কংসের তীরে বসন্ত আসবে দেরিতে!
একটি বিশেষ ঘোষণা। রাত ছোট হয়ে গেছে, দিন বড় হয়ে গেছে— প্রত্যেক রুমে রুমে গিয়ে এ ঘোষণা জানায়া আসছে দীপ্ত। ওরে ধরলাম, কী রে বেটা এটা কেমন কথা, রাত কেমনে ছোট হলো? দীপ্ত বলল, ঘড়ির দিকে তাকায়া দেখেন। সন্ধ্যা হতে না হতেই রাত ১টা বেজে গেছে। … তাকায়া দেখি বাজে ৬টা ৫। কই ১টা বাজল? ও যেহেতু ঘণ্টা-মিনিটের কাটা চেনে না, মাত্র গুনতে শিখছে, তাই মিনিটের কাটা যেহেতু একের ঘরে আছে তাই ৫ মিনিটের ব্যাপারটা বুঝতে পারে নাই! বাচ্চারা তো এভাবে শেখে, এভাবে শেখে বলেই হয়তো ভালোবাসাবাসিগুলো থেকে থেকে বেশি বেশি হয়।
যদিও ডিসেম্বরের দিকে যাইতে যাইতে রাত বড় হয় যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিনের আগে পর্যন্ত, সেটা দীপ্তর জানার কথা না, হয়তো ওর ছোট্ট শরীর এ আবহাওয়া টের পাইছে উল্টোভাবে, বাট ব্যাখ্যা করতে পারছে না।
বাসার সবাই মিলে হাসাহাসি করার এ ঘটনা মনে পড়ল হাওর এক্সপ্রেসে বসে। একদম মাঝরাতে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ যাইতেছিলাম আমি আর রাফসান গালিব। তখন আমার মনে হচ্ছিল, সময়ের উল্টো দিকে যাইতেছি। আসলে উল্টো হয়ে চলতেছিলাম। বাট, সময়ের না গন্তব্যের। পরিবহন ব্যবস্থার নিরিখে এ উল্টো চলার সুযোগকেও সৌভাগ্যই বলা যাইতে পারে। যাত্রার তিনদিন আগে ট্রাই করে অনলাইনে ট্রেনের টিকিটের টিকিটিও পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন একদিন আগে কাউন্টারে যখন বলল, এক-দুই নাম্বার টিকিট আছে। সবচেয়ে লো কোয়ালিটির (এক্সট্রা) বগি হওয়ার সত্ত্বেও বললাম, দেন। টিকিট কাটার পর খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পর মনে হলো, আরেকটু খোঁজাখুঁজির দরকার ছিল। একে তো টয়লেটের পাশে হওয়ার আশঙ্কা, টানা বেঞ্চের মতো হতে পারে, দ্বিতীয়ত যেদিকে ট্রেন যাবে তার উল্টো দিকে মুখ করে বসতে হবে। তবে ট্রেনে ওঠার পর দেখা গেল টয়লেটের আশঙ্কাটা ঠিক ছিল না, টয়লেট বেশ দূরত্বে আছে। সিটও টানা বেঞ্চের মতো না। সামনে-পেছনে দুটো সিঙ্গেল সিট। আর উল্টো দিকেই বসছিলাম।
উল্টো মুখ করে কোনো দিকে যাত্রাকে সময়ের বিপরীত বলা যায় না। এটা আমার বুঝতে অনেকক্ষণ সময় লাগছে। ঠিক কেন জানি না! এ বিষয়ে আমার প্রেজুডিসগুলো কী কী? একটা শব্দ কানে বাজতেছিল ‘পশ্চাৎপদ’। নানা উপলক্ষে এটা গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এমন একটা অর্থও আছে বোধ হয়, সময়ের সঙ্গে (গালিদাতার হিসেবে) হাল নাগাদ হতে না পারা। যাই হোক, ট্রেনের বগির তো একটা মাঝামাঝি পয়েন্ট থাকে। যেখানে দুটো সিট মুখোমুখি। তেমন মুখোমুখি দুটি সিটে আমি ও আমার সঙ্গী বসি এবং সময় সম্পর্কিত একই ধরনের মনোভাব থাকে। মানে যাত্রাপথের দিকে আগাচ্ছে মনে হইলে সময়ের সঙ্গে যাচ্ছি, আর আমার উল্টো দিকে কেউ ভাবে সময়ের পেছন দিকে যাচ্ছে। যদিও এ ঘটনায় কারো সাদা চুল কালো হওয়ার সম্ভাবনা না-ই একদম। আসলেই!কিন্তু সময় এবং চিন্তার ধারণা এভাবে কাজ করে আমাদের মনে।
‘ইন্টারস্টেলার’ ছবিটার কথাও মনে পড়তেছিল। ওই ছবিতে তৃতীয় মাত্রার বাইরে অন্য একটা মাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয় সম্ভবত। একসময় ভাঁজ করা কাগজের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন সময় থেকে একই স্পেস স্পর্শ করে মূল দুটি চরিত্র। যদিও তারা সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছিল না (ভূতের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ যেমনে হয়)। এখানে আরেকটা বিষয় আছে, তারা বাবা-মেয়ে। এটা তো একটা মাত্রা। এটা বাদ দিয়েই বলি, তাইলে মুখোমুখি বসা দুই লোক, যাদের একজনের মুখ গন্তব্যের দিকে ও অন্যজনের উল্টো দিকে, তারাও যোগাযোগ বিভ্রাটে ভোগে। অন্তত ওই বিষয়টা নিয়ে তারা কথা বলতে পারে না।
আমরা ঘুমায় পড়ছিলাম। এক জায়গায় ওঠার পর গালিব বলল, ভাই আমরা তো মোহনগঞ্জের দিকে মুখ করা। ট্রেন ঘুরলো কেমনে। আমার জবাবটা গালিবের বিশ্বাস হইলো না। রেলওয়ের ম্যাপ দেখলে হয়তো হইতো। আমার উল্টোদিকে বসা এক মহিলা, যাকে দেখে আম্মার কথা মনে পড়তেছিল। সারা রাত উনি জেগে ছিলেন মনে হয়। যখনই চোখে পড়ে, দেখি আমার দিয়ে তাকায় আছেন। তিনি বলে উঠলেন, ময়মনসিংহে ট্রেন মোড় নিছে। এখন যখন লিখছি উনাকে ‘হোম অ্যালোন’ মুভির পঙ্খীমানবী মনে হচ্ছে!
আমাদের এ ভ্রমণে আমার জন্য সময় একটা গুরুত্ব বিষয় ছিল। মূল ব্যাপারটা অন্য কোথাও লিখব। তবে, যেটা হলো ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোহনগঞ্জ গেছিলাম। উকিল মুন্সীর কবরের খোঁজে। প্রায় এক দশক পরের এ যাত্রা মূলত ওই সময়ের নিরিখে যা যা পরিবর্তন চোখে পড়ে তাকে ধরতে চাওয়া। সেটা যেহেতু অন্যদিনের কথা। এ বেলা যেটা হলো, মোহনগঞ্জ থেকে জৈনপুর যাইতে যাইতে দুইদিকে সারি সারি ফসলের খেত দেখে চোখ ভরে গেল। সোনালি শস্য। শ্রমিকের বদলে কাটাকাটির কাজ করছে দানবীয় মেশিন। আমরা যতই হাওরের দিকে আগাইতে থাকলাম, ফসলের খেতের রং পাল্টাইতে থাকে। সোনালি ধানগাছগুলো ক্রমশ সবুজ হইতে থাকে, সাইজও ছোট হইতে থাকে।
যখন পুরোপুরি হাওর অঞ্চলে পৌঁছে গেলাম, তখনো ধান লাগানো হয় নাই। কিছু জমি জেগে আছে, আর কিছু এখনো পানিতে ডোবা। কচি কচি বাচ্চারা তাদের বাবা-দাদার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে কংস নদীর দড়ি টানা নৌকা পার হয়ে ওপারে যাচ্ছে। কেউবা ফিরছে সেচের যন্ত্র হাতে। এই যে একটার পর একটা জায়গায় আসতে আসতে ফসলের মৌসুমের এই উল্লম্ফন (শব্দটা ইউজ হয়তো ঠিক না, বাট মাথায় আসলো) সেটা যদি একটা সরললৌকিক জায়গা থেকে সময়ের কোনো হিসাব মিলাইতে যায়, কেমন হবে কে জানে? একটা রোমান্টিকভাব নিয়ে বললে, এখানে বসন্ত আসলেও কাছাকাছি কোথাও আসবে না? যদিও ঠিক না। তারপরও এমনই মনে হয় আরকি!
পরে আমরা নানান কসরত করে কংসের পারে ছবি তুলতেছিলাম। কংসও কেউ তেমন, মাঝি নৌকার ঢেউয়ে কুলবধূর কলসি ভেসে যায়। সেই যে সময় আর স্রোত গেলে আর ফিরে আসে না। আসলে সবকিছুই তো যায় এভাবে। দশ বছর পর ফিরেও আমি আসলে ফিরি নাই। আমারে রেখে আসছি, যা আমি ওই সময়টারে ধরছিলাম। এখন বর্ণনা করবো, গত দশ বছরের আমি যে ওয়াহিদ সুজনে পরিণত হইছি তার দিক থেকে। ইভেন যখন, বেতাই নদীর দড়িটানা নৌকা পার হচ্ছিলাম, তখনো ঢের বোঝা যাচ্ছিল, এটা সেই নদী। অথচ এপারের বাজার ভেঙে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পারে চলে গেছে, যেখানে যেতে আরেকবার নৌকা পাড়ি দিতে হবে।
মহান হেরাক্লিটাস যেমনে বলছিল, এক নদীতে দুইবার গোসল করা যায় না। দরকার কী? দরকার তো আছে! ধরনের প্রথম গোসলটারে গোসল মনে করলেন না। মানে সচেতন ছিলেন না, পরেরটা খেয়াল করলেন গুরু বা লঘুভাবে। এখন আসলে তফাত সচেতন থাকা বা না থাকা নয়। দুটো সময়ের তুলনা করতে পারার মধ্যে! আচ্ছা। সেটাই হবে!
ওয়াহিদ সুজন
Latest posts by ওয়াহিদ সুজন (see all)
- অসুখের দিন (শেষ কিস্তি) - জুলাই 22, 2023
- অসুখের দিন (কিস্তি ৭) - মে 22, 2023
- অসুখের দিন (কিস্তি ৬) - ফেব্রুয়ারি 2, 2023