Main menu

সুরিয়ালিস্ট মেনিফেস্টো – আদ্রে বেতো

উনিশ আর বিশ শতকে ইউরোপের আর্ট সিন ছিল পুরাই আউলা, বিশেষত ফ্রান্স। নো রিগার্ড ফর ট্রেডিশন। একটার পর একটা নতুন মুভমেন্ট চলতেসে। এক্সপ্রেশনিজম, সিম্বলিজম, ফোভিজম, কিউবিজম, দাদাইজম, ইউ নেম ইট! তবে খুব সম্ভবত সেই সময়ের সবচাইতে ইম্প্যাক্টফুল মুভমেন্ট ছিল সুরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট। আমাদের জন্য সম্ভবত সুরিয়ালিজম সবচেয়ে এক্সেসিবল ভিজুয়াল মিডিয়ামে। দালির সেই গলন্ত ঘড়ি, কিংবা ম্যাগ্রিটের চিমনির ভিতরকার ট্রেন, এগুলাই তো মাথায় আসে সুরিয়ালিজমের কথা ভাবলে, নাকি? কিন্তু আদতে সুরিয়ালিজমের জন্ম হইসিল লিখিত মিডিয়ামে। এপোলোনিয়র নিজের এক নাটকরে প্রথম নাম দিসিলেন সুরিয়াল (বাস্তবতার চাইতেও বেশি কিছু বুঝাইতে) এবং তারপর ব্রেতো সেই শব্দটারেই এক্সটেন্ড করলেন ইচ্ছামত। একদিন তিনি স্বপ্নে দেখলেন একটা জানালায় তিনি দুইভাগ হয়া দাঁড়ায়ে আছেন। এই ইমেজটাই তারে প্রথম তাড়ায়ে বেড়াইল। সুরিয়ালিজমরে ব্রেতো দেখাইতে চাইসেন একটা ভৌতিক স্বরের মত, একটা প্রফেটিক উইজডম। সক্রেটিসের ডেমন ছিল যেমন। তিনি নিজেরে এই স্বরের কাছে ছাইড়া দিতে পারসিলেন, প্রস্তুত ছিলেন নিজেরে এই স্বর দ্বারা ডিকটেটেড হইতে দিতে। মিলান কুন্দেরা তার ‘আর্ট অফ দ্য নভেলে’ প্রায় এরকমই উইজডম অফ নভেল নামে একটা ধারণার কথা বলসিলেন।

তবে আগে যে বললাম, নো রিগার্ড ফর ট্রেডিশন, তা হয়তো পুরাপুরি সত্য না। ব্রেতোর একলার পক্ষেই কি সম্ভব হইত আর্টে এত র‍েডিকেল পজিশন নেয়া, যদি না আগে অল্প হইলেও তার পাটাতন তৈয়ার হইয়া থাকতো? সুরিয়ালিজমের ঠিক আগের দুইটা মুভমেন্ট, সিম্বলিজম আর দাদাইজম থিকা অনেক নিসে সুরিয়ালিস্টরা। ম্যাক্স আর্নস্টের* কোনো ছবিতে পাখি দেখলে বুঝবেন সে যৌনতা বুঝাইতেসে, দালির কোনো ছবিতে শামুক মানেই ফ্রয়েড। এগুলা সিম্বলিজমের দান। আর দাদাইজম নিজে খুব বেশিদূর যাইতে পারে নাই। কিন্তু তারা আগের সবকিছু তছনছ কইরা দিতে পারসিল। নতুন কিছু আসার পথ তৈরি করতে পারসিল। আমাদের এই র‍েশনাল দুনিয়া, যা চালাইতেসে সুন্দর সুট-বুট পরা, সহীহ উচ্চারণে কথা বলা, নিয়ম মাইনা চলা সেন্সিবল মানুষজন, তারাই তো লাখ লাখ মানুষরে বাধ্য করলো বিশ্বযুদ্ধে মরতে। তাইলে এই র‍েশনালিটি, এই নিয়মকানুন দিয়া আর কী হবে? তারপর এই দাদাইস্টরা সব লণ্ডভণ্ড কইরা দিলেন। চিরাচরিত সব আর্টফর্ম দিয়া জগাখিচুড়ি পাকায়ে ফেললেন। ব্রেতো নিজেও এই দলের লোক ছিলেন। এইখান থিকাই তিনি নিসেন তার সাহস।

এমনকি কনটেন্টের দিক থিকাও সুরিয়ালিস্টরা যা করসে তা একদম নতুন না। তারা বরং একটা ধারারে নতুন কইরা ডিসকভার করসে। সেই রেনেসাঁস আমলেই হিরোনিমাস বশ, কিংবা আর্কিমবোল্ডোরা যেইসব আঁকতেসিলেন, তা সুরিয়ালিজম হইতে খুববেশি দূরে না হয়তো। কিন্তু রেনেসাঁস আর্ট বলতে আমরা যেহেতু বুঝি শুধু কোমল, গুরুগম্ভীর সিমেট্রি, ফলে হয়তো ভিঞ্চি আর বোত্তিচেল্লির সমসাময়িক বইলা এদের স্বীকার করতে আমাদের কষ্ট হবে। এমনকি আমরা যদি আরো পিছে যাই, একদম দুই হাজার বছর আগের হোরেস*ও তার আর্স পোয়েটিকায় বলতেসিলেন কিছু কবিদের কথা যারা বিষয়বস্তুর একঘেয়েমি কাটাইতে গিয়া জঙ্গলে ডলফিন কিংবা সমুদ্রে শূয়ার ছাইড়া দেয়। এইটারে হোরেস নিন্দা হিসেবেই বুঝাইসিলেন, কিন্তু তার এত বছর পরে ম্যাগ্রিট কি আসমান হইতে মানুষের বৃষ্টি পড়ান নাই? আরেক জায়গায় তিনি কিছু কবিদের নিন্দা করসিলেন যে তারা ‘অসুস্থ মানুষের দুঃস্বপ্নের’ মত কবিতা লিখে। সুরিয়ালিস্টরা তো সারাজীবন স্বপ্নের কাছেই পৌঁছাইতে চাইসে। এবং বর্তমানে ‘দুঃস্বপ্নের’ মত লেখাগুলা আমাদের কাছে এসথেটিকালি আরো রিলেভেন্ট হইয়া উঠতে পারসে মনে হয়। অর্থাৎ, সুরিয়ালিজমের এই আলামতগুলা আগেও ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে হয়তো এগুলা আমরা আরেকটু মানতে প্রস্তুত হইতে পারসি এই দুই হাজার বছরে। তার উপর ফ্রয়েডও গত শতকের হওয়ায় সুরিয়ালিস্টরা একপ্রকার ইন্টেলেকচুয়াল বৈধতাও পাইয়া গেলেন।

কিন্তু সুরিয়ালিজম যে আমার খুব প্রিয় স্টাইল তা বলবো না। অনেক ক্ষেত্রে আমার লাগে এইটা অলসদেরই হাতিয়ার হইসে বেশি। তবে সুরিয়ালিজমও তার পরের আর্ট ফর্মগুলার জন্য তাই করসে যা এর আগেরগুলা করসিল তার জন্য: নতুন কিছুর জায়গা তৈরি কইরা দেয়া। বর্তমানে কনটেম্পরারি খুব কম আর্টই হয়তো পাব যেইখানে সুরিয়ালিজমের অন্তত কিছুটা এলিমেন্ট নাই। আমাদের ভিতরে দুনিয়ারে দেখার একটা নতুন চক্ষু এড হইসে। আর্টের টোটাল ইতিহাস তো মনে হয় এইভাবে নানান পথে আমাদের নিজেদের প্রকাশ করতে পারার ও দেখতে পারার চক্ষু আবিষ্কারেরই ইতিহাস।

তো, ওই টাইমের বেশিরভাগ ফ্রেঞ্চ টেক্সটের মত এইটাও প্রচণ্ড দুর্বোধ্য ও ফ্ল্যাশি। যত না কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি স্টাইলের শো-অফ। ফলে অনুবাদটা করতে অনেক প্যারা খাইতে হইসে সত্যিই। এবং স্বীকার করি, কিছু জায়গায় অল্প কিছু বাক্য বা ছোট ছোট প্যাসেজ হয়তো বাদও দিসি। তবে তা মেইন কথাটা আরো সহজবোধ্য করার জন্যই। এছাড়া, কিছু ভুলও হয়তো হইসে অনুবাদে, কে-জানে। তবে আমার ধারণা, ভুল হইলেও, আমার ভুলগুলাও বেশ সুরিয়ালিস্টই হইসে।

মাহীন হক
ডিসেম্বর, ২০২২

 

সুরিয়ালিস্ট মেনিফেস্টো

 

জীবনের প্রতি, জীবনের সবচাইতে নাজুক অংশ তথা বাস্তবতার প্রতি মানুষের এমনই অগাধ বিশ্বাস, যে সবশেষে সেই বিশ্বাস ভাইঙা পড়তে বাধ্য হয়। যেহেতু মানুষ এক ঘাড়ত্যাড়া স্বাপ্নিক প্রজাতি, ফলে নিজের কিসমতের প্রতি রোজ তার বিরক্তি বাড়তে থাকে, যেইসব জিনিস তারে ব্যবহার করতে বাধ্য করা হইসে একসময় সে আর সেইসবের মূল্য ঠাহর পারে না। তার কাছে আর দাম থাকে না যাকিছু সে নিজের চেষ্টায় কামিয়াব হইসে, প্রায় সবসময়ই সে সেইসব পায় নিজের চেষ্টায়, যেহেতু সে কাজ করতে রাজি হইসে, অন্তত নিজের কিসমতরে নাকচ করে নাই (কিংবা যারে সে কিসমত বইলা ডাকে!) এই পর্যায়ে আইসা তার মধ্যে বিনয় জন্মায়: সে জানে কোনসব মহিলাদের সাথে সে ছিল, সে জানে কীসব আলতুফালতু কাজকাম তারে করতে হইসে; নিজের ধনসম্পদ কিংবা গরিবি নিয়াও তখন আর তার কোনো আগ্রহ থাকে না। এই অর্থে সে মাত্র জন্মানো কোনো বাচ্চার মত। এমনকি তখন আর তার বিবেক-টিবেকেরও তেমন প্রয়োজন হয় না। তবুও যদি তার মধ্যে কোনো স্পষ্টতা বাকি থাইকা থাকে, তখন নিজের শৈশবের দিকে পিছন ফিরা তাকানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। যে শৈশব হাজারো গুরু-মাষ্টারদের ধাতানিতে ভচকায়ে গিয়া থাকলেও তার কাছে তখনও তা মিঠা লাগে। যেহেতু ছোটকালে কোনো বাঁধা-ধরা সীমানা ছিল না, ফলে সে বহু জীবন একবারে যাপন কইরা ফেলার একটা স্বাদ পায়। এই ইলিউশনটা তার মধ্যে গভীর শিকড় গাঁথে। এখন সে কেবল ভাইসা যাইতে চায়, সে চায় সবকিছুর চূড়ান্ত সৌন্দর্য শুইষা নিতে। বাচ্চারা প্রতিদিন বাইর হইয়া পড়ে দিনদুনিয়ার কোনোকিছুর চিন্তা ছাড়াই। সবকিছুই তাদের হাতের কাছে থাকে। এমনকি সবচাইতে জঘন্য যা ঘটতে পারে তাও মাইনা নেয়া যায়। সকল জঙ্গলই সাদা নাইলে কালা। এবং তার চোখে কোনো ঘুম নাই। তবে এও সত্য যে আমরা অতদূর যাওয়ার সাহস জুগাইতে পারবো না। এইটা স্রেফ দূরত্বের মামলা না। এই পথে হুমকির পরে হুমকি ছড়ানো। লোকে বাধ্য হয় ধীরে ধীরে পিছু হটতে, জমিনের একটা অংশ ছাইড়া দিতে। সুতরাং যেই কল্পনা কোনো বাঁধ মানে না তারেও চর্চা করতে হয় উপযোগিতার কঠোর আউলফাউল নিয়মের অধীনে। ফলে কল্পনাশক্তি খুব বেশিদিন এই বাজে দশায় টিকতে পারে না, এবং সাধারণত মানুষের বিশ বছর হইতে না হইতেই তারে সে তার নীরস নিয়তির হাতে একলা ফালায়ে চইলা যায়। যদিও মানুষ পরে চেষ্টা করে নিজের কল্পনাশক্তিরে আবার জাগাইতে, কারণ ক্রমশ তার মনে হইতে থাকে জীবনের সকল অর্থ সে হারায়া ফেলতেসে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে ব্যর্থ হয়, কার‍ণ ততদিনে সে ভালোবাসার মত কোনো উঁচা পর্যায়ে পৌঁছানোর শক্তিই হারায়া ফেলে। কারণ ততদিনে সে তার শরীর ও মন সঁইপা দেয় নিছক দুনিয়াবি প্র‍াকটিকাল কাজকামে যা তার সব মনোযোগ খায়া ফেলে। তার কোনো আচরণই আর খুববেশি মহান থাকে না, তার কোনো ধ্যানধারণা আর থাকে না উদার কিংবা সুদূরপ্রসারী। সকল ঘটনা, বাস্তব হোক আর কল্পিত, তার মনের চক্ষুতে সবকিছুরে সে কেবলই তার পরিচিত অন্যান্য ঘটনার আদলেই শুধু বুঝতে পারবে। আমি যা বলতেসি তা হইল: সবকিছুরে সে কেবল নিজের পরিচিত অন্যান্য ঘটনার সাথের সম্পর্কের মধ্য দিয়াই বিচার করবে। কোনো ঘটনারেই সে নিজের মোক্ষ হিসেবে গ্রহণ করবে না।

প্রিয় ইমাজিনেশন, তোমার ব্যাপারে আমি যা সবচেয়ে ভালোবাসি তা হইল তোমার বিন্দুমাত্র ছাড় না দেয়ার স্বভাব।

শুধুমাত্র “স্বাধীনতা” শব্দটাই আমারে এখনও নাড়া দিতে পারে। আমি বিশ্বাস করি একমাত্র এই শব্দটাই এখনও পুরাপুরি ধইরা রাখতে পারসে মানুষের আদিম ক্ষ্যাপা স্বভাবটা। কোনো সন্দেহ নাই, এই শব্দই ধারণ করে আমার সকল আশা-ভরসা। আমরা মানুষেরা যদিও হাজারটা দুর্দশার আওলাদ, তবু এই কথা মানতেই হবে যে, শুধুমাত্র আমাদেরকেই দেয়া হইসে সবচাইতে বেশি চিন্তার স্বাধীনতা। আর আমাদের দায়িত্ব হইল এর অপব্যবহার না করা। নিজের কল্পনাশক্তিরে চাকরানি করতে বাধ্য করা (যদিও সেইসাথে আনন্দ বলতে আমরা যা বুঝি তাও বিলুপ্ত হইয়া যায়), মানে হইল নিজের প্রতি নিজের করা ধোঁকা ও অবিচার। শুধুমাত্র কল্পনাই আমারে কিছুটা ধারণা দেয় যা ঘটতে পারে তার ব্যাপারে, ফলে সব বিধিনিষেধ মাইনা নেয়া কিছুটা হইলেও সহনীয় হয়। এবং এইটুকুই যথেষ্ট, কল্পনার কাছে নিজেরে কোনো ভুল করার ভয় ছাড়াই সঁইপা দেয়ার জন্য (যেনবা এরচাইতে বড় কোনো ভুল করা সম্ভব)। ঠিক কখন সব পচতে শুরু করে, অন্তরের স্থিরতা কখন নষ্ট হয়? মনের জন্য কি কখনো কখনো দুই-একটা ভুল করার সম্ভাবনাই বেশি ভালো না?

তবুও পাগলামি থাকে, “যেই পাগলামি লুকায়ে রাখে লোকে,” এরকম বলা হয় এর ব্যাপারে। পাগলামি, কিংবা হয়তো অন্যকিছু…আমরা সবাই জানি পাগলদের আদতে বন্দি কইরা রাখা হয় তাদের অল্পকিছু আইনি কটু আচরণের কারণে। এগুলা না করলে তাদের স্বাধীনতার (যারে আমরা স্বাধীনতা ভাবি) উপর কোনো হুমকিই আসতো না। আমি স্বীকার করতে রাজি আছি যে তারা অনেকসময়ই নিজেদেরই কল্পনাশক্তির শিকার। তাদের কল্পনাশক্তির কারণে তারা এমন অনেক নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কাই করে না যার বাইরে গেলে মানবপ্রজাতি ডর খায়, ফলে আমাদের সবার সেই নিয়ম মাইনা চলা লাগে। কিন্তু আমাদের এই বিচার এবং শাস্তির প্রতি তাদের যে গভীর উদাসীনতা দেখা যায়, তাতে ধারণা করা যায় তারা নিজেদের কল্পনা হইতে প্রচুর আরাম ও সান্ত্বনা পায়, ফলে তারা এই জাইনাও তাদের পাগলামিটারে এনজয় করে যে তাদের এই কল্পনার কদর তাদের বাইরে আর কেউ বুঝে না। আর অবশ্যই, হেলুসিনেশন, ইলিউশন এইসবের মাধ্যমে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা তো তুচ্ছ কিছু না। সবচাইতে কন্ট্রোলড সেন্সুয়ালিটি এরমধ্যে শামিল হয়। আর আমি জানি বহু সন্ধ্যায় আমার মনে হইসে খুশিমনেই আমি নিয়া নিব সেই হাত, যা Taine এর L’Intelligence-এর* শেষ পাতাগুলায় অদ্ভূত সব কুকাম করসিল। আমার পুরা জীবন আমি কাটায়ে দিতে পারি উন্মাদদের গোপন কথা ফাঁস করতে করতে। তারা নিজেদের ভ্রান্তির প্রতি সৎ, আর তাদের সরলতার কোনো তুলনা নাই আমি বাদে। ক্রিস্টোফার কলোম্বাসের উচিত ছিল নৌকভর্তি পাগল নিয়া আমেরিকা আবিষ্কার করতে বের হওয়া। আর খেয়াল রাখবেন কিভাবে এই পাগলামি গইড়া উঠসে, এবং এখনও টিকা আছে। পাগলামি অন্তত আমাদের বাধ্য করে না কল্পনাশক্তির ঝাণ্ডা ফালায়ে দিতে।

বাস্তববাদী এটিটিউডের বিরুদ্ধে যা যা বলা হয় তা আরেকবার ঝালাই কইরা নেয়া দরকার, এবং সেইসাথে বস্তুবাদী এটিটিউডটারেও। বস্তুবাদী এটিটিউড অবশ্য বাস্তবিকতার চাইতে বেশি কাব্যিক। এবং এইটা মানুষেরে একটা বিশাল দম্ভের জায়গা দেয়, তবু তা নতুন কোনো অবক্ষয়ের জন্ম দেয় না। এরে যদিও গ্রহণ করা উচিত স্পিরিচুয়ালিজমের নানান ফালতু প্রবণতার উত্তর হিসেবে। সেইন্ট থমাস একুইনাস হইতে শুরু কইরা আনাতোল ফ্রান্সের* পজিটিভিজমের দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড হইয়া বাস্তববাদী এটিটিউড বরং সকল প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক বা নৈতিক বিস্তারের বিরুদ্ধে গিয়া দাঁড়াইসে। আমি ঘৃণা করি এরে, কারণ এর মধ্যে আছে শুধু মিডিওক্রিটি, ঘৃণা, আর ভোঁতা দম্ভ। এই এটিটিউডের কারণেই আজকাল এইসব ফালতু বই, জঘন্য নাটকগুলা পয়দা হইতেসে। নিউজপেপারগুলি হইতে সে শক্তি জোগায় আর বিজ্ঞান ও শিল্প দুইটারেই বেকুব বানায়, আর ক্রমাগত সবচাইতে নিচু রুচিগুলারে সার্ভ করতে থাকে। ভোদাইদের জীবনে যে নিশ্চয়তা থাকে, এইটা তা-ই দেয়। যেন একটা কুত্তার জীবন। এবং এর প্রভাব পড়ে আমাদের সবচাইতে উন্নত মাথাগুলার উপরেও; সবচাইতে নিচুদের শাসন অন্য সবার মত তাদের উপরেও আছর ফেলে। সাহিত্যে এই বেকায়দা অবস্থার একটা ফল হইল এত বিশাল পরিমাণে উপন্যাসের পয়দা হওয়া। সবাই সবকিছুর উপরে নিজেদের ইক্টুখানি অবজারভেশন রাখতে চায়। এর এক অষুধ হিসেবে পল ভালেরি* সাহেব প্রস্তাব করসিলেন, বিভিন্ন উপন্যাস হইতে শুরুর প্যাসেজগুলা নিয়া একটা সংকলন করা হোক; এর ফলে যে উদ্ভট জিনিসের জন্ম হবে তাতে নিশ্চয়ই আমরা অনেককিছু শিখতে পাব। সবচাইতে বিখ্যাত লেখকরা এইখানে থাকবে। পল ভালেরি সাব নিজে কিছুকাল আগে উপন্যাসের ব্যাপারে বলার সময় বলতেসিলেন তিনি কখনোই “মার্কুইস পাঁচটার সময় বাইর হয়া গেল” মার্কা লাইন লিখবেন না। কিন্তু তিনি কি তার কথা রাখসেন?

স্রেফ তথ্য-বলনেওয়ালা যে এই স্টাইল, সেইটা এখন উপন্যাসে ব্যতিক্রম না, বরং নিয়ম হইয়া দাঁড়াইসে। তার কারণ হইল লেখকের নিজের এম্বিশনও অনেক সীমিত হইয়া আসছে। তাদের এত ঘটনার বর্ণনা, বেহুদা নিখুঁত বিবরণ পড়লে আমার মনে হয় তারা আমার সাথে ফাইজলামি করতেসে। কারেক্টারের সবচাইতে ছোটখাটো দোটানার কথা জানানো হইতেও আমারে মাফ করা হয় না। তার চুল কি সাদা? তার নাম কী? তার সাথে কি আমাদের পয়লা পরিচয় হবে গরমকালে? সুযোগ পাইতে না পাইতেই সবকিছুর উত্তর লেখক নিজেই দিয়া দেয়। আমার হাতে শুধুমাত্র বইটা বন্ধ করার ক্ষমতা বাকি থাকে, যা কিনা আমি বেশিরভাগ সময় প্রথম পাতা পড়তে না পড়তেই করতে বাধ্য হই। আর বর্ণনাগুলা! ওগুলা স্রেফ ধরা-বাঁধা স্টক হইতে নেয়া কতগুলা ইমেজ, লেখক যা নিজের ইচ্ছামত বারবার ইউজ করতে থাকে। লেখক চায় আমারে তার এই ক্লিশেগুলা খাওয়াইতে:

জুয়ান ছেলেটা যেই ছোট্ট রুমের ভিতর ছিল তার দেয়াল ছিল হলুদ ওয়ালপেপারে ঢাকাঃ জানালায় ছিল জেরেনিয়ামের লতা, যা ছিল মসলিনের পর্দায় ঢাকা; পড়ন্ত সূর্য এই গোটা সিনটার উপর একটা রুক্ষ আলো ফেলে…এই রুমের ব্যাপারে স্পেশাল কিছুই ছিল না। হলুদ কাঠের আসবাবগুলা ছিল খুবই পুরান। পিঠ হেলানো এক বিশাল সোফা, তার বিপরীতে একটা গোল টেবিল, একটা ড্রেসিং টেবিল আর আয়না। দেয়াল বরাবর কিছু চেয়ার, দুই-তিনটা মূল্যহীন কাঠখোদাই যাতে পাখি হাতে কতগুলা জার্মান মেয়েদের দেখা যায়। এই ছিল সেই রুমের ফার্নিচার। (দস্তয়েভস্কি, ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট)

এইসব ফালতু বিষয় নিয়া জানতে আমার মন বিন্দুমাত্র আগ্রহী না, সেই কথা বলার মত মেজাজ আমার এখন নাই। হয়তো কেউ বলতে পারে এইসব পোলাপাইন্যা বিবরণেরও প্রয়োজন আছে, এবং লেখকেরও নিজস্ব কিছু কারণ আছে আমার উপর এইসব চাপাইয়া দেয়ার। তবু আমি বলবো সে তার সময় নষ্ট করতেসে, কারণ আমি তার রুমে পা দিতে রাজি না। অন্যের আইলসামি কিংবা ক্লান্তি আমারে বিন্দুমাত্র আগ্রহী করে না। জীবনের কন্টিউনিটি নিয়া আমার ধারণা অতটাও মজবুত না যে আমি আমার সবচাইতে দুঃখের মুহূর্তগুলার সাথে আমার সেরা মুহূর্তগুলারে মিলায়ে ফালাব। আমার কথা হইল একজন মানুষ যখন অনুভূতি হারায়ে ফেলে, তখন তার চুপ থাকাই ভালো। আমি এও জানায়ে রাখতে চাই যে আমি বলতেসি না এইসব লেখার মধ্যে অরিজিনালিটি নাই বা এই নিয়া তাদের দোষও দিতেসি না। আমি স্রেফ বলতেসি যে জীবনের এইসব ফাঁপা মুহূর্তগুলার ব্যাপারে আমি অত খেয়াল দিতে চাই না, এবং আমি মনে করি এইগুলারে এমনে ক্রিস্টালাইজ কইরা রাখার কিছু নাই। সুতরাং, আপনাদের আজ্ঞা হইলে, আমি দস্তয়েভস্কির সেই রুমের বর্ণনা, এবং সেইসাথে এরকম আরো অনেক বিবরণ নজর-আন্দাজ কইরা যাইতে চাই।

(টু বি কন্টিনিউ…)

The following two tabs change content below.
Avatar photo

মাহীন হক

মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →