Main menu

অসুখের দিন (কিস্তি ১)

This entry is part [part not set] of 8 in the series অসুখের দিন

পর্ব এক: শুরুর আগে

আর সব গল্পের মতো নিজের গল্পটাও দ্বিধা সমেতই বলতে এলাম। মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে ভাবি, আমি ও আমার চারপাশ দ্বিধার জাল মুক্তি থেকে কেন মুক্তি পায় না। যেন এক আবশ্যিক আবহ। এমনও মনে হয়, প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো বৃত্তে আবদ্ধ, একই অলি-গলিতে নিত্য যাতায়াত, কখনো কখনো পুনরাবৃত্তির ফাঁকে নতুন কিছু চোখে পড়ে। তা শুধু তার নিত্যদিনের বলয়েই না, তাকে নিয়ে আর যা যা ঘটে ও অন্যদের বোঝাপড়া বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তাও একই রকম। এর মানে কি এই যে— আমি আসলে ঠিক করে দিচ্ছি, বা আমরা এমন কিছু নিয়ে আবির্ভূত হই, যা ঠিক করে দেয় দুনিয়াটা আমার সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করবে।

হয়তো ব্যাপারটা পুরোপুরি এমন নয়, আমার দেখার একটা ছাঁচ দুনিয়াটাকে আর অন্যভাবে দেখতে দেয় না। মাঝে মাঝে তো ভয় কাজ করে, যার কারণ আমরা সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে ফেলি। কিছুদিন আগে তুমুল ঝড় হচ্ছিল বাইরে। আমরা সব দরোজা-জানালা বন্ধ করে বসে আছি। তখন একটা লাইন মনে হলো— সব কিছু উড়ে যাচ্ছে, শুধু দ্বিধা ছাড়া। আসলে আমার গল্প এটাই। মামুলি রোগ-শোকের ভেতর লড়ে যাওয়া, যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে আটকে গেছে দ্বিধা।

এ লেখাটার কথা যখন ভাবছিলাম, তখন দুটো ঘটনা মনে পড়লো। প্রথমত, সেটা কারণ-অকারণে মনে পড়ে, ইন্টারনাল কোনো হারমোনি নিশ্চয় আছে। যখন স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার একটা রাস্তা ছিল শহীদ মিনারের পেছন দিক হয়ে, রাস্তাটা স্কুলের পেছনে এসেই মিলতো। কোনো একদিন বিকেলে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হয়তো ছুটির দিন ছিল। যখন লম্বা লম্বা একাশি গাছের ছায়া দীর্ঘ হয়ে পুবদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তীর্যকভাবে সারি সারি ইট বিছানো পথ। হঠাৎ মনে হলো, পেছন থেকে আমাকে কে যেন ডাকছে। ফিরে দেখে কেউ নেই। এ কণ্ঠস্বর আমাকে নানা সময় তাড়া করেছে। যদিও আজকাল আমি শুনি না। মাঝে একটা টুংটাং শব্দ শুনছি বলে মনে হয়। এর সঙ্গে শৈশবের সেই ঘটনার তুলনা চলে না। আর এত এত গিয়ার-গ্যাজেটের আশপাশে থাকতে হয়— কোত্থেকে কোন শব্দটা আসে বোঝা দায়। আচ্ছা, এসব কেন বলছি। আমার কেন যেন মনে হয় এই যে পথ চলা, নানান দুর্বিপাক, আমাকে হয়তো এমন কোনো শব্দের উৎসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যা হয়তো আমার আরও গভীর থেকেই ডাক। যেখানে নিজের দিকে তাকানোটা ঠিক আয়না দেখা নয়, অন্য কিছু।

অন্য ঘটনাটা হলো এই, যখন নাইন বা টেনে পড়ি। এক শিক্ষক বলছিলেন, আজ তোমাদের হাত দেখবো। সবার মাঝে কী যে মজা। যদিও পরে কারো কাছে ভাগ্য দেখাতে যাই নাই আর। ওই স্যার বলছিলেন, অনেকগুলো ঝামেলা আছে জীবনে। ইন্টার লাইফে একটা। এরপর বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি হবে। ইন্টারটা বাজে কাটছিল অবশ্য। টাইফয়েডের ভুগে পরীক্ষায় ফেল। তারপর ভর্তি হওয়া নিয়ে নানান টানাপোড়ন। আর চল্লিশের কাছে? এটাই যে গল্প। যদিও আমার বন্ধু মো. আরিফ মুর্শেদ মিশু বলে, আমরা নিজেদের নিয়ে যা যা খারাপ কিছু ভাবি, তা ফলে যায়। হয়তো তাই। কারণ আমি চারপাশে এমন জগৎ দেখি। বিমর্ষ, রোগশোক; আর ব্যর্থতা। যাই হোক, এই গল্প শুধু আমার না। আমার বন্ধুদেরও গল্প। আমাকে নিয়ে পরিবারের লড়াইও। সমান্তরালে আমার এক বন্ধুর অসুস্থতার গল্প আসবে, যা হয়তো আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা সংক্ষিপ্ত ধারণা দেবে। তবে শুরু হোক ব্যথার গল্প।

প্রথম যে ব্যথার কথা মনে পড়ে সেটা সম্ভবত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের দিকে। আমরা মাত্র ২৩ বছরের পুরোনো বাসা ছেড়ে বেশ দূরের একটা বাসায় এসেছি। একদিন সন্ধ্যার পেটে ব্যথা শুরু হয়। সাধারণ বদহজম, গ্যাস বা অন্য ক্ষেত্রে যেমন হয় তেমন ব্যথা না। পেটে গ্যাসের সমস্যা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মূল ঝামেলা অন্য একটা ব্যথা। যা কোনোভাবে ডিফাইন করা যাচ্ছে না। বুক আর পেটের মাঝামাঝি কোথাও। যা না যাচ্ছে খামচে ধরা বা বালিশ দিয়ে চেপে ধরা। এক মুহূর্তও সুস্থিরভাবে বসা, দাঁড়ানো বা শুয়ে থাকার জো নেই। সোজা হয়ে থাকা যায় না। শুয়ে বা বসে থাকি, কুঁকড়ে থাকতে হয়। এমন যে গতিক দশার মধ্যে দুলাভাই কাছের ফার্মেসিতে ফোন দিলেন। সেখান থেকে একজন ঔষধ দিয়ে গেলেন। গুলে খাওয়ায় যায় সেকলো’র প্যাকেট। আরেকটা ট্যাবলেট। তো, সেকলো খাওয়ার কিছুক্ষণ পর ভাত খাইলাম, এরপর ব্যথার ট্যাবলেট। এর এক বা দুই ঘণ্টা পর আস্তে আস্তে ব্যথা কমলো, টয়লেটেও গেলাম।

একই সময়ে অন্য একটা সমস্যায় ভুগছিলাম। যা কল্যাণপুরের বাসায় প্রথম ঘটে। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে টের পায় ডান পায়ের এক পাশে হালকা ব্যথা। বিছানা থেকে পা নিচে থাকতে গিয়ে ব্যথা হলো। সেদিন ছিল ১৪ বা ১৫ আগস্ট। তারপর অফিস গেলাম। ব্যথা বাড়তে বাড়তে এত তীব্র হলো যে, চেয়ার থেকে পা ঝুলিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। আমি অনেক সময় চেয়ার পা ভাঁজ করে বসি বা সিপিইউ’র ওপর পা রেখে বসি। এ দিন সবকিছুতে সমস্যা। পরে রাইড শেয়ারের মোটরসাইকেল ডেকে বাসায় চলে যাই। পা ঝুলিয়ে রাখার কারণে কী যে অসহ্য ব্যথা। যাই হোক, এখানে একটা বিষয় বলি— স্বঃস্বপ্নের কথা। আমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখতাম কলেজবেলা থেকে, মাঝ রাস্তায় হুট করে পা অবশ হয়ে গেছে। কোথাও যেতে পারছি না। কান্না করছি হয়তো বা। এটা হলো গন্তব্যহীন একটা জীবনের স্বপ্ন, তা-ই ভাবতাম। যাই হোক, পরদিন বাসার কাছে হাসপাতালে গেলাম। অনেকগুলো টেস্ট করে কোনো ঝামেলা পাই নাই। শুধু প্রশ্রাবের ইনফেকশন, যদিও গেছিলাম পায়ের সমস্যা নিয়ে। আর অস্বাভাবিক ব্ল্যাড প্রেশারের কারণে সেই যে ঔষধ খাওয়া শুরু করলাম, এখনো চলছে।

পরের মাসে আমরা অনেক দূরে নতুন বাসায় চলে আসি। সেখানে আসার কিছুদিন পর আবার পায়ে সেই অদ্ভুত ব্যথা। এবার ইমরান ইমু ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি তখন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক। তার সঙ্গে কিশোরগঞ্জে দারুণ একটা ভ্রমণ হয়েছিল। তখন পরিচয়। ইমরান ভাই দু-তিনদিনের মাথায় দুইজন চিকিৎসকের ঠিকানা পাঠালেন। এর মধ্যে আল হামরা হাসপাতালের চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করলাম। সব শুনে তিনি বললেন, আমার ধারণা আমার কাজের সঙ্গে আপনার সমস্যার কোনো যোগ নেই। তবুও কিছু টেস্ট দিচ্ছি নিশ্চিত হওয়ার জন্য। একটু বেশি খরচ পড়বে। তবুও করে দেখেন। চার-পাঁচ হাজার টাকার টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে দু-একদিন পরে গেলাম। উনি বললেন, এটা ভিটামিন ডি জাতীয় সমস্যা। তিনি ধানমন্ডির আল আজহার হাসপাতালে পাঠালেন। সেখানেই প্রায় বছর খানেক চিকিৎসা নিলাম। অনেক ওষুধ খাইলাম, দুই মাস পরপর চেকআপ। ডাক্তারের দেখা পাইতে পাইতে রাত ১২টা-১টাও বাজতো। কী যে হ্যাপা।

ভিটামিন ডি-জনিত সমস্যা নিয়ে দৌড়ের উপরে থাকায় হয়তো পেটের ভয়ংকর ব্যথার ওপর জোর দেওয়া হয় নাই, আরেকটা বিষয় হলো— এ ব্যথার সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন, ব্যথা না ওঠা পর্যন্ত বিশ্বাস করা যায় না বিষয়টা কত ভয়ংকর। আমার যা রোগ, কোনো বিষয় ঘটে যাওয়ার পর ভুলে যাওয়া বা ফিরে না আসা পর্যন্ত বিশ্বাস না হওয়া।

এরপরের যে ঘটনা, সেটা সম্ভবত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে। হঠাৎ একদিন ফোন দিল রাসেল মাহমুদ। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। ওর সঙ্গে দারুণ সব স্মৃতি আছে, কিছু খারাপ লাগাও আছে। ব্রিটেনের গ্লাসগোতে থাকে। ওর বিয়ে। আকদের দিন গেলাম। অফিসে ব্যাগে করে পাঞ্জাবি নিয়ে গেলাম। কাজ শেষে ওই পাঞ্জাবি পরে বিয়েতে গেলাম। সাধারণত দুই ঈদের জামাত ছাড়া এ পোশাক পরা হয় না। আকদের দিন ভালোই খাবার-দাবারের ব্যবস্থা ছিল। আমার বৈশিষ্ট্য মতো খুব একটা খাইতে পারি নাই। এরপর দুই পক্ষের গায়েহলুদ, রিসেপশন কয়েকটা অনুষ্ঠান। গায়েহলুদ এভয়েড করছি, রিসেপশন দুটোতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কনে পক্ষের রিসেপশন উত্তরা ক্লাবে। অনেকটা সময় হাসি হাসি মুখে থাকার কসরত করে রাইড ডেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত একটার মতো। এসে হাত-মুখ ধুয়ে সোফায় বসে আছি। আস্তে আস্তে পেটের মধ্যে কিছু একটা টের পেলাম। যেটা ক্রমশ বাড়ছে তো বাড়ছে। প্রথমে মনে হলো, ভারি খাবার, তেল-চর্বির চাপ। হতেও পারে। কিন্তু সেকেন্ড-মিনিট পার হতে হতে ব্যথা বাড়তে থাকলো। এ দিকে বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে। ভাগনে জেগে থাকলেও সে ব্যাপারটায় পাত্তা দিল না। বরং, তার রুমে বারবার যাওয়ায় বিরক্ত হলো। সারারাত ছটফট করলাম। একবার নিজের আরেকবার ডাইনিং বা ড্রয়িং রুম, এভাবে হাঁটাহাঁটি করছি। না পারছি শুয়ে থাকতে, না বসে থাকতে, হাঁটলেও মুশকিল। কখনো মেঝেতে বসে পড়ছি। এর মধ্যে অনলাইনে ঘাটতে থাকলাম পেটে ব্যথা কুইক রিলিফ। প্রচুর পানি খাইলাম। নতুন যা হলো- লবঙ্গ চিবুতে থাকলাম। দেখলাম লবঙ্গ চিবুলে একটু স্বস্তি লাগে। এই করতে করতে ভোর ছয়টার দিকে সম্ভবত একটু স্বস্তি পাইলাম। তারপর ঘুমাতে গেলাম। আর অফিসে মেসেজ করে দিলাম। শরীর খুবই খারাপ, রবিবারের ডে অফ শনিবারে কাটাবো। কিন্তু সেই অসুস্থতার রেশ আরও কয়েকদিন থাকলো। এরপরও আমার যত মনোযোগ ভিটামিন ডি’র দিকে। মাঝে মাঝে খোড়া হয়ে হাঁটি, মাটিতে পা রাখলেই ব্যথা। নিজেকে ক্ষুরা রোগ আক্রান্ত গরুর মতো মনে হয়।

এর মাঝে সম্ভবত দুই-একবার পেটের ব্যথায় ভুগলাম। যেটা স্পষ্ট মনে আছে। সেবার থার্টি ফার্স্ট নাইটে বাসায় হাঁস ভুনা আর পরোটার আয়োজন হবে। ছোটবোন রুমি ও তার মেয়ে মায়েদাও আছে। ঘরে বেশ হৈচৈ ব্যাপার। সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল। চারটায় অফিস শেষ হলে মিরপুর দশ গেলাম নাজমুল হাসান দারাশিকো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। উনাকে বললাম, চলেন হালিম খাই। এ জিনিস আবার কিছুদিন পরপর না খাইলে কেমন যেন লাগে। অথচ ছোটবেলায় আম্মার দেখাদেখি হালিম খুব অপছন্দের ছিল। কতদিন বাবার আনা হালিম মাটির পাতিলসহ বাইরে ছুড়ে মারছেন। সে দিন খুশি মনে দশ নাম্বারের মুসলিমের দুই তলায় বসে হালিম খাইলাম। আসতে আসতে বাসে বসে কেমন যেন অস্বস্তি শুরু পেটে। বাসায় ঢুকে বুঝলাম, বাজে ব্যথাটা উঠবে আজ। সে কথা শুনে আপা ভীষণ বকা দিলেন, উনি বেশ কয়েকবার ডাক্তারের কাছে যাইতে বলছিলেন, যাই নাই বলে।

বাসায় এসেই দারাশিকো ভাইকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তার পেটে কোনো ঝামেলা? উনি বললেন, না। ব্যথা খুব বাড়তে থাকলে নিচে ফার্মেসিতে গেলাম, এরপর ডা. ইমরান ইমু ভাইকে ফোন দিলাম। সব শুনে কিছু কয়েকটা ঔষধ লিখে পাঠালেন মেসেজে। এরপর বললেন, আশা করি ব্যথা সারবে। কিন্তু যদি ব্যথা না কমে সোজা হাসপাতালে চলে যাবেন। বিষয়টা সিরিয়াস কিছু পারে। এ সব যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে রাত বারোটা নাগাদ ব্যথা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। ততক্ষণে সবাই হাঁসের মাংস খাওয়া শুরু করছে। আমি নয়টার দিকে ওষুধ খাওয়ার জন্য পানি দিয়ে কচলিয়ে দুই মুঠো ভাত খাইলাম। এবার পণ করলাম, শুধু ভিটামিন ডি’র পেছনে টাকা খরচ করলে হবে না। এবার পেটের সমস্যার জন্য ডাক্তারের কাছে অবশ্যই যেতে হবে।

এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর আপা-দুলাভাই গেলেন নোয়াখালী। আমার চেয়ে কম বয়সী এক চাচার বিয়েতে। বাসায় আমি, ভাগ্নে নিশান-ভাগনি নিপুণ। ওহ, আপা ডাক্তার দেখানোর জন্য টাকা দিলেন আমাকে। সেদিন ছিল ১০ জানুয়ারি, শুক্রবার। বিকেলে অফিস থেকে বের হলাম। সহকর্মী পাভেল ভাই টেনে নিয়ে গেলেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে, আরে ভাই কিছু খেয়ে যান। ছোলা-মুড়ি খাইলাম, সঙ্গে অন্য কিছুও থাকতে পারে। বাসায় ফিরতে ফিরতে পুরোনো অস্বস্তি ফিরলো। নিচে নেমে কিছু ঔষধ কিনলাম। খেয়েও কোনো কাজ হলো না। ইমরান ভাইয়ের আগে লিখে দেওয়া একটা সিরাপ কিনতে নিচে বের হলাম। এর আগে এক ফুপাতো ভাই ফোন দিলেন, ইজতেমায় আসছেন, আমাদের বাসায় থাকবেন। কাছের ফার্মেসিগুলোতে ঔষধ না পেয়ে বাজারে গেলাম, কিনে আনতে আনতে ফুপাতো ভাইয়ের খবর নিলাম, বাসা চিনবে তো! ওই ঔষধ খেয়েও কোনো কাজ হয়নি। ব্যথা অসহ্য অবস্থায় চলে গেলে ভাগনিকে বললাম, হাসপাতালে যেতে হবে। দ্রুত প্যান্ট পরে নিলাম। একটা লুঙ্গি ব্যাগে নিলাম, টাকাও। দুজনে বের হলাম। দ্রুত সিএনজি নিয়ে কাজের এফএফসি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকলাম।

ডেস্কে একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনি বললেন বেডে শুয়ে পড়তে। পেটে হাত দিয়ে দেখলেন। তারপর পাশের রুমে সেই যে গেলেন আর আসার নাম নাই। আমি বেড থেকে ওঠে গেলাম। গিয়ে বললাম, কিছু একটা করেন খুব ব্যথা করছে। সেখানে থাকা আরেকজন বলল, জরুরি বিভাগে বেশিক্ষণ রাখার নিয়ম নেই। বেড খালি রাখতে হয়। আপনাকে ভর্তি হতে হবে। আমি বললাম, আপনি কে? উনি ডাক্তার শুনে বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না, ‘আপনি ডাক্তার?’ এটা নিয়ে পরে আমরা বাসায় হাসাহাসি করেছি। কিন্তু লোকটা যেভাবে কথা বলছিলেন, তার মধ্যে কোনো সহানুভূতির লেশমাত্র নাই। বিশ্বাসই হতে চায় না, এমন একজন মানুষ ডাক্তার হতে পারে। আমি বললাম, ভর্তি হতে হলে তাড়াতাড়ি করান। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

[ লেখাটি বেশ দীর্ঘ। গল্পের শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারি, ২০২২ সালের মার্চের শেষ নাগাদ চলমান…]

পর্ব ২: বাবা আর আমি পাশাপাশি

ছয় বা সাততলায় জেনারেল ওয়ার্ডে নেওয়া হলো। প্রায় বিশটার মতো বেড। রোগী বলতে একমাত্র আমিই। ইনজেকশন দেওয়া হলো। ব্যথা কমছে না। ডাক্তাররা বলল, সহ্য করতে হবে। সম্ভবত সাপোজিটরও দেওয়া হয়েছে ওই সময়। ছটফট করছি হাসপাতালের বেডে। ডাক্তার-নার্স সামলাতে পারছেন না। দুই-তিনটার দিকে একটু ব্যথা কমল। ততক্ষণে ভাগনেও এসেছে।

খেয়াল হলো, তারা দুই ভাই-বোন সেই কখন থেকে আমার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য বেডগুলো খালি হলেও তোষক উল্টানো, বিছানা চাদর নেই। বললাম, তোদের কষ্ট হচ্ছে। ওরা বলল, সমস্যা নাই। একজন নার্সকে ডেকে ওদের জন্য পাশের বিছানাটা ঠিক করতে বললাম। উনি বললেন, ৩০০ টাকা ভাড়া। বললাম, ঠিক করে দেন, ওরা কি সারারাত দাড়িয়ে থাকবে? আমি যদিও অনুভব করছিলাম না, কিন্তু ভালোই শীত পড়ছে। তারা রীতিমতো কাঁপছে। বিছানা ঠিক করে দিল, কিন্তু কম্বল দেওয়ার কোনো নামগন্ধ নাই। আবার ওদের মানা সত্ত্বেও নার্সকে ডাকলাম। কম্বল দিতে বললাম। নার্স ভেবেছিল আমার জন্য কম্বল। যখন বললাম, ওদের দিতে তখন খুবই বিরক্ত প্রকাশ করল।

ব্যাপারটা যখন মাথায় আসে, আমার আর ভালো লাগে না। নিশানের জন্ম আমি প্রাইমারি স্কুলে, আর নিপুণ আরেকটু পরে। ওদের আর আমার বেড়ে উঠা একই সময়ে। ওদেরকে সেই বাচ্চাটা হয়তো মনে করি, কিন্তু একই ধরনের ফিলিংস নিশ্চয় অন্যরা দেখাবে না। কিন্তু শীতের মধ্যে ওর কাঁপছে, তখন একটা কম্বল দিতে বিরক্তিবোধ আমাকে প্রায়শ বিষণ্ন করে তোলে।

রাতের শেষ দিকে ঘুম এলো। সকালবেলায় দেখতে এলেন চিকিৎসকদের চিফ ডা. অসীম। বেশ কিছু চেকআপ দিলেন। আলট্রাসনোগ্রাম বা ইউএসজি’র সঙ্গে এক্সরে ছিল সম্ভবত। বললেন, আপাতত খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। মাঝে মাঝে পানি খাওয়া যাবে। আর স্যালাইন চলবে। এবার এসে বকা দিয়ে গেলেন (এমন বকা সামনেও শুনতে হবে)। সারাক্ষণ শুয়ে থাকা যাবে না, হাঁটাহাঁটি করতে হবে। স্যালাইন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখি স্যালাইনের লাইনে রক্ত উঠছে। আবার শুয়ে পড়লাম।

যাই হোক, এই অধ্যায়টা ছোট করা যাক। এর আগের মাসে মানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথমবার কভিড-১৯ ধরা পড়ে। এ নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে নানা ধরনের খবর পরিবেশিত হচ্ছে। তবে সতর্কতা নিয়ে ততটা আলোচনা তখনো শুরু হয় নাই।

দুই দিনের মাথায় জানানো হলো হাসপাতাল থেকে আমার ছুটি হচ্ছে। এখন শক্ত খাবারও খেতে পারছি। ডা. অসীম জানালেন, খাবারের সমস্যাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। টেস্টে খারাপ কোনো ইঙ্গিত পাননি। প্রথমে তারা অ্যাপেন্ডিসাইট ভাবলেও এ ধরনের কিছু নেই। কিছু ওষুধ দিলেন, বললেন ছয়-সাত দিনের মাথায় আরেকবার ফলোআপের জন্য আসতে।

এর দু-তিনদিন পর আপা-দুলাভাই বাসায় ফিরলেন। সঙ্গে আসলেন বাবা, উনিও ডাক্তার দেখাবেন। বুকে ব্যথার মতো একটা ব্যাপার। হাসপাতাল থেকে ফেরার পরও আমার শরীরের কোনো উন্নতি হয় না। খেতে পারছি না ঠিকমতো, হাঁটাচলাও কষ্টকর। বুকের মাঝামাঝি একটা ব্যথা সারাক্ষণ থাকে। খুব তীক্ষ্ন না, কিন্তু সারাক্ষণ এ অস্বস্তি। বোঝা যাচ্ছে, কোথাও একটা ঝামেলা হয়েছে।

সাধারণত আমাদের কোনো অসুখ-বিসুখের কথা আম্মা-বাবাকে শোনাতে চাই না। তারা সারাক্ষণ শুধু এ নিয়ে চিন্তা করবেন। কিন্তু বাবাকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। তখন শুয়ে ছিলাম। দেখি বাবা এদিক-ওদিক হাঁটছে, নানা বিষয়ে কথা বলছে। কিন্তু আমার পাশে বসছে না। বেশি কিছু জিজ্ঞাসাও করেন না। আমাদের একটু ছুঁয়েও দেখে নাই। কী যে মন খারাপ হলো। বলেই ফেললাম, আপনি এতক্ষণ হয় আসলে আমার পাশে বসলেন না, আমাকে একটু মাথা হাতও বুলিয়ে দিলেন না।

ছোটবেলায় বাবা কোলে নিয়ে না হাঁটলে বা পিঠে আস্তে আস্তে থাপ্পড় না দিলে ঘুম আসতো না। এখনো বাবার সঙ্গে ঘুমালে একই কাণ্ড করতে হয়।

আমাদের আচরনে বাবা বিব্রতবোধ হলেন। একটু লজ্জা নিয়ে বললেন, আমি কতদূর থেকে আসছি। তুই অসুস্থ তাই তোরে ধরি না। হাত-মুখ না ধুয়ে তোর পাশে কী করে বসি। তবুও আমি ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলাম। বাবা আমার পাশে বসলেন। মাথায় বুলাতে লাগলেন। আমার মনটা এতই গলে গেল যে, বাবা-আম্মাকে অসুখ নিয়ে কিছু বলে যাবে না এমন বিষয় ভুলে গড়গড় করে নিজের সব দুঃখের কথা খুলে বললাম। বাবার খুব মন খারাপ হয়ে গেল।

খেতে পারি না ঠিকঠাক, চলাচলও ঠিক নাই। সারা দিন শুয়ে থাকি। রাতে আমি আর বাবা একসঙ্গে ঘুমায়। দুজনই অসুস্থ, প্রায় সারারাত জেগে থাকি। যখনই ডাকি ‘বাবা’, দেখি বেশির ভাগ সময় উত্তর দেন ‘কী আবু’। কখনো উনার পিঠে আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, কখনো বা তিনি। আমার তো ঘুমই আসে না। যখন চোখ লেগে আসে অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি, এভয়েড করতে চাই, পারি না। স্বপ্ন যেন আরও জেঁকে বসে। সবচেয়ে বাজে বিষয় হলো নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা। যেন আমি আমার সামনে বসে আছি। যতই বলি ‘চুপ থাক’। মাথার মধ্যে অন্য আমি অবিরাম কথা বলতেই থাকে। মাঝে মাঝে বলি, প্লিজ চুপ করো করো। কিছুতে কিছু হয় না, যখন কেউ কথা বলে না, একের পর এক দৃশ্য এসে চোখের সামনে ঘুরতে থাকে। সকাল হলে বাবা উত্তরার একটা হাসপাতালে যান। আমি সারাদিন শুয়ে থাকি, ওষুধ চলছে।

বাবার আসার পর যে ব্যাপারটা হলো— ছোটবেলার কোনো একটা স্মৃতি মাথায় আটকে গেছিলো। অসুস্থ হওয়ার পর বাবা আমাকে বড় কোনো ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি শক্ত করে তার হাত ধরে আছি। এ স্মৃতি এতই পোক্ত যে, এসএসসির পর থেকে বাবা-আম্মার সঙ্গে না থাকলেও যেকোনো অসুখে একজন ফাদার ফিগার খুঁজতাম। কেউ যদি আমাকে হাত ধরে নিয়ে না যেতো তবে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হতো না। বিশেষ করে ইউনিভার্সিটিতে থাকতে খুবই ঝামেলা হতো। অনেক সময় দেখা গেল জ্বরে পড়ে আছি, ডাক্তারের কাছে যাওয়া হচ্ছে না। অথচ একটা কল দিলে মেডিকেল থেকে অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। বাবা আসায় মনে হলো, আমার আর কোনো ঝামেলা থাকবে না। যদিও জানি না আসলে ঝামেলাটা কী। আমি পরিবার ও বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞ যে অসুস্থতার প্রতিটা পর্যায়ে তারা আমাকে হাত ধরে ছোটাছুটি করেছেন।

এক সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে বাবাকে নিয়ে ডা. অসীমের কাছে গেলাম। উনি বললেন, কোনো সমস্যা নাই। এমন তো হওয়ার কথা না। জ্বর থাকবে কেন? আর ব্যথাও হওয়ার কথা না। আমরা পরীক্ষা করে তো কিছু পেলাম না। আবার ইউএসজি করেন। সঙ্গে এনডোসকপিও করেন। উত্তরার পপুলার ল্যাবে করতে বললেন। ইউএসজিতে একজন ম্যাডামের নাম লিখে দিলেন। আরও এক সপ্তাহের ওষুধ দিয়ে বললেন, এরপর যেন করি।

এর মাঝে অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। একদিন খবর হলো মেজো খালু খুবই অসুস্থ। হলি ফ্যামিলিতে হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন তিনি। ডাক্তার একপ্রকার আশা ছেড়েই দিয়েছেন। সেদিন অফিসে গেছিলাম। বাসার সবাই গেছিলো খালুকে দেখতে। বাংলামোটর মোড়ে যেহেতু অফিস, ভাবলাম হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটই তো লাগে। হায় আল্লাহ! এতটুকু পথ হাঁটতে আমার কত যে কষ্ট হলো। হলি ফ্যামিলির বিশাল করিডোর ধরে হাঁটছিলাম, মনে হচ্ছিল এখনই হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবো, এর মধ্যে খিদাও লেগেছে। যেহেতু এক মুহূর্ত আগের দৃশ্যও অনেক সময় অবিশ্বাস্য মনে হয়। বুঝতে পারলাম আমি অনেকটাই অসুস্থ।

হাসপাতালের আইসিইউতে একজন একজন করে খালুকে দেখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আমাকেও যেতে বলল। কিন্তু যাইতে ইচ্ছা হলো না। অন্যদিকে দুলাভাই ও এক খালাতো বোনের জামাইয়ের ফিসফাসে যা শুনলাম— খালুর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নাই। অন্তত ডাক্তার তাদের বলছেন। হু হু করে হাসপাতালের বিল বাড়লেও ইমোশনের কারণে এ কথা কেউ খালা বা খালাতো বোনদের বলছে না।

আবার অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এখন আতঙ্কের নাম যেন এনডোসকপি। কলেজে পড়াকালের ঘটনা। তখন রাসেলদের বাসায় খুব আসা-যাওয়া ছিল। একদিন ওদের বাসায় গিয়ে দেখি থমথমে অবস্থা। কী হলো? আন্টি খুবই অসুস্থ। উনাকে ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। দেখতে গেলাম। দেখি আন্টি খুবই আতঙ্কিত। তার ভাষ্যে, একটা ডাক্তার আসছে। আজরাইল যেন। উনার মুখ দিয়ে একটা পাইপ ঢুকিয়ে দিলেন। উনার তো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা। পরে জানতে পারলাম, এ পরীক্ষার নাম এনডোসকপি। গলা দিয়ে সরু পাইপের মাধ্যমে ক্যামেরা ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এ বিষয়টা মনে পড়তে খুবই ভয় পেলাম। একদিন বিকেলে সবাই খালুকে দেখতে গিয়েছিলেন, আমি বাসায় একা। জ্বরে কাঁপতেছিলাম, কী যে কান্না পেল। আম্মার কথা মনে পড়ছিল। কন্নড় ‘কেজিএফ’ সিনেমার একটা গান আছে মাকে নিয়ে। এ গানটা কয়েকবার শুনলাম।

অবশ্য ততদিন রাতের বেলায় দুঃস্বপ্নগুলোকে সামাল দেওয়ার চেষ্টায় খানিকটা সফলই হলাম বোধহয়। যেহেতু নিজের ভুলগুলো চোখের সামনে ভাসতো। ভাবতাম এবার ভালো হলে জীবন নতুন সাজাবো। এর মাঝে এমন এটা খবর শোনা গেল, খাবারের মাধ্যমে বিষাক্ত কিছু শরীরে ঢুকেছে। যেটা ইচ্ছা করে কেউ খাইয়েছে। এ খবর শুনে রাতারাতি নতুন করে জীবন সাজানোর স্বপ্ন মিলিয়ে গেল। তবে একটা ব্যাপার যে, এটা পরে উপলব্দি করলাম— স্বল্পমেয়াদি অসুস্থতার মধ্যে জীবনকে রিভিশন দেওয়া সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার ক্ষেত্রে আমাদের স্বপ্নগুলো ভেঙে যায় দ্রুত। জীবন চারদিক থেকে দুর্বিষহ হয়ে উঠে। সে ক্ষেত্রে অসুস্থতা ছোট বা বড় কোনো ব্যাপার না। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো দিন দিন কঠোর হয়ে উঠে। চারদিকের প্রতিক্রিয়াও সমান থাকে না।

সম্ভবত ৩১ জানুয়ারি ছিল। সারাদিন না খেয়ে ছিলাম। ভাগনিকে নিয়ে বিকেল বেলায় পপুলারে গেলাম। এনডোসকপির সিরিয়াল দিয়ে ইউএসজি করাতে গেলাম। সেখানকার ম্যাডাম তো অবাক। উনি বললেন, আপনার গলব্লাডারে পাথর, বাম কিডনিতেও পাথর আছে। আগের পরীক্ষায় ধরা পড়লো না কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তো নাই।

এরপর এনডোসকপি করতে গেলাম। দরোজা খুলে ঢুকতেই আমাকে চমশা খুলে রাখতে বলা হলো। সম্ভবত এ পরীক্ষার নিয়ম এমনই আমাকে দ্রুত বেডে শুয়ে পড়তে বলা হলো। দেখলাম মাথার কাছে একজন নারী, বিয়ের পোশাক পরা। চশমা না থাকায় সব ঘোলা। এমন দৃশ্য ভয় জাগানোর মতোই। অল্প সময় লাগলেও এনডোসকপি ভীতিকর একটা বিষয়। ওই মহিলা আমার মাথা ধরেছিলেন। তবে বেশি যন্ত্রণাকর কিছুর অপেক্ষায় থাকায় ততটা ভয়ংকর কিছু হলো না। ডাক্তার বললেন, ওয়াহিদ সুজন আপনার কোনো সমস্যা নাই। সব পরিষ্কার। অথচ আমার ধারণা ছিল, আমার খাদ্যনালি হয়তোবা একটা এবড়ো-তোবড়ো রাস্তার মতো হবে!

গলব্লাডারের পাথর আমাদের পরিবারে নতুন কোনো বিষয় নয়। আম্মা-বাবারও এ অপারেশন হয়েছিল। কিন্তু তাদের এতটা ভুগতে হয় নাই। যখন অনার্স ফাইনাল দিচ্ছিলাম আম্মার অপারেশন হয়। পরীক্ষা বলে আমাকে জানানো হয় নাই। আর পাশ করে ঢাকায় চলে আসি বাবার অপারেশন হয়। বাবা তো দেড়দিনের মাথায় রীতিমতো হেঁটে বাসায় চলে গেছিলেন। এমনকি আমাকে না দেখে হাসপাতাল ছেড়ে রাস্তা পার হয়ে বহুতদূরও গেছিলেন রিলিজের আগে। আমার এ গড়বড় অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম বাবাকে কিছু জানাবো না। বাসায় এসে বাবা ছাড়া সবাইকে এ ঘটনা বললাম।

পরদিন সন্ধ্যায় একা একা ডা. অসীমের কাছে গেলাম। রিপোর্ট দেখে তো রেগে লাল। হাসপাতালের ল্যাবের লোকজন, আরও কাকে কাকে যেন তলব করলেন। আমাকে বাইরে বসতে বললেন। নিজের হাসপাতালে ভুল রিপোর্ট আসায় রেগে গেছেন তিনি। আমাকে পরামর্শ দিলেন ভালো একজন সার্জেনের খোঁজ করতে। সপ্তাহখানেক প্রতিদিন একটা ইনজেকশন নিতে বললেন। কিন্তু যেহেতু অফিস আছে, তাই ক্যানোলা লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব না। পরামর্শ করলাম ডা. শাহ মোহাম্মদ ফাহিমের সঙ্গে। তিনিও বললেন, ইনজেকশনে যাওয়ার দরকার নাই। দ্রুত ডাক্তার খুঁজে অপারেশনটা করাতে। আমরা চাইছিলাম না বাবা থাকা অবস্থায় ছুরি-কাচির নিচে যেতে। বাবা হয়তো এটা সহ্য করতে পারবেন না।

যদিও গলব্লাডার অপারেশন খুবই মামুলি একটা ব্যাপারের মতো। কিন্তু কাটাকাটি বা রক্তের বিষয় কখনো কারো ভালো লাগার কথা না। এছাড়া একটা শঙ্কার বিষয় তো থাকে। আম্মা বা বাবার ক্ষেত্রে বিষয়টা জটিল ছিল না। ক্রমাগত জ্বর, ওজন কমতে, খেতে না পারা, দুঃস্বপ্ন মিলিয়ে রয়ে গেলাম দ্বিধায়।

দুজনের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি এ অংশে। হাসপাতালে ভর্তিকালীন দেখতে এসেছিলেন নাজমুল হাসান দারাশিকো। আমরা অনেকদিন ধরে বাংলা মুভি ডেটাবেজ নামে একটা সাইট চালিয়ে নিচ্ছি। উনি একদিন ফোন করে জানতে চাইলেন, টাকা লাগবে কিনা। আরেকদিন অনেকটা সময় নিয়ে আমার কথা শুনলেন ও দরকারি পরামর্শ দিলেন শাহাদাৎ তৈয়ব ভাই। শেষে টাকা দিতে চাইলেন। যেখানে অনেক বন্ধু জানা সত্ত্বেও খবর নেন নাই, সেখানে তাদের এ সাহায্যের আবেদন আমি সারা জীবন স্মরণ করবো।

চলবে…

Series Navigation
The following two tabs change content below.
Avatar photo

ওয়াহিদ সুজন

দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
Avatar photo

Latest posts by ওয়াহিদ সুজন (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →