Main menu

সেইসব কিছুরে গুডবাই – জোয়ান ডিডিওন

জোয়ান ডিডিওনের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৫ ডিসেম্বরে, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোতে। পাঁচ বছর বয়স থেকেই উনি লেখালেখি করতেন। হাতের কাছে যেই বই পাইতেন পইড়া ফেলতেন। টিনেজার থাকা অবস্থায় সেন্টেন্স স্ট্রাকচার বুঝার জন্য উনি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কাজগুলা টাইপ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উনার বাবা আর্মিতে ছিলেন দেখে প্রায়ই উনাদের মুভ করতে হইছে। এই ব্যাপারটা উনারে অ্যাফেক্ট করছিল, উনি কইছেন যে যেই জায়গাতেই যাইতেন নিজেরে আউটসাইডার মনে হইত। বেশ লাজুক, বুকিশ হিসেবেই বড় হইছেন, যেইটা উনি পরে অভিনয় আর পাবলিক স্পিকিং কইরা কাটাইছেন। বার্কলিতে (ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া, ইংলিশে গ্র্যাজুয়েট করছেন) সিনিয়র ইয়ারে থাকার সময় উনি ভোগ ম্যাগাজিনের ‘প্রি দে প্যারিস’ নামের এসে কন্টেস্টে ফার্স্ট হইছিলেন, যেইটার জন্য পরে উনি ম্যাগাজিনটাতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজের অফার পান।

ভোগে কাজ করার সময় উনি উনার প্রথম নভেল রান, রিভার (১৯৬৩) পাবলিশ করেন। নভেলটার থিম ছিল বিয়ে আর ক্যালিফোর্নিয়া। প্রথমে যখন ক্রিটিকরা এই বইরে তেমন নোটিস করেন নাই, আপসেট হইছিলেন। পরে অবশ্য উনি এই নভেলরে বেশ ক্রিটিসাইজ করছেন, কইছেন যে নভেলটা উনি হোমসিক অবস্থায় লিখছিলেন, ওইটা নাকি ভুয়া নস্টালজিয়া আর ফেক ক্যালিফোর্নিয়ান লাইফের উপর লেখা। এরপরে উনি স্যাটার্ডে ইভেনিং পোস্টে কলাম লিখা শুরু করলেন। ক্যালিফোর্নিয়া নিয়া লেখা এই ম্যাগাজিন কলামগুলার কালেকশন নিয়া ডিডিওনের পরের কাজ স্লাউচিং টোয়ার্ডস বেথেলহেম (১৯৬৮) পাবলিশড হইল। এই বই অবশ্য ক্রিটিকরা ইমিডিয়েটলি নোটিস করেন আর এইটার পপুলারিটি বাড়তে থাকে। এই নন ফিকশন বইটা দিয়া উনি একজন পপুলার এসে রাইটার হিসেবে আমেরিকান লিটারেচারে নিজের জায়গা পাকা করেন।

উনার লেখার স্টাইলরে নিউ জার্নালিজম জঁরার মধ্যে ফেলা যায়। নরমাল জার্নালিজম স্টাইল উনার বেশি একটা পছন্দ না। উনার লেখা এসের মধ্যে তাই উনার নিজস্ব একটা স্টাইল খুঁইজা পাওয়া যায়, যেইখানে একটা লেখা শুধু কিছু ইনফরমেশনের কালেকশন না, এইটার সাথে লেখকের নিজের ফিলিংস থাকে, একটা সাব্জেক্টিভ ভাব থাকে। উনার এই ইউনিক লেখার স্টাইল নিয়া অবশ্য ক্রিটিসিজমও হইছে, উনার সময়েরই আরেকজন কইছে যে উনার সব লেখার সাব্জেক্ট উনি নিজেই, যেইটা নিয়া ডিডিওন বেশ প্যারা খাইছিল। উনি জার্নালিজম নিয়াও বেশ ইন্টারেস্টেড, তাই জার্নালিস্টদের প্রায়ই অবজার্ভ করেন। উনার মতে ফিকশন আর নন ফিকশন লেখার প্রসেসের মধ্যে ফারাকটা হইল নন ফিকশনে হুটহাট নানা জিনিস বাইর হয়, আর এইটা লেখার সময় বাইর হয় না, রিসার্চ করার সময় বাইর হয়। উনার লেখাতে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, হেনরি জেমস আর জর্জ এলিওটের কাজের ইনফ্লুয়েন্স দেখা যায়।

ষাট থেকে সত্তরের দশকে জোয়ান ডিডিওনের লেখাগুলা কাউন্টারকালচারের বাস্তবতা নিয়া কথা কইত, হলিউডের বাস্তবতার কথা কইত। উনি ১৯৯১ সালের নিউ ইয়র্ক সিটির ‘সেন্ট্রাল পার্ক ফাইভ’ কেসের সরকারি পক্ষের বিভিন্ন আর্গুমেন্টের লুপহোল বের করছিলেন, লেখালেখি করছিলেন যে ওই পাঁচজন আসামির বিচারটা ওদের রেসের জন্য ঠিকভাবে করা হয় নাই। উনি প্রথম কয়েকজনের মধ্যে একজন ছিলেন যারা এই দাবি তুলছিলেন। এমনে পলিটিকাল সাবটেক্সট নিয়া বেশ লেখালেখি করছেন। ‘৬৮ এর দিকে মেন্টাল ব্রেকডাউন, পরে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসসহ নানা ধরণের রোগ ধরা পড়ার পরেও দমেন নাই। ২০০৩ সালে হাজব্যান্ড মারা যাওয়ার দুই বছরের মাথায় একমাত্র মেয়েও মারা যায়। উনাদের নিয়া উনি পরপর দুইটা বই লিখেন, যেইটা উনার শোক প্রসেস করার জন্য বেশ থেরাপেটিক হইয়া দাঁড়াইছিল। উনি আর উনার হাজব্যান্ড মিইলা কয়েকটা মুভির জন্য স্ক্রিনপ্লেও লিখছিলেন।

জোয়ান ডিডিওন এখন পর্যন্ত পাঁচটা ফিকশন, চৌদ্দটা নন ফিকশন, ছয়টা স্ক্রিনপ্লে আর একটা নাটক লিখছেন। ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, সেইন্ট লুইস লিটারেরি অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক অ্যাওয়ার্ড তো পাইছেনই, হার্ভার্ড আর ইয়েল উনাকে সম্মানসূচক ডক্টরেটও দিছে। ২০১৭ সালে নেটফ্লিক্স থেকে উনার জীবন নিয়া ডকুমেন্টারি রিলিজ হইছে। উনি এখন নিউ ইয়র্কে থাকেন, এখনো লিখালিখি করেন।

রূপকথা নাওয়ার

… … …

জোয়ান ডিডিওন। ছবি: গুগুল সার্চ থিকা নেয়া।

 

সেইসব কিছুরে গুডবাই

কোনকিছুর শুরুওয়াত দেখা সহজ, শেষ দেখা কঠিন। কখন আমার জন্য নিউ ইয়র্ক শুরু হইল- এখন আমি এইটা এত স্পষ্ট কইরা মনে করতে পারি যে আমার ঘাড়ের নার্ভগুলা শক্ত হয়া যায়, কিন্তু আমি মনে করতে পারি না কোন সময়ে এইটা শেষ হইছিল। এত অস্পষ্টতা, দ্বিতীয় শুরুয়াত, ভাঙা প্রমিজগুলা সরায়া আমি মনে করতে পারি না ঠিক কোন পেইজে কোন জায়গায় নায়িকা আগের মত অপটিমিস্টিক থাকে না। আমার বয়স যখন ২০ বছর তখন আমি নিউ ইয়র্কে আসি। তখন সামার ছিল। আমি পুরান আইডেলওয়াইল্ড টেম্পোরারি টার্মিনাল থেকে একটা ডিসি-৭ (প্লেন) এ করে আইছিলাম। আমার একটা জামা পরা ছিল যেইটা স্যাক্রামেন্টোতে খুব স্মার্ট দেখাইতেছিল, কিন্তু নামার সাথেই পুরান টার্মিনালেও জামাটারে অলরেডি কম স্মার্ট লাগা শুরু করল। হালকা গরম বাতাসে একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছিল। নিউ ইয়র্ক নিয়া এত বছরের দেখা যত মুভি, যত শোনা গান, যত পড়া গল্প- সবকিছু থেকে আমার মনে হইছিল যে জীবন আর আগের মত থাকবে না। আর এইটা থাকেও নাই। পরে আপার-ইস্ট সাইডের সব জুকবক্সে একটা গান বাজত “but where is the school-girl used to be me” (সেই স্কুল-গার্ল আমি এখন কই), অনেক রাত হইলে আমিও এইটাই ভাবতাম। আমি এখন জানি যে আগে হোক, পরে হোক, যাই করতে থাকুক, প্রায় সবাই এই জিনিসটা নিয়া ভাবে। কিন্তু বিশ, একুশ, এমনকি তেইশ বছর বয়সী হওয়ার একটা ভালো দিক হইল, একটা শক্ত বিশ্বাস থাকে যে প্রমাণ থাকলেও এইরকম কিছু কখনো কারো সাথে হয় নাই।

যদি সময় আর পরিস্থিতি অন্যরকম হইত, আমি অন্যরকম হইতাম, অবশ্যই এইটা অন্য একটা শহর হইতে পারত- প্যারিস বা শিকাগো, এমনকি স্যান ফ্রান্সিসকোও, কিন্তু যেহেতু আমি নিজের কথা কইতেছি, আমি এইখানে নিউ ইয়র্ক নিয়াই কইতেছি। ওই প্রথম রাতে আমি বাসে কইরা শহরে যাইতে যাইতে জানালা দিয়া চারপাশ দেখতেছিলাম, কিন্তু যেদিকেই তাকাইতেছিলাম দেখতেছিলাম কুইন্স শহরের সব ময়লা আর বড় বড় সাইন যেগুলাতে লেখা ছিল “মিডটাউন টানেল এই গলিতে”, তারপর সামারের বৃষ্টি পড়ল (এইটাও আমার কাছে অসাধারণ আর এক্সোটিক লাগছিল, কারণ আমি ওয়েস্ট থেকে আসছি যেখানে সামারে বৃষ্টি হইত না)। পরের তিন দিন আমি একটা হোটেলের ৩৫০ ফারেনহাইট তাপমাত্রা সেট করা এসি রুমে কাঁথামুড়ি দিয়া জ্বর আর বাজে রকমের ঠাণ্ডা থেকে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করতেছিলাম। আমার মনেও হয় নাই যে ডাক্তার ডাকা উচিত, কারণ আমি কোন ডাক্তাররে চিনতামই না, আর যদিও মনে হইছিল যে ডেস্কে কল কইরা এসিটা বন্ধ কইরা দিতে বলি, আমি কলটা করি নাই। কারণ আমি জানতাম না কেউ আসলে তারে কত টাকা বখশিশ দিতে হবে- কেউ কি কখনো এত ইয়াং ছিল? আমি আপনাদের বলতেছি, হ্যাঁ, কেউ ছিল। ওই তিন দিন আমি যা করছি তা হইল একটা ছেলের সাথে লং ডিস্ট্যান্সে কথা কইছি, যারে আমি কখনই বসন্তে বিয়া করতাম না। আমি তারে কইছিলাম, আমি শুধু ছয় মাস নিউ ইয়র্কে থাকব, আর আমি জানালা দিয়া ব্রুকলিন ব্রিজ দেখতে পারি। দেখা গেল, ব্রিজটা আসলে ট্রাইবরো ব্রিজ ছিল, আর আমি আট বছর থাইকা গেলাম।

আগের কথা ভাবলে মনে হয় আমি যখন সব ব্রিজের নাম জানতাম না তখনই বেশি হ্যাপি ছিলাম, আপনিও বুঝবেন। আমি আপনারে যা বলতে চাই তা হইল নিউ ইয়র্ক শহরে ইয়াং অবস্থায় কেমন লাগে, কেমনে ফিল্মের মত সহজেই ছয় মাস আট বছরে গড়ায়া যায়। আমার কাছে ওই বছরগুলা এমনই লাগে, ফিল্মের সেন্টিমেন্টাল ভিডিও ইফেক্ট আর ওল্ড-ফ্যাশন্ড কিছু ট্রিক শটের মত- সিগ্রাম বিল্ডিং এর ঝর্ণাগুলা স্নোফ্লেক হয়া যায়, আমি বিশ বছর বয়সে একটা বিল্ডিংয়ে ঢুকি আর আরেক রাস্তায় বয়স্ক হিসাবে বের হই। আমি আপনারে বিশেষ কইরা বুঝাইতে চাই, এর সাথে মনে হয় নিজেরেও, কেন আমি আর নিউ ইয়র্কে থাকি না। এইটা বলা হয়া থাকে যে নিউ ইয়র্ক শুধু বেশি বড়লোক আর বেশি গরিবদের জন্য। এইটা কম বলা হয় যে, নিউ ইয়র্ক সবচেয়ে ইয়াং মানুষদের জন্যও, অন্তত আমরা যারা অন্যজায়গা থেকে আসছি তাদের কাছে।

আমার মনে পড়ে, একবার ডিসেম্বরের নিউ ইয়র্কের এক ব্রাইট, ঠাণ্ডা সন্ধ্যায় আমি আমার এক বন্ধুরে, যে অনেকদিন ধইরাই এইখানে থাকে, তেইশ বছর বয়সী রিসোর্সফুলনেসের সাথে কইছিলাম যেন আমার সাথে এক পার্টিতে যায়, তাইলে ওইখানে “নতুন নতুন চেহারা” দেখতে পারবে। তার তখন হাসতে হাসতে দম আটকানোর মত অবস্থা হয়া গেল, আর আমি ট্যাক্সির জানালা খুইলা তার পিঠে বাড়িও মারছিলাম। সে পরে আমারে কইলো, “নতুন নতুন চেহারা? আমারে নতুন চেহারা নিয়া বইলো না।” ব্যাপারটা ছিল যে শেষবার যখন সে এইরকম “নতুন চেহারা” এর প্রমিজওয়ালা পার্টিতে গেছিল, সেই পার্টিতে পনেরজন ছিল, যার মধ্যে পাঁচজন মহিলার সাথে সে এর মধ্যেই বিছানায় গেছে, আর দুইজন পুরুষ বাদে সবাই তার কাছে টাকা পায়। আমি তার সাথে হাসতেছিলাম, কিন্তু প্রথম তুষার পড়া শুরু করল, পার্ক এভিনিউয়ে যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় ক্রিসমাস ট্রিগুলা হলুদ আর সাদা বাতিতে জ্বলজ্বল করতেছিল, আর আমার জামাটা নতুন ছিল। এই কাহিনির বিশেষ মোরালটা বুঝতে আমার লম্বা সময় লাগছিল।

লম্বা সময় লাগছিল কারণ খুব সিম্পল, আমি নিউ ইয়র্কের প্রেমে পড়ছিলাম। আমি ইনফর্মাল ভাবে “প্রেম” বুঝাইতেছি না, আমি বলতেছি আপনারে টাচ করা প্রথম মানুষটারে আপনি যেমন ভাবে ভালোবাসেন যে আপনি আর কাউরে ওই ভাবে ভালোবাসতে পারেন না, ঠিক তেমন ভাবেই আমি শহরটার প্রেমে পড়ছিলাম। আমার মনে আছে কোন এক প্রথম বা দ্বিতীয় বসন্তে (সব বসন্ত একটা সময়ের জন্য একইরকম ছিল) আমি ভোরের দিকে সিক্সটি-সেকেন্ড স্ট্রিটে হাঁটতেছিলাম। কারো সাথে দেখা করতে গিয়া দেরি হয়া গেছিল, কিন্তু আমি লেক্সিংটন এভিনিউতে থাইমা একটা পিচ কিনছিলাম আর কর্নারে দাঁড়ায়া ওইটা খাইতেছিলাম। আমি জানতাম আমি ওয়েস্ট থেকে বাইর হইয়া এক মরীচিকায় আসছি। আমি পিচটার স্বাদ পাইতেছিলাম আর টের পাইতেছিলাম সাবওয়ে থেকে হালকা বাতাস আমার পা ছুঁইতেছে। আমি লায়লাক (ফুল), ময়লা আর দামী পারফিউমের গন্ধ পাইতেছিলাম আর আমি জানতাম কখনো না কখনো আমারে এই শহরে থাকার দাম দিতে হবে, কারণ আমি ওইখানের না, ওইখানে আমার জন্ম হয় নাই- কিন্তু আপনি যখন বাইশ-তেইশ বছর বয়সী হন, আপনি বুইঝা যান পরে আপনার একটা হাই ইমোশনাল ব্যালেন্স হবে, আর যতই দাম হোক, আপনি এইটা দিতে পারবেন। আমি তখনো পসিবিলিটিতে বিশ্বাস করতাম, তখনো আমার ওই সেন্সটা ছিল যে যেকোন মিনিটে, দিনে বা মাসে অসাধারণ কিছু হবে, যেই সেন্সটা নিউ ইয়র্কে তেমন কারো থাকে না। আমি তখন সপ্তাহে মাত্র ৬৫ বা ৭০ ডলার কামাইতাম (আমি যেই ম্যাগাজিনে কাজ করতাম সেইটার এডিটর আমারে আয়রনি ছাড়াই কইছিল, “নিজেরে হ্যাটি কার্নেগির আন্ডারে ভাবেন”), এত কম কামাইতাম যে কিছু কিছু সপ্তাহে আমারে ব্লুমিংডেলের গোর্মে শপের ফ্রি খাবার খায়া চলতে হইত। এই জিনিসটা আমি ক্যালিফোর্নিয়াতে পাঠানো চিঠিতে লিখতাম না। আমি কখনো বাপরে বলি নাই যে টাকা দরকার, কারণ তাহলে উনি পাঠায়া দিতেন, আর আমি তাহলে কখনো জানতে পারতাম না আমি একা কিছু পারতাম কিনা। ওই সময়ে কামাই করা আমার কাছে একটা গেম ছিল, ইচ্ছামত রুলস বানাইতাম কিন্তু ওইগুলা ফ্লেক্সিবল হইত না। আর কোন কোন বিশেষ শীতের সন্ধ্যা বাদে- ধরেন সাড়ে ছয়টা বাজে, সেভেন্টিজের এভিনিউগুলাতে তখনই অন্ধকার হয়া যাইত আর নদীর পাশ দিয়া ঠাণ্ডা বাতাস বইত, যখন আমি বাস ধরার জন্য অনেক জোরে হাঁটতাম আর ব্রাউনস্টোনের তৈরি ব্রাইট জানালার ভিতর দিয়া দেখতাম পরিষ্কার কিচেনে বাবুর্চি কাজ করতেছে, উপরতলায় নারীরা মোমবাতি জ্বালাইতেছে, তার উপরের ফ্লোরে সুন্দর সুন্দর বাচ্চাদের গোসল করানো হইতেছে- এইসব রাতের কথা বাদ দিলে আমার নিজেরে কখনো গরিব মনে হয় নাই। আমার এইরকম একটা ফিলিং থাকত যে টাকার দরকার হইলে আমি কোনভাবে পায়া যাব। আমি ‘ডেবি লিন’ নাম দিয়া টিনেজারদের জন্য সিন্ডিকেটেড কলাম লিখতে পারতাম, বা ইন্ডিয়াতে গোল্ড পাচার করতে পারতাম বা ১০০ ডলারের কল গার্ল হইতে পারতাম, কিছুই ম্যাটার করত না।

কিছুই আনচেইঞ্জেবল ছিল না, সবকিছুই হাতের কাছে পাওয়া যাইত। প্রত্যেক কোণাতেই এমন ইন্টারেস্টিং জিনিসপাতি পাওয়া যাইত যেইগুলা আমি কখনো দেখি নাই, করি নাই বা জানতাম না। একটা পার্টিতে গিয়া দেখা যাইত আমার এমন একজনের সাথে দেখা হইল যে নিজেরে মিস্টার ইমোশনাল অ্যাপিল নামে পরিচয় দেয় আর দ্য ইমোশনাল অ্যাপিল ইন্সটিটিউট চালায়। বা টিনা অনাসিস ব্ল্যানফর্ডের সাথে, বা “বিগ সি” (সাউথহ্যাম্পটনের এল মরক্কো সার্কিট) এর একজন ফ্লোরিডা থেকে আসা মানুষের সাথে (“বিগ সিতে আমার বেশ নামটাম আছে, হানি,” ভাড়া করা বিশাল ছাদের সবজি বাগানে আমারে এইটা কইত) দেখা হয়া যাইত। বা হার্লেম মার্কেটের হেড সেলেরি (এক ধরণের শাক) ব্যবসায়ী্র বিধবার সাথে, বা মিসৌরির বন টেরা শহরের একজন পিয়ানো সেলসম্যানের সাথে, বা টেক্সাসের মিডল্যান্ডের বড়লোক থেকে দেউলিয়া হওয়া কারো সাথে দেখা হয়া যাইত। আমি নিজের সাথে অন্যদেরও প্রমিজ করতে পারতাম যে এই প্রমিজগুলা রাখার জন্য অনেক সময় থাকবে। আমি সারারাত জাইগা একটার পর একটা ভুল করতেই থাকব, আর একটাও ম্যাটার করবে না।

দেখেন, আমি নিউ ইয়র্কে একটা কিউরিয়াস পজিশনে ছিলাম। আমার মাথায় এইটা কখনোই আসে নাই যে আমি ওইখানে একটা রিয়েল লাইফে থাকতেছি। আমার কল্পনায় আমি সবসময়ই আরো কিছু মাসের জন্য ওইখানে ছিলাম, ক্রিস্টমাস, ইস্টার বা মে মাসের প্রথম গরম দিন পর্যন্ত। এই কারণে আমি সাউথের মানুষদের সাথে সবচেয়ে কম্ফোর্টেবল ছিলাম। আমি যেইভাবে নিউ ইয়র্কে ছিলাম, তারাও সেইভাবেই ছিল। আমার মত তারাও এক জায়গা থেকে ছুটি নিয়া আসছিল, ফিউচারের কথা তেমন একটা ভাবতে চাইত না। তারা টেম্পোরারি ভবঘুরে কিসিমের ছিল, জানত নিউ অর্লিয়েন্স, মেমফিস বা রিচমন্ড- বা আমার কেসে, ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্লাইট কখন। যে সবসময় ড্রয়ারে প্লেন শিডিউল রাখে সে একটু অন্যরকম ক্যালেন্ডারে চলে। যেমন, ক্রিস্টমাস একটা কঠিন সময় হয়া দাঁড়াইত। অন্যদের কাছে খুব সহজ ছিল, একদিনের জন্য স্টোতে (ভার্মন্টের একটা শহর), বিদেশে, বা কানেক্টিকাটে মার বাসায় যাইতে পারত। আমরা যারা বিশ্বাস করতাম যে আমরা অন্য জায়গায় থাকি, আমাদের সারাদিন কাইটা যাইত এয়ারলাইন রিজার্ভেশন বুক আর ক্যান্সেল করতে করতে, বাজে আবহাওয়ার জন্য দেরি করা ফ্লাইটের অপেক্ষা করতে করতে, যেন এইটা ১৯৪০ সাল আর লিসবন থেকে চইলা যাওয়ার একটাই প্লেন বাকি। আর শেষে যারা একই জায়গায় থাইকা যাইতাম, একে অপরকে কমলা, সুভেনির, বা স্মোকড-অয়েস্টারের সাথে দূর দেশে ফালায়া আসা চাইল্ডহুড, ক্লোজ গ্যাদারিংয়ের মেমোরি দিয়া কম্ফোর্ট দিতাম।

নিজেদের দূর দেশ থেকে আসা কলোনিয়াল মনে হইত। আমরা যারা ওয়েস্ট বা সাউথ থেকে আসছি, আমরা যেমনে নিউ ইয়র্করে, নিউ ইয়র্কের আইডিয়ারে অ্যাপ্রেশিয়েট করি, আমার মনে হয় না ইস্টে বড় হওয়া কারো পক্ষে এমনে নিউ ইয়র্করে অ্যাপ্রেশিয়েট করা সম্ভব। একজন ইস্টার্ন বাচ্চার কাছে, বিশেষ কইরা এমন বাচ্চা যার সবসময় ওয়াল স্ট্রিটের কোন মামা-চাচা ছিল, যে কয়েকশ শনিবার প্রথমে এফ. এ. ও. শোয়ার্জে (খেলনার দোকান), তারপর বেস্টসের দোকানে জুতার ফিটিংয়ে, পরে বিল্টমোর ঘড়ির নিচে দাঁড়ায়া লেস্টার ল্যানিনে (জ্যাজ মিউজিশিয়ান) নাচত, এদের কাছে নিউ ইয়র্ক কেবল একটা শহর, যদিও শহরটা থাকার জন্য একটা ভালো জায়গা। কিন্তু আমরা যারা এমন জায়গা থেকে আসছি যেখানে কেউ লেস্টার ল্যানিনের নাম শুনে নাই, আর যেখানে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন মানে সবাই বুঝত শনিবারের রেডিও প্রোগ্রাম, যেখানে ওয়াল স্ট্রিট আর ফিফথ এভিনিউ ছিল কেবলমাত্র আইডিয়া (“টাকা”, “হাই ফ্যাশন”, “দ্য হাকস্টারস মুভি” এর প্রতিশব্দ), আমাদের কাছে নিউ ইয়র্ক কোন যেমন তেমন শহর ছিল না। এইটা ছিল একটা ইনফিনিট রোমান্টিক আইডিয়া, সব ভালোবাসা, টাকা আর ক্ষমতা যেইখানে এক হইত, ব্রাইট আবার নিমেষেই ফুরায়া যাবার স্বপ্ন। ওইখানে “থাকার” কথা চিন্তা করা ছিল বাস্তব থেকে কল্পনার দেশে চইলা যাওয়ার মত। কেউ কল্পনার দেশে “থাকে” না।

আসলে আমার জন্য এইটা বুঝা খুব কঠিন ছিল যে কেন যেসব ইয়াং মেয়েরা টোস্টার কিনত, অ্যাপার্টমেন্টে ক্যাবিনেট লাগাত আর একটা ভালো ফিউচারে নিজেদের কমিট করত, তাদের কাছে নিউ ইয়র্ক একটা অল্প সময়ের এস্টোরিল (পর্তুগালের বিলাসী শহর) না হয়ে রিয়েল জায়গা ছিল। আমি কখনো নিউ ইয়র্কে ফার্নিচার কিনি নাই। বছরখানেক আমি অন্যদের অ্যাপার্টমেন্টে থাকছি, এরপর আমি নাইন্টিজ এভিনিউতে বউ চইলা যাওয়া এক ফ্রেন্ডের স্টোরেজ থেকে ফার্নিচার নিয়া একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকছি। আর যখন আমি ওই অ্যাপার্টমেন্টটা ছাইড়া দিলাম, (ওইসময়ে আমি সবকিছুই ছাইড়া দিতেছিলাম, সব শেষ হয়া যাইতেছিল) যা ছিল সব রাইখা গেছিলাম, এমনকি আমার শীতের কাপড়, আমি কে আমারে মনে করায়া দেওয়ার জন্য বেডরুম দেয়ালে ঝুলানো স্যাক্রামেন্টো কাউন্টির ম্যাপটাও। সেভেন্টি-ফিফথ স্ট্রিটের একটা আশ্রমের মত চার-রুমের অ্যাপার্টমেন্টে চইলা গেছিলাম। আশ্রম বলাটাও মনে হয় মিসলিডিং, শুনলে ফ্যাশনেবল মনে হবে, কিন্তু আমি যখন বিয়ে করলাম আর আমার হাজব্যান্ড কিছু ফার্নিচার আনল, তখন ওই চার রুমে একটা সস্তা ডাবল ম্যাট্রেস, একটা বক্স স্প্রিংয়ের খাট, যেইগুলা আমি এই বাসায় আসার দিন ফোনে অর্ডার দিয়া আনাইছিলাম, আর ফ্রেন্ডের ইম্পোর্ট করা দুইটা ফ্রেঞ্চ গার্ডেন চেয়ার ছাড়া কিছু ছিল না। (আমার কাছে এখন অবাক লাগে যে নিউ ইয়র্কে যাদেরই আমি চিনতাম সবারই অদ্ভুত, লস খাওয়া সাইড ব্যবসা থাকত। তারা গার্ডেন চেয়ার ইম্পোর্ট করত যেইটা রিটেইল দোকান হ্যামেকার শ্লেমারে একদমই চলত না, বা হার্লেমে হেয়ার স্ট্রেইটনার মার্কেট করার চেষ্টা করত, বা পেপারের সানডে সাপ্লিমেন্টস কলামে মার্ডার ইনকরপোরেটেডে গ্যাং নিয়া এক্সপোজে লিখত। আমার মনে হয় আমরা কেউই অতটা সিরিয়াস ছিলাম না, শুধুমাত্র আমাদের পার্সোনাল লাইফ নিয়াই পইড়া থাকতাম।)

জোয়ান ডিডিওন

 

ওই অ্যাপার্টমেন্টে আমি বেডরুমের জানালাতে পঞ্চাশ গজ ঝলমলে হলুদ সিল্ক ঝুলানো ছাড়া কিছুই করি নাই, কারণ আমার মনে হইছিল সোনালি আলো আমারে বেটার ফিল করাবে, কিন্তু আমি পর্দাগুলা ঠিকমত মাপি নাই। ওই পুরা সামার ট্রান্সপারেন্ট সোনালি সিল্ক জানালা দিয়া বাইরে উইড়া প্যাঁচ খাইত আর বিকালের ঝড়ে ভিজে যাইত। আমি তখন আটাশ, আর ওই বছরেই আমি টের পাইতেছিলাম যে সব প্রমিজ রাখা হয় না, কিছু জিনিস আসলেই আনচেইঞ্জেবল, সবকিছু ম্যাটার করছে, প্রত্যেকটা ঢিলামি, প্রত্যেকটা ভুল, প্রত্যেকটা শব্দ- সবকিছু।

ব্যাপারটা তো তাই ছিল, না? প্রমিজগুলা? এখন নিউ ইয়র্ক আমার কাছে হ্যালুসিনেশনের মত কইরা আসে, এত ছোটছোট ডিটেইলে যে আমি মাঝে মাঝে উইশ করি যেন আমার মেমোরি কিছুটা হইলেও ডিটেইলগুলারে ভুলভাবে মনে করায়। নিউ ইয়র্কে থাকতে একটা লম্বা সময় আমি ফ্লেউর দে রোকে (Fleurs de Rocaille) আর লেয়ার ডু টাম্প (L’ Air du Temps) নামের পারফিউম ইউজ করতাম, এখন এই পারফিউমগুলার সামান্য গন্ধ পাইলেই বাকি দিন আমার ব্রেইনে শর্ট সার্কিট হইতে থাকে। হেনরি বেন্ডেলের জেসমিন সোপের গন্ধ পাইলে আমি অতীতে চইলা যাই, কাঁকড়া সিদ্ধ করতে যেইসব মসলা লাগে সেইগুলার গন্ধেও। এইটিজের এভিনিউতে একটা চেক জায়গায় ড্রামভর্তি কাঁকড়া সিদ্ধ কইরা রাইখা দিত। অবশ্যই গন্ধ মেমোরিরে জাগায়া তুলার জন্য বেশ কুখ্যাত, কিন্তু অন্য অনেক কিছু আছে যেইগুলা আমারে একইভাবে অ্যাফেক্ট করে। নীল-সাদা স্ট্রাইপের চাদর। ভারমুথ ক্যাসিস (ককটেইল)। ১৯৫৯ বা ১৯৬০ এ নতুন ধরণের ফেইডেড নাইটগাউন, কিছু শিফনের স্কার্ফ যেইগুলা আমি একই সময় কিনছিলাম।

ধরতেছি আমরা যারা নিউ ইয়র্কে ইয়াং ছিলাম আমাদের হোম স্ক্রিনে একই সিন চলে। ভোর পাঁচটায় হালকা মাথাব্যথা নিয়া অনেকগুলা অ্যাপার্টমেন্টে বইসা থাকার কথা মনে পড়ে। আমার একজন ফ্রেন্ড ছিল যে ঘুমাইতে পারত না, আর সে আরো কিছু মানুষরে চিনত যাদের একই সমস্যা, আর আমরা একসাথে ভোর হওয়া দেখতাম, বরফ ছাড়া একটা শেষ ড্রিংক খাইতাম, তারপর সকাল সকাল বাসায় যাইতাম যখন রাস্তা পরিষ্কার আর ভিজা থাকত (রাতে কি বৃষ্টি হইত? কখনো জানতাম না)। যে কয়টা ট্যাক্সি থাকত, ওদের হেডলাইটগুলা জ্বলত, আর ট্রাফিক সিগনালে খালি লাল আর সবুজ বাতিই জ্বলত। হোয়াইট রোজ বারগুলা খুব সকাল সকাল খুলত। আমার মনে আছে একজন অ্যাস্ট্রোনাটরে স্পেসে যাইতে দেখার জন্য আমি একবার ওই বারগুলার একটাতে বইসা অপেক্ষা করতেছিলাম, আর এত লম্বা সময় ধইরা অপেক্ষা করতেছিলাম যে যখন ঘটনাটা ঘটল আমি টেলিভিশনের দিকে না তাকায়া মেঝের উপর একটা তেলাপোকার দিকে তাকায়া ছিলাম। ভোরবেলার ওয়াশিংটন স্কয়ারের উপরের মলিন ডালগুলা ভালো লাগত, সেকেন্ড এভিনিউয়ের মনোক্রোম ফ্ল্যাটনেস ভালো লাগত, অদ্ভুত আর খালি ফায়ার এস্কেপ আর গ্রিল লাগানো দোকানগুলাও।

ঘুমছাড়া সকাল সাড়ে ছয়টা-সাতটায় ফাইট করা মুশকিল, আমাদের রাত জাগার একটা কারণ এইটা হইতে পারে, আর আমার কাছে এই সময়টা ভালো লাগত। নাইন্টিজে যে অ্যাপার্টমেন্ট ছিল ওইটার জানালায় শাটার দেওয়া ছিল। আমি কিছু ঘণ্টা ঘুমায়া কাজে যাইতে পারতাম। দুই-তিন ঘণ্টার ঘুম আর চক ফুল অ’ নাটসের এক কন্টেইনার কফিতে আমি কাজ করতে পারতাম। আমি কাজে যাইতে পছন্দ করতাম, ম্যাগাজিন বের হওয়ার সুদিং আর স্যাটিসফ্যাক্টরি রিদমটা পছন্দ করতাম, কেমনে কাগজে রং আর সাদা-কালো কালি ফুটত, পরে ম্যাগাজিনটা বের হইত, যেইটা গ্লসি হইত আর মনে হইত নিউজস্ট্যান্ড থেকে হাতে নিয়া মাপা যাবে। প্রুফ আর লেয়াউট দেখার ছোটখাট কাজগুলা, ম্যাগাজিন যেইদিন প্রেসে যাইত ওইদিন রাত পর্যন্ত কাজ করা, কপি ডেস্ক থেকে কল আসার অপেক্ষা করতে করতে বইসা বইসা ভ্যারাইটি পড়া। আমার অফিস থেকে মিউচুয়াল অফ নিউ ইয়র্ক বিল্ডিংয়ের ওয়েদার সিগনাল দেখা যাইত, রকেফেলার প্লাজার উপরে টাইম আর লাইফ লেখা বাতিগুলা দেখা যাইত- এইগুলা আমাকে অদ্ভুতভাবে প্লিজ করত। মভ রঙের সামারের সন্ধ্যাগুলাতে আটটা বাজে যখন আপটাউনে হাঁইটা যাইতাম, ফিফটি-সেভেন্থের জানালাগুলাতে রাখা স্যুপের বাটিগুলা, সন্ধ্যার জামাকাপড় পইরা ট্যাক্সি ভাড়া করার চেষ্টা, গাছগুলার সব পাতা উঠা, তাজা বাতাস, টাকাপয়সা আর সামারের সব সুইট প্রমিজগুলা- সবই ভালো লাগত।

কয়েক বছর গেল, কিন্তু নিউ ইয়র্ক নিয়া আমার আবেগ কমলো না। এইটার লোনলিনেসরে আমি পছন্দ করা শুরু করলাম, আমি কোথায়, কী করতেছি এইটা কারো জানার দরকার নাই, এই সেন্সটা। হাঁটাহাঁটি করতে পছন্দ করতাম। ব্যস্ত দিনগুলাতে ইস্ট রিভার থেকে হাডসনে হাঁটতাম, গরম দিনগুলাতে ভিলেজের কাছে হাঁটতাম। আমার এক ফ্রেন্ড ছিল যে শহরের বাইরে গেলে আমারে তার ওয়েস্ট ভিলেজের অ্যাপার্টমেন্টের চাবি দিয়া যাইত। মাঝেমাঝে আমি ওইখানেই কয়েকদিন থাইকা যাইতাম, কারণ ততদিনে টেলিফোনটা বেশ বিরক্তিকর লাগা শুরু করছিল (বুঝছেন, গোলাপে অলরেডি পোকা ধরে গেছিল) অথচ বেশি মানুষের কাছে আমার নাম্বার ছিল না। আমার মনে পড়ে, ওয়েস্ট ভিলেজের নাম্বার জানে এমন একজন আমারে লাঞ্চের জন্য পিক আপ করতে গেছিল, আর আমাদের দুইজনেরই হ্যাংওভার হইতেছিল। বিয়ার খুলতে গিয়া আমার আঙুল কাইটা গেছিল আর আমি কাইন্দা দিছিলাম। এরপরে একটা স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে গিয়া বেটার ফিল না করা পর্যন্ত ব্লাডি মেরি (ককটেইল) আর গাজপাচো (ডিশ) খাইছিলাম। এমন কইরা সন্ধ্যা কাটাইতে আমার কখনো গিল্ট ফিল হয় নাই, কারণ আমার কাছে তখনো দুনিয়ার সব সন্ধ্যা পইড়া ছিল।

আর এত পরেও আমি তাও পার্টিতে যাইতে পছন্দ করতাম, সব ধরণের পার্টি- বাজে পার্টি, স্টাইভেসান্ট শহরে থাকা নতুন বিয়া করা কাপলের দেওয়া শনিবার-বিকালের পার্টি, আনপাবলিশড বা ব্যর্থ লেখকদের দেওয়া ওয়েস্ট সাইড পার্টি, যারা সস্তা রেড ওয়াইন সার্ভ করত আর গুয়াদালাজারাতে (মেক্সিকান শহর) যাওয়ার কথা কইত, ভিলেজ পার্টি যেখানে সব গেস্ট অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে কাজ করত আর রিফর্ম ডেমোক্র‍্যাটদের ভোট দিত, সার্ডির প্রেস পার্টি, সবচেয়ে বাজে পার্টিগুলা৷ আপনি মনে হয় এতক্ষণে বুইঝা গেছেন আমি অন্যের এক্সপেরিয়েন্স থেকে ফায়দা নিতাম না, যে অনেক লম্বা সময় যাওয়ার পরেই আমি নতুন নতুন চেহারায় বিশ্বাস করা বন্ধ করে দিছিলাম আর ওই গল্পটার লেসন বুঝা শুরু করছিলাম। লেসনটা ছিল যে ফেয়ার অঞ্চলে অনেক লম্বা সময় থাকাটা ভালোমতই পসিবল।

আমি কইতে পারব না কখন আমি এইটা বুঝতে শুরু করছিলাম। আমি শুধু জানি যে আমার বয়স যখন আটাশ বছর ছিল আমার দিনকাল খুব খারাপ যাইতেছিল। যেটাই আমারে বলা হইত মনে হইছিল আগেও শুনছি, তাই আমি আর কিছু শুনতে পারতাম না। গ্র‍্যান্ড সেন্ট্রালের কাছে ছোট বারগুলাতে বইসা কানেক্টিকাটের ট্রেন ছুইটা যাওয়া মানুষের বাসার বুয়ার সাথে বউয়ের বনিবনা না হওয়ার কমপ্লেনও শুনতে পারতাম না। পাবলিশার কত টাকা অ্যাডভান্স দিছে, ফিলাডেলফিয়াতে কোন নাটকের সেকেন্ড অ্যাক্টে ঝামেলা হইতেছে, এইসব নিয়া আর ইন্টারেস্ট পাইতেছিলাম না। যেইসব মানুষের সাথে আমি নিজে থেকে দেখা করলেই পছন্দ করতাম, ওইসব মানুষের ব্যাপারেও ইন্টারেস্টেড ছিলাম না। আমি তাদের সাথে দেখা কইরা ফেলছি, সবসময়ই করতাম। শহরের কিছু অংশ অ্যাভয়েড করতে হইত। উইকডে সকালগুলা আমি আপার ম্যাডিসন এভিনিউ সহ্য করতে পারতাম না, (এইটা খুবই প্যারা ছিল কারণ আমি তখন ম্যাডিসনের পঞ্চাশ/ষাট ফিট পূর্বদিকে থাকতাম) কারণ আমি দেখতাম মহিলারা ইয়র্কশায়ার টেরিয়ার (কুকুরের ব্রিডের নাম) হাঁটাইত আর গ্রিস্টিডিসে শপিং করত। এইসব দেইখা আমার একটা ভেবলেনীয় (থরস্টিন ভেবলেনের কাজ, বিলাসিতারে ট্যাবু ধরা হয়) খিদা লাগত। আমি কোন কারণ ছাড়াই বিকালে টাইমস স্কয়ারে যাইতে পারতাম না, নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে যাইতে পারতাম না। একদিন দেখা গেল আমি স্ক্র‍্যাফটসে (দোকান) যাইতে পারতেছি না, পরেরদিন থেকে বনউইট টেলারেও (দোকান) না।

যাদের নিয়া কেয়ার করতাম তাদের হার্ট করতাম, যাদের নিয়া কেয়ার করতাম না তাদের ইনসাল্ট করতাম। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ থেকে নিজেরে সরায়া নিছিলাম। এতই কানতাম যে বুঝতেও পারতাম না কখন কানতেছি বা কানতেছি না, লিফটে, ট্যাক্সিতে, চাইনিজ লন্ড্রিগুলাতেও কানতাম। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর উনি কইলেন আমারে ডিপ্রেসড লাগতেছে, একজন “স্পেশালিস্ট” দেখানো উচিত। একজন সাইকিয়াট্রিস্টের নাম-ঠিকানাও দিলেন, কিন্তু আমি যাই নাই।

উল্টা আমি বিয়া কইরা ফেললাম, যেইটা দেখা গেল আমার জন্য ভালোই হইছিল, কিন্তু বাজে টাইমিংয়ে। এইটার পরেও আমি সকালে আপার ম্যাডিসন এভিনিউতে হাঁটতে পারতাম না, মানুষের সাথে কথা বলতে পারতাম না, চাইনিজ লন্ড্রিতে কান্নাকাটি করতাম। “হতাশা” কী এইটা আগে জানতাম না, আমি শিওর না এখন জানি কিনা, কিন্তু ওই বছর বুঝছিলাম। অফ কোর্স আমি কাজ করতে পারতাম না। ডিনারও শিওরলি আনাইতে পারতাম না, সেভেন্টি-ফিফথ স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্টে প্যারালাইজড হয়া বইসা থাকতাম যতক্ষণ না আমার হাজব্যান্ড অফিস থেকে কল দিয়া আমারে কইত যে আমার ডিনার আনানো লাগবে না, মাইকেলস পাব, টুটস শডস বা সার্ডিস ইস্টে ওর সাথে ডিনার করলেও হবে। তারপর এপ্রিলের এক সকালে (আমরা জানুয়ারিতে বিয়া করছিলাম) ও আমারে কল দিয়া কয় যে ও নিউ ইয়র্ক থেকে কিছুদিনের জন্য বাইর হইতে চায়, ছয় মাসের ছুটি নিয়া আমরা কোথাও যাইতে পারি।

জোয়ান ডিডিওন

এইটা বলার পর তিন বছর হয়া গেছে, আমরা এর পর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকি। নিউ ইয়র্কের অনেকে এটারে অদ্ভূত ভাবে, আমাদের বলছেও। এইটার কোন পসিবল আর যথেষ্ট ভালো উত্তর আমাদের কাছে নাই, তাই অন্যরা যা বলে তেমন কয়েকটা কথা বইলা দেই। বলি যে আমাদের জন্য এখন নিউ ইয়র্কে থাকা “অ্যাফোর্ড” করা মুশকিল, আমাদের কত “স্পেস” দরকার। আমি যেইটা মিন করি, সেইটা হইলো যে আমি নিউ ইয়র্কে অনেক ইয়াং অবস্থায় গেছি, আর কোন পয়েন্টে ওই সোনালি রিদম ভাইঙ্গা গেছে, আমি আর তেমন ইয়াং নাই। শেষবার এক ঠাণ্ডা জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্কে গেছিলাম, সবাই অসুস্থ আর টায়ার্ড ছিল। ওইখানে আমি যাদের চিনতাম তারা ডালাসে চইলা গেছিল, নাইলে অ্যান্টাবিউস (ড্রাগ) নিয়া পইড়া ছিল, নাইলে নিউ হ্যাম্পশায়ারে ফার্ম কিনছিল। আমরা দশ দিন থাকছিলাম, তারপর বিকালের ফ্লাইটে লস অ্যাঞ্জেলেসে ব্যাক করছিলাম। ওই রাতে বাসায় ফেরার পথে আমি প্রশান্ত মহাসাগরের উপর চাঁদ দেখতেছিলাম, আর চারপাশে জেসমিনের গন্ধ পাইতেছিলাম, আর দুইজনই তখন বুঝছি যে নিউ ইয়র্কে যেই অ্যাপার্টমেন্ট আমরা এখনো রাইখা দিছি, ওইটার কোন দরকার নাই। একসময় আমি লস অ্যাঞ্জেলেসরে “দা কোস্ট” কইতাম, কিন্তু মনে হয় অনেক আগে।

১৯৬৭

বইটা কিনতে এই লিংকে ক্লিক করেন:
ইন্টারভিউ সিরিজ এবং বাছবিচার ও প্রিন্ট পোয়েট্রি’র বই – Posts | Facebook

The following two tabs change content below.
Avatar photo

রপকথা নাওয়ার

জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →