Main menu

ফিকশন: ছায়াবাণী

ছায়াবাণী সিনেমা হলের প্রজেক্টম্যান ছিলেন আমার ছোটচাচা। আব্বার চে এক বছরের ছোট। নতুন সিনেমা আসলে আমারে উনার রুমে বসায়া সিনেমা দেখাইতেন। মুশকিল হইতো কারেন্ট চইলা গেলে। জেনারেট চালু কইরা সিনেমা শুরু করতে টাইম লাইগা গেলে লোকজনের গালিগালাজ শুরু হইতো। কারেন্ট আসলে পরে অফ কইরা আবার চালু করা লাগতো। ছোটচাচা তখন শরমে পড়তেন। আর সিনেমা শুরু হইলে পরে আমারে ঢুকাইতেন। ম্যানেজার হইতেছে সিনেসাহলের মালিকের শালা, দেখলে হয়তো কিছু বলবে না, কিন্তু ছোটচাচা দেখাইতে চান না। চেকার’রা দেখলে কোন সমস্যা নাই। অরা বরং চাচার ফেভার চায়, শো শুরু হইলে পরে আরো দুয়েকজনরে হলে ঢুকায় বইলা ছোটচাচারে হাতে রাখা লাগে অদের। অনেক সময় আমারে ঝালমুড়ি, ছোট ছোট পিঁয়াজুও খাওয়ায়।

তবে ছোটচাচার এক নিয়ম, এক সিনেমা দুইবার দেখতে দিবেন না। ভেজা চোখ যখন আসলো, পুরা হাউজফুল, তারপরেও আমারে সেকেন্ড টাইম দেখতে দিলেন না! টিকেট কাইটা দেখা আরেকবার দেখা লাগল। তারপরও দুইবার দেইখা মন ভরে নাকি! ইলিয়াস কাঞ্চন যে মারা যায়, অই সিনটা একবার দেখলে তো মন ভরে না। চম্পার যে কি কান্দা! যেই নায়ক মারা যায় সেই নায়কই যে সবচে ভালো, এইটা ভেজা চোখ দেইখাই ফার্স্ট টের পাইছিলাম।

তবে ‘ভেজা চোখ’র টাইমে আরেকটা ঘটনা ঘটলো। আমাদের শহরে এক সুন্দরী আন্টির আগমন ঘটলো। শিরিন আন্টি। কয়েকবার আন্টি ডাকার পরে ধমক দিয়া কইলেন আমারে আপা ডাকবা! শিরিনাপা’র হাজব্যান্ড বিদেশে থাকেন, এক মেয়ে নিয়া উনি বাসা ভাড়া নিলেন আমাদেরই বিল্ডিংয়ের দোতালায়। মেয়েটা স্কুলে যাওয়া শুরু করছে। মেয়ের স্কুলের জন্যই শহরে আসছেন। এমনিতে গ্রামে থাকতেন। উনার শ্বশুর-শাশুড়িও গ্রামে থাকেন। গ্রামে উনাদের অনেক জমি-জমা, অইগুলা ছাইড়া আসা সম্ভব না। কিন্তু শিরিনাপা আধুনিক মেয়ে, মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাপ-মা বিয়া দিয়া দিছে। আসলে সুন্দরী মেয়ে ঘরে রাখা মুশকিল। শিরিনাপা’র হাজব্যান্ডও উনার মতন সুন্দর, লম্বা। কিন্তু উনার গ্রামে ভাল্লাগে না। এই কারণে বাচ্চা হওয়ার পরে বিদেশে চইলা গেছেন। শিরিনাপাও গ্রামে থাকতে রাজি না। যেই ভুল নিজের ব্যাপারে হইছে, সেই ভুল উনি মেয়ের জীবনে করতে দিবেন না। ভালো স্কুলে পড়াইবেন। ভার্সিটিতে যাবে মেয়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি, হ্যাজব্যান্ড কেউ না করতে পারে নাই উনার জেদের উপ্রে। ঠিকাছে, জিদ যখন চাপছে, পড়াক। এই কারণে শহরে চইলা আসছেন, মেয়েরে নিয়া।

শিরিনাপা যখন মেয়েরে নিয়া স্কুলে যান রাস্তায় লাইন লাইগা যায়; কারো সাইকেলের চেইন পইড়া যায়, কারো ক্যাসেট প্লেয়ারের ভলিউম বাইড়া যায়, কোন প্যাসেঞ্জার খেইপা যান রিকশাঅলার উপ্রে, কি রে বেটা আস্তে যাইতে পারোস না, এতো তাড়াহুড়া কিসের! আমিও মুদির দোকানের জিনিসপত্র কিনতে যাইতে হইলে টাইম মিলানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সবসময় তো পারি না। কিন্তু শিরিনাপা’র কিছু যায় আসে না, উনি উনার মতন থাকেন। সবারই উনার লগে কথা কইতে ভাল্লাগে। বড়ভাই, ছোটভাই, কাকা, মামা, খালা, চাচী, মামী সবাই উনার ফ্যান। উনি যে এই পাড়াতে কখনো ছিলেন না, এইটা মনেই হয় না আমাদের।

কিন্তু সমস্যা হয় ছোটচাচারে নিয়া। ছোটচাচা তো শিরিনাপা’র লগে কথা কইতে চান না। কি সমস্যা? আম্মারা হাসাহাসি করেন, ছোটচাচা তো প্রেমে পড়ছেন শিরিনাপা’র!

২.
ছোটচাচা খালি আমারে জিগান শিরিনাপার কথা। জিগাইতে কন, “ভেজা চোখ” দেখবে কিনা! শিরিনাপাও দেখতে চান, কিন্তু উনার মেয়ে তো ছোট, কান্দা-কাটি করে যদি, তাইলে তো ঝামেলা হবে! আমি তখন সমাধান দিলাম, আমিও তো থাকবো, কান্দা-কাটি করলে আমি বাইরে নিয়া যাইতে পারবো তো!

শিরিনাপা রাজি হইলেন। আমিও থার্ড টাইম ভেজা চোখ দেখার সুযোগ পাইলাম।

ম্যাটিনি শো-ই ভালো। আমরা ডিসাইড করলাম। ছোটচাচা তো আগে বাইর হয়া গেলেন। আমি পরে শিরিনাপা’র লগে রিকশা করে গেলাম। শিরিনাপা’র কোলে উনার মেয়ে। শে-ও খুশি। আমি অর লগে সিনেমার গল্প করতেছিলাম। শে কিছু বুঝতেছিল না। আমি আর শিরিনাপা হাসতেছিলাম।

যখন আমরা ছায়াবাণীর সামনে পৌঁছাইলাম তখন ব্ল্যাকের টিকিটও শেষ। সামনে ভীড় নাই আর। আমি শিরিনাপারে নিয়া প্রজেকশন রুমের কাছে চইলা গেলাম। যাওয়ার আগেই চেকার সুলাইয়মান কাকার লগে দেখা। সুলাইমান কাকা শিরিনাপা’রে সালাম দিয়া কইলো, ‘ভাবী, ভালো আছেন?” শিরিনাপাও হাসলো। শিরিনাপারে কেন ভাবী কইলো, আমি বুঝতেছিলাম না। সুলাইমান কাকা-ই আমাদেরকে ছোটচাচার রুমের সামনে নিয়া গেলো। দেখলাম, আলাদা একটা চেয়ার রাখা। শিরিনাপা অইখানে বসলো। আমি উনার মেয়েরে কোলে নিয়া সাইডের টুলটাতে বসলাম।

ছোটচাচা খুবই সিরিয়াস। আসলে প্রজেক্টর চালানোর কাজও তো খুব জটিল। সবকিছু চালু কইরা দেয়ার পরে একটু ফুসরত যেন মিললো উনার। শিরিনাপারে এইটা-অইটা বলতে লাগলেন। শিরিনাপা’র তো পর্দা থিকা চোখই সরে না। চোখ বড় বড় কইরা দেখতে লাগলেন। এইখানে আমরা যে আছি, খেয়ালই নাই তার। ছোটচাচার কথা শুইনা একটু পরে পরেই খিল খিল কইরা হাইসা উঠতেছিলেন। তখন দশর্কের সিট থিকা আওয়াজ উঠলো, আরে, এই আওয়াজ আবার কই থিকা আসে! চম্পার তো হাসির কোন সিন নাই! কিন্তু অরা তো জানে না প্রজেকশন রুমে আরেক জোড়া চম্পা আর ইলিয়াস কাঞ্চন বইসা আছে!

ছোটচাচা শিরিনাপা’রে ঠোঁটে আঙুল দিয়া চুপ থাকতে বলে। শিরিনাপা তখন কি মায়া-ভরা চোখ নিয়া ছোটচাচা’র দিকে তাকায়! আমি তো বুঝতেই পারি না কোন সিনেমা দেখবো, পর্দায় যেইটা প্রজেক্ট হইতেছে নাকি প্রজেকশন রুমেরটা।

শিরিনাপার মেয়ে কোন সমস্যাই করে নাই। খামাখা ভয় পাইতেছিলেন উনি। এমন লক্ষী মেয়েই হয় না। আমার তো ওর সাথে খাতিরই হয়া গেলো। স্কুলে যাইতে আসতে আমার খোঁজ করে। খুবই ন্যাওটা হয়া গেল। এমনকি কারণে অকারণে শিরিনাপা আমারে ডাকেন, সোহেল, রূপানজেলের সাথে একটু খেইলা যাও তো, ও তো ভাত খাইতেছে না! এইরকম।

আর এরপর থিকা শিরিনাপার সিনেমা দেখার নেশাও বাইড়া গেল। প্রজেকশন রুমেও মাঝে মধ্যে যায়। কিন্তু পাড়াতে কেউ সিনেমা দেখতে গেলে শিরিনাপা হইতেছেন কমন পার্টনার। কেউ সিনেমা দেখতে যাবে, শিরিন চলো তো, বিরাজ বৌ আসছে, দেইখা আসি। শিরিন চলো তো, হীরামতি আসছে, চলো দেইখা আসি। শিরিনাপা একটু একটু ভাব নেয়, ভাবী দেখছি তো একবার, চাচী দেখছি তো একবার; কিন্তু পরে ঠিকই দেখতে চইলা যায়।

আমি বুঝতে পারি, শিরিনাপারে সিনেমার নেশাতে পাইছে।

৩.
কিন্তু ছোটচাচার কাহিনি আর আগায় না। মানে, উনি আগাইতে পারেন না আর। এর মধ্যে সিনে আরো অনেক কারেক্টার চইলা আসে। একজন ফয়জুর ভাই, কলেজের মাস্তান। কলেজ পাশ কইরা ফেলছেন, কিন্তু বাপ এলাকার নেতা, ব্যবসাপাতি আছে উনাদের, টাকারও অভাব নাই। মোটরসাইকেল চালান আর ঘুইরা বেড়ান। উনি টাংকি মারলে এলাকার মেয়েরাও খুশি হয়া যায়। এইরকম। উনার কথা পরে বলতেছি।

আরেকজন হইলেন বামপন্থী ছাত্রনেতা রাজীব বসু। রাজীব খুবই আদর্শবাদী ছেলে। টিউশনি করান। বিপ্লব প্রচার করেন। স্টুডেন্টরা যেমন উনারে পছন্দ করেন, স্টুডেন্টদের বাপ-মা’রাও। শিরিনাপা’র মেয়েরে পড়াইতে আসতেন। কিন্তু পড়ানোর পরেও অনেকক্ষণ দুইজনে মিইলা চা খাইতেন, ঘুরতে যাইতেন, কথা বলতেন। আমার মনে হইতো, রাজীবদা’র কথার ফান্দে পইড়া যাইতেন শিরিনাপা। একটা মাকড়সার জালে যেমন পোকাগুলা আটকায়া যায়। কিন্তু শিরিনাপা বাইর হইতেও চাইতেন না। আগে যেইখানে লতা মুঙ্কেশকর শুনতেন, সেইখানে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত শুনতে শুরু করলেন। এইগুলা হইতেছে সত্যিকারের গান, বুঝছো! এইগুলা শুনবা! শিরিনাপা আমারে বলতেন। যেহেতু শিরিনাপা বলছেন, ঠিক কথাই হয়তো। আমি বুঝতে পারতাম, বাংলা-সিনেমার গান তো ভালো না এতো বেশি, খালি রং-ঢং। কিন্তু এইগুলা তো আসলে রাজীবদার কথা।

আর পাড়ার লোকজনও এইগুলা নিয়া কথা বলা শুরু করলো। ছোটচাচার মুখের দিকে তো তাকানোই যাইতো না। আম্মারা, খালারা শিরিনাপারে বুঝাইলেন, দেখো, তুমি একটা বিবাহিত মেয়ে, এইগুলা এতো বেশি ভালো দেখায় না। রাজীবদাও যতোই বিপ্লবী হন, সমাজ তো বিপ্লবের জন্য এখনো এতোটা রেডি না। উনি চাকরি নিয়া চিটাগাং না কুমিল্লা চইলা গেলেন।

ছোটচাচা তখন সাহস নিয়া আগায়া আসলেন। প্রজেকশন রুমে আমার সামনেই একদিন শিরিনাপারে বললেন, দেখেন, আপনার জীবন তো আপনার জীবন, এইটা তো সমাজের জীবন না। আপনি ডরাইয়েন না। যেইটা করতে ভালোলাগে, আপনার মনে চায়, সেইটা করবেন। নিজে যদি ভালো থাকেন, তাইলে জগতও ভালো।

আমি ভাবলাম, এইটা আবার কোন সিনেমার ডায়ালগ!

কিন্তু শিরিনাপা সত্যি সত্যি কাইন্দা দিলো!

তখন ফয়জুর খুব ডিস্টার্ব দেয়া শুরু করলো। সকাল বিকাল বাসার সামনে বইসা থাকে। শিরিনাপার পিছন পিছন স্কুলে যায়। যাইচা পইড়া কথা বলে। বাসায় এইটা সেইটা নিয়া আসে। ফয়জুর যেহেতু পাওয়ারফুল লোকের ছেলে, কেউ কিছু বলতেও পারে না। এমনকি ফয়জুর তো শিরিনাপার চে বয়সে একটু ছোট হবেই, চার-পাঁচ বছর না হইলেও, দুই-তিন বছর তো হবেই। এই কারণে লোকজন ভাবে, ছোটভাই বড়বইন হয়তো। লোকজনেরও তো একটা না একটা অজুহাত লাগে, যে, আমরা তো বুঝি নাই!

ফয়জুর ভাই বাইরে যতোই মাস্তান হোক, মনে মনে খুবই ইমোশনাল। মদ খায়া বাসার সামনে আইসা রাত-বিরাতে চিল্লাইতে থাকে, কানতে থাকে, ‘শিরিন, শিরিন…’ বইলা। এক কেলেংকারির ঘটনা। ছোটচাচা গিয়া কয়েকদিন সামলান। পরে শিরিনাপা একটু একটু কইরা কথা বলতে শুরু করেন ফয়জুরের সাথে। লোকজনও হাঁপ ছাইড়া বাঁচে। যাক! মিটমাট হইলো একটা। আমাদের তো আর দেখা লাগলো না।

কিন্তু ঝামেলা বাঁধান শিরিনাপার শ্বশুর-শাশুড়ি। গ্রামের অনেক লোক তো শহরেও থাকেন। উনারা এইসব গিয়া উনার শ্বশুর-শাশুড়িরে বলেন। গ্রামের জমি-জমা রাইখাও কয়েকদিনের জন্য উনারা শহরে চইলা আসেন। বলেন, “বউমা, এইগুলা কি শুনি!” শিরিনাপা প্রথম প্রথম চুপ থাকেন, পরে বলেন, আমি একলা কেমনে থাকি, সেইটা আপনারা ভাবেন না! আপনারে ছেলেরে ভাবতে বলতে পারেন না! আমি কি শখ কইরা এইখানে একলা থাকি! শিরিনাপা কানতে থাকেন। আমি উনার মেয়ের সাথে অন্যঘরে বইসা এইসব শুনতে থাকি।

শিরিনাপার মেয়ে ক্লাস টু’তে পড়ে। কিন্তু খুবই বুদ্ধিমতী। বুদ্ধিমান আর বুদ্ধিমতীর পাথর্ক্য শে বুঝে। আমাদের মধ্যে যে গোপন বন্ধুত্ব আছে, সেই জায়গা থিকা আমরা বুঝি যে এইগুলা নিয়া আমরা কেউ কিছু শুনি নাই, কেউ কোন কথা বলবো না কোনদিন। এইটা আমাদের গোপন আতাঁত।

৪.
শিরিনাপা’র শ্বশুর-শাশুড়ি কয়দিন থাইকা আবার গ্রামে চইলা যান। শিরিনাপার জামাইও আর আসেন না। শিরিনাপা তখন ফয়জুর ভাইয়ের বাইকের পিছনে বইসা সারা শহর ঘুইরা বেড়ান। ছায়াবাণী সিনেমাহলে ফার্স্টক্লাসে বইসা সিনেমা দেখেন। ছোটচাচা একদিন বাসার সামনে শিরিনাপারে বলেন, অন্য সিনেমাহলেও তো একই সিনেমা চলে, আপনি ছায়াবাণী’তে আইসেন না!

শিরিনাপা কিছু না বইলা ছোটচাচার দিকে তাকায় থাকে। মনে মনে খুবই কষ্ট পায় মনেহয়। ছোটচাচা অন্যদিকে তাকায়া থাকে। তারপরে চইলা যায়।

কয়দিন পরে শিরিনাপা আমাদের বিল্ডিং ছাইড়া চইলা যান। আমরা শুনি যে, ফয়জুর ভাইয়ের সাথে উনার বিয়া হইছে। ফয়জুর ভাইয়ের বাপ-মা প্রথমে আপত্তি করলেও শিরিনাপারে দেইখা মাইনা নিছেন। শিরিনাপা-ও আর বাইরে বাইর হন না খুব একটা। এটলিস্ট আমার সাথে আর কোনদিন দেখা হয় নাই। উনি আমারে কোনদিন ডাকেন নাই। আমিও কোনদিন যাই নাই।

কয়দিন পরে ফয়জুর ভাই শহরে প্রথম ভিসিআরের দোকান দেন। দোকান থিকা চাইরটা ভিসিআর ভাড়া দেন। অনেক ক্যাসেট। মেট্রিক পাশ করার পরে একদিন বন্ধুরা মিইলা ভিসিআর ভাড়া করতে যাই আমরা উনার দোকানে। ফয়জুর ভাই আমারে দেইখা চিনতে পারেন, বলেন, সোহেল তুমি বাসায় আইসো! শিরিন তো তোমার কথা বলে খুব। আমার ফ্রেন্ডদের সামনে আমি কুঁকড়ায়া যাই। কেন যে, নিজেও জানি না।

শিরিনাপা’র বিয়ার পরে ছোটচাচা’র অবস্থা খারাপ হয়া যায়। ছায়াবাণী সিনেমাহলের চাকরিটা উনি ছাইড়া দেন। ছোটভাইয়ের অবস্থা খারাপ দেইখা আব্বা উনারে উনার সাথে আখাউড়া নিয়া যান। আখাউড়াতে একটা সিনেমাহলে কিছুদিন কাজ করেন। তারপরে ইতালিতে চইলা যান। আমাদের সাথে, বাংলাদেশের সাথে কোন যোগাযোগই রাখেন না। কিন্তু প্রতি বছর নিয়ম কইরা আমার নামে কিছু টাকা পাঠান। শিরিনাপার মতন ছোটচাচার কথাও আমি ধীরে ধীরে একটা সময় ভুইলা যাই।

৫.
পরে ভার্সিটিতে উইঠা সিনেমা প্যারাডিসো আর ম্যালিনা দেইখা বুঝতে পারি, এইগুলা আসলে তেমন কোন ঘটনা না। সিনেমাতে তো কতো আগেই ঘইটা গেছে। ছোটচাচা যদি ভেজা চোখ না দেইখা এইগুলা দেখতো তাইলে হয়তো এতোটা কষ্ট পাইতো না। মানে, ঢাকা শহরে থাইকা, সিনেমা চুদায়া, এইরকমের ডাম্ব অ্যাস আমি হইতে পারছি তো!

যে, জীবন হইলো একটা সিনেমা। আমরা সবাই আসলে কোন না কোন সিনেমারই কারেক্টার।

৬.
ভার্সিটি পাশ করার পরেও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের বড়ভাই হিসাবে টিএসসি’তে যাওয়া চালু রাখছি আমি। যেহেতু টুকিটাকি ভিজ্যুয়ালের কাজ করি, নতুন নতুন সিনেমা দেখতে-শেখা পোলাপাইনগুলা ভাবে, আমি কি না জানি! আসলে একটা বয়স পার না হইলে তো বয়স জিনিসটারে অইরকম বুঝা যায় না।

তো, একদিন হঠাৎ দেখি, একটা মেয়ে দূর থিকা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকায়া আছে। সাদিয়াদের জুনিয়র, নতুন রিক্রুট মেবি। একটু পরে দেখি, কাছে আইসা দাঁড়াইছে। অনেক দোনামোনা কইরা আমারে জিগায়, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি সোহেল চাচ্চু? আমি তাকায়া দেখি, আরে, এই মেয়েরে তো চিনা চিনা লাগে! কইলাম, হ্যাঁ।

আমি কিছু বুঝার আগেই, আমারে জড়ায়া ধইরা কানতে থাকে, সোহেল চাচ্চুু, আমি রূপানজেল! শিরিনাপা’র মেয়ে!

আমি তো অবাক! আরে, বলো কি! কি ঘটনা!

একটু ধাতস্থ হয়া আমরা চা-টা খাই। রূপানজেল এই বছরই ভর্তি হইছে ভার্সিটিতে। বললো, ক্লাস সিক্সে উইঠাই ভিকারুন্নেসাতে ভর্তি হইছিল, তখনই ওরা ঢাকায় চইলা আসছে। ওর একটা ছোটভাইও আছে এখন। বইলা একটু লজ্জা পায়। আমি কই, রূপানজেল নাম রাখছে বইলা চোখ ছোট কইরা ফেলছো! ওর ফ্রেন্ডরা হাসে। জিগায়, আপনারা কি মেলায় হারায়া যাওয়া ছোটবেলার ভাই-বইন!

আড্ডা শেষ হওয়ার আগেই রূপানজেল কয়, আপনি এখন আমাদের বাসায় চলেন! আমি বলি, আরে, এখন তো রাত! এই-সেই। কিন্তু কিসের কি, অর সাথে যাইতেই হয়।

বাসার দরজা খোলার পরেই রূপানজেল চিল্লায়া উঠে, আম্মা, দেখো, কারে নিয়া আসছি!

শিরিনাপা!

কি যে সুন্দর এখনো!

উনার মনের হাসিটা মুখে চইলা আসে। একটা সেকেন্ডও দেরি হয় না উনার আমারে চিনতে। কি যে খুশি হন উনি। যেন গতকালকেই দেখা হইছে আমাদের। মাঝখানে এই এতোগুলা বছর ছিল-ই দুনিয়ায়। আন-রিয়েল অইগুলা! কথার পরে কথা। কথাই শেষ হয় না।

একটু পরে ফয়জুর ভাই আসেন। বাইরে ছিলেন। আমারে দেইখা খুবই খুশি। বলেন, কিছু খাইতে দিছো অরে! ঢাকায় থাকো এতোবছর, অথচ বাসায় আসো না! সবসময় আসবা! দেখো, আমি তো বুড়া হয়া যাইতেছি, তোমার শিরিনাপা তো কোনদিনই বুড়া হবে না। বইলা হাসেন। আমি আর রূপানজেলও হাসি। শিরিনাপার আসলেই কোনদিন বয়স হবে না।

শিরিনাপা অনেককিছু রান্ধা-বান্না করেন। আগেই রান্ধা ছিলো কিনা জানি না। নতুন কইরা আবার এইটা-সেইটা রান্ধেন। খাইতে খাইতে রাত এগারোটা-বারোটা। আমারও উঠতে ইচ্ছা করে না। উনারাও বলেন, এতো রাতে বাসায় গিয়া আর কি করবা! বাসায় তো আর বউ বইসা নাই তোমার লাইগা! হাসেন। আমি হাসি।

আসার সময়, দরজার কাছে যখন জুতা পরতেছি তখন শিরিনাপা খুব আস্তে কইরা জিগান, রোমেল কেমন আছে? রোমেল, আমার ছোটচাচার নাম।

আমি বোবা একটা চোখ নিয়া শিরিনাপা’র দিকে তাকায়া থাকি। বলতে পারি না, ছোটচাচার কথা তো আমি ভুলেই গেছি!

৭.
অনেকগুলা সিনেমাহল বন্ধ হয়া গেছে। ছায়াবাণী এখনো বন্ধ হয় নাই। যে কোনদিন তো বন্ধ হয়া-ই যাবে। এর আগে প্রজেকশন রুমে বইসা একদিন ম্যাটিনি শো দেখতে হবে। আমি ভাবি।

কতোকিছুই তো ভাবি আসলে। কিছুই করা হয় না।

The following two tabs change content below.
Avatar photo
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →