Main menu

আমার বন্ধু নজরুল : তাঁর গান – কাজী মোতাহার হোসেন [লাস্ট পার্ট]

ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা ইংরেজী প্রবন্ধ Nazrul Islam : The singer and writer of songs  লেখার তরজমা এইটা। নজরুল-ভক্ত বিদেশী বন্ধুদের একটি মুশায়েরায় পড়বার জন্য তাঁর এক ছাত্রের অনুরোধে তিনি এই এসে লেখেন। লেখাটা নজরুল একাডেমী পত্রিকা ৪র্থ বর্ষ, ১ম (গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত ১৩৮১) সংখ্যায় ছাপানো হয়। তরজমা করছিলেন শাহাবুদ্দিন আহমদ।

কিস্তি ১

১৩.
কুমারী ফজিলাতুন্নেসার বিলাত গমন উপলক্ষে নজরুল “বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন। তাঁর বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। কিন্তু কবিতাটি এমন নৈর্ব্যক্তিকভাবে লেখা যে অধিকাংশ পাঠকের পক্ষে এর ব্যঙ্গার্থ কিংবা রূপকের রহস্যভেদ করা কঠিন। তাঁরা শুধু দেখবেন প্রকৃতি কিভাবে বর্ষা ঋতু থেকে শীত ঋতুতে রূপ পরিবর্তন করছে। অথবা অন্যভাবে বলা যায় যে তিনি তাঁর অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে চেতনাশ্রিত কল্পনায় এমনভাবে জারিত করে নিয়েছিলেন যা থেকে তিনি মুক্তোর মত এমন কতকগুলো কবিতা রচনা করেন যা তাঁর অনুভূতিকে বিশ্বচারিত্র্য দান করেছে। অসাধারণ ক্ষমতাবান কবি ছাড়া বক্তব্য বিষয়কে এমন অনিন্দ্যসুন্দর রূপকের আড়ালে ব্যক্ত করা অসম্ভব। আমি কবিতাটির নির্বাচিত কয়েকটি পংক্তি এখানে তুলে দিলাম :

ওগো বাদলের পরী।
যাবে কোন দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী
ওগো ও ক্ষণিকা পূব অভিসার ফুরাল কি আজি তব?
পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব?
তোমার কপোলে পরশ না পেয়ে পাণ্ডুর কেয়া রেণু,
তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেনু।

ওগো ও কাজল মেয়ে –
উদাস আকাশ ছল ছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।
ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায় পথে
কাননে কাননে কদম কেশর ঝরিছে প্রভাত হতে ।

তুমি চলে যাবে দূরে –
ভাদরের নদী দু’কূল ছাপায়ে কাঁদে ছল ছল সুরে!
যাবে যবে দূর হিমগিরি শিরে, ওগো বাদলের পরী
ব্যথা করে বুক উঠিবে না কভু সেথা কাহাকেও স্মরি।
সেথা নাই জল, কঠিন তুষার নির্মম শুভ্রতা,—
কে জানে কী ভালো বিধূর ব্যথা – না মধুর পবিত্রতা।
সেথা রবে তুমি ধেয়ানমগ্না তাপসিনী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি “ফটিকজল”।

১৪.
বাদলের পরীর সঙ্গে আর একটি কবিতার যে অনেকখানি মিল আছে সে কথাটি আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই । এই কবিতাটিও ফজিলাতুন্নেসার বিলাত গমন উপলক্ষে রচিত। কবিতাটি এমনি :

জাগিলে “পারুল” কি গো “সাতভাই চম্পা” ডাকে।
উদিলে চন্দ্রলেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে!
চলিলে সাগর ঘুরে
অলকার মায়ায় পুরে,
ফোটে ফুল নিত্য যেথায়
জীবনের ফুল-শাখে
আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা টুটে ঐ বন্ধকারা
থেকোনা স্বর্গে ভুলে –
এ পারের মর্ত্য কূলে
ভিড়ায়ো সোনার তরী
আবার এই নদীর বাঁকে।।

এই কবিতাটিতে নজরুল তাঁর মনের ভার গোপন করেন নি, ফজিলাতুন্নেসাকে ফিরে আনার জন্য সরাসরি আবেদন করেছেন। কিন্তু আরও একটি কবিতায় এবং ‘বুলবুল’ ও ‘চোখের চাতক’-এর অনেকগুলি কবিতায় কবি তাঁর অন্তরের গভীর অনুভূতিকে বিভিন্ন অর রূপকের আড়ালে ব্যক্ত করেছেন। ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা বছরের সময় সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। সমান্তরাল আর একটি স্তবকে লক্ষ করা যায় কবি তাঁর আকাঙ্ক্ষিত প্রেমকে সুন্দরতর আর এক জগতে খুঁজে ফিরছেন যেখানে প্রেমে কোনো নৈরাশ্য নেই, কোনো বেদনা নেই। প্রেমের জন্যে নারীর কাছ থেকে তিনি চেয়েছিলেন পূর্ব আত্মসমর্পণ কিন্তু কোথাও তিনি তা পান নি। ফলে ধীরে ধীরে তিনি খোদা-প্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়লেন

পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।।
এ জনমে যাহা বলা হল না,
আমি বলিব না, তুমিও বলো না।
জানাইলে প্রেম করিও ছলনা,
যদি আসি ফিরে, বেদনা দিও।।
হেথায় নিমেষে স্বপন ফুরায়,
রাতের কুসুম প্রাতে ঝরে যায়,
ভালো না বাসিতে হৃদয় শুকায়,
বিষ-জ্বালা ভরা হেথা অমিয়।।
হেথা হিয়া ওঠে বিরহে আকুলি’,
মিলনে হারাই দু’দিনেতে ভুলি’,
হৃদয়ে যথায় প্রেম না শুকায়
সেই অমরায় মোরে স্মরিও॥

স্পষ্টতঃই, প্রেমের এই বিশ্বাসহীনতা ও ক্ষণস্থায়িত্বের অভিজ্ঞতা কবিকে পার্থিব প্রেমের প্রতি নিরাসক্ত করে তুলেছিল। তাই তিনি অমর এক প্রেমের জগতে আত্মার শান্তি খুঁজে ফিরছিলেন; যেখানে প্রেম কখনও বিচ্ছেদের জ্বালায় কলুষিত হয়ে ওঠে না— শাশ্বত মিলনের আনন্দই যেখানে সদা প্রবাহিত।

১৫.
১৯৩০ সালে কবিকে বাঙালী জাতির তরফ থেকে কলকাতা এলবার্ট হলে জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সভায় বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সভাপতিত্ব করেন। অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন ব্যারিস্টার এস, ওয়াজেদ আলী এবং কনিষ্ঠতম রাজনৈতিক নেতা সুভাষচন্দ্র বোস, যিনি আই. সি. এস. হলেও রাজনীতিতে আরোহণ করার জন্য সরকারী চাকুরীতে যোগ দেন নি, প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেন। আমি দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম।

১৯৩১ সালের দিকে নজরুল সিনেমা ও থিয়েটার জগতে প্রবেশ করেন। আমার মনে আছে ঐ সময় যখনই আমি কলকাতায় গিয়েছি তখনই নজরুল আমার ও আমার স্ত্রীর জন্য টিকেটের ব্যবস্থা করতেন। মাঝে মাঝে তিনি নিজেও অভিনয়ে অংশ নিতেন – যেমন ‘ধূপছায়া’ ছায়াছবিতে তিনি বিষ্ণুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

এই সময় ঠুংরী সম্রাট ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খান সাহেবের মৃত্যু হলে ফোন কোম্পানী তাকে হেড কম্পোজার ও সঙ্গীত শিল্পীদের ট্রেনার হিসাবে নিযুক্ত করেন। অনেক দফা নজরুল ইসলাম আমাকে সঙ্গে নিয়ে দমদম রেকর্ডিং অফিসে গিয়েছেন। সেখানে আমি কবিকে আঙুরবালা, ইন্দুবালা, আশ্চর্যময়ী, বেদানাদাসী, কমলা ঝরিয়া, কাননবালা (পরবর্তীকালে কাননদেবী), কানা কেষ্ট (কৃষ্ণচন্দ্র দে), কে. মল্লিক (মুহম্মদ কাসেম)-এর মত প্রথম শ্রেণীর শিল্পীদের এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের শিল্পীদেরকে সঙ্গীত শিক্ষা দিতে এবং তদারক করতে দেখেছি। রেকর্ডিং-এর জন্য শিল্পীদের নিয়ে প্রাথমিক রিহার্সাল তিনি কখনো তাঁর নিজের বাসায় অথবা ১০৬ আপার চিৎপুর রোডে সমাধা করতেন।

এর থেকে স্বভাবতই একটা প্রশ্ন জাগে “নজরুল কি এত উঁচুদরের সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন যে ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খানের স্থলে ঐসব নামজাদা অভিজ্ঞ শিল্পীদের সঙ্গীত শিক্ষাদানের তিনি উপযুক্ত?” উত্তর হল : নজরুলের সঙ্গীতের মান প্রশ্নাতীতভাবে সুন্দর এবং যখন তিনি করাচীতে ৪৯নং বাঙালী পল্টনে সৈনিকতা করছেন তখন একজন সুদক্ষ বংশীবাদক বলে তিনি খ্যাত ছিলেন। ঐ করাচীর পল্টন জীবনে তিনি একজন পশ্চিমা ওস্তাদের কাছে দ্রুপদ ও খেয়াল শিখেছিলেন। আমি তাঁকে ওস্তাদ মঞ্জু সাহেবের কাছেও সঙ্গীতের পাঠ নিতে দেখেছি। মঞ্জু সাহেব মুর্শিদাবাদের অধিবাসী ছিলেন, পরবর্তীকালে কলকাতার এন্টালীতে এসে স্থায়ীভাবে বাস করতেন। নজরুল তখন পানবাগান লেনে ঐ একই জায়গায় বাস করতেন। এরপরে তিনি মেটিয়া বুরুজের ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খান এবং পরে মহান ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পাঞ্জাবী ফৈয়াজ খাঁ তখন কলকাতায় এসে বাস করছিলেন।

ঢাকাতে ১৯২৭।২৮-এর দিকে একবার নজরুলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ঢাকার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদদের (যাদের মধ্যে খেয়াল, ঠুংরী ও টপ্পার অভিজ্ঞ সঙ্গীতজ্ঞ আমার ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরীও ছিলেন) সঙ্গে তুলনা করলে সঙ্গীত জগতে আপনার স্থান কোথায় হতে পারে বলে আপনি মনে করেন। নজরুল তখন এই বলে উত্তর দেন : আপনার ওস্তাদজী সঙ্গীতে বি. এ. এবং আমি সম্ভবতঃ একজন ম্যাট্রিক কিংবা বড় জোর আই. এ.। অন্যান্য ওস্তাদদের মত মোহম্মদ হোসেনের তাল, লয় এবং বিশুদ্ধ রাগের উপর পুরোপুরি দখল আছে। অতি সহজে বাদী সম্বাদী থেকে উড়ব, খাড়ব এবং সম্পূরণ রাগাদি প্রদর্শনে তানের আরোহণ ও অবরোহণে তাঁর ঐতিহ্যগত স্বাভাবিক ক্ষমতা তর্কাতীতভাবে সুন্দর, কিন্তু আমার এমন কতকগুলো মৌলিকতা আছে যা সঙ্গীত শাস্ত্রে এম. এ. ডিগ্রীপ্রাপ্ত এইসব ওস্তাদেরা তার ধারে কাছেও কোনোদিন পৌঁছতে পারবেন না। এইসব ওস্তাদেরা গানের অর্থ, ভাব এবং আবেদনকে শ্রদ্ধা করেন না এবং সে জন্যেই প্রয়োজনবোধে যেখানে বিশেষস্থানে নাটকীয় শৈল্পিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার প্রয়োজন হয়, আন্তরিকতার সুযোগে সঙ্গীতকে মর্মস্পর্শী করার দরকার হয়, সেখানে তাঁরা ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তাঁরা মনে করেন রাগের কাঠামোর বাইরে শিল্পীর কোনো স্বাধীনতা নেই। কিন্তু আমি এমন কিছু স্বাধীনতার প্রশ্রয় দিই যাতে গানটি আরও জীবন্ত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। গানের অন্তরানুভূতি শারীরিক রূপলাভ করে।

আমার মনে হয় কবির এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে সত্য এবং এই প্রশ্ন আমি কবির ব্যাপারে আমার ওস্তাদজীকে (যার কাছে আমি দু’বছর ধরে কণ্ঠসঙ্গীত শিখেছিলাম। এবং পরে যিনি আমাকে তিনবছর ধরে সেভারের গোপন রহস্য শিখবার পরামর্শ নিয়েছিলেন) জিজ্ঞাসা করেছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন: কবি নজরুলের কণ্ঠ তেমন উচ্চাঙ্গের কিংব সুরেলা নয়। তবে তাঁর কণ্ঠ বেশ জোরালো পৌরুষময় (বুলন্দ)। তাছাড়া তাঁর গলাতে অপ্রত্যাশিতভাবে এমন কতকগুলো কাজ ফুটে উঠতে দেখা যায় যার সঙ্গে আমার আদৌ পরিচয় নেই। যদিও সঙ্গীতের মহত্তম শিল্পীরা এই ধরনের কলাকৌশল কখনও কখনও দেখিয়ে থাকেন; তবু তারা আবার মূল রাগের কাঠামোর মধ্যে ফিরে আসেন। বলাবাহুল্য রাগের এই রস কিংবা আত্মার উপর অসাধারণ দখল ছাড়া এমনটি করা কারও পক্ষে সম্ভব না। মোটকথা তিনি তাঁর পথে চলেন আর আমরা চলি আমাদের পথে।

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদেরা সাধারণতঃ এইভাবে কাউকে স্বীকৃতি দেন না। সুতরাং আমার ওস্তাদ যে এই ঔদার্য দেখালেন সেজন্য তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার অন্ত নেই। এই প্রসঙ্গে বলা অকারণ হবে না মোহিনী সেনগুপ্তা নাম্নী রবীন্দ্র-সঙ্গীত ও নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপিকার একজন মহিলা নজরুলের পরম হিতৈষিণী ছিলেন এবং তিনিই প্রথমে নজরুলকে ধ্রুপদ গানে কিভাবে অস্থায়ী অন্তরা আভোগ ও সঞ্চারী বিন্যস্ত করতে হয় তারই শিক্ষা গ্রহণে মনোনিবেশ করতে এবং ঐগুলো পৃথক পৃথক সঙ্গীতের পৃথক পৃথক স্থান এবং পংক্তিতে কিভাবে সন্নিবেশিত হবে এবং “ন্যাসম্বর” ও “গ্রহম্বর”-এর ভূমিকা গানে কতটা সে-বিষয়ে পরামর্শ ও জ্ঞানদান করেন। সঙ্গীতের এই আঙ্গিকগত কলা-কৌশল শিখবার পরামর্শ নজরুলকে অনুপ্রাণিত করে এবং গভীরভাবে সেগুলো অনুশীলন ও শিক্ষালাভে কৌতূহলী করে তোলে। ফলে তিনি বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে পরবর্তীকালে ঐগুলি শিখবার জন্যে উৎসাহিত হয়ে উঠেন। যদিও একথা সত্যি যে নজরুল অবিকলভাবে একাধারে সঙ্গীতের কোনো বিশেষ ধারা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে চর্চা করেন নি; কিন্তু সঙ্গীতের সূত্রগুলো তাঁর অসাধারণ প্রতিভার আগুনে তিনি শোষণ করে নিতে পারতেন এবং অসঙ্গতিপূর্ণ গগুলিকে শিল্পীসুলভ আশ্চর্য ক্ষমতাবলে জোড়া লাগাতে সক্ষম হতেন। সুতরাং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিনয় করে তিনি নিজেকে সঙ্গীত-জগতে ম্যাট্রিক ও আই. এ-এর স্তরে পড়ি বললেও পরবর্তীকালে আরও অধিক শিক্ষা, সাধনা ও অধ্যাবসায়ের দ্বারা এবং তাঁর জন্মসূত্রে অর্জিত সঙ্গীত-প্রতিভার এম. এ ডিগ্রীর বদৌলতে তিনি তাঁর সময়কার সকল গুণী, বি. এ পাশ করা, কণ্ঠসঙ্গীতের ওস্তাদদের সমকক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দমদম এবং চিৎপুর রোডের রিহার্সাল রুমে শিল্পীরা যখন কোনো গান গাইতেন কবি তখন সেই গান অনুসরণ করে মৃদুভার হাতের কাছে যেটাই থাকতো, হারমোনিয়াম কিংবা অর্গান, সেটাই বাজাতেন এবং শিল্পীদের গাওয়ার মধ্যে বিন্দুমাত্র ত্রুটিবিচ্যুতি হলে গানের ভাব, ভাষা ও সুর অনুযায়ী গানের শিল্পরূপটি যথাযথ না ফুটলে তিনি হাত তুলে শিল্পীদের থামবার ইশারা করতেন এবং স্বকণ্ঠে গেয়ে সেই স্থানটা সংশোধন করে দিতেন। এবং যেমনটা স্বাভাবিক, তার ব্যাখ্যা এতটাই বিশুদ্ধ হত’ যে পণ্ডিতেরা সেটাই অনুমোদন করতেন এবং তাঁর পদ্ধতি অনুসরণ করে গাইতেন। এইভাবে তাঁর গানকে যাঁরা কণ্ঠে তুলতেন তাঁরা বারংবার একটি গানকে সার্থকভাবে রূপায়িত না করা পর্যন্ত গেয়ে চলতেন। অবশ্য, বেদানা দাসী, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া এবং কানন দেবী নজরুলের গায়কীটা যত তাড়াতাড়ি ধরতে পারতেন আঙুরবালা, আশ্চর্যময়ী, কানাকেষ্ট, কে. মল্লিক, আব্বাসউদ্দীন এবং অন্যদের পক্ষে তা ধরতে একটু দেরী হ’ত। কেননা, আপন-আপন গাইবার ভঙ্গী ও একঘেঁয়ে অভ্যাস তাঁদের পক্ষে ত্যাগ করা কঠিন হত বলে নজরুলের যথাযথ প্রকাশভঙ্গিটা তাঁদের পক্ষে কব্জায় আনা সহজ হ’ত না।

১৬.
আব্বাসউদ্দীন, প্রতিভা সোম এবং আরও অনেকে নবীন প্রতিশ্রুতিশীল কণ্ঠশিল্পীরা সঙ্গীতের পাঠ নিতে নজরুলের বাড়ীতে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। নজরুল এজন্য মোটেই বিরক্ত হতেন না, তাঁদের সবাইকে বিনা পারিশ্রমিকে সাহায্য করতেন। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, নজরুল তাঁর কতকগুলো বাছাই করা গানের গ্রামোফোন ও জেনোফোনের রেকর্ড (এক ডজনের বেশী) কুমারী ফজিলাতুন্নেসাকে উপহার দিয়েছিলেন; আমাকেও হিজ মাস্টার্স ভয়েসের খান পাঁচেক রেকর্ড দিয়েছিলেন।

বলাবহুল্য যে-গতিতে নজরুল একটি নতুন গান লিখে শেষ করতেন সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ব্যাপারটা এমনি বিস্ময়কর। হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রথমে তিনি বিষয় ছাড়াই একটি রাগের সম্পূর্ণ কাঠামোটা তৈরী করে নিতেন তারপর যে যে শব্দ ঐ সুরের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে খাপ খায় তেমনি বাছাই করা উত্তম সুরের সাহায্যে তিনি গানটি রচনা করতেন। নজরুল হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে গানটি গাইতে থাকতেন আর গ্রামোফোন কোম্পানীর স্ক্রিপ্ট লেখকেরা সেটা দ্রুতগতিতে লিখে নিতেন, অথবা কবি নিজেই গাইতেন এবং লিখতেন। এইভাবে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটি রাগের কাঠামোর প্রতটি অঙ্গের আকার অনুযায়ী সুন্দর সুন্দর পংক্তিগুলি রূপায়িত হয়ে উঠতো একটি সম্পূর্ণ গানের শরীরে। ১৪ নং ওয়েলেস্‌লি স্ট্রীটে অবস্থিত “সওগাত” অফিসে কবি অনেক সময় প্রতিশ্রুত সময়ে তাঁর লেখা লিখতে না পারলে সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন ঘরে আটকে লেখা আদায় করতেন। দেখা যেত আধঘণ্টা একঘণ্টার মধ্যে লেখক অতি মনোরম আবেগসমৃদ্ধ প্রবন্ধ কিংবা কবিতা লিখে দিয়েছেন।

তরুণ অথবা তরুণী লেখক-লেখিকাদের নজরুল সাহিত্যকর্মের জন্য উৎসাহ জোগাতেন। কখনও তাঁদের লেখা প্রয়োজনমত সংশোধন করে দিতেন অথবা কাউকে লক্ষ্য করে ছোট্ট একটি কবিতা লিখে তাঁকে প্রেরণা যোগাতেন। এইসব তরুণ-তরুণীর মধ্যে যাঁদের নাম সহজে মনে আসে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন : হাবিবুল্লাহ বাহার, শামসুন্নাহার, সুফিয়া এন. হোসেন (পরবর্তীকালে সুফিয়া কামাল), দক্ষিণ-কলকাতার মেটিয়া ব্রুজের জাহানারা বেগম, ফরিদপুরের সুফী মোতাহার হোসেন, কবি আবদুল কাদির (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)। হাবিবুল্লাহ বাহার ছিলেন নজরুলের বন্ধু এবং ইডেনগার্ডেন ও গড়ের মাঠের ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা দেখার সঙ্গী। সুফিয়া কামাল ও শামসুন্নাহার আমাদের বিখ্যাত লেখিকাদ্বয়; জাহানারা বেগম ছিলেন “বর্ষবাণী” নামক বার্ষিক সাহিত্য-পত্রিকার সম্পাদিকা; সুফী মোতাহার হোসেন হলেন অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ও নজরুল ইসলাম প্রশংসিত বিখ্যাত সনেটকার আবদুল কাদির “দিলরুবা” ও “উত্তর বসন্ত” কাব্যযুগলের কবি – এবং নজরুল “নজরুল রচনাবলী” ও “নজরুল রচনাসম্ভারের” বিখ্যাত সম্পাদক। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা নজরুল নিরাময় সমিতির উৎসাহী সদস্য কবি আবদুল কাদির নজরুল সাহায্য তহবিল থেকে কিছু টাকা নিয়ে কলকাতায় কবিকে দেখতে যান নজরুলের চিকিৎসার ব্যাপারে সাহায্য করতে। ফিরে এসে তিনি জানিয়েছিলেন নজরুল নাকি কয়েকবার ‘মোতাহার’ ‘মোতাহার’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। যদিও তখন নজরুল সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রষ্ট। তবু তাঁর অবচেতন মনে হয়ত আজও কয়েকজন বন্ধুর নাম সাঁতরিয়ে ফেরে।

১৭.
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যকার সম্পর্কটি ঠিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ছিল না, ছিল কিছুটা গুরু-শিষ্যের মত এবং তা শুধু কাব্য ও সাহিত্য ক্ষেত্রেই নয় সঙ্গীত ও সুরের রাজ্যেও। রবীন্দ্রনাথ যে নজরুলকে কতটা স্নেহের চোখে দেখতেন তা “ধূমকেতু”কে আশীর্বাদ করে লেখা তাঁর কবিতা পংক্তিসমূহে সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুট:

আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু!
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক-রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধ-চেতন।

শুধু এই কবিতায় নয়। নজরুল যখন পুনরায় ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে স্বরাজ পার্টি কর্তৃক প্রকাশিত “লাঙলে”র সম্পাদনার ভার নেন তখনও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসাহমূলক এই আশীর্বাণীটি পাঠান :

জাগো, জাগো বলরাম ধরো তব মরু-ভাঙা হল
প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ কর ব্যর্থ কোলাহল ।

অনশন ধর্মঘট ত্যাগ করাতে হুগলী জেলে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে “অনশন ত্যাগ কর, আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়” বলে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তার থেকে বোঝা যায় – বাংলা সাহিত্যের কাব্য-গগনে উদিত এই নতুন নক্ষত্রটির জন্যে তাঁর কী গভীর উৎকণ্ঠা ছিল। নজরুল সেই স্নেহের প্রতিদানে রবীন্দ্রনাথকে “গুরুদেব” সম্বোধন করে তাঁর হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন যে দেশের সবাই যখন তাঁকে পরিহাস করছিলেন রবীন্দ্রনাথই তখন তাঁকে যথার্থ বুঝতে পেরেছিলেন। প্রথম যৌবনে নজরুল রাবীন্দ্রনাথের গানকে সবকিছুর উপর স্থান দিয়েছিলেন। বস্তুতঃ নজরুলই আমাকে প্রথম কয়েকটি রবীন্দ্রনাথের গান শেখান। তার প্রথমটি হল :

কে যেন আমারে এনেছে ডাকিয়া এসেছি ভুলে।
তবু একবার চাও মুখপানে নয়ন তুলে।
দেখি, ও নয়নে নিমেষের তরে
সেদিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে,
সজল আবেগে আঁখিপাতা দু’টি পড়ে কি ঢুলে। ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙ্গায়ো না এসেছি ভুলে।।

দ্বিতীয় গানটি হল :

তোরা পারবি নাকি যোগ দিতে সেই ছন্দেরে
খসে যাবার ভেসে যাবার মরবারই আনন্দে রে ॥

এই দুটি সুপরিচিত গান ছাড়াও “গীতাঞ্জলি” ও “গীতিমাল্য” প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের আরও অনেক গান নজরুল গাইতেন। সুতরাং এই দুই দৈত্যতুল্য সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীত-রচয়িতার মধ্যে কে শ্রেষ্ঠতর আমার পক্ষে সেটা বলা নাজুক ব্যাপার।

১৮.
রবীন্দ্রনাথ প্রায় হাজার তিনেক গান লিখেছেন। অপরদিকে নজরুল গ্রামোফোন রেকর্ডের গান নিয়ে প্রায় চার হাজারের মত গান লিখেছেন। দু’জনের সব গানই প্রথম শ্রেণীর নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান শিল্পের খাতিরে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে লিখেছেন আর নজরুল অধিকাংশ গান লিখেছেন জীবিকা নির্বাহের দায়ে পড়ে। তাই বলে নজরুলের গানগুলিতে তাঁর সমস্ত হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি শিল্প-সুষমা ফুটে উঠে নি, বলা চলে না। সঙ্গীতের গোটা পরিধির মধ্যে পুনরাবৃত্তি ঘটতে বাধ্য যদি পর্যায়ক্রমে চিন্তা ধারার পরিবর্তন না ঘটে। যেমন ধরুন আপনি কেবল বসন্তের সৌন্দর্য নিয়ে যদি অবিরাম লেখেন তো বিষয়-বৈচিত্র্যের অভাব ঘটবে। যদি রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল দশটি কবিতা লেখেন তা হ’লে চিন্তাধারার পুনরাবৃত্তি হবেই — প্রতিটি কবিতার আঙ্গিকগত ভিন্নতাসত্ত্বেও। পাঠক ও শ্রোতার কল্পনাকে আকর্ষণ করতে পারে এমন নন্দনতাত্ত্বিক প্রকাশ ভঙ্গিমাই কাব্যালোচনার মৌল বিষয়। জীবনের প্রথম পনর বছর বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথ ৬৫ বছর সাহিত্যসাধনা করেছেন। এই পরিমাপ অনুযায়ী নজরুলের সাহিত্যজীবন মাত্র ২৬ বৎসরের যা রবীন্দ্র-সাহিত্য-জীবনের পাঁচ ভাগের দুইভাগ মাত্র। যদি শুধু সঙ্গীতের বিষয় ধরা যায় তাহলে বলতে হবে নজরুলের সৃষ্টি ক্ষমতা অনেক বেশী। দেখে মনে হয় তিনি তাঁর বংশধরদের জন্য তাঁর পক্ষে যতটা দেওয়া সম্ভব তা উজাড় করে দিয়ে গেছেন। যদি উভয়ের সঙ্গীতের গুণগত দিকের বিচার করতে হয় তাহলে উভয়ের জীবনের বাল্য ও কৈশোর জীবনের অর্থাৎ পনর বছরে পৌঁছা পর্যন্ত প্রাথমিক জীবনের পরিবেশের কথা উল্লেখ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, নিধু বাবু (বিখ্যাত টপ্পার স্রষ্টা), রামপ্রসাদ ও রজনীকান্তের সঙ্গীতের উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতে তাঁদের প্রতিফলন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সঙ্গীতকে সম্পূর্ণ আত্মস্থ সুমার্জিত ও উৎকৃষ্ট করার সুযোগ পেয়েছিলেন। অন্যদিকে নজরুল রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক সমৃদ্ধ তৈরী বাংলা ভাষা পেয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পূর্বসূরী ওস্তাদদের রাগের কাঠামোকে ভেঙে নতুন রাগ সৃষ্টি করেছিলেন, পূর্ববর্তীদের গায়কী ঢঙ বদলে দিয়ে ছন্দ বজায় রেখে রক্ষণশীল ঐতিহ্যগত ধ্বনি ও মাত্রার পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। এতে গায়কেরা রাগের ওস্তাদী রক্ষণশীলতার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গানগাইবার স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। বস্তুতঃ, সঙ্গীতের স্বীকৃত চারটি আঙ্গিক ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুংরী, টপ্পার (তাদের বৈচিত্র্যসহ) সঙ্গে তিনি আরও একটি নতুন ঢঙ সংযুক্ত করেছিলেন। সঙ্গীতের এই নতুন ঢঙটি “রবীন্দ্র সঙ্গীত” । এতদ্‌সত্ত্বেও রবীন্দ্র-সঙ্গীতে তিনি ধ্রুপদ ও খেয়ালের গাম্ভীর্য বজায় রেখেছিলেন। সংক্ষেপে ব্রাহ্ম-সঙ্গীত, ভজন, কীর্তন প্রভৃতি রাগের চারিত্রিক পরিবর্তন না ঘটলেও একটি রাগের সংহতি থেকে ক্রমান্বয়ে তাদের মুক্তি ঘটলো । অন্য কথায় বলা যেতে পারে দু’তিনটি রাগকে তিনি একত্রে মিশ্রিত করেছিলেন যাদের নতুন নাম হল ‘সঙ্কর’ বাগ ও রাগিণী। উপরন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি বিদেশী সুরেরও মিশ্রণ ঘটান। বাংলা সঙ্গীতে এ-ছিল একটি অভিনব সাহসী পদক্ষেপ, স্বাস্থ্যকর অবদান।

১৯.
মহান রবীন্দ্রনাথের কাছে যে নজরুল ঋণী সে বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। ঐতিহ্যসূত্রে তিনি যা পেয়েছিলেন সেগুলোকে আত্মস্থ করে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সঙ্গীতে যে নতুনত্ব সৃষ্টি করেছিলেন তার থেকে আরও এগিয়ে গেলেন তিনি। সংস্কৃত শব্দপ্রাচুর্যে শৃঙ্খলিত বাংলা ভাষাকে মুক্ত করে রবীন্দ্রনাথ সহজবোধ্য ভাষায় রূপান্তরিত করেন যে ভাষা হিন্দী, ফার্সী, আরবী, পর্তুগীজ, প্রাকৃত প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষা থেকে আহরিত শব্দে নির্মিত ভাষা হিসেবে জনগণের ভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়ে উঠেছিল। নজরুল ইসলাম বিপুল সাহসের সঙ্গে নতুন নতুন আরবী-ফার্সী ও অন্য বিদেশী শব্দ যা বাংলা ভাষার সঙ্গে অশ্রাব্য না হয়ে মিশতে পারে — ব্যবহার করেন। একথা অবশ্য স্বীকার্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি হয়ত কিছুটা বাড়াবাড়ি করেছেন; কিন্তু এ-কথাও ঠিক ঐ শব্দগুলোই আবার পরিবর্তিত হয়ে আগামী ৪০/৫০ বছরের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে – বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারকে সমৃদ্ধ করে। নজরুল ইসলাম যে-সব শব্দ ব্যবহার করেছেন তার অধিকাংশই ১৮শ শতাব্দীর পুঁথি- সাহিত্যে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু খ্রীস্টান মিশনারীদের সহযোগিতায় উন্নাসিক সংস্কৃত পণ্ডিতদের দ্বারা ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে অতি চাতুর্যের সঙ্গে মৌখিক ভাষাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংস্কৃত শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। নজরুল ইসলামের প্রকৃত কৃতিত্ব বিদ্বেষবশতঃ বিবর্জিত বিদেশী শব্দকে বাংলা সাহিত্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।

বাংলাগানে নজরুল গজলকে জনপ্রিয় করে তুলেন। কিন্তু প্রকৃত গজলের সুরে একঘেয়েমীর যে-রেশ দেখা যায় নজরুল তাঁর গজলকে সেই প্রচলিত অনুশাসন থেকে মুক্তি দিলেন তাঁর গজলের মধ্যে শেয়র-এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে। ‘শেয়র’ হ’ল গানের মধ্যে হঠাৎ কয়েকটি পংক্তির আবৃত্তি এবং আবৃত্তির পর পুনরায় গানের মূল তাল ও লয়ে ফিরে আসা। যেমন একটা উদাহরণ :

চেয়োনা সুনয়না আর চেয়োনা এ নয়ন পানে।
জানিতে নাই কো বাকি সই ও আঁখি কী যাদু জানে।।
একে ঐ চাউনি বাকা সুরমা-আঁকা তায় ডাগর আঁখি।
বধিতে তায় কেন সাধ যে মরেছে ঐ আঁখি-বাণে॥
কাননে হরিণ কাঁদে সলিল ফাঁদে ঝুরছে সফরী,
বাঁকায়ে ভুরুর ধনু ফুকে . অতণু কুসুম-শর হানে।। (কুনাল কি পড়ল ধরা পিযুষ-ভরা ঐ চাঁদো মুখে,
কাঁদিছে নার্গিসের ফুল লাল কপোলের কমল-বাগানে।।
জ্বলিছে দিবস-রাতি মোমের বাতি রূপের দেওয়ালী,
নিশি-দিন তাই কি জ্বলি’ পড়ছে গলি অঝোর নয়নে।।)
মিছে তুই কথার কাটায় সুর বিধে হায় হার গাঁথিস কবি,
বিকিয়ে যায় রে মালা আয় নিরালা আঁখির দোকানে।।

এই গজলের মধ্যে বন্ধনীত পংক্তিসমূহই শেয়র। নজরুলের গানের অন্যান্য গুণ সম্পর্কে পূর্ববর্তী পরিচ্ছদে বলেছি। এখানে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন এমন কথা আমরা বলতে পারি না। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথের বিশালতা ও গভীরতা নজরুলের চেয়ে কিছুটা বেশী। প্রকৃত পার্থক্য হ’ল দু’জনের রুচির ভিন্নতা এবং তারও কারণ সময়ের পার্থক্য, তারুণ্যের সঙ্গে বার্ধক্যের পার্থক্য, নবীনের সঙ্গে প্রবীণের পার্থক্য। আসলে কবিতায় কিংবা গানে নর নারীর দেহ-সম্পর্কিত প্রেম ও ভাষা বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের শালীন কৃষ্টি ও রুচি বিশেষ সীমা অতিক্রম করতে বাঁধ সেধেছিল। কিন্তু নজরুল তাঁর ভিন্নরুচির (যা অতটা মার্জিত নয়) জন্য রবীন্দ্রনাথ যে উদাহরণ আমাদের সামনে রেখেছিলেন তা নিঃসঙ্কোচে অতিক্রম করে গেছেন। এইসব কারণে, এবং যৌন-সম্পর্কিত বাস্তবভিত্তিক বর্ণনার জন্য, যা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে প্রকাশ করা কঠিন ছিল, নজরুল হাল-জগতের মানুষকে তৃপ্ত করতে বেশী সক্ষম হয়েছিলেন। নজরুলের বাস্তব-সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা ও প্রজ্ঞাদৃষ্টি সাধারণ মানুষের অনুভূতি ও আবেগকে রূপদান করতে এবং এর ক্ষেত্র প্রসারণ করতে সাহায্য করেছিল।

২০.
এখানে আরও একটি বিষয় আলোচিত হতে পারে সেটা সঙ্গীতের স্বরলিপি-ঘটিত বিষয়। রবীন্দ্রনাথের অনুমোদিত প্রয় ছাব্বিশ খানা স্বরলিপি এবং মোহিনী সেনগুপ্তাকৃত “রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বরলিপি” যা রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন করেছিলেন সে-গুলোর কাঠামো-ভিত্তিক রূপ ছাড়া অন্যরূপে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে দিতে রবীন্দ্রনাথের প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। অথচ নজরুলের অনুমতি নিয়ে যে-সব গানের স্বরলিপি তাঁর জীবিতকালে প্রকাশিত হয় উৎকর্ষ সাধন হেতু তার সামান্য রদবদলে তিনি তেমন আপত্তি করতেন না। এটা ভাবতে অবাক লাগে যে রবীন্দ্রনাথ, যিনি পুরনো রীতিকে ভেঙ্গে স্বাধীন রীতির জন্ম দিলেন, তিনিই স্ববিরোধিতা করলেন সঙ্গীতের শিক্ষকদের অভিনবত্ব দানের জন্য তাঁর গান গাইবার স্বাধীনতা দিতে অস্বীকার করে। যদিও সন্দেহ নেই আজকালকার সঙ্গীতবিদ্যালয় অথবা মহাবিদ্যালয়ে যেসব ভূঁয়ো সঙ্গীত-শিক্ষক আছেন তাঁদের অনেকেরই মধ্যে সঙ্গীত সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞানই অবর্তমান। প্রকৃতপক্ষে সেইজন্যই আজকাল রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুল-গীতি উভয়ই এইসব তথাকথিত শিক্ষকদের দ্বারা এমনভাবে বিকৃত হচ্ছে যে অনেক সময় তাদের স্বরূপ চিনে উঠাই মুশকিল। কিন্তু এ মুশকিলের আসান হবে কি করে! যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ অভিজ্ঞ জ্ঞানবান শিক্ষক না পাওয়া যায় তাহলে ভণ্ড শিক্ষকের ইচ্ছারই জয় হবে। ব্যবহারিক সঙ্গীতকে অবশ্যই কার্যকরী হতে হবে। সময়ের গতির ও কায়দা-কানুনের বিরুদ্ধে না গিয়ে নজরুল ভালই করেছেন। তিনি নিজেই রবীন্দ্রনাথের মত সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নতুন নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। অন্যমিকে এমন নাম দিলে অবহেলিত বিষয়কে আমরা এমনি করে মহাত্মা দান করি। বস্তুতঃ পরিবর্তনশীলতাকে স্বীকৃতি না দিলে একমাত্র আজকের ধ্রুপদ ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। আধুনিক প্রবণতা হ’ল লোক-গীতিকেও স্বীকৃতি দেওয়া— যেগুলোকে সাধারণতঃ গীতি বলা হয়। বছর দশেক আগে ওস্তাদেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন কিন্তু তাঁরা সঙ্গীতকে গীত অপেক্ষা অভিজাত বলে চিহ্নিত করতেন। কিন্তু আভিজাত্য জনগণের চাহিদার কাছে তেমন মূল্য পাচ্ছে না। সুতরাং এই প্রবণতাকে আর ঠেকিয়ে রাখা অর্থহীন।

২১.
রবীন্দ্রনাথ বহুদিন হল আমাদের মধ্যে নেই। নজরুল আজও আমাদের মধ্যে আছেন; কিন্তু জীবিত থেকেও তিনি আজ মৃত। ১৯৪২ সালে এক দুশ্চিকিৎসা রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। জগতের শ্রেষ্ঠ ডাক্তাররা ঘোষণা করেছেন যে তাঁর মস্তিষ্কের প্রধানতম অংশ Brain Cells শুকিয়ে গেছে। সুতরাং চিকিৎসা দ্বারা তাঁর রোগ নিরাময়ের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রথমদিকে দেখা যেত শিশুর মত তিনি বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন, টুকরো টুকরো করে ছিড়ছেন, সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার তাদের কুড়িয়ে তুলছেন এবং একটা একটা করে গুণছেন; মাঝে মাঝে উন্মাদের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে দর্শকদের দিকে মারমুখিভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই রকম মর্মান্তিক পরিস্থিতির মধ্যেও আমি সব সময় দেখেছি ভগ্নস্বাস্থ্য পক্ষাঘাতাক্রান্ত তাঁর স্ত্রী প্রমীলা বিছানায় শায়িত থেকে তাঁর হতভাগ্য স্বামীকে সেবা করছেন। পায়ের দিকটা অবশ হয়ে যাওয়াতে তিনি উঠতে পারতেন না। কিন্তু সে অবস্থাতেও গৃহভৃত্যকে নির্দেশ দিয়ে একজন ভক্তিমতি সেবাপরায়ণা গৃহকর্ত্রীর মত স্বামীর হাওয়া, পরা, গোসলাদি সবই নিখুঁতভাবে সম্পাদন করতেন। আমি জানিনা ১৯৬২ সালে প্রমীলা যখন মারা যান তখন নজরুল তাঁর এই আনন্দে প্রোজ্জ্বল এবং বেদনার অন্ধকারে আক্রান্ত জীবনের নিত্যসঙ্গী, এই প্রিয়তম বন্ধুটির শেষ বিদায় মহূর্তটিকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কি না। এই ভক্তিমতী সাদ্ধী-সতীর আত্মা আল্লাহর অসীম করুণা লাভ করুক। নজরুল আজও জ্ঞানহীন অবস্থায় আছেন – নিশ্চল, নিশ্চুপ! পরিবর্তনহীন!

হে আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা, সর্বশক্তিমান, সর্ববিরাজমান, সর্বদয়াল মহাপ্রভু, একবার তুমি তোমার হতভাগ্য বিদ্রোহী সন্তান নজরুলের প্রতি তোমার করুণার দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। তোমারই দৃষ্টির আশ্রয়ে, তোমারই নিযুক্ত এই মহাসৈনিক, পৃথিবীর লাঞ্ছিত নিপীড়িত অবহেলিত অগণিত মানবসন্তানের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য, ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির জন্য শোষকের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। হে করুণাময়, তোমার এই বীর সন্তানের প্রতি তোমার রহমত বর্ষণ কর। তুমি গফুরুর রহিম, তুমি দয়ার সাগর! তোমার ক্ষমা ও দয়া প্রাপ্তির জন্য নজরুলের মূক প্রার্থনাকে তুমি কবুল কর।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →