Main menu

অসুখের দিন (কিস্তি ৭)

This entry is part 7 of 8 in the series অসুখের দিন

[ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে। … অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই। এখন পর্যন্ত সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের নাম বদলে দেওয়া।]

কিস্তি ১ ।। কিস্তি ২ ।। কিস্তি ৩ ।। কিস্তি ৪ ।। কিস্তি ৫ ।। কিস্তি ৬ ।।

পর্ব ১৩: ‘সুস্থ হয়ে গেছি’ বিশ্বাস হতে চাইল না

সব মিলিয়ে দেড়-দুই মিনিট কথা। ডা. মোহাম্মদ আলী কম্পিউটার স্ক্রিনের ওপারে। আমি আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না। কিন্তু উনি খুবই নিশ্চিত, আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি আসলে কী চাইছিলাম, জানি না। মানে, খুবই তো খুশি হওয়ার কথা। তারপরও উনার চেম্বার থেকে যখন হলাম, মনে হলো, হ্যাঁ এটা তো দারুণ একটা ব্যাপার। নিজেকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে লাগল। এ মুহূর্তে যা যা করতে চাই, তার জন্য প্রস্তুত।

নিচে নেমে রিকশা নিলাম। অফিসে যাবো। এত দ্রুত ডাক্তারকে পেয়ে গেছি যে, অফিসের গাড়ি ধরার জন্য যথেষ্ট সময় আছে। যেতে যেতে ফোনে রাশেদ আর মিশুকে জানালাম খুশির খবরটা। ওরা বেশ খুশি। তারপর বাড়িতে ফোন করলাম। ডা. মহসিন শুনেও খুশি। যদিও উনি আগে থেকে এমন কথায় বলছেন।

‘আমি পুরোপুরি সুস্থ’ মিশ্র একটা অনুভূতি। ঠিকঠাক, ভালো আছি বা সমস্যা নাই; বিষয়টা বিশ্বাস হতে চায় না। এত এত জটিলতার ভেতর দিয়ে আসার পর মনে হয় না যে, এত সহজে ব্যাপারটার নিস্পত্তি হবে। কিন্তু একটা বিষয় সময়ে তো একটা ঘটনা ঘটে। যার জন্য আমরা প্রস্তুত থাকি বা না থাকি। সেখানে আগের অভিজ্ঞতা কখনো মেনে নিতে বাধা দেয়। পেছনে তাকালে অনেক লম্বা পথ মনে হলেও, হুট করে মনে হয়, জীবনটা অল্প দিনের। যেন এই অসুখও দুদিনের আগে। ফলে সমাধানটা বিশ্বাস হয় না। অবিশ্বাস্য হলেও, এমন কথা শুনে কেমন যেন খারাপও লাগছিল।

একটা অভ্যাস, বা রোগ, যেন আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। তাকে বিসর্জন দিতে খারাপ লাগছিল। আরেকটা যুক্তি হলো, এই অসুখ আমাকে জীবনের চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্তি দিয়েছে। অজুহাত হিসেবে কাজ করেছে আমার অলস, সাহসহীন জীবনে। এখন তো একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো সবকিছুর মুখোমুখি হতে হবে। মাত্র দেড় বছরেই সবকিছু এভাবে বদলে গেল। জীবন তো নিছক যাপনের অভ্যাস নয়, উত্থান-পতন, নানা বাঁক আছে। শুধু এটা নয় যে, আমরা সুস্থ বা স্বাভাবিক থাকলেই নিজের ইচ্ছাগুলোকে কাজে লাগাতে পারি। আসলে তা নয়, আমরা অস্বাভাবিক একটা শর্ত, যেটা আমি না চাইলেও বর্তমান।

হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম, আমরা একটা খুশির খবর পাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেটা এপ্রিল-মে মাস থেকে। যদিও সার্জারি সম্পর্কিত একটা অনিশ্চয়তা ছিল। আমরা এই কয় মাসে নানান টেস্ট করালাম। মোটামুটি সব স্বাভাবিক। আমার স্ত্রীকে একটা ইঞ্জেকশন নিতে হলো। ওষুধপত্র বাবদ বেশ খরচ হয়ে যাচ্ছিল। মনে আছে, ঈদুল আজহায় আমরা হোম অফিসে ছিলাম। ঈদের দিন পড়েছিল ইঞ্জেকশনের ডেট। দুই ঘণ্টা আরেকজনের হাতে দায়িত্ব দিয়ে হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসি। আমাদের ভাগ্য হলো, নেক্সট পরীক্ষায় ইঞ্জেকশনের ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। ডাক্তার আমাদের আশ্বস্ত করলেন। এ দিকে বউয়ের ট্রেনিং শেষ হয়ে আসলো। উনি ১৪ আগস্ট চলে গেলেন। পরদিন ১৫ আগস্টের প্রোগ্রাম থাকার কথা স্কুলে।

আমরা একদিন-দুইদিন করে অপেক্ষা করছিলাম সুখবরের জন্য। বিশেষ করে ওনার তর সইছিল না। যাক, কয়েকদিনের মধ্যে জানা গেল, রিপোর্ট পজিটিভ। আমাদের সবার মাঝে খুশির রেশ ছড়ায়া গেল। মনে হলো, এত এত কষ্ট, টেনশনের পর এটা একটা উপহার। সুদিনের আভাস। আমি যখন অসুখের গল্পটা বলার পরিকল্পনা করছিলাম, তখন এ ধরনের একটা সমাপ্তি খুঁজছিলাম। কিন্তু কে জানে এমন একটা সমাপ্তিতে পৌঁছাতে গেলে কতটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শুধু তা-ই নয়, আমার অসুখের দিন এখানে শেষ নয়।

যাই হোক। মনে আছে, বন্ধু রাসেল মাহমুদের কথা। সেই যে বিয়ে খেয়ে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়লাম। রাসেল আবার দেশে এসেছে। দু-একদিন কথা হয়েছে। তার একটাই আবদার চল আরেকটা টুর দেই। বছর কয়েক আগে আমরা চাঁদপুর ঘুরতে গেছিলাম, সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে অনেকগুলো পুরোনো মসজিদ দেখেছি, আমার চট্টগ্রামের বন্ধু দাউদের সুবাদে। রাসেল সেই টুর মনে রেখেছে। যাই হোক, একটা টুর বোধহয় হতে পারে। আমি আগে যাইনি, এমন জেলা খুঁজতেছিলাম। কিন্তু সেই সব প্ল্যান তার পছন্দ হয় নাই। তাই ঠিক হলো, হাকালুকি হাওর যাবো। দুদিনের প্ল্যান। একদিন রাতের ট্রেনে গিয়ে কোনো হোটেলে উঠবো। তারপর হাওর ঘুরে সেদিন বিশ্রাম। পরদিন রিজার্ভ ফরেস্ট ও লেক দেখার কথা। কিন্তু আমি ৬১টা জেলা ঘুরলেও কখনো নিজের ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে ঘুরি নাই। হয়তো কোথায় যাবো, কী দেখবো, এ সব জায়গায় বাগড়া দিয়েছি। বাকিটুকু বন্ধুরা ম্যানেজ করেছে। শুরুতেই একটা বিপত্তি ঘটে গেল। ট্রেন আমাদের ৩টার দিকে কুলাউড়া নামিয়ে দিয়ে গেল, এত রাতে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। এই নিয়ে ঝামেলা শুরু। রাসেল বারবার আয়েশি রিসোর্ট বা গ্রামীণ রোমান্টিজিমের গল্প করছিল। যদিও আমাদের গ্রাম ভাবনা আলাদা। তারপর হাওরের নৌকা নিয়ে এক বন্ধুর কথা শুনে গুবলেট হয়ে গেল। পরে অন্য বিষয় নিয়ে দুজনের ঝগড়া। অদ্ভুত বিষয় না, হাকালুকি থেকে ফিরে আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেল। রাগের মাথায় আমি বলেছিলাম, তাইলে তুই তোর পথে যা, আমি আমার পথে চলে যাই। এছাড়া কলেজে থাকার সময়ের একটা ঘটনা তুললাম। বিষয়টা ওর ইগোতে লাগল খুব। বিকেলের দিকে দুজন ভাত খেয়ে কুলাউড়া থেকে ভিন্ন দিকে যাত্রা করলাম। রাসেল চলে গেল শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে বাস বা ট্রেন ধরবে। আর চলে গেলাম মৌলভীবাজার। ডা. মহসিনকে কৃতজ্ঞতা জানাতে।

সিএনজি অটোতে আরও দুজন লোকের সঙ্গে মৌলভীবাজারের পথে চেপে বসলাম। দুই পাশে চা বাগান রেখে ঘুম ঘুম চোখে চালক এগিয়ে চলছিলেন। কী মনোহর একটা বিকেল। এমন স্বর্গীয় পথেই যেন চিরটা কাল চলতে চাই। আমি একা একা তেমন টুর করি না। পথে যা দেখছিলাম, ভালো লাগছিল। অসুখের সময়ে প্রায়ই মনে হতো, সামনে জীবনটা নতুন করে শুরু হবে। হয় না কিছু। হায়, যদি জীবনটা নতুন করে শুরু করা যেতো। আমার পাশে ইসকনের এক লোক। সঙ্গে মৌলভী টাইপের একজন। সামনে দুজন। একজন চালককে জোরে চালানোর জন্য খুব তাড়া দিচ্ছিল। চালক হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে ফেলেন। মুখ ধুইয়ে পান খাইতে খাইতে বলেন, চালককে কখনো জোরে চালানোর তাড়া দিতে নাই। সে তার কাজ সম্পর্কে জানে। এখন যদি ঘুম চোখে গাড়ি চালায় উল্টো অঘটন ঘটবে। অঘটন ছাড়াই আমরা মৌলভীবাজার পৌঁছি।

ডা. মহসিনের ড্রাইভার এসে পথ থেকে তুলে নিলেন। উনার বাসায় ফ্রেশ হয়ে তরমুজ আর মিষ্টি খাইলাম। উনার পড়ালেখা ও আঁকাআঁকির দক্ষতা আছে। প্রায় এক বছর পর লিখছি। কিন্তু যা মনে হচ্ছে, আগস্টে তরমুজ থাকার কথা না। যাই হোক, মহসিন ভাই তার ব্যস্ত শিডিউলের মাঝে আমাকে মাঝ রাত পর্যন্ত সময় দিলেন। ফাঁকে ফাঁকে রোগী দেখা, ছোটখাট সার্জারি করছেন। পরে হাওরের বোয়াল মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াইলেন পানশি নামের সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে। তার ১২টার বাস ধরে ভোরে বাসায় ফিরে আসি।

এটা ছিল ৩০ আগস্টের কথা। এরপর বউকে নিয়ে নিয়মিত হাসপাতালে গেছি। ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ বইটার দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য নেত্রকোণা গেলাম এক ফাঁকে। আমি আর গালিব। সে যাত্রায় উকিল মুন্সীর বাড়ি পাশাপাশি রশিদ উদ্দিন ও জালালউদ্দিন খাঁর বাড়িতে গেলাম। সিলেটে গেলাম, মিশুর বিয়েতে। নোয়াখালী তো প্রায় যেতে হচ্ছে। বাড়ির কাছে উড়ির চরেও ঘুরলাম। মনে হলো, জীবন ছন্দে ফিরে এসেছে। কাজ করবো, আর ঘুরব; এটাই হয়ে গেল সামনের লক্ষ্য।

প্রথম ধাক্কাটা আসে বোধহয় জানুয়ারিতে। ওই মাসে শুরুতে খানিকটা টাইট শিডিউলে ছিলাম। সাংবাদিকদের একটা পিকনিকে গেছিলাম। আরেকদিন গেছিলাম মোস্তফা ভাইয়ের বাসায়। খাবো না খাবো করে অনেক কিছু খাইতে হলো। বাসায় ফিরছি রাত বারোটার দিকে। দেখি আপা অনেককিছু আমরা জন্য রেখে দিছে। ফ্রাই করা বিশাল মাছের মাথা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আরো কী কী। বাধ্য হয়ে খেতে হলো। এগুলো বলছি, একটু বেশি খাওয়া-দাওয়া হইলে শরীর খারাপ হতে থাকে। তা-ই হলো। দিন দু-এক জ্বরে ভুগলাম। তার আগে অবশ্যই সেই পেটব্যথাটা শুরু হলো। কোনো কোনো সময় এমন হাসফাস লাগছে গরম পানি খেতাম বা লবঙ্গ চিবুতাম। ভাবতেছিলাম, এটাই স্বাভাবিক জীবন। আম তো আর আগের মতো নাই। এভাবেই চলতে হবে। বাইরে থেকে আমরা দেখি না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনেকেরই গল্প হয়তো এমন।

সুস্থ হয়ে আগের রুটিন মতো অফিস করছি। এর মাঝে নামি একটা পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করলাম। রেফারেন্সও ভালো ছিল। সেটা ফেব্রুয়ারি মাস। ওই অফিসে কয়েকদিন বিকেল থেকে রাতে কাজও করলাম। তারা পছন্দও করলো। এদিকে কোনোভাবে আমার এক বস বিষয়টা জেনে প্যারা দিতে শুরু করল। ওই পত্রিকা আমাকে আর ডাকলো না। পরে খবর নিয়ে জানলাম, কেউ একজন এমন কিছু কথা বলছে, তারা আমার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কী কী হতে পারে সেই তথ্য। বেশকিছু জিনিস ভাবলাম, তার মধ্যে পুরোনো হিস্ট্রি মানে অসুখের হিস্ট্রিও আছে। ওভারঅল কারো সুনাম বা দুর্নাম দুটোই তো অতীতের উপর নির্ভর করে। যাই হোক, পরে সেই পত্রিকায় চাকরি করে এক বন্ধু বলছিলেন, এখানে জয়েন করেন নাই ভালো হয়েছে। তখন আমি আরেক দফা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। পরের কথা আগে বলে না দিই তবে!

মার্চের শুরুতে বাসায় একটা বিপর্যয়কর অবস্থা শুরু হয়। যার পয়লা লক্ষণ দেখা দেয় আরো আগে। কিন্তু আমরা স্বাভাবিকই ভেবেছিলাম। দুলাভাইয়ের ডায়াবেটিকসের সমস্যা অনেকদিন ধরে। নিয়মিত ওষুধ নিলেও মাঝে মাঝে সুগার একেবারে কমে যায়। এমন সময় উনার কেমন যেন হয়। একটা ঘোরের মাঝে চলে যান। কথা বলতে পারেন না, নড়তে-চড়তে পারেন না। সেই রকম একটা ঘটনা আবার শুরু হলো। দেখা গেল নামাজ পড়ছেন এর মাঝে ঢুলছেন। দু-একবার পড়েও গেছেন। বিশেষ করে করোনার সময় যখন বাসায় তারাবির নামাজ পড়াতেন তখন বেশি দেখা যেত। তো, ২০২২ সালের মার্চ নাগাদ কয়েকবার পড়েও গেলেন। ডা. ফাহিমের পরামর্শে ঢাকা স্পেশালাইজডে একজন নিউরোর ডাক্তারের কাছে ওনাকে নিয়ে গেল নিশান। হাজার চল্লিশেক টাকার পরীক্ষা-নিরিক্ষা দিয়ে এলো।

এর দিন কয়েক বাদে উনি জ্বরে পড়লেন, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। একদিন অফিস থেকে ফিরছিলাম, আপা ফোন করে বললেন, দুলাভাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় উনাকে ঢাকা স্পেশালাইজডে নেয়া হয়েছে। ততক্ষণে আমি বাসার কাছাকাছি। বাসায় ফিরে আসতে আসতে শুনলাম, দুলাভাই ফিরে আসছেন। ডাক্তার কিছু ওষুধ ও টেস্ট দিয়েছেন। ভয়ংকর কেঁপে কেঁপে জ্বর আসতে লাগলো। সেই ছোটবেলায় চট্টগ্রামে আমাদের বাড়ি গিয়ে জ্বরে পড়েছিলেন দুলাভাই। দু-তিনটা লেপ দিয়ে শীত মানানো যাচ্ছিল না। মনে আছে, একটা হারিকেন জ্বালিয়ে শরীরের সঙ্গে চেপে ধরেছিলেন। এবার জ্বরের সঙ্গে ভালোই কাশি। এভাবে পরদিন কাটলো। তারপর রাতে শুরু হলো শ্বাসকষ্ট। আমি ততটা গুরুত্ব দিই নাই। কিন্তু ভাগনে আর পরিচিত একজন মিলে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল তখন খুব লজ্জা পেলাম, রাত তখন বারোটার মতো।

পরদিন অফিসে থাকতে থাকতে দুপুরে আপার ফোন। দুলাভাইয়ের শ্বাসকষ্ট খুবই বেড়ে গেছে। এফএফসি হাসপাতাল আইসিইউতে নেয়ার কথা বলছিল। যেহেতু সর্বশেষ দেখানো হয়েছিল ঢাকা স্পেশালাইজড হাসপাতালে, নিশান অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সেদিকে রওয়া দিল। আমিও দ্রুত বেরিয়ে ঢাকা স্পেশালাইজডে চলে আসলাম। সেখানে আনতেই ইমার্জেন্সিতে অক্সিজেন দেয়া শুরু করলো। তখন একটা বিষয় অস্বস্তি হয়ে দাঁড়ালো। একে তো আইসিইউ একটা ভয়ের ব্যাপার, তার ওপর খরচ। প্রতিদিনের খরচ ৫০ হাজার টাকা। কতদিন থাকতে হবে এর গ্যারান্টি নাই। যেহেতু দেরি করা যাবে না, আমরা ভর্তি করিয়ে ফেললাম।

ঠিক রাস্তার ওপারেই আল হামরা হাসপাতাল, যেখানে আমার সার্জারি হয়েছিল। ওখানকার কাস্টমার কেয়ারের রাজু ভাইয়ের নাম্বার খুঁজতেছিলাম। কিন্তু পেলাম না, ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে সহসা কোনো রিপ্লাই পেলাম না। শেষে দুলাভাইকে নয় বা দশ তলার আইসিইউ কেবিনে নেয়া হলো। ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করার পর একজন ডাক্তার আসলেন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে। উনার সামনে একটা সোফায় আমি আর নিশান বসলাম। আমি কখনো ভাবি নাই কোনো মানুষের পক্ষে এভাবে বলা সম্ভব। উনি স্পষ্ট করে বলছেন, আইসিইউ মানে রোগী এক পা কবরে চলে যাওয়া। আমি একটা হাত নিশানের কাঁধে রাখলাম। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল, আবার ভয়ও। ডাক্তার বললেন, তারা বেশকিছু জটিলতা দেখতে পেয়েছেন। কিডনি, ফুসফুস আক্রান্ত, তার ওপর ডায়াবেটিক। তারা বিকেলে একবার ব্রিফ করবে। আশপাশে কাউকে সব সময় থাকতে বলল। যদি হাসপাতাল থেকে ফোন না দেয়, তবে বুঝতে হবে রোগীর অবস্থার অবনতি হয় নাই।

পর্ব ১৪: জাহানের জন্ম ও রক্তাক্ত আরেকটা সকাল

খানিকক্ষণের জন্য আমার গল্প থেকে বিরতি নিই। কয়েক মাস এগিয়ে যাই আপাতত। ২০২২ সালের শেষ দিকে। আমি আর রাশেদ গেলাম শ্যামলীতে। ওইখানকার এক হোটেলে উঠেছে আমাদের স্কুলের বন্ধু আলমগীর। সঙ্গে তার স্ত্রী, দুই বাচ্চা ও ছোট ভাই। উদ্দেশ্যে এসেছে কৃত্রিম পা লাগানো। এই গল্প এই জন্য বলছি, আমাদের জীবনটা আসলে কী, কীভাবে আমরা বেঁচে থাকি, কীভাবে সব মেনে নিতে হয়, তা আগে-ভাগে কখনো বোঝা যায় না। সেটা বোঝানোর জন্য।

চট্টগ্রামে আলমগীর ও আমি শিশু শ্রেণী থেকে এসএসসি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি। এখন ও আমাদের স্কুলেরই শিক্ষক। কয়েক বছর আগে স্কুলের ৩৯ বছর পূর্তিতে গেছিলাম। দেখলাম শিক্ষক হিসেবে সে বেশ তৎপর, প্রচুর দৌড়ের মধ্যে ছিল। হঠাৎ করে একটা পা হারিয়ে ফেলল সে। এমন না ধীরে ধীরে আমার মতো কোনো রোগ বাসা বেধেছে বা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছে। রাস্তার পাশের দোকান থেকে মেয়ের জন্য চিপস বা কিছু একটা কিনছিল। এরপর রাস্তা পার হবে। আচানক করে রাস্তা থেকে ছিটকে একটা ক্রেন এসে ওর গায়ের ওপর উঠে গেল। তারপর লম্বা সময় ধরে অপারেশন, পা কেটে ফেলা। কয়েক মাসের ট্রমা। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। এ সবের মাঝে একদিন ফোন করেছিলাম। কথায় কথায় জানালো, ওর বাবার পিত্তথলির অপারেশন হয়েছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু যেটা ওপেন হওয়ার দরকার ছিল, ডাক্তাররা ভুলে করল লেপরোস্কপি। আধা সমাপ্ত অপারেশন নিয়ে ঢাকায় এলেন। যেখানে অনেক কাণ্ড। শেষ পর্যন্ত তিনি মারাই গেলেন।

কৃত্রিম পায়ের জন্য আলমগীর বেশ কয়েক জায়গায় যোগাযোগ করেছিল। ব্র্যাকেও কথা বলেছিল। ওর মতে, এই প্রতিষ্ঠানে দেয়া পায়ের অনেকটাই আসে ডোনেশনে থেকে, তা সত্ত্বেও দাম তুলনামূলক বেশি। এখন যে ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিনছে, উনি নাকি অন্য কারো কাছ থেকে খবর পেয়ে আলমগীরকে ফোন দিয়েছেন। এমনকি চট্টগ্রামে ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এসেছে। যাচাই-বাছাই করতে করতে কৃত্রিম পা নিয়ে রীতিমতো এক্সপার্ট হয়ে উঠেছে মনে হলো। ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার ভীষণ কান্না পেল। সম্ভবত, লম্বা ধকল সামলে ইমোশনাল হয়ে পড়েছি। আহা! জীবনটা কেমন। যেন কৃত্রিম পা নয়, নতুন এক জোড়া জুতার ক্ষেত্রে আমরা যেমন খুঁতখুঁত করি ঠিক তেমন। আমরা মানিয়ে নিই, সব মানিয়ে নিই। নইলে কীভাবে বেঁচে থাকব।

আমার গল্পে ফিরে আসি। দুলাভাই হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, দ্রুত সার্জারি করায়া নেবো। তখন মার্চের শেষ দিক। পরের মাসের শেষ দিকে আমাদের প্রথম বাচ্চা আসার ডেট। তাই যতটা সম্ভব আগে আগেই হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইছিলাম। সবাইকে জানায়া দিলাম। দেশ রূপান্তরের সম্পাদক অমিত দা বললেন, যতটা সময় লাগে যেন নিই।

আর বাকি থাকে টাকা-পয়সা। আগেরবার অনেকটাই খরচ দিয়েছিলেন আপা আর দুলাভাই। সঙ্গে বউ কিছু দিয়েছিলেন। এরপর তো টানা দুই বছর অসুস্থতার মাঝে গেছি। ফলে মোটামুটি আমার হাতে কোনো টাকা নেই। দেখতেছিলাম, অনেক পরিচিতজন স্যালারি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে। আমিও ভাবলাম সেই পথে হাঁটব। কিন্তু কয়েকজন বন্ধু যখন শুনল সঙ্গে সঙ্গে মানা করল। তাসমিয়া আফরিন মৌ সার্জারির অর্ধেক টাকা ধার দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন; নেজাম ভাই বাংলা মুভি ডেটাবেজের (বিএমডিবি) তহবিলের পুরো টাকাটা খরচের প্রস্তাব দিলেন। পরে অবশ্য আমার বউ প্রস্তাব দিলেন, পুরো খরচ উনি বহন করবেন। আর রাশেদ যখন শুনল, টাকার ঝামেলার কথা উঠার আগেই নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট দিতে পারবে বলে জানালো। মেজবাহ যখন সার্জারির কথা শুনল, তার একটাই কথা কত টাকা লাগবে।

যাই হোক, তাদের কারো কাছ থেকে টাকা নিলাম না। বউয়ের হাসপাতাল খরচের জন্য সে টাকাটা রেখেছিলাম, উনি নিলেন না। সঙ্গে একই পরিমাণ টাকা নগদে পাঠিয়ে দিলেন। মূলত আগের বছর একাধিক হাসপাতালে কথা বলার সুবাদে এই বাজেটটা করেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, ডা. মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে একবার যোগাযোগ করা যাক। উনি যদিও বলে দিয়েছিলেন, যখনই সিদ্ধান্ত যেন সার্জারি করাবেন, আগেরদিন হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়ে গেলে হবে। তারপরও ভাবলাম দেখা করে আসি। শেষ মুহূর্তে টাকার কথা জিগাসা করতে উনি যে অ্যামাউন্ট বললেন, তাতে চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ, যা ভেবেছিলাম তার দ্বিগুণ।

দ্রুত মিশুকে ফোন দিলাম। ও ৫০ হাজার টাকা পরদিনই পাঠিয়ে দেবে বলল। এখন সেই ডরমেন্ট হওয়া অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা ছাড়া কোনো উপায় নাই। টাকাটা তুলতে শ্যামলীতে গেলাম। বাসায় যখন ফিরলাম, আপা বললেন, দুলাভাই এক লাখ টাকা দিতে চান। মাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরলেন, তাই বললাম না। উনাকে টিবির জন্য ছয় মাস টানা ওষুধ খেতে হবে। ঠিকমতো চলাফেরা করতেও পারেন না। তো, ব্যাংক থেকে আসার পর উনি, আমাকে একটা চেক দিয়ে বললেন, টাকাটা যেন খরচ করি। যখন দিতে পারি, তখন যেন দিই। এটা নিয়ে চিন্তা করতে মানা করলেন। বললাম, মোটামুটি যোগাড় হয়ে গেছে। আপা বললেন, আপাতত রাখ। কখন কী খরচ আগে থেকে তো বোঝা যায় না। না লাগলে ফেরত দিস। আসলেই আমি কি জানতাম, আমাকে একবার নয় পরপর দুইবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। এমনকি পরের বছরেও আরেকবার সার্জারির টেবিলে যেতে হবে।

টাকার বিষয়টা শেয়ার করতাম না। কিন্তু একটা ভুল চিকিৎসার কারণে আমাকে কতটা ভুগতে হচ্ছে, সেটা জানালাম। সঙ্গে মানসিক যে ক্ষতি কখনো হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবো না। পারিবারিক স্বাভাবিক জীবনের যে অসম্পূর্ণতা বা যা কিছুকে অবহেলা বলে ভেবেছি তাও কাটিয়ে উঠা অসম্ভব। আমি মানুষকে পরীক্ষা করাতে বিশ্বাসী নয়, ফলে অনাহুত এই ঘটনায় যাকে যেভাবে দেখেছি, তা কখনো জানতে পারতাম না। এমনকি আমাদের কাছের মানুষেরা এমন হয়ে থাকলেও সমস্যা না, একেক জনের দেখার ভঙ্গি একেক রকম, আবেগ-অনুভূতি একেক রকম। এখন চিকিৎসকের ভুলের কারণে বা ভুল স্বীকার না করার কারণে তাদের প্রতি জাজমেন্টাল হইতে হচ্ছে।

তৃতীয় রমজানে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। প্রথম সার্জারির বছরের ক্ষতের মুখ খোলা থাকলেও পুরো রোজা রেখেছিলাম। পরের বছর মানে ২০২১ সালে ব্যথার কারণে ১৩টা রোজা রাখতে পেরেছিলাম। এবার সাকুল্যে এই তিন।

হাসপাতালে যাওয়ার দিন সকালে দুলাভাইয়ের চেকটা নিয়ে বাসার কাছে ব্যাংকে গেলাম। সেখানে হলো ঝামেলা। অসুস্থতার কারণে উনার হাত কাঁপে। ফলে চেকে স্বাক্ষরের খানিকটা গোলমাল হলো। কাটাকাটিও ছিল। ব্যাংক সেটা মানবে না। আমি পরিস্থিতিটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তাদের কথা, আরেকটা ঠিকঠাক স্বাক্ষর লাগবে। বাসায় ফিরে আসলাম। খানিকটা ট্রায়ালের পর দুলাভাই আরেকটা স্বাক্ষর দিলেন। না হলে, অন্য ব্যাংকের একটা চেক দিলেন। এবার অবশ্য ব্যাংক কবুল করলো, দুলাভাইকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিল। এরপর উবার ধরে হাসপাতালে গেলাম, সেখানে অপেক্ষা করছিল রাশেদ। কাউন্টারে বলে দিল, আমরা যেন ঘণ্টা দু-এক অপেক্ষা করি। করোনার একটা টেস্ট করে এই সময়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে পজিটিভ বা নেগেটিভ। নইলে ডা. মোহাম্মদ আলী সার্জারি করাবেন না। তথাস্ত। টেস্ট করিয়ে রিসেপশনে বসে আছি। তখন একটা ডিসপ্লেতে চিকিৎসকের তালিকা দেখাচ্ছিল। হয়তো চোখের ভুল হতে পারে, একজন যে দেখে বিরক্ত হলাম। উনার সঙ্গে চিকিৎসার অভিজ্ঞতা ছিল ভীষণ রকম জঘন্য। আবার আরেকজনকে দেখে ভালো লাগল। আশরাফ জুয়েল। লেখক হিসেবে উনারে জানি এখন। করোনার বাড়বাড়ন্ত সময়ে উনার অনেক পোস্ট শেয়ার হইতো এই বিষয়ে, তাই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়াছিলাম। সম্ভবত খেয়া মেজবার মা যখন অসুস্থ, উনিই হাসপাতালে বেড পাইতে হেল্প করছিলেন। এই সব গল্প ফেসবুকে পড়ছিলাম।

করোনার রিপোর্ট নেগেটিভ আসলো। কেবিনে ইন করার খানিক পর ডা. আশরাফ জুয়েলকে ফেসবুকে নক দিলাম। এরপর উনি মেসেঞ্জারে কল দিয়ে একবার দেখে গেলেন। খুবই ভালো লাগল। সার্জারির ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন তিনি। বিকেল নাগাদ রাশেদ চলে গেল, আজ রাতটা আমাকে একা থাকতে হবে। ওই দিকে সকাল সকাল নোয়াখালী থেকে রওনা দিয়েছে ছোট ভাই সোহেল, দুপুরের মাঝে বাসায় পৌঁছে গেছে। বিকেলে দেখতে এলেন ডা. মোহাম্মদ আলী। বাকি সব রিপোর্ট দেখে বললেন, ঠিক আছে। এমআরসিপি রিপোর্ট কই? যেটা আগের বছর করেছিলাম। সেই রিপোর্ট না পেলে আবার করাতে হবে। সাত-আট হাজার টাকার ধাক্কা। বাসায় ফোন করে রিপোর্টটার হদিস পাওয়া গেল। সোহেল পরদিন সকালে আসার কথা থাকলেও ইফতারের পর হাসপাতালে রিপোর্ট নিয়ে চলে এলো।

পরদিন সন্ধ্যার দিকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো। ওই সময় রাশেদ, সোহেল ও নিশানের সঙ্গে ছিল আমাদের বন্ধু মোস্তফা ভাই। ঘণ্টা চার-এক পর মনে জ্ঞান ফিরল। ঠাণ্ডা একটা ঘর। সোহেল এসে একবার দেখা করে গেল। চশমা দিয়ে গেল। সকালে কেবিনে এলাম। এবার পেটে দুটো ড্রেনেজ ব্যাগ লাগানো। রাশেদ পরে বলতেছিল, ডা. মোহাম্মদ আলী অপারেশন শেষে বাইর হয়ে তাদের পিত্তথলির সেই শয়তানি অংশটা দেখাইছে। সেটা দৃশ্যমান হিসেবেই যথেষ্ট বড়ই। যথারীতি খাইতে পারতেছিলাম না। ডাক্তার প্রতিবার এলেই ধমক দিতেন। প্রচুর মানে হাসপাতালের দেয়া খাবার ফেলে রাখা যাবে না। তাই লুকায়া রাখতাম। প্রচুর হাঁটতে হবে। মাঝে মাঝে কেবিন থেকে বাইর হইতাম। দুই হাতে দুটো ড্রেনেজ ব্যাগ ধরে হাঁটতাম। মূলত রিসেপশনের পাশের বড় জানালাটা দিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকতাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দশ তলা থেকে নিচের জীবনটা অন্য রকম লাগত। ভীষণ স্থবির, ঢাকার ভীষণ জ্যামের কারণে, আবার ভোরে যখন দাঁড়াইতাম, তখন হঠাৎ হঠাৎ গাড়ি দেখা যাইতো। এর মাঝে আমি ভাবতাম, একটা অনিশ্চিত সময় নিয়ে। যেহেতু আমি জানি না, এই যন্ত্রণার কোনো শেষ আছে কিনা। এবারের সার্জারি নিয়ে কয়েকজন বন্ধু ছাড়া কেউ জানত না। এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার, অসুস্থ সময়ের জন্য। মনে হচ্ছিল, আস্তে আস্তে যাচ্ছি।

আমার কেবিনে প্রচুর আলোর ব্যবস্থা ছিল। যদিও জানালাটা ঝাপসা পেপারে মোড়া। আরেকটা কেবিন নিতে চাইছিলাম। রাস্তার পাশে, এক পাশজুড়ে কাঁচ। তবে সেখানে গরমের সঙ্গে ছিল, রোগীর অ্যাটেন্ডেন্টের থাকার জায়গার স্বল্পতা। আসলে খুবই বিষন্ন একটা সময়। তাই ওই সময় কেবিনজুড়ে যতই আলোই থাকুক আমার মনে হতো- আলো নাই একদম।

সার্জারির দুইদিন পর আমার বউয়ের পেইন উঠল। উনাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নেয়া হলো। কিন্তু এটা ছিল ফলস পেইন। এই সময়টা নিয়ে আমার আলাদা কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু পাশে থাকব এটুকু জানতাম। যা ভাবি তার চেয়ে ভিন্ন হয় সবকিছু। পরদিন আবার ব্যথা উঠল। আমাকে ফোন করা হলো। প্রার্থনা ছাড়া আর কী করতে পারি। হাসপাতালে যাওয়ার আগেই আলোর মুখ দেখলো আমাদের মেয়ে জাহান! খবরটা শুনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম। চোখে পানি চলে এলো। সত্যি বলতে কী আমার অনুভূতি কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল, কোনো অনুভূতিই বাবাসুলভ হচ্ছে না। একটা অপরোধবোধ কাজ করছিল। এমন সময়ে আমার পরিবার আম্মা-বাবা, ছোট বোন আমার বউকে নিয়মিত সঙ্গ দিয়েছে। পাশে থেকেছে। আমি জানতাম না, কখন যাওয়ার মতো ছুটি পাবো। শুয়ে-বসে থাকা আর নিয়ম করে দুটো ড্রেনেজ ব্যাগ হাতে ধরে হাসপাতালে করিডোরে হাঁটা। প্রথম সার্জারিতে মোট তিনদিন হাসপাতালে ছিলাম। এবার কতদিন থাকতে হবে, তার কোনো নিশানা নাই। মাঝে মাঝে মনে হতো, আর যেন বাসায় ফিরব না। ডা. মোহাম্মদ আলী নিশ্চিত না হয়ে রোগীদের ছাড়েন না। আমার কেসটা তো ক্রিটিকালই ছিল। তাই উনার বলার ভেতর একটা অনিশ্চিতভাব থাকত। মাঝে মাঝে সব খাবার শেষ না করার কারণে বকা দিতেন। ভালো লাগত। এই করে ছাড়া পেলাম পয়লা বৈশাখের একদিন আগে। মানে ১৩ এপ্রিল। সাতদিন হলেও মনে হচ্ছিল সাত বছর। বাসায় ফেরার তর সইছিল না। ডা. মোহাম্মদ আলী ড্রেনেজ ব্যাগ খুলে দিয়ে বললেন, দুইদিন পর এসে যেন জরুরি বিভাগ থেকে সেলাই কাটিয়ে নিয়ে যায়। উনাকে দরকার হবে না। যে কেউ করে দিতে পারবে। এর সাতদিন পর আরেকবার দেখা করতে বললেন।

নিচ তলায় এসে ওষুধপত্র কিনলাম। তারপর উবার ডেকে গাড়িতে উঠলাম। যেতে যেতে ড. মহসিনকে মেসেজ দিলাম। বাড়ি ফিরছি। বিস্তারিত জানার পর বিলের বিষয়টা জানতে চাইলেন। অঙ্কটা বলতে জানালেন, সবাই ভাবে বেশির ভাগ টাকা ডাক্তাররা নেন, কিন্তু তার বেশির ভাগই হাসপাতালের ইউটিলিটি বিল। সেটাই দেখা যাচ্ছে।

পরদিন পয়লা বৈশাখ। সারাদিন টিভি দেখছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেবার হট টপিক ছিল টিএসসির কিছু মূর্তি। যেখানে মূলত ধর্ম নিয়ে উসকানি। ব্যাপক গরমের মধ্যে লোকজনের ঘোরাঘুরি দেখলাম। পরপর কয়েক বছর করোনার কারণে জনসমাগম বন্ধ থাকায় মানুষ খানিকটা ঘোরাঘুরি সুযোগ পেল। আসলে টিভি দেখাদেখি বা মোবাইলে সোশ্যাল মিডিয়া সার্ফিং ছাড়া কিছুই করার থাকে না। ওই দিকে আমার বউ নানান জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বাচ্চা খাচ্ছে না। মা-মেয়ে দুজনেই কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।

১৬ এপ্রিল হাসপাতালে গেলাম। জরুরি বিভাগে জুনিয়র একজন ডাক্তার ব্যান্ডেজ খুলে পিনগুলো তুলে দিলেন। সব দেখে বললেন, ঠিক আছে। একটা ক্রিম দিলেন শুধু। দিনে কয়েকবার ব্যবহার করতে বললেন। আমি যেদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলাম, সেদিন রাতে আরেক কাণ্ড। দুলাভাই খেয়াল করলেন, আমার ছোটভাইয়ের হাতে টিউমার জাতীয় কিছু একটা। কিন্তু ও চাইছিল বিষয়টা আড়াল করে রাখতে। বেশ খানিকটা বকাবকি শুনলো সে। তো, সেলাই কাটার দিন আমরা বিষয়টা নিয়ে জরুরি বিভাগে যখন কথা বললাম, তখন জানানো হলো একজন রেসিডেন্ট সার্জেন আছেন, ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি, নিশান ও সোহেল সেই ডাক্তারের রুমের সামনে সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করছি। আমার কেমন যেন লাগছিল। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল, শরীরটা দুইভাগ হয়ে গেছে। সেলাইয়ের জায়গাটা খুলে গেছে। সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। রক্ত গড়ানোর কিছু দাগ যেন দেখা যাচ্ছে। হাত দিয়ে দেখি এটা সার্জারির সময়কার দাগ। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে অনেকক্ষণ একা বসে, নিশান ও সোহেল ভেতরে। ডাক্তার পরে একদিন আসতে বললেন। নিশানকে বললাম, সার্জারির জায়গায় কেমন যেন লাগছে। ও বলল, সন্দেহ হলে জরুরি বিভাগে চলো যায়।

জরুরি বিভাগে গেলাম। ভেতরে দেখি প্রচুর মানুষ। কোনোভাবে ডাক্তারকে রিচ করতে পারছি না। ঘটনা হলো, একজন স্ট্রোকের রোগী নিয়ে আসা হয়েছে। ডা. আশরাফ জুয়েল এখানকার আইসিইউয়ের দায়িত্বে আছেন। উনি ওই রোগীর বুকে পাম্প করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে গেলেন। আশপাশে তার খেয়াল নেই, মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজের কাজ করেই যাচ্ছেন। জরুরি বিভাগে এত মানুষ না থাকার কথা থাকলেও কে শোনে কার কথা। বারবার তাগাদা দিয়ে সরানো যাচ্ছে না। এক সময় ডা. জুয়েল সফল হলেন। ভদ্রলোকের হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে। ওই দৃশ্যটা আমি অনেকদিন ভুলি নাই। বেশ কসরত করে একজন ডাক্তারকে পেলাম, যিনি সকালে আমার সেলাই খুলেছিলেন। তাকে পুরো ঘটনাটা বললাম। উনি চেক করে বললেন, কোনো সমস্যা নাই। ডাক্তারের কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হলাম।

বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় যখন টিভি দেখছিলাম, পাশের সোফায় ছিলেন দুলাভাই। ওনাকে জিগাসা করলাম, আইসিইউর কথা মনে পড়ে? তখন কেমন লাগত? উনি বললেন, প্লিজ মনে করাইয়া দিও না। আইসিইউতে থাকা মৃত্যুর সমান। আর সে কথা মনে করতে চাই না। এই সব কথা বলতে বলতে খুব কাশি পাইলো। অসহ্য রকম এই কাশি। যেটা শুরু হয়েছিল হাসপাতালে থাকতে। কিন্তু এতটা জঘন্য ছিল না। আর কাশির সঙ্গে তলপেটে নাভির কাছে প্রচণ্ড ব্যথা। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। শুয়ে থাকলাম। এর আগে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাসায় ফেরার পর গরম পানি দিয়ে কয়েকবার কুলিও করছিলাম। কিন্তু আজ অসহ্য ব্যথা। ডাক্তার মহসিনকে ফোন করার পর সাপোজিটর ব্যবহারের কথা বললেন। করে একটু রিলিফ পাইলাম। কিন্তু খানিকক্ষণ পর আবার একই অবস্থা। উনি সমতলভাবে শুইতে মানা করছিলেন। তাই বালিশকে উচু-নিচু এমন করে ঢালু করে রাতে শুইলাম। কিন্তু কাশির দমকে একটু পরপর ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল।

ভোর ছয়টার দিকে ঘুম ভেঙে গেল। সেহেরি খেয়ে সবাই তখন গভীর ঘুমে। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। পেটের দিকে হাত যেতে বুঝতে পারলাম, পুরো জায়গাটা ভিজে গেছে। অনেক কষ্টে উঠলাম। দেখলাম পুরো টি-শার্ট ও কাঁথা রক্তে ভেজা। দুই বছর আগে প্রথম সার্জারির পর যেমন হয়েছিল। কী করব এখন? মাত্র গতকাল সেলাই খোলা হয়েছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, রক্ত হারাতে হারাতে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ব। সাহস করে পেট চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। দুলাভাইকে ডাকব কিনা ভাবছি। ডাইনিং রুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর তখনই নিশান বাথরুম থেকে বের হলো। বললাম, নিশান দেখ এবার এখান থেকে রক্ত পড়ছে। ঘুম ঘুম চোখে সে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারল না। পরে বলছিল, ওর মনে হচ্ছিল, বিশাল একটা ফাঁক দিয়ে আমার নাড়িভুড়ি সব দেখা যাচ্ছিল।

আগামী পর্বে সমাপ্য

Series Navigationঅসুখের দিন (শেষ কিস্তি) >>
The following two tabs change content below.
Avatar photo

ওয়াহিদ সুজন

দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
Avatar photo

Latest posts by ওয়াহিদ সুজন (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →