Main menu

অসুখের দিন (শেষ কিস্তি)

This entry is part 8 of 8 in the series অসুখের দিন

[ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে। … অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই। এখন পর্যন্ত সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের নাম বদলে দেওয়া।]

কিস্তি ১ ।। কিস্তি ২ ।। কিস্তি ৩ ।। কিস্তি ৪ ।। কিস্তি ৫ ।। কিস্তি ৬ ।। কিস্তি ৭ ।।

রমজানে বাসার কেউ নয়টার আগে ঘুম থেকে উঠে না। এমন দিনে সকাল ছয়টায় সবাই আমাকে ঘিরে বসে আছে। গজ-তুলা দিয়ে পেটে চেপে ধরেছি। দুলাভাই ও নিশান ফোনে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে পরিচিত সব ড্রাইভারকে তারা ফোন দিয়ে ফেলল। গতকাল আমাকে বাসায় নিয়ে আসছিল কাছের একজন ড্রাইভার। উনাকে প্রথম ফোন দেয়া হয়। কিন্তু কেউ ধরছে না। হয়তো সেহেরি খেয়ে তারাও একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে অথবা রাতে ট্রিপ ছিল।

বাসা থেকে অটোরিকশায় গেলে মূল সড়কের দুরত্ব মিনিট দশেক। এ এলাকায় আমরা এসেছি বছর তিনেক। এর মধ্যে রাস্তার অবস্থা দিনদিন এত খারাপ হয়েছে যে, কেউই ভাবতে পারছে না অটোরিকশায় মূল সড়ক পর্যন্ত গিয়ে উবার ধরব। আমার অবস্থা কতটা আশঙ্কাজনক বা কতটা রক্ত হারাচ্ছি বা ঝাঁকুনিতে কী হতে পারে আমাদের ধারণা নাই। এর মধ্যে দুইবার টয়লেটের বেগ নিয়ে কমোডে বসলাম। পেটে চাপ পড়ছে। পেট চেপে ধরে ভয়ে ভয়ে বসে আছি।

ঘণ্টা দু-এক পর একটা ফোনে রেসপন্স পাওয়া গেল। বাবু নামে এক ড্রাইভার, উনি নিজে আসতে না পারলেও অনেকবার আমাদের গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিলেন। আজকেও একজনকে পাঠাবেন বললেন। ওই দিকে, রক্তে গজ-তুলা ভিজে গেছে। সোহেল নিচে নেমে বড় এক ব্যান্ডেল তুলা নিয়ে এলো। গজ পাওয়া গেল না। নিপুণ দ্রুত জায়গাটা পরিষ্কার করে তুলা ও টেপ দিয়ে মুড়ে দিলো। নয়টার দিকে গাড়ি আসতে ব্যাগ গুছিয়ে আমি, সোহেল আর নিশান রওয়ানা দিলাম।

সেই রমজান অর্থাৎ, ২০২২ সালের এপ্রিলজুড়ে ঢাকা শহর তুমুল ট্রাফিক জ্যামে ভুগেছে। বিমানবন্দর থেকে পান্থপথের বিআরবি হাসপাতাল তক পৌঁছাতে প্রায় তিন ঘণ্টার মতো লাগল। সামনের সিটে সোহেল, পেছনে আমার পাশে নিশান ঘুমাচ্ছে। আমার চোখে ঘুম নাই, নানা চিন্তা ভর করছে। টাকা-পয়সার একটা ভাবনা ছিল। লাখ খানেকের মধ্যে হলে চালিয়ে নিতে পারব। যে অবস্থা, তাতে বাসায় আপাতত ফেরা হবে বলে মনে হচ্ছিল না। হাসপাতালে থাকতে হবে। তবে গাড়িতে উঠতে উঠতে নিশান আশ্বস্ত করে বলল, তার কার্ড থেকে হাজার চল্লিশেক টাকা আমাকে দেবে, বাকিটা আমি দিলে চলবে। টাকা তো জোগাড় হবে, কিন্তু এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, আসলে আমার হয়েছেটা কী? কখনো কি সুস্থ হতে পারবো? বারবার পেটের দিকে হাত চলে যাচ্ছিল। যতটা সম্ভব আরামের সঙ্গে বসার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ খুবই আবেগী হয়ে উঠলাম। খুব কান্না পেল। আগের দিন বাচ্চার জন্ডিসের চিকিৎসায় হাসপাতালে গিয়ে উঠেছে আমার বউ। মানে, আমরা তিনজন এখন কোনো না কোনোভাবে হাসপাতালে। মেসেজে পুরো বিষয়টা অফিসে জানালাম। গাড়ি তখন বনানী পার হচ্ছিল।

জরুরি বিভাগে আমার অবস্থা দেখে দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকরা হতবাক। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। একজন ডা. মোহাম্মদ আলীকে কল দিয়ে পুরো পরিস্থিতি জানালেন। ছবি তুলে মোবাইলে পাঠালেন। ডা. আশরাফ জুয়েলকে ফোন করতে আইসিইউ থেকে নেমে আসলেন। উনিও বেশ চমকে গেলেন। সার্জেনের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। ওপাশ থেকে দ্রুত ক্ষত পরিষ্কার করার নির্দেশ দেয়া হলো। একজন জুনিয়র ডাক্তার সহকারীকে নিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করলেন। এরপর জরুরি বিভাগের একটা বেডে শুইয়ে দেয়া হলো। সার্জেন আসতে আসতে সেই দুপুর দুটো বা তিনটা। খুব ঠাণ্ডা লাগছিল, বিছানার চাদরে গা ঢেকে নিলাম। মাঝে প্রশ্রাবের বেগও পেল। একজন ওয়ার্ড বয়কে জানাতে বলল, অপেক্ষা করতে। টয়লেট জরুরি ওয়ার্ডের বাইরে। পরে বুঝতে পারলাম, মূলত তার শিফট শেষ। এই কারণে আমাকে আনা-নেয়ার মতো বাড়তি জটিলতায় যেতে চাইছে না। তো, প্রশ্রাবের বেগ নিয়ে শুয়ে রইলাম।

ডা. মোহাম্মদ আলী সবকিছু দেখে আবার ভর্তির পরামর্শ দিলেন। এখনই নতুন করে সেলাই দেয়া যাবে না। কয়েকদিন ড্রেসিংয়ের পর স্ট্যাবল অবস্থা তৈরি হলে আবার ওটিতে নিয়ে সেলাই দেবেন।

কিছুক্ষণ পর কিট নিয়ে দুজন টেকনিশিয়ান আসল। আবার করোনা টেস্ট। আচ্ছা, টেস্ট যদি পজিটিভ আসে, তাহলে কী হবে, ভর্তি করাবে না? রেজাল্ট আসতে আসতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। নিশান আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দশ তলার কেবিনে নিয়ে এলো। আগের কেবিনটা পেলাম না। এখন নার্স স্টেশনের পাশের একটা কেবিন। সারাক্ষণ হৈচৈ থাকে। মাঝে মাঝে বিরক্তি এলেও ভীতিকর একাকীত্বের মাঝে কিছুটা স্বস্তি। আমাকে দেখে অনেক স্টাফ অবাক। দু-এক দেখতে এসে কথাও বললেন। কেউ কেউ অভয়ও দিয়েছিলেন, টেনশনের কিছু নেই। এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না জানি না, কিন্তু মন কিছুটা ভারমুক্ত হতো।

জরুরি ওয়ার্ডে ক্ষতে ড্রেসিং করা হয় নাই। শুধু পরিষ্কার করে গজ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। যা ডিউটি ডাক্তারকে বোঝাতে খানিকটা কষ্ট হয়। ততক্ষণে ব্যান্ডেজটুকু রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। উনার যুক্তি জায়গাটা বেশি খোলা যাবে না। প্রতিদিন একবার চেঞ্জ করতে হবে। এ সময়ে ড্রেসিং ভিজে গেলে যাক। পরে বোঝাতে সম্মত হলাম যে, আজ ড্রেসিং হয় নাই। এরপর তিনি ভালো করে, পরিষ্কার করে ড্রেসিং করে দিলেন। অন্যদের মতো আঁতকে উঠলেন। এরপর খোঁজ নিয়েও জানতে পারছিলাম না, আবার সেলাই দেয়া হবে কখন। এ যাত্রায় মোট পাঁচ দিন থাকলেও প্রত্যেকটা মুহূর্ত ভারী পাথরের মতো চেপে বসছিল। কিছুক্ষণ পরপর হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকি, একদম খাদের কিনারায় যেতে যেতে নিজেকে আবার ভাসিয়ে তোলার চেষ্টা করি।

আগেরবার খুব একটা ফোন করি নাই, ফেসবুকেও কিছু লিখি নাই। তখন দারাশিকো ভাই, মোস্তফা ভাই তাদের ফ্যামিলি নিয়ে দেখতে এসেছিলেন। এবার নিজে থেকে কয়েকজনকে ফোন করলাম। ভাবিকে নিয়ে দেখতে এলেন জুবেরি ভাই। এলেন মজনু ভাই, গালিব ও উপল। নরমালি ফোনে কথাবার্তা কম বলি, এবার শুধু কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু বারবার একই বর্ণনা দেয়া, আসলে বিরক্তিকর। এর মাঝে জ্বরে পড়ে রাশেদ আসতে পারল না। নিশান আসত আসর নামাজের আগে আগে। এরপর ইফতারের আধাঘণ্টা আগে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যেতো। ও এলে কী যে ভালো লাগত। সারাদিন ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। কিন্তু জ্যামের কারণে কখনো বেশিরক্ষণ থাকতে পারত না। আমার ও সোহেলের এমনিতে বলার মতো কথা খুব বেশি থাকত না। এবার ইনজেকশন দিয়ে হাতের ফোড়া থেকে কিছু ফ্লুইড বের করে নেয়া হয়। প্রায় দুদিন যন্ত্রণায় ভুগল। রোজা রাখায় ব্যথা ওষুধ খেতো শুধু রাতে। হাসপাতালে খাবার আনায় বাধা থাকায় ওর খাওয়া-দাওয়ায় খুব সমস্যা হতো। মাঝে মাঝে রাতে আমার খাবার ভাগাভাগি করে খেতো। যদিও রোগীদের খাবার ওর পছন্দ হতো না। সেহেরির খাবারটা হাসপাতালের কেন্টিন থেকে আসতো, এটাই সারাদিন ওর জন্য স্বস্তির ছিল, আবার মাগরিবের নামাজের পর বাইরে চা খাওয়াটা। আমার জন্য ওর শ্রম ও কষ্ট কখনো যেন না ভুলি, আল্লাহ সেই তাওফিক দিন।

এ সময় দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। রাতে হয়তো ঘণ্টাখানেক ঘুম হতো। কিন্তু কোনো না কোনো স্বপ্ন দেখতাম। প্রায় দিন ঘুম ভেঙে দেখতাম সোহেলের বিছানা খালি। খুব টেনশন শুরু হতো। পরে দেখতাম ও ঘুমিয়ে আছে। দুদিন ভয়ংকর দুটো স্বপ্ন দেখলাম। আর যখন করিডরে হাঁটাহাঁটি করতাম, না চাইলে মাথায় আসত— আত্মহত্যার মধ্যে কম কষ্টের কোনটা। জানালা দিয়ে যখন বাইরে তাকাতাম; মাঝে মাঝে মনে হতো, ওইটা আলাদা একটা দুনিয়া, কখনো বের হতে পারব না।

ভয়ে বাড়িতে আম্মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতাম না। একদিন বাবা ফোন করলেন। সোহেলকে পাঠাতে বললেন, বাড়িতে ধান চলে আসছে। উনি একা সব করতে পারছেন না। বারবার জিগাসা করছিলেন, আমি কোথায়? বাড়ি আসছি না কেন? বললাম, বাসায়। শিগগিরই আসব। দুলাভাই অসুস্থ দেখে আসতে পারছি না। ফোন কেটে দিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদলাম। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল। … এই যে বললাম না, প্রচুর কথা বলতে ইচ্ছা হতো। মাঝে মাঝে ডিউটি ডাক্তাদের সঙ্গে এই-সেই কথা বলতাম। অসুখের হিস্ট্রি শোনাতাম। আগেরবার একদমই টিভি দেখতাম না। এবার প্রচুর টিভি দেখছি। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে নিউ মার্কেটের দোকানীদের মারপিট কয়েকদিন গড়ালো। সারাদিন টিভিতে এ নিয়ে কথাবার্তা। আগের ঘটনা ছিল হাওর অঞ্চলে পানি বেড়ে ফসল তলিয়ে যাওয়া। তখন মিশুর দায়িত্ব সুনামগঞ্জের ডিসি অফিসে। মাঝে মাঝে ফোন করে ওদিকের খবর নিতাম। একটু হাসির হলেও সারাদিন টিভি দেখে দেখে বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্টার মান্না। প্রতিদিন বিভিন্ন চ্যানেলে তার চার-পাঁচটা সিনেমা দেখায়।

এবার আসার পর কাশি আমার অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে উঠল। প্রতিদিন তিন দফা নেবুলাইজার নিতে হতো। খাইতাম এক গাদা ওষুধ। সারাদিনে ছয় ঘণ্টা পরপর এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন নেয়া লাগত। শুধু ইনজেকশনে নেয়া যন্ত্রণাকর বলে স্যালাইনের সঙ্গে নিতাম। কিন্তু দু-একবার নেয়ার পর ক্যানোলা জ্যাম হয়ে যেতো। তখন দশ মিনিটের স্যালাইন দেড় ঘণ্টাও লেগেছে। এই স্যালাইনের জন্য রাত বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকতে হতো। প্রতিদিন সাতটায় নার্সরা এসে ওষুধ খাবারের জন্য তোড়জোর করতেন। যেহেতু আটটায় তার শিফট শেষ, তাই। একদিন উনাকে জিগেস করছিলাম, কোন ওষুধের কী কাজ? এর মধ্যে দেখে একটা ঘুমের ওষুধ। আমি অবাক হয়ে বললাম, রাত বারোটার আগে ঘুমাতে পারি না। আর আটটায় সময়ই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছেন। এরপর থেকে ওষুধটা আলাদা করে রেখে পরে খেতাম। যদিও এক-দেড় ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙে যেতো। মাঝে মাঝে সোহেল উঠে পা টিপে দিত। তখন একটু শান্তি লাগত।

হাসপাতালে ভর্তির তিনদিনের মাথায় আমাকে আবার ওটিতে নেয়া হলো। আসর নামাজের পর। এর আগে কয়েকজন স্টাফ অভয় দিয়ে গেলেন। ডা. মোহাম্মদ আলী অন্য সময় ‘আপনি’ বললেও সেদিন ‘তুমি’ বলছিলেন। অনেকটা সময় নিয়ে সেলাই হবে। কিন্তু পুরো অজ্ঞান করা যাবে না। কারণ, এতে আবার কাশি বেড়ে যেতে পারে। সাধারণত সার্জারি রোগীদের এক-আধটু কাশির সমস্যা হয়। কিন্তু আমার মতো সর্বনাশী হয় না। অবশ্য পুরো বিষয়টা যে কাশিরই ঝামেলা আমি কী করে জানবো। তাই, লোকাল অনেস্থশিয়া নিয়ে জেগে থাকতে হবে। আমার ভয় করছিল, ব্যথার! যে জিনিসটা আমারে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে কয়েক বছর ধরে।

ওটিতে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতো শুয়ে পড়লাম। বাম হাতে লাগানো হলো স্যালাইন। একজন সহকারী এসে পেটের ওপর থেকে ব্যান্ডেজটা খুলে ফেললেন। তারপর সিরিঞ্জ দিয়ে পরিষ্কার করল। ভেতরটা দেখে আফসোসের মতো হলো চেহারা। এ জিনিসটা দেখতে ততদিনে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু যেকোনো মানুষের কাছ থেকে সহানুভূতির চোখটা দেখতে খুব ভালো লাগে।

খুব ঠাণ্ডা লাগছে, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না বা গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। আমাকে রেখে সবাই পাশের রুমে চলে গেছে। সবকিছু ধবধবে চকচকে, এর মধ্যে কোথাও থেকে হাজির হলো একটা মাছি। এসে কপালে বসল। তারপর উড়ে গেল। আমার ভয় লাগছিল পেটের খোলা জায়গায় যদি বসে। ঠিক সেটাই হলো। আমি বোধহয় টের পাচ্ছিলাম, কিছু একটা ওই জায়গাটায় বসছে। কিন্তু কথা বলতে পারছিলাম না। এক সময় একজন আয়া এসে চিৎকার করতেই এক সহকারী এলো ব্যাট হাতে। একটু পর শব্দ হতে হতে পোড়া গন্ধ পাওয়া গেল। শব্দ থেকে গন্ধ। এই। বাকি দৃশ্য দেখতে পাশ ফেরার মতো অবস্থা আমার নাই। একটু পর যখন ডা. মোহাম্মদ আলী আসলেন। আবারো মাছি হাজির। এবারও শব্দ আর গন্ধ মিলে প্রাণ হারানোর গল্পটা জানিয়ে দিল।

ডা. মোহাম্মদ আলী বললেন, বাবা তোমার একটু ব্যথা লাগবে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করব যতটা কম লাগে। লম্বালম্বি ক্ষতটার দুইপাশ জুড়ে তিনি ইঞ্জেকশন পুশ করবেন। যাতে সেলাইয়ের সময় কোনো ব্যথা টের না পাই। অনেকক্ষণ ধরে পুরো পেট জুড়ে সুই টের পাচ্ছি। আহ ব্যথা! যতটা না সুইয়ের ব্যথা, কখনো তার চেয়ে বেশি ভয়। মাঝে মাঝে ‘আহ! উফ!’ শব্দ করছিলাম। আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলাম। পরে সেলাইয়ের সময় জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তুমি অনেক বেশি সিগারেট খাও। অনেক কষ্টে বলেছিলাম, ক্লাশ ফাইভে থাকতে একটান দিছিলাম। এই বিচ্ছিরি জিনিস মানুষ যে কীভাবে খায়!

এক সময় অনেস্থেশিয়া দেয়া শেষ হলো। এরপর অনুভূতিটা ভোতা হয়ে গেল। ভীষণ ঠাণ্ডা ও আধো ঘুমের মতো একটা খেলা। এতদিন মন খারাপ হলে চোখ বন্ধ করে আমার মেয়েটার কথা ভাবতাম। ভাবতাম, ও আমাকে জড়িয়ে আছে। একটা বাচ্চার হাত ধরা, তার হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনতে পারা। কতটা যে আনন্দের! ভেবে ভেবে চোখে পানি আসত। ওর বয়স তখন কতদিন। চার নাকি পাঁচদিন। আমাদের কখন দেখা হবে। একমাস, নাকি দুই মাস; জানতাম না। এখন আমার ভাবার জন্য বেশ অবসর। ওকে নিয়ে ভাবলাম। একটা বাচ্চার হাত ধরে আছি, বা আমাকে জড়িয়ে আছে যতটা ভাবতে পারলাম।

ঘুমানো যাবে না। কথাও বলতে পারছি না। তাদের কথা ভাবতে থাকি, যাদের আমি ভালোবাসি। বাবা। জানি না, এমন কিছু কখনো ঘটেছে কি-না। নিজেকে দেখতে পাই। একদম ছোট্ট আমি। বাবার হাত ধরে হাঁটছি, ক্ষেতের আল ধরে। উনি হাত ছাড়তে দৌড়ে গেলাম সামনে। এই স্বপ্নটা আমাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এখনো আমি একা একা কিছু করতে পারি না, ভাবি বাবা আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবে। আম্মা। তাকে নিয়ে যে স্মৃতি। স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলেছি। ঘরে আম্মা নাই। দৌড়ে গেলাম আম্মাকে খুঁজতে। আম্মাকে দেখতে পেলে কী করতাম জানি না। শুধু দৃশ্যটা দেখি। আর দেখি অনেক মানুষের মাঝে আম্মা। দূর থেকে দেখে খুব চিনতে পারছি। তার গায়ে থেকে একটা আভা বের হচ্ছে। যেন স্বর্গীয় একটা পাখি। আপা, তিনি তো অনেকদিন আমার মা হয়ে আছেন। সেই আধো জাগরণে তাকে নিয়ে কী ভাবছিলাম, এখন অনেকটাই ফিকে। ছোটবোন রুমি, আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে সারাদিন বসে থাকতো ও। আর সোহেল, আমাদের চেহারা কাছাকাছি কিন্তু ততটা অমিল। ও আমাকে কতটা ভালোবাসে, রাত নেই দিন নেই সারাক্ষণ ছায়া হয়ে আছে। তার ছোটবেলার কচি মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম। নিশানকে নিয়ে কী ভাবছিলাম? হা হা হা। ও জানতে পারলে রাগ করবে। ও যখন আপার কোলে এলো আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। প্রায় বিকেলে ওকে কোলে নিয়ে ঘুরতে যেতাম। হঠাৎ বলে উঠতাম, এই ছেলে তুই কে? তোকে চিনি না। প্রথমে হাসি হাসি মুখে অভিনয়টা দেখত। কিন্তু এক সময় মনে হতো সত্যি সত্যি বলছি। কেঁদে উঠবে উঠবে এমন অবস্থায় ওকে জড়িয়ে ধরতাম। আর নিপুণ। সেই কল্যাণপুরের বাসায় সাদা-নীল ফ্রক পরা সেই ছবিটা ভেসে উঠল। দুলাভাই আমাকে নিয়ে করোনার ভয়ংকর দিনগুলোতে নিজের অসুস্থতা উপেক্ষা করে দৌড়াচ্ছেন। এ ধরনের একের পর এক দৃশ্য চোখের সামনে উঠে আসছিল।

প্রথমে ভেবেছিলাম শৈশব নিয়ে। প্রথম স্মৃতি ছিল বালুর মাঝে লুকানো কী যেন একটা পায়ে ফুটেছিল। এরপর মাহবুবা খালাম্মার কোলে ছিলাম, হাতে ছিল লেবানন থেকে নানার আনা ছোট টর্চলাইটটা। আমি টুক করে উনাদের সিন্দুকে ফাঁকে ফেলে দিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমার মুখে যে কথা ফোটেনি, তাই বলতে পারছিলাম না কোথায় ফেলেছি। আচ্ছা, এই বয়সের স্মৃতি থাকে নাকি! আহা স্কুলের দিন। যখন ভাবি, আমার মাথায় আসে একটা পাহাড় চূড়ায় বসে আছি। স্কুলের পেছনে পাহাড়ের চুড়ায় আমি আর রাশেদ বসেছিলাম একদিন। আমাদের চমৎকার দিনগুলো। দুজন গল্প করতে করতে টেম্পুতে চড়ে একবার ওদের এলাকা, আরেকবার আমাদের এলাকা। আমি, রাশেদ আর আরিফ পাহাড়ের গভীরে উষ্ণ প্রস্রবণ দেখতে গিয়েছিলাম, সেই স্মৃতিও বাদ পড়ে না। আর মিশু। আমার ভাই, বন্ধু, ছেলে। আমরা দুজন অনিঃশেষ হেঁটেছিলাম পৃথিবীর পথে। এক ফাঁকে আমার বউকে ভেবে নিই। হা হা হা। প্রথম যৌনতার কথাও মনে আসে। সর্বনাশ। খুবই লজ্জা পেয়ে যাই। ওটির ঘোলা ঘোলা পরিবেশে!

এই সব ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায়। আমি নিজেকে ভুলে ছিলাম এতকাল। আমার তো এখানে আসার কথা না। কোথাও না। আমার তো চুপচাপ বসে থাকার কথা ছিল কোনো এক পাহাড় চূড়ায়। তার আগে আমি শুধু সেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে থাকবো, উঠতেই থাকবো। এ সব ভাবতে ভাবতে আমার কান্না পায়। হায়, আমি তো কাউকে বলি নাই ভালোবাসি। এবার বাড়ি ফিরি, আমি সবার কাছে যাবো, সবাইকে জড়িয়ে ধরে বলব, ভালোবাসি।

এ সব যখন ভাবছিলাম তখন আমাকে ঘিরে কিছু মানুষ কাজ করে যাচ্ছে। একবার অনেক কষ্টে বলতে লাগলাম খুব ঠাণ্ডা লাগছে। কাঁপতে লাগতাম। ডা. মোহাম্মদ আলী বললেন, আগে বলো নাই কেন? আমাকে ভালো করে ঢেকে দেয়া হলো। এবার বললাম, আমি পড়ে যাচ্ছি। ডা. মোহাম্মদ আলী বললেন, বাবা তুমি পড়বে না। আমরা আছি। তবুও মনে হচ্ছিল, এখনই গড়িয়ে পড়ে যাবো। এমন সময় মাথার কাছে দাঁড়ানো একজনের হাত লাগল চুলে। আমি ভোঁতা গলায় বললাম, প্লিজ আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন। ওই স্পর্শটুকুর কথা আমি যখন ভাবি, খুব কান্না পায়। এতটুকু স্নেহের জন্য হয়তো আমরা বেঁচে থাকি। সেলাই শেষে বললাম, কে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, একটু সামনে আসেন। একলোক আসলেন। বললাম, অনেক শুকরিয়া। আমি আপনাকে কখনো ভুলব না। ডা. মোহাম্মদ আলীকে বললাম, অনেক শুকরিয়া। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভুলে গেছিলাম। আপনারা মনে করিয়ে দিলেন।

পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে রাখা হলো। সাপোজিটর দেয়া হলো। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছিল। সবাই দৌড়ে গেল ইফতার করতে। আরো ঘণ্টাখানেক পর কেবিনে নেয়া হলো। ওহ! আবারো পেট কাছে ঝুলছে ড্রেনেজ ব্যাগ। তারপর দুদিন শুধু একই জিগাসা, কবে বাড়ি ফিরব। কিন্তু ড্রেনেজ ব্যাগের অবস্থা থেকে ডা. মোহাম্মদ আলী চাইছেন থাকি। বাস্তব অবস্থা তো অন্য রকম। মনে আছে, একদিন ভোরে ঘণ্টাখানেক করিডোরে হাঁটাহাঁটি করলাম, দেখতে পারছিলাম, আকাশে অনেক মেঘ। এক সময় ক্লান্ত হয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। ওই সময় ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করল। হাত-পায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। মৌসুমের প্রথম বৃষ্টি বলে কথা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ভেতর না থাকলে হয়তো এলার্জিতে শরীর ফুলেও যেতো। আমি চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির আনন্দটুকু নিতে থাকি। এ সময় এক কেবিন বয় এসে বললেন, স্যার বাইরে আসেন। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। শিল পড়ছে। বললাম, এখানেই ভালো। আর যেতে পারব না। দুপুরে আপাকে ফোন করলাম। জানাই ছিল, আমাদের এলাকা পানিতে ভেসে গেছে। আপা বলতেছিলেন, আজ আসিস না। হাসপাতালে থেকে যা। রাস্তার যা অবস্থা, তু্ই বাসায় ঢুকতে পারবি না। খুব হাসি পেয়ে গেল। একদিন মানে ১০-১২ হাজার টাকা। উন্নয়নের দেশে জাস্ট রাস্তায় পানি উঠছে বলে এই টাকা খরচ করতে হবে। না, সেদিন এমনিতেই ছাড়েনি। আসলে ড্রেনেজ ব্যাগে যতটা পানি ঝরার কথা তা হয়নি। এর মধ্যে একদিন সকালে এসে রুম গুছিয়ে দিল, কিছু ফল উপহার দিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আজ তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এত উৎসব উৎসব অবস্থার মাঝে আমাকে ছাড়বে তো। না, সেদিনই ছাড়ল।

কিন্তু ড্রেনেজ খোলা হলো না। তার জায়গায় বিশাল একটা সিরিঞ্জ বেধে দেয়া হলো। প্রতিদিন একবার করে খালি করতে হবে। চার দিন পর আবার আসতে বললেন। দ্রুত সব গুছিয়ে নিলেও সাধারণত হাসপাতালে বিল ও অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে চেকআউটের যে দেরি হয়, আজও তা হলো। এর মধ্যে কেবিন বয়দের নেতা টাইপ এক লোক এসে জিগাসা করল, কত বিল হলো? অঙ্কটা জানাতে বললেন, আপনার উপর এত দুর্ভোগ যাচ্ছে, স্যারকে বলে কিছু বিল কমিয়ে নিতেন। কিছু বললাম না। আসলে সেরকম কিছু হলে উনি বলতে পারতেন। পুরো পরিস্থিতি তো উনি জানেন। যাই হোক, সামান্য কিছু টাকার জন্য ধরাধরি বা বলাবলি পোষাবে না। আপাতত চিন্তা হলো, এই সিরিঞ্জ নিয়ে কতদিন চলাফেরা করতে হবে।

কতদিন গোসল করি না। দাড়িতে পর্যন্ত খুশকি ধরে গেছে। একদিন দুলাভাইয়ের চুল কাটাতে সেলুন দোকান থেকে ছোট দুইটা ছেলে আসলো। আমিও চুল কাটিয়ে নিলাম। দাড়ি ট্রিম করিয়ে নিলাম। শ্যাম্পু করে নিলাম। অনেকটা হালকা লাগল। দু-তিনদিন পরপর শ্যাম্পু করতাম। প্রতিদিন মাথায় ধুইয়ে নিতাম। সবই চলতো বিছানায় শুয়ে।

এর মাঝে অফিস থেকে ফোন আসল। মাস শেষ। হেড অফিসে হাজিরা রিপোর্ট দিতে হবে। এছাড়া আমি অ্যাপ্লিকেশন করেও আসিনি। অ্যাডমিনের রোবায়েত ভাই বললেন, যেদিন হাসপাতালে আসি জানাতে, উনি একটা ফর্ম পাঠিয়ে দেবেন। আমি নিজেই গেলাম অফিসে। মাহবুব মোর্শেদ ভাই চিন্তিত, কারণ এতদিন ছুটি পাবো কিনা। রোবায়েত ভাই আশ্বস্ত করলেন। আমার ১৩৫ দিনের মতো ছুটি পাওনা আছে। এ দফায় মোট ৪০ দিন ছুটি কাটিয়েছি।

যাই হোক, ভেবেছিলাম চারদিন পর সিরিঞ্জটা সরিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু সব দেখে ডাক্তার বললেন, আরো কয়েকদিন রাখতে হবে। কী যে কষ্টকর! এরপর ঈদের এক সপ্তাহ সেলাই কাটা হলো। সে দিন সেলাই খোলা হলো, আমি আর নিশান বাংলামোটর গেলাম, অফিসে। পরে অফিসের উল্টো দিকে একটা কফিশপে বসলাম। কফি আর চটোলেট কেক খেলাম। ঢাকা স্পেশালাইজড হাসপাতালে দুলাভাইকে দেখতে গিয়ে কুপারস থেকে চটোলেক কেক নিয়ে গেছিলাম। সেটা খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়ি।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলাম। বই পড়ার চেষ্টা করছি। সিনেমা দেখছি মূলত। তবে মূল সমস্যা হলো ঘুমাতে পারি না। রাতের পর রাত জেগে থাকি। এই সময় ডা. মহসিন বেশ কয়েকটা ওষুধ সাজেস্ট করলেন। তাতেও কাজ হয় না। তখন উনাকে হাসপাতালের ওষুধের নাম জানাতে দমে গেলেন। বেশ ভালো পাওয়ার। এর বেশি আমার জন্য হিতে বিপরীত হবে। উনার পরামর্শ হলো, ঘুমানোর আগে এক ঘণ্টা হাঁটতে হবে। কোনো গেজেট ব্যবহার করা যাবে না। টিভি দেখা যাবে না। পুরো ঘর অন্ধকার করে বিছানায় যেতে হবে। কয়েকদিন চেষ্টা করেও কিছু হলো না। এরপর বিরক্ত হয়ে ভাবলাম, ঘুম আসলে আসুক, না হলে নাই। এ নিয়ে আর ভাবব না। মজার বিষয় হলো, হাল ছেড়ে দেয়ার পর আমার ঘুম নিয়মিত হয়ে এল। ততদিনে অফিস যাওয়া শুরু করেছি।

হাসপাতাল ছাড়ার দুই মাস পর বাড়ি গেলাম। তখনো ভীতি যায় নাই। হঠাৎ একটু ব্যথা বা অস্বস্তি হলে কাবু হয়ে যেতাম। যেদিন বাসে চড়েছি, হঠাৎ মনে হচ্ছিল, জামার একপাশে রক্ত। পরে ধরে দেখি জামার ভাঁজ। যাই হোক, রাত আটটা কী নয়টা দিকে বাস থেকে নেমেছি। বৃষ্টি হয়েছিল বোধহয়। তাই আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। আকাশ একদম পরিষ্কার, যদিও চাঁদ ছিল না। চরের রাস্তা ধরে অটোরিকশা চলছিল। আকাশে লাখ লাখ তারা দেখে মন ভালো হয়ে গেল। ভাবতেছিলাম জাহানের কথা। ওকে পরদিন দেখতে যাবো। আমরা একেকটা মানুষ কত আলাদা। যার জন্ম একদম সদ্য সে যতই আমাদের উপর নির্ভরশীল হোক, তার কত আলাদা। কোনো কিছু তার অপছন্দ হলে সরাসরি জানিয়ে দেয়। বাচ্চারা কত অকপট। আমাদের বেঁচে থাকার ভেতর, বেদনার ভেতর, অনিশ্চয়তার ভেতর কোথায় থেকে হাজির হয় তারা। নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক, তা স্রেফ ভালোবাসা, সংসার, যৌনতা দিয়ে ডিফাইন হয় না। বরং পরম্পরার ভেতর দিয়ে যে ভবিষ্যত নির্মাণ হয় যাকে আমরা কখনো জানতে পারি না, সেখানে বোধহয় আমাদের মুক্তি। আমরা যখন ছোট ছোট মানুষগুলোর কথা ভাবি আপ্লুত হয়, খুশি হয়। কিন্তু তাদের ইতোমধ্যে উপহার দিয়ে অনিশ্চিত এক দুনিয়া। আমাদের মতো। যার এত এত বিপত্তির মাঝেও অনিঃশেষ ভালোবাসা ও জীবনের ভাগাভাগি করে বাঁচি। এটাই বোধহয় জীবনের নিশ্চিত একটা ব্যাপার, যার জন্য আমাদের আসা। আমাদের যত অর্থময়তা। যাকে বৃহত্তম দিক হলো মানুষে মানুষে ভালোবাসা। এই অনিশ্চয়তাগুলো ভাগাভাগি করা। যার জন্য ভালো-মন্দের লড়াই। আমি ভাবি সেই কণ্ঠস্বরের কথা। যা আমাকে ডাকে, হয়তো তার সঙ্গে দেখা হবে আরো দূর কোথাও। সেই অপেক্ষার জন্যও ভালো থাকতে হয়। এ সব ভেবে ভেবে অল্পতে কাতর হয়ে উঠা আমি জাহানের কাছে যেতে থাকি।

পরিশেষ: কিছুদিন ধরে পেটে হাত দিয়ে ও আয়নায় তাকিয়ে অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। পেট ফুটবলের মতো ফুলে উঠছে। সেই কথা জানাতে ডা. মহসিন কিছু প্রশ্ন করলেন। এরপর জানালেন, একে বলে ইনসশনাল হার্নিয়া। বারবার অপারেশন ও খোলা থাকায় জায়গাটায় মাংসপেশি দুর্বল হয়ে গেছে। ছোট একটা সার্জারি করতে হবে, উনি বলছিলেন রিপায়ার। পেটের উপরের চামড়া কেটে ভেতরে মেস নামের কিছু একটা দিয়ে সেলাই করে দিতে হবে। বললেন, জটিল কিছু না। আরো কয়েক মাস পর হাসপাতালে ভর্তি হলেও চলবে। আমি ভাবছিলাম, হায়! আমার জন্য কিছুই তো জটিল ছিল না, তারপরও কতগুলো বছর ভুগছি। হ্যাঁ, এই গল্প ততদূর পর্যন্ত এগোবে না। এখানে শেষ নয়। জীবন চলমান। ঘটন-অঘটন, নিশ্চিত-অনিশ্চিতের মাঝে চলবে। চলতে থাকুক।

Series Navigation<< অসুখের দিন (কিস্তি ৭)
The following two tabs change content below.
Avatar photo

ওয়াহিদ সুজন

দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
Avatar photo

Latest posts by ওয়াহিদ সুজন (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →