়ারের কারণেই দেখবেন, পশ্চিমবঙ্গের সোকল্ড শিক্ষিত লোকজন হিন্দিরে যতোটা হেইট করেন, ইংলিশরে এতোটা না। কারণ উনারা ইংলিশ তো জানেন কিছুটা কলোনিয়াল আমল থিকা, কিন্তু নতুন কইরা হিন্দি শিখাটা তো পসিবল না! বা ইংরেজদের নিজেদের মালিক বইলা মানতে যতোটা রাজি আছিলেন, সেই জায়গায় অন্য নেটিভ ইন্ডিয়ানদের মালিক বইলা ভাবাটাও মুশকিলেরই হওয়ার কথা।…

পাকিস্তানেও একইরকমের সিচুয়েশনই ছিল, ইংলিশের জায়গায় কোনটা আসবো, এই কোশ্চেনটা উঠছিল। রাষ্ট্র যেহেতু সেন্ট্রালাইজড একটা জিনিস, একক একটা জিনিস তো থাকা লাগবে। মানে, ইংলিশের বিপরীতে আরেকটা অপশনের কথাই উঠছিল। 

জিন্নাহ কিন্তু ইংলিশেই কইছিলেন – উর্দু’রে স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ করার কথা; উর্দুতে কন নাই। আর যেই স্টুডেন্ট এইটার প্রতিবাদ করছিলো, সে কিন্তু ‘না’ কয় নাই; ‘নো’-ই কইছিলো! ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না? যেই দুইটা ভাষা’র লাইগা ফাইটটা চলতেছে, সেই দুইটাই নাই; এইটা নিয়া কথা হইতেছে অন্য আরেকটা ভাষাতেই।

জিন্নাহ আসলে ইংরেজি জানা লোকদেরকেই শুনাইতে চাইতেছিলেন (উনার উর্দু না বলতে পারা’র কথা মনে রাইখাই বলতেছি)। যারা খালি বাংলা জানে, ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়া উনারা কিছু কইতে পারবে এইরকম গণতন্ত্রে উনি বিলিভই করেন নাই আসলে। যিনি রিভোল্ট করলেন, উনিও জিন্নাহরে জানাইতে চাইছিলেন, বাংলা তো আমরা জানি, ইংরেজির ভিতর দিয়াই। উনি জিন্নাহরে প্রটেস্টই করছেন, অথরিটি’টারে যে উনি চিনেন এইটা জানাইছেন।

মজার ব্যাপার হইলো, “অরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়…” গানটা নিয়া; ‘কাইড়া’, কি রকম অদ্ভূত বাংলা! লিখতে গেলেও ফানি লাগে না একটু, ব্যাপারটা! এই বাংলা-ভাষা ভাষা আন্দোলনের ‘নো’ বেঙ্গলিরা চাইছিলেন বইলা মনে হয় না। এইখানে পাওয়ারের ঘটনাটা আরো ক্লিয়ার হওয়ার কথা আসলে। 

তো, সৈয়দ মুজতবা আলী তার আর্গুমেন্টের ভিতরে বারবার ভাষা কেমনে অন্য সব সোশিওপলিটিক্যাল জায়গাগুলাতে দখলের জায়গাগুলা জারি রাখে, সেই জায়গাগুলারে খোলাসা করতেছিলেন।  এই জায়গা থিকা দেখতে গেলেও, এইটা ইন্টারেস্টিং একটা লেখা। 

ই. হা.

…………………………………

ইংরেজও ‘ভদ্রলোক’ ও ‘ছোটলোকের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা করে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজ কৃষি রিপোর্ট বের করত ইংরেজি ভাষায় এবং চাষাভুষাদের শেখাত বাংলা! বোধ হয় ভাবত বাঙলি ‘মাছিমারা’ কেরানী যখন ইংরেজি  না জেনেও ইংরেজি দলিলপত্র নকল করতে পারে তখন ইংরেজি অনভিজ্ঞ চাষাই বা ইংরেজিতে লেখা কৃষি রিপোর্ট, আবহাওয়ার খবরাখবর পড়তে পার, না কেন? এই পাগলামি নিয়ে যে আমরা কত ঠাট্টা-মস্করা করেছি সেকথা হয়তো উর্দুওয়ালারা ভুলে গিয়েছেন কিন্তু আমরা ভুলি নি। তাই শুধাই, এবার কি আমাদের পালা? এখন আমরা কৃষি-রিপোর্ট, বাজার দর, আবহাওয়ার খবরাখবর বের করব। উর্দুতে আর চাষীদের শেখাব বাংলা! খবর শুনে ইংরেজ লণ্ডনে বসে যে অট্টহাসি ছাড়বে আমরা সিলেটে বসে তার শব্দ শুনতে পাব।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

উর্দুওয়ালারা বলবেন, ‘ক্ষেপেছ? আমরা উর্দু কৃষি রিপোর্ট বাংলাতে অনুবাদ করে চাষার বাড়ীতে পাঠাব।’

উত্তরে আমরা শুধাই সে অনুবাদটি করবেন কে? কৃষি রিপোর্টের অনুবাদ করা তো পাঠশালা-পাসের বাংলা বিদ্যে দিয়ে হয় না। অতএব বাংলা শেখানোর জন্য। হাইস্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়াতে হবে। অর্থাৎ আমাদের সকলকে স্কুল। কলেজে বাংলা উর্দু দুই-ই বেশ ভালো করে শিখতে হবে (কৃষি রিপোর্ট ছাড়া উর্দুতে লেখা অন্যান্য সৎসাহিত্যও তাে বাংলাতে তর্জমা করতে হবে); ফলে দুই কুলই যাবে, যেমন ইংরেজ আমলে গিয়েছিল—না শিখেছিলাম, বাংলা লিখতে, না পেরেছিলাম ইংরেজি ঝাড়তে।

ইংলণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানীতে যে উচ্চশিক্ষার এত ছড়াছড়ি, সেখানেও দশ হাজারের মধ্যে একটি ছেলে পাওয়া যায় না যে দুটো ভাষায় সড়গড় লিখতে পারে। আরব, মিশরের আলিম-ফাজিলগণও এক আরবী ছাড়া দ্বিতীয় ভাষা জানেন না।

না হয় সব কিছুই হল কিন্তু তবু মনে হয়, এ বড় অদ্ভুত পরিস্থিতি—যে রিপাের্ট পড়নেওয়ালার শতকরা ৯৯ জন জানে বাংলা সে রিপাের্টের মূল লেখা হবে উর্দুতে! ব্যবস্থাটা কতদূর বদখত বেতালা তার একটা উপমা দিলে আমার বক্তব্য খোলাসা হবে: যেহেতু পূর্ব পাকিস্থানে উপস্থিত শ’খানেক রুটি-খানেওয়ালা পাঞ্জাবী আছেন অতএব তাবৎ দেশে ধানচাষ বন্ধ করে গম ফলাও! তা সে আলবাধা, জলে-টৈ-টম্বুর ধানক্ষেতে গম ফলুক আর নাই ফলুক!

উর্দুওয়ালারা তবু বলবেন, ‘সব না হয় মানলুম, কিন্তু একথা তো তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না যে কেন্দ্রের ভাষা যে উর্দু সে সম্বন্ধে পাকাপাকি ফৈসালা হয়ে গিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের লোক যদি উর্দু না শেখে তবে করাচীর কেন্দ্রীয় পরিষদে তারা গাকগাক করে বক্ততা বাড়বেনই বা কি প্রকারে, এবং আমাদের ছেলেছোকরারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ডাঙর ডাঙর নোকারি বা করবে কি প্রকারে?

বক্ততা দেওয়া সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, আমরা যত ছেলেবেলা থেকে যত উত্তম উদুই শিখি না কেন, উর্দু যাদের মাতৃভাষা তাদের সঙ্গে আমরা কস্মিনকালেও পাল্লা দিয়ে পেরে উঠব না। আমাদের উচ্চারণ নিয়ে উর্দু-ভাষীগণ হাসিঠাট্টা করবেই এবং সকলেই জানেন উচ্চারণের মস্করাভেংচানি করে মানুষকে সভাস্থলে যত ঘায়েল করা যায় অন্য কিছুতেই ততটা সুবিধে হয় না। অবশ্য যাদের গুরদা-কলিজা লোহার তৈরী তারা এ সব নীচ ফন্দি-ফিকিরে ঘায়েল হবেন না কিন্তু বেশীরভাগ লোকই আপন উচ্চারণের কমজোরী বেশ সচেতন থাকবেন, বিশেষত যখন সকলেই জানেন যে প্রথম বহু বৎসর ধরে উত্তম উচ্চারণ শেখবার জন্য ভালো শিক্ষক আমরা যোগাড় করতে পারব না, এবং একথাও বিলক্ষণ জানি যে একবার। খারাপ উচ্চারণ দিয়ে বিদ্যাভ্যাস আরম্ভ করলে অপেক্ষাকৃত বেশী বয়সে সে জখমী উচ্চারণ আর মেরামত করা যায় না। দৃষ্টান্তের জন্য বেশী দূর যেতে হবে না। পূর্ববঙ্গের উর্দু ভাষাভাষী মৌলবী সাহেবদের উচ্চারণের প্রতি একটু মনোযোগ দিলেই তাদের উচ্চারণের দৈন্য ধরা পড়ে। সে উচ্চারণ দিয়ে পূর্ব বাংলায় ‘ওয়াজ দেওয়া চলে কিন্তু যাদের মাতৃভাষা উর্দু তাদের মজলিসে মুখ খোলা যায় না। এমন কি দেওবন্দ রামপুর ফের্তা কোনো কোনো মৌলবী সাহেবকে উচ্চারণ বাবতে শরমিন্দা হতে দেখেছি, অথচ বহুক্ষেত্রে নিশ্চয় জানি যে এদের শাস্ত্রজ্ঞান দেওবন্দরামপুরের মৌলানাদের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু এরা নিরুপায়, ছেলেবেলা ভুল উচ্চারণ শিখেছিলেন, এখনো তার খেসারতি ঢালছেন।

কিন্তু কি প্রয়োজন জান পানি করে ছেলেবেলা থেকে উর্দু উচ্চারণে পয়লানম্বরী হওয়ায়? অন্য পন্থা কি নেই?

আছে। গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূমি সুইজারল্যাণ্ডে চারটি ভাষা প্রচলিত। তাঁদের পার্লামেন্টে সকলেই আপন আপন মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেন। সেসব বক্তৃতা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়। উর্দুওয়ালারা প্রশ্ন শুধাবেন এসব বক্তৃতা অনুবাদ করে কারা ?

সেই তত্ত্বটা এইবেলা ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার। এই ধরুন, আপনার মাতৃভাষা বাংলা, আপনি উর্দুও জানেন। কিন্তু উর্দুতে বক্তৃতা দিতে গেলে আপনি হিমশিম খেয়ে যান। অথচ অল্প উর্দু জানা সত্ত্বেও যদি আপনাকে কোনো উর্দু বক্তৃতা বাংলায় তর্জমা করতে হয় তবে আপনি সেটা অনায়াসে করে দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ফ্রান্স, জার্মানী, হল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশে সফর করে খ্যাতি অর্জন। করেছিলেন তখন তিনি দুনিয়ার বাহান্নটা ভাষায় বক্তৃতা দেন নি? বক্তৃতা দিয়েছিলেন হামেশাই ইংরেজিতে এবং অনুবাদকেরা আপন আপন মাতৃভাষায় সেসব বক্তৃতা অনুবাদ করেছিলেন।

মার্শাল বুলগানিন, আইসেনহাওয়ার, চার্চিল, মাও-সে-তুও, চিয়াং কাই শেখ যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ আলোচনা করেন—আর চার্চিল তো মামুলি কথা। বলতে গেলেও ওজস্বিনী বক্তৃতা ঝাড়েন-তখন সকলেই আপন আপন মাতৃভাষাতেই কথা বলেন। দোভাষী তর্জুমানরা সেসব আলাপ-আলােচনার অনুবাদ করেন।

এত বড় যে ইউনাইটেড নেশন্স্ অরগেনাইজেশন (UNO), যেখানে দুনিয়ার প্রায় তাবৎ ভাষাই শুনতে পাওয়া যায়; সেও চলে তজুমানদের মধ্যস্থতায়।

পাঠক হয়তো বলবেন অনূদিত হলে মূল বক্তৃতার ভাষার কারচুপি অলঙ্কারের ঝলমলানি, গলা ওঠানো-নাবানোর-লম্ফঝম্ফ মাঠে মারা গিয়ে বক্তৃতা রসকষহীন সাদামাটা হয়ে বেরোয়, ওজস্বিনী বক্তৃতা তখন একঘেয়ে রচনা পাঠের মত শােনায়। সে কথা ঠিক—যদিও প্রোফেশনাল এবং বিচক্ষণ তর্জুমান মূলের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ জৌলুস রাখতে সমর্থ হন—কিন্তু যখন সব বক্তারই বক্তৃতা অনূদিত হয়ে সাদামাটা হয়ে গেল তখন সকলেই সমান লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।

গুণীরা বলেন, আলাপ-আলােচনা যেখানে ঝগড়া-কাজিয়ায় পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেখানে কদাচ বিপক্ষের মাতৃভাষায় কথা বলবে না; তুমি একখানা কথা বলতে না বলতে সে দশখানা বলে ফেলবে। বিচক্ষণ লোক মাত্রই স্টেশনে লক্ষ করে থাকবেন যে হুঁশিয়ার-বাঙালী বিহারী মুটের সঙ্গে কদাচ উর্দুতে কথা বলে না। আর মুটে যদি তেমনি ঘুঘু হয় তবে সেও বাংলা জানা থাকলেও, আপন উর্দু চালায়। তবু তো বিহারী মুটেকে কিছুটা ভালো উর্দু জানা থাকলে ঘায়েল করা যায়, কিন্তু করাচীতে যে-সব উর্দুভাষীদের মোকাবেলা করতে হবে তাঁদের উর্দুজ্ঞান পয়লানম্বরী হবে নিশ্চয়ই। প্রেমালাপের কথা স্বতন্ত্র, সেখানে কোনো ভাষারই প্রয়োজন হয় না, টোটিফুটি উর্দু বললেও আপত্তি নেই। তুলসী দাস কহেন,

‘জো বালক কহে তোতরি বাতা।
সুনত মুদিত নেন পিতু আরু মাত—

বালক যখন আধা-আধা কথা বলে তখন পিতামাতা মুদ্রিত নয়নে (গদগদ। হয়ে) সে কথা শোনেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যগণ শুদ্ধমাত্র রাসলাপ করার জন্য করাচী যাবেন না। স্বার্থের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলে, দরকার বোধ করলে তো বাগবিতণ্ডাও করতে হবে।

কেন্দ্রের ডাঙর ডাঙর নোকরীর বেলাও এই যুক্তি প্রযোজ্য। আমরা যত উত্তম উদুই শিখি না কেন প্রতিযোগিতাত্মক পরীক্ষায় উর্দু-মাতৃভাষীর সঙ্গে কখনোই টক্কর দিতে পারব না। অথচ আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় পরীক্ষা দিই এবং উর্দু-মাতৃভাষীরা তাঁদের মাতৃভাষার পরীক্ষা দেন তবে পরীক্ষায় নিরপেক্ষতা রক্ষা করা হবে। তখন প্রশ্ন উঠবে বাঙালী ছেলেরা উর্দু না জেনে কেন্দ্রে নোকরী করে কি করে? উত্তরে বলি, সিন্ধি বেলুচি-ছেলে যে প্রকারে কেন্দ্রে কাজ করবে ঠিক সেই প্রকারে—তাদের মাতৃভাষাও তো উর্দু নয়। পাঠানেরা পশতুর জন্য যে রকম কাজ আরম্ভ করেছেন তাদের এই একই অবস্থা হবে। অথবা বলব উর্দু মাতৃভাষীরা যে কৌশলে বাংলা দেশে নোকরী করবেন ঠিক সেই কৌশলে। এ সম্বন্ধে বাকী বক্তব্যটুকু অন্য প্রসঙ্গে বলা হবে।

উর্দুওয়ালারা এর পরও শুধাতে পারেন, “আমরা যদি উর্দু না শিখি তবে কেন্দ্র থেকে যেসব হুকুম, ফরমান, আইন কানুন আসবে সেগুলো পড়ব কি করে?”

উত্তরে বলি, “তার জন্যে ঢাকাতে তর্জুমানদের ব্যবস্থা করতে হবে।” একথা শুনে উর্দুওয়ালারা আনন্দে লাফ দিয়ে উঠবেন। বলবেন, “তবেই তো হল। তর্জুমানদের যখন উর্দু শেখাতেই হবে তখন তামাম দেশকে উর্দু শেখালেই পারো।”

এ বড় অদ্ভুত যুক্তি উদাহরণ না দিলে কথাটা খোলসা হবে না বলে নিবেদন কর আরব ফ্রান্স, জার্মান, স্পেন, রুশিয়া, চীন ইত্যাদি দেশে পাকিস্তানের লোক রজত হয়ে যাবে। তাই বলে কি পাকিস্তানের লোককে আমরা দুনিয়ার তাবৎ ভায়া শেখাই?”

একটা গল্প মনে পড়ল। স্বয়ং কবিরুগুরু সেটি ছন্দে বেঁধেছেন; তাই যতদূর সম্ভব তার ভাষাতেই বলি—

কহিলা হবু  “শুনগো গোবু রায়
কালিকে আমি ভেবেছি সারারাত্র
মলিন ধলা লাগিৱে কেন পায়
ধরণী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র?
নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।”

মন্ত্রী তখন,
“অশ্রুজলে ভাষায়ে পাকা দাড়ি
কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে
যদি না ধূলা লাগিবে তব পায়ে
পায়ের ধূলা পাইব কি উপায়ে।”

সেয়ানা উওর। কিন্তু রাজা মীর চেয়েও ঘড়েল তাই বললেন—

“কথাটা বটে সত্য,
কিন্তু আগে বিদায় করো ধূলি।
ভাবিয়ো পরে পদধূলির তত্ত্ব!”

তখন নানা তরকিব নানা কৌশলে রাজার পা দুখানকে ধুলা থেকে বাঁচানাের চেষ্টা করা হল। সাড়ে সতেরো লক্ষ ঝাটা দিয়ে দুনিয়া সাফ করার প্রথম চেষ্টাতে যখন কোনো ফল হল না তখন ‘একুশ লাখ ভিস্তি দিয়ে জল ঢালার ব্যবস্থা করা হ’ল। তাতেও যখন কিছু হ’ল না তখন;

কহিল মন্ত্রী, “মাদুর দিয়া ঢাকো;
ফরাশ পাতি করিব ধূলা বন্ধ।”
কহিল কেহ, “রাজারে ঘরে রাখো
কোথাও যেন না থাকে কোনো রন্ধ্র।”

রাজার কপাল ভালো বলতে হবে, কেউ যে তার পা দুখানা কাটার ব্যবস্থা। করলেন না। শেষটায় সমস্বরে,

কহিল সবে, “চামারে তবে ডাকি
চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথী।”
তখন ধীরে চামার কুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
“বলিতে পারি করিলে অনুমতি
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।”

এত সোজা সমাধান? তাই তো বটে! এই করেই হ’ল জুতা আবিষ্কার। তিনকুড়ি কেন্দ্রীয় সদস্য, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে শ’দুই চাকুরে, আরো শ’দুই তজুমানের উর্দু জানার প্রয়োজন [হিসেবটা অত্যন্ত দরাজ হাতে করা গেল]; তার জন্য চার কোটি লোককে উর্দু কপচাতে হবে!

নাহয় পাঁচ শ’ নয়, সাত শ’ নয়, পাঁচ হাজার লোকেরই উর্দু বলার প্রয়োজন হবে। তবে তাদের পায়েই উর্দুর জুতা পরিয়ে দিই; এই ভলভলে কাদার দেশে চার কোটি লোককে জুতো পরাই কোন হস্তী-বুদ্ধির তাড়নায়?

রবীন্দ্রনাথের গল্পটি এইখানেই শেষ নয়; আমদের কথাও এখানে ফুরোয় না। আমরা যখন এই জটিল সমস্যার সরল সমাধান বাৎলে দি তখন,

কহিলা রাজা, “এত কি হবে সিধে,
ভাবিয়া ম’ল সকল দেশসুদ্ধে।”
মন্ত্রী কহে, “বেটারে শূলে বিধে ?
কারার মাঝে করিয়া রাখ রুদ্ধ।”

চামারের মত সরল সমাধান যারা করতে চায় তাদের জন্য শূলের হুকুম জারী হয়। তাদের তখন নামকরণ হয় “এনিমিজ অব দি স্টেট” “আজাঁ প্রভোকাতর”!!

ইতিহাস দিয়ে যদি বা সপ্রমাণ করা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানের মত বিশাল দেশের বিপুল সংখ্যক লোককে কখনো তাদের মাতৃভাষা ভুলিয়ে অন্য ভাষা শেখানো সম্ভবপর হয় নি, ইরান তুর্কী প্রভৃতি দেশে এ প্রকারের চেষ্টা সর্বদাই নিস্ফল হয়েছে, তবু এক রকমের লোক যারা আপন স্বাধিকার প্রমত্ততায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নাথিং ইজ ইমপসিবল’ বুলি কপচান, এ সম্প্রদায়ের লােক যদি দেশের দণ্ডধর না হতেন তবে আমাদের ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজেই আর পাঁচজনকে সত্যনিরূপণ করাতে সমর্থ হত। তাই প্রশ্ন, এসব দণ্ডধরদের সামনে অন্য কোন্ যুক্তি পেশ করা যায়, কি কৌশলে বোঝানো যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে উর্দু চালানো সম্পূর্ণ অসম্ভব।

কাসীতে বলে জান-মাল’, বাংলায় বলি ‘ধন-প্রাণ মানুষ এই দুই বস্তু বড় ভালোবাসে; ইতিহাস যা বলে বলুক, এই দুই বস্তু যদি মানুষের হাত এবং দেহ ছাড়ার উপক্রম করে তবে দণ্ডধরেরা পর্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়েন; হাতের পাখী এবং প্রাণপক্ষী বাঁচাবার জন্য তখন ঝােপের ইমপসিব্‌ল্ ‘ চিড়িয়ার তালাশী বন্ধ হয়ে যায়।

তাই প্রথম প্রশ্ন, ঝোপের উর্দু চিড়িয়া ধরতে হলে যে ফাঁদ কেনার প্রয়োজন তার খর্চার বহরটা কি?

ধরা যাক আমরা পূর্ব পাকিস্তানের পাঠশালা, স্কুল, কলেজ সর্বত্র উর্দু চালাতে চাই। পর্ব পাকিস্তানে ক’হাজার পাঠশালা, ক’জন গুরুশহাশয় দ্বিতীয় শিক্ষক, স্কুলমাস্টার, কলেজ প্রফেসার আছেন জানি না কিন্তু একথা নিশ্চয় জানি যে কেবলমাত্র পাঠশালাতেই যদি আজ আমরা উর্দু চালাবার চেষ্টা করি তবে আমাদের হাজার হাজার উর্দু শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। সেসব শিক্ষকরা আসবেন বিহার এবং যুক্তপ্রদেশ থেকে। তার আঠারো-কুড়ি টাকার মাইনেতে পূর্ব বাংলার গায়ে পরিবার পোষণ করতে পারবেন না। আমাদের পাঠশালার পণ্ডিত মশাইদের কিছু কিছু জমিজমা আছে, কেউ কেউ হালও ধরে থাকেন, এবং তৎসত্ত্বেও তারা যে কি দারিদ্র্যর ভেতর দিয়ে জীবনযাপন করেন সে নিদারুণ কাহিনী বর্ণনা করার মত শৈলী এবং ভাষা আমার কলমে নেই। লেখাপড়া শিখেছেন বলে গ্রামের আর পাঁচজনের তুলনায় এঁদের সূক্ষ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা এবং আত্মসম্মান জ্ঞান হয় বেশী। মহাজনের রূঢ়বাক্য, জমিদারের রক্তচক্ষু এদের হৃদয়-মনে আঘাত দেয় বেশী এবং উচ্চশিক্ষা কি বস্তু তার সন্ধান তারা কিছুটা রাখেন বলে মেধাবী পুত্রকে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা না দিতে পারাটা এঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ‘ইত্তেহাদ’, ‘আজাদ’ মাঝে মাঝে এঁদের হস্তগত হয় বলে এঁরা জানেন যে যক্ষ্মারোগী স্বাস্থ্যনিবাসে বহুস্থলে রোগমুক্ত হয়, হয়তো তার সবিস্তার বর্ণনাও কোনো রবিবাসরীয়তে তারা পড়েছেন এবং তারপর যখন পুত্র অথবা কন্যা যক্ষ্মারোগে চোখের সামনে তিলে তিলে মরে তখন তারা কি করেন, কি ভাবেন আমাদের জানা নেই। বাইবেলি ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়, “ধন্য যাহারা অজ্ঞ, কারণ তাহাদের দুঃখ কম’ পণ্ডিতের তুলনায় গাঁয়ের আর পাঁচজন যখন জানে না ‘স্বাস্থ্যনিবাস সাপ না। ব্যাঙ না কি, তখন তারা যক্ষ্মারোগকে কিস্মতের গর্দিশ বলেই সান্তনা দিতে পারে।

সুদূর যুক্তপ্রদেশ, বিহার থেকে যারা উর্দু শেখাবার জন্য বাংলার জলেভেজা, কাদাভরা, পানাঢাকা, জ্বরেমারা পাড়াগাঁয়ে সপরিবার আসবেন তারা মাইনে চাইবেন কত? আমদের গাঁয়ে গাঁয়ে ফালতো জমিজমা আর নেই যে চাকরি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের লাখেরাজ বা ব-খেরাজ ভূ-সম্পত্তি দিয়ে দেব আর তারা সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে চন্দ রোজের মুসাফিরী কোনো সুরতে গুজার করে। নেবেন। তাই তাঁদের মাইনে অন্ততপক্ষে কত হওয়া উচিত, আপনারা এবং আর পাঁচজন গাঁও-বুড়ারা, মাথা মিলিয়ে ধরে দিন। আমরা মেনে নেব।

যত কমই ধরুন না কেন তার দশমাংশ দেবার মত তাগদও পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রীর নেই (শুধু পূর্ব পাকিস্তানের কেন, এরকম পাগলা প্ল্যান চালাতে চাইলে ইংলেণ্ড ফ্রান্সেরও নেই। জমির সার, হালের বদল, কলকবজা কেনা সব কিছুর জন্য পয়সা খরচা বন্ধ করে এই কি এডুকেশনাল এক্সপেরিমেন্ট করার মোকা!

এতক্ষণ ধনের’ কথা হচ্ছিল, এখন প্রাণের কথাটি তুলি।

বিহার, যুক্তপ্রদেশ থেকে শিক্ষক আনিয়ে তো আমাদের পাঠশালাগুলো ভর্তি করা হ’ল। আটার অভাবে তারা মাসহারা পেয়েও অর্ধাহারী রইলেন।

তা থাকুন, কিন্তু যেসব হাজার হাজার পাঠশালার বাংলা শিক্ষককে পদচ্যুত করে বিদেশীদের জায়গা করা হ’ল তারা যাবেন কোথায়? কোনো দোষ করেন নি, ‘এনিমিজ অব দি স্টেট’ এরা নন, এদের বরখাস্ত করা হবে কোন হকের জোরে কোন ইসলামি কায়দায়?

পাকিস্তান সফল করেছে কারা? গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানের প্রােপাগান্ডা হল কে, সিলেটের প্লেবিসিটের সময় কুর্তা বিক্রয় করে নৌকা ভাড়া করল কারা, পোলোয় করে মরণাপন্ন ভোটারকে বয়ে নিয়ে গেল কার বেটা বাচ্চারা?

এরাই লড়েছে পাকিস্তান-বিরোধীদের সঙ্গে। এরা কুর্সীনশীন, মোটরসাওয়ার পলিটিশায়ান নয়। এরা লড়তে জানে। দরকার হলে এরা দলে দলে চারদিকে ধাওয়া করবে, সঙ্গে যাবে তাদের বাধ্য চাষা-মজুর। তাদের সংখ্যা কি হবে অনুমান করতে পারছি নে, কিন্তু শুনেছি এক ঢাকা শহরের বাংলাভাষী মুষ্টিমেয় ছাত্র সম্প্রদায়ের হাতেই বাংলা-উর্দু বাবদে কোনো কোনো দপ্তর কর্তাব্যক্তি লাঞ্চিত অপমানিত হয়েছেন। ছাত্ররা শহরবাসী কিন্তু এরা ’গ্রাম্য’; এরা প্রাণের ভয় দেখতে জানে। ’ধন’ তো আগেই গিয়েছিল বিদেশ থেকে শিক্ষক আনিয়ে, তখন আর হরে প্রাণের উপর হামলা।

খুদা পানাহ। আমরা এ অবস্থার কল্পনা করতে পারিনে। আমাদের বিল, কর্তাব্যক্তিরা তার বহু পূর্বেই ‘কিতাবুন্মুবী’ দেখে সিরাতুল মুস্তাকিমের সন্ধান পাবেন;—‘ওয়া আম্মসূসইলা ফলা তনহর’ অর্থাৎ ‘সাইল (প্রার্থীদের প্রত্যাখান করো না!’ i এস্থলে ‘সাইল’ শব্দ আরবী অর্থে নিতে হবে, উর্দু অর্থে নয়, এবং তা হলে কথাটা আমাদের গরীব গুরুমহাশয়দের বেলাই ঠিক ঠিক খাটে।

হিটলার কুরানের এ আদেশ মানেন নি। যে রোম ও তার সাঙ্গপাঙ্গের – তৎপরতার দরুন তিনি জার্মানীতে তার তৃতীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন দেড় বৎসর যেতে না যেতে তিনি র্যোম এবং তাঁর প্রধান সহকর্মীদের গুলি করে মেরেছিলেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস আমাদের কর্তাব্যক্তি কুতুবমিনাররা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন — এবং ইসলামে গণতন্ত্রের অর্থ ‘হক’ ও ‘সবর’-এর উপর নির্ভর করা (ওয়া তাওসাও বিল হক্কি ও তাওসাও বিস্-সবর)।

এ তো গেল পাঠশালার কথা। হয়তো উদুওয়ালারা বলবেন যে পাঠশালায় বাংলাই চালাবেন কিন্তু স্কুল-কলেজে পড়াবেন উর্দু। দুরকম শিক্ষাব্যবস্থার অধর্ম ও কুফল আমরা পূবেই আলোচনা করেছি। আপাতত শুধু এইটুকু দ্রষ্টব্য যে স্কুল-কলেজে তাবৎ বিষয়বস্তু উর্দুর মাধ্যমিকে পড়া উপস্থিত যেসব শিক্ষকরা এসব বিষয় পড়াচ্ছেন তাদের সকলকে বরখাস্ত করতে হবে এবং তাদের স্থলে যুক্তপ্রদেশ ও বিহার থেকে হাজার হাজার শিক্ষক আনতে হবে।

কাজেই প্রথম প্রশ্ন, এসব মাস্টাররা কি অন্ন-হারা হওয়ার দুর্দৈবটা চোখ বুজে সয়ে নেবেন? প্রত্যেক অনুন্নত দেশের বেকার সমস্যার প্রধান অংশ সমাধান করে শিক্ষাবিভাগ, কারণ তার হাতে বিস্তর চাকরি। পূর্ব পাকিস্তান সে সমস্যার সমাধান দূরে থাক, পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালী শিক্ষকদের বরখাস্ত করে বাইরের লোক ডেকে সৃষ্টি করবেন বৃহৎ বেকার সমস্যা।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক এবং কলেজে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, কৃষিবিদ্যা, পূর্ত-খনিজ-বৈদ্য-শাস্ত্র পড়াবার জন্য উর্দুভাষী শিক্ষক পাওয়া যাবে তো? ভুললে চলবে না যে পূর্ব পাকিস্তান যদি উর্দুগ্রহণ করে তবে সিন্ধুপ্রদেশ এবং বেলুচিস্তানেও ঠিক আমাদের কায়দায়ই উর্দুমাস্টার, প্রফেসরের চাহিদা ভয়ঙ্কর বেড়ে যাবে। ফলে যখন আমরা ঢাকার স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের যে মাইনা দিচ্ছি সে মাইনের চেয়ে দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ দিতে হবে এইসব বহিরাগতদের। অত টাকা কোথায় ? এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস উর্দুর মাধ্যমিকে উপরে লিখিত তাবৎ বিষয় পড়বার মত শিক্ষক বিহার, যুক্তপ্রদেশে পাঞ্জাবে প্রয়ােজনের দশমাংশও নেই।

তৃতীয় প্রশ্ন, তাবৎ পাঠ্যপুস্তক উর্দুতে লেখবার জন্য গ্রন্থাকার কোথায়? প্রয়োজনীয় শিক্ষকের দশমাংশ যখন বাজারে নেই তখন লেখকের দশমাংশও যে পাব না সে তথ্যও অবিসংবাদিত সত্য। কিছু বই লাহোরে থেকে আসবে সত্য, কিন্তু বাংলার ভূগোল, ইতিহাস, কৃষিবিদ্যা তো লাহোরে লেখা হবে না এবং পূর্ব পাকিস্তানে এসব বিষয় লেখার লোক নেই। এবং যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করি না কেন, আমাদের পাঠ্যপুস্তক লেখকদের রুটি বহু বৎসরের জন্য নির্ঘাৎ মারা যাবে।

চতুর্থ প্রশ্ন, উর্দু ছাপাখানা, কম্পজিটর, প্রুফ-রীডার কোথায়? বাংলা প্রেস, প্রুফ রীডাররা বেকার হবে যাবে কোথায়?

এবং সর্বশেষ দ্রষ্টব্য : পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশের স্কুল-কলেজে এখনো উর্দু শিক্ষার মাধ্যমিক হয় নি। বিবেচনা করি, আস্তে আস্তে হবে। কিন্তু পাঞ্জাবীদের পক্ষে এ কর্ম অপেক্ষাকৃত সরল হবে কারণ উর্দু তাদের মাতৃভাষা। দরকার হলে কেঁদে-ককিয়ে তারা উর্দুতে আপন আপন বিষয় পড়াতে পারবেন কিন্তু বাঙালী মাস্টার-প্রফেসারের পক্ষে উর্দু শিখে আপন কর্তব্য সমাধান করতে বহু বহু বৎসর লাগবে। ততদিন আমরা ত্রি-লেগেড রেস রান করি?——বিশেষ করে যখন কিনা পূর্ব পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাষ্ট্রাংশ করার জন্য আমাদের কর্তব্য (ফরুজু বললে ভালো হয়) উর্ধ্বশ্বাসে, ত্বরিতগতিতে সম্মুখপানে ধাবমান হওয়া।

উর্দুওয়ালারা যদি বলেন, “না, আমরা ইস্কুল-কলেজে উর্দু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শেখাব, আজ যে রকম ফারসী, আরবী, সংস্কৃত অপশনাল সেকেণ্ড ল্যানগুইজ হিসেবে শেখাচ্ছি”, তা হলে এ প্রস্তাবে যে আমাদের বিন্দুমাত্রও আপত্তি নেই শুধু তাই নয়, আমরা সর্বান্তঃকরণে সায় দিই। প্রসঙ্গান্তরে সে আলোচনা হবে!

এ বিষয়ে আরেকটি কথা এই বেলা বলে নেওয়া ভালো। সাধারণত ওদিকে কেউ বড় একটা নজর দেন না। আমাদের প্রশ্ন, সব বিষয় পড়াবার জন্য যদি আমরা উর্দু শিক্ষক পেয়েও যাই, উর্দু শিক্ষয়িত্রী পাব কি? না পেলে আমাদের স্ত্রীলোকদের শিক্ষার কি ব্যবস্থা হবে উর্দুওয়ালারা ভেবে দেখবেন কি? আমাদের কাছে পাকাপাকি খবর নেই, কিন্তু শুনতে পাই বাংলা শিক্ষয়িত্রীর অভাবেই আমরা যথেষ্ট কাহিল হয়ে পড়েছি। (এস্থানে উল্লেখ করি শ্রীহট্ট শহরের মহিলা মুসলিম লীগ তথা অন্যান্য মহিলারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গত নভেম্বর মাস থেকে একটানা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, পাকিস্তান নবজাত শিশুর ন্যায় নবজাত রাষ্ট্র। মাতৃভাষারূপ মাতৃস্তন্য ব্যতীত অন্য যে-কোনো খাদ্য তার পক্ষে গুরুপাক হবে’।)

উর্দুওয়ালারা কেউ কেউ বলে থাকেন,—“অতশত বুঝি না, আমরা চাই, বাংলা ভাষার আজ যে পদ পূর্ব পাকিস্তানে আছে ঠিক সেই রকমই থাক, এবং ইংরেজির আসনটি উর্দু গ্রহণ করুক।” তার অর্থ এই যে উর্দু উচ্চশিক্ষার মাধ্যমিক (মিডিয়ম্ অব্ ইনস্ট্রাকশন্) হোক।

মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা শিক্ষার মাধ্যমিক করলে যে কি প্রাণঘাতী বিষময় ফল জন্মায় তার সবিস্তার আলােচনা না করে উপায় নেই।

প্রথমত পৃথিবীর কোন শিক্ষিত সভ্য দেশ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছে? ইংলণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালি, চীন, জাপান, রুশ, মিশর, ইরাক, তুকী, ইরান এমন কোন দেশ আছে যেখানকার লোক আপন মাতৃভাষাকে অবমাননা করে  আপন দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে? আরবী পূত পবিত্র, ঐশ্বর্যশালিনী, ওজস্বিনী ভাষা, কিন্তু কই তুকী, ইরান, চীন, জাভার কোটি কোটি লােকে তো আরবীর মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে না, বিদ্যাভ্যাস শাস্ত্রচর্চা করে না। তবে বাংলার বেলায় এ ব্যত্যয় কেন? বাংলা-ভাষা-ভাষী লোকসংখ্যা তো নগণ্য নয়। সংখ্যা দিয়ে যদি ভাষার গুরুত্ব নির্ণয় করি এবং সে নির্ণয়করণ কিছু অন্যায় নয়-তবে দেখতে পাই চীনা, ইংরেজী, হিন্দী-উর্দু, রুশ, জর্মন ও স্পেনিশের পরেই বাংলার স্থান। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ছয় কোটি (পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সােয়া চার কোটি) এবং তার তুলনায় ভুবনবিখ্যাত ফরাসী ভাষায় কথা বলে সাড়ে চার কোটি, ইতালিয়ানে চার কোটি, ফার্সীতে এক কোটি, তুর্কীতে সত্তর লক্ষ, এমনকি আরবীতেও মাত্র আড়াই কোটি। যে ভাষায় এত লোক সাহিত্য সৃষ্টি করবার জন্য। সুযোগ অনুসন্ধান করছে তাদের এতদিন চেপে রেখেছিল মৌলবী-মৌলানাদের আরবী-ফারসী-উর্দু এবং পরবর্তী যুগে ইংরেজী। বাংলার সময় কি এখনো আসে নি, সুযােগ কি সে কোনো দিনই পাবে না ?

মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষাদানের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে এবং তার ফল কি সেকথাও ঐতিহাসিকদের অবিদিত নয়। ক্যাথলিক জগতের কেন্দ্র অর্থাৎ পোপের সঙ্গে যোগ রাখার প্রলোভনে (আজ পূর্ব পাকিস্তান করাচীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য যে রকম প্রলুব্ধ) একদা ইয়োরোপের সর্বত্র লাতিনের মাধ্যমিকে শিক্ষাদান পদ্ধতি জনসাধাণের মাতৃভাষার উপর-জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। এবং সে পাথর সরাবার জন্য লুথারের মত সংস্কারক ও প্রোটেস্টান্ট ধর্মের মত নবীন সংস্কার পদ্ধতির প্রয়োজন হয়েছিল। পরবর্তী যুগে দেখতে পাই ফরাসী লাতিনের জায়গা দখল করেছে এবং তার চাপে দিশে হারা হয়ে ফ্রেডরিক দি গ্রেটের মত জর্মন সম্রাট মাতৃভাষা জর্মনকে অবহেলা করে ফরাসীতে কবিতা লিখেছেন এবং সে কবিতা মেরামত করবার জন্য ফরাসী গুণী ভলতেয়রকে পৎসদামে নিমন্ত্রণ করেছেন। ঠিক সেই রকম রাশিয়ারও অনেক বৎসর লেগেছিল ফরাসীর নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে। আজ উর্দুওয়ালারা বাংলাকে যে রকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন ঠিক সেই রকম জর্মন ও রুশ আপন আপন মাতৃভাষাকে অবহেলা করে বহু বৎসর যশের মন্দিরে প্রবেশ লাভ করতে পারেন নি।

এসব উদাহরণ থেকে এইটুকু স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যতদিন পর্যন্ত মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমিক রূপে গ্রহণ না করা হয় ততদিন শিক্ষা সমাজের উচ্চস্তরের গুটিকয়েক সংস্কৃতিবিলাসের উপকরণ হয় মাত্র এবং যেখানে পূর্বে শুধু অর্থের পার্থক্য মানুষে মানুষে বিভেদ আনত সেখানে উচ্চশিক্ষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য দুই শ্রেণীর বিরোধ কঠোরতর করে তোলে।

 

 

 

 

 

Series Navigation<< পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ১ ।।পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ৩।। >>

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →