একখানি পুরাতন দলিল: আবদুল করিম [১৯০৬]
- বাঙ্গালা ভাষা ।। লিখিবার ভাষা* – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় [১৮৬৪]
- Bengali, Spoken and Written. Sayamacharan Ganguli (1877). কিস্তি ১
- Bengali, Spoken and Written. Sayamacharan Ganguli (1877). কিস্তি ২ ।।
- Bengali, Spoken and Written. Sayamacharan Ganguli (1877). শেষ কিস্তি ।।
- বাঙ্গালা ভাষা – গ্রাডুএট্ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী) [১৮৮১]
- একখানি পুরাতন দলিল: আবদুল করিম [১৯০৬]
- আমাদের ভাষাসমস্যা – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৯১৭)
- “মুসলমানী বাঙ্গালা” কি? – আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ
- বাঙ্গালা বানান সমস্যা (১৯৩১) – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
- বাংলাভাষা পরিচয় – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৯৩৮]
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ১ ।।
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ২ ।।
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ৩।।
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। শেষ কিস্তি।।
- আমাদের ভাষা ।। আবুল মনসুর আহমেদ ।। ১৯৫৮ ।।
- আঞ্চলিক ভাষার অভিধান [১৯৬৪] : সৈয়দ আলী আহসান ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষা প্ল্যানিং
- (বই থেকে) স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রিক বনাম কৃষ্টিক স্বাধীনতা – আবুল মনসুর আহমদ (১৯৬৮)
- বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক
- বাংলা ভাষার আধুনিকায়ন: ভাষিক ঔপনিবেশিকতা অথবা উপনিবেশিত ভাষা
- বাংলা ভাষা নিয়া কয়েকটা নোকতা
- খাশ বাংলার ছিলছিলা
- বাছবিচার আলাপ: খাশ বাংলা কি ও কেন? [২০২২]
বাংলা-ভাষা নিয়া এই কথা খুব স্ট্রংগলিই চালু আছে যে, বিফোর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলায় ‘গদ্য ভাষা’ বইলা তেমন কিছু ছিল না। এমনকি এই এক্সটেন্ড পর্যন্তও কল্পনা করা যাইতে পারে যে, কেউ যেন বাংলা-ভাষায় কথা কইতো না, খালি কবিতার ছন্দে গান-ই গাইতো খালি! :p
অথচ ঘটনা ছিল হইতেছে যে, সাহিত্যের ফর্ম বলতে ছিল শুধু কবিতা; গদ্য সাহিত্যের ফর্ম হিসাবে একসেপ্টেড ছিল না। এমনকি ৫০/৬০ বছর আগেও তো ছন্দ না মাইনা কবিতা লেখলে সেইটারে কবিতা বলা যাইতো না; এখনো গদ্য-ছন্দ বইলা আলাদা কেটাগরি করা লাগে। মানে, সাহিত্যের ফর্মগুলারেই ভাষা বইলা মিস-রিড কইরা আসতেছি আমরা। গদ্য জিনিসটা অনেক পরে সাহিতের ফর্ম হিসাবে একসেপ্টেড হইছে বইলা আমরা মনে করতে থাকি যে, গদ্য-ভাষা বইলা কোন জিনিস ছিল না।
আবদুল করিম (সাহিত্য-বিশারদ) এই জায়গাতে ইন্টারভেইন করছেন। উনি খালি ‘পুঁথি সংগ্রহ’-ই করেন নাই, এইরকম একটা দলিলও খুঁইজা পাইছিলেন বাংলা ১৩১৩ সনে (ইংরেজি ১৯০৬), যেইটা আনুমানিক ১৭৭৮ সালের। এখন অইটা তো বাংলা-ভাষা, এবং গদ্য; সাহিত্য করা হয় নাই বইলা অইটা ছিল না – তা তো না!
আরো দুইটা উদাহারণ দেখেন –
(১৬৭২)
“শ্রীজসোমাধব ঠাকুর কুমড়াল গ্রামে দেবালয়ত আছিলা। রামসর্মা ও গয়রহ সেবকেরা আপনার ২ ওয়াদা মাফিক সেবা করিতেছিল। রাত্রদিন চৌকী দিতেছিল। শ্রী রামজীবন মৌলিক সেবার সরবরাহ পুরুসানুক্রমে করিতেছেন। ইহার মধ্যে পরগণা পরগণাতে দেওতা ও মুরূত তোড়িবার আহাদে…… থাকিয়া আর আর পরগণাতে দেওতা ও মুরূত তোড়িতে আসিল । ……. তাহার পর ২৭ মহরম মাহে ২৮ জৈষ্ঠ ঠাকুর দেখিবার প্রাতেঃকালে সকল লোক গেল…..।
—শ্ৰীমনোমোহন ঘোষের ‘বাংলা গদ্যের চার যুগ’ ( ১১ পৃঃ)
(১৭৮৬)
“শ্রীযুক্ত ওলন্দেজ কোম্পানীতে আড়ঙ্গ বিরভূমের গঞ্জে খরিদের দাঁদ আমি লইয়া ঢাকা আড়ঙ্গ চালানী করিয়াছি আপরেল যাহাতে এবং মোকাম মজকুরের গোমস্তা কাপড় খরিদ করিতেছিল এবং কাপড় কথক ২ আমদানী হইয়াছে এবং হইতেছিল দাস্ত কথক ২ তৈয়ার হইয়াছে এবং মবলক কাপড় ধোবার হাতে দাশতর কারণ রহিয়াছে তাহাতে সংগ্ৰীতি মেঃ গেল সাহেবের তরফ পেয়াদা আসিয়া খামখা জবরদস্তী ও মারপিট করিয়া ঘাট হইতে ধোবা লোককে ধরিয়া লইয়া গেল আমার তরফ হইতে গোমস্তা পেয়াদা যাইয়া সাহেব মজকুরকে হাজির করিলো তাহা সাহেব গৌর না করিয়া আমার লোককে হাকাইয়া দিলেক এবং কহিলেক তোমরা আইয়াছ সাজাই দিব আমার কমবেষ ৪০০০ চারি হাজার থান কাপড় ধোবার ঘাটে দাস্ত বেগর পচিতে লাগিল বহা সেওয়ায় কোরা কাপড় কাচীতে তইয়ার অতএব আরজ ইহার তদারক মেহেরবাণী করিয়া করিতে হুকুম হয়—“
(ওলন্দাজ কোম্পানীর ডিরেক্টরের কাছে লেখা হরিমোহন বর্মার আরজি)
২.
ঘটনা হইতেছে, এই উদাহারণগুলা নাই না, বা অনেক কষ্ট কইরা খুঁইজা বাইর করতে হবে – পুরাপুরি এইরকমও না ঘটনাটা। সাহিত্যের বাইরে নানান কাজে-কামে লেখা তো লাগতো মানুশের; অই জিনিসগুলাও ভাষা। রেফারেন্স হিসাবে শুধুমাত্র সাহিত্য-রে আমলে নিলে এইসব জিনিস আমরা দেখতে পাবো না।
আর আমরা দেখতে পাইতেছি না বইলাই জিনিসগুলা নাই না।
৩.
আবদুল করিমের লগে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র ইন্টেলেকচুয়াল জার্নিটা যদি কম্পেয়ার করেন তাইলে দেখতে পাইবেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র কন্ট্রিবিউশন ছিল রেফারেন্সগুলারে ক্রিটিকালি এগজামিন করার জায়গাটাতে; হিস্ট্রিকালি যেই রেফারেন্সগুলা আছে, সেইগুলারে উনি খুব বেশি কোশ্চেন করেন নাই। এই জায়গাটাতে আবদুল করিম এগজিসটিং রেফারেন্সগুলারে মান্য বা অমান্য করেন নাই, বরং নতুন রেফারেন্সের খোঁজ করছেন, এবং দেখাইছেন যে, যেই জায়গাগুলাতে আমাদের খোঁজ-খবর করা দরকার সেই জায়গাগুলারে আমরা এভয়েড করে যাইতেছি।
আনফরচুনেটলি, আজকে একশ বছর পরেও এই জায়গাগুলা খুব একটা চেইঞ্জ হয় নাই। যার ফলে আবদুল করিমের ফোকাসের জায়গাগুলারে আরেকবার খেয়াল করা দরকার আমাদের।
ই.হা.
…
বঙ্গের প্রাচীন ইতিবৃত্ত ও ভাষাতত্ত্বের খাতিরে পুরাতন বাঙ্গালা দলিল দস্তাবেজগুলির সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিতান্ত আবশ্যক। সাধারণের নিকট তাহার মূল্য অকিঞ্চিৎকর হইলেও ঐতিহাসিকদিগের নিকট তাহা বড়ই মূল্যবান বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। কেননা, বৈজ্ঞানিকগণ কোন জিনিসকেই তুচ্ছ জ্ঞান করিতে পারে না। আমাদের সোনার বাঙ্গালার পুরাতত্ত্ব ঘোর কুহেলিকা সমাচ্ছন্ন। এই তিমিরাবরণ উন্মোচণের জন্য সকলেরই যথাসাধ্য যত্ন করা কর্তব্য। অদ্য আমরা নিম্নে যে একখানি প্রাচীন দলিলের প্রতিলিপি প্রকাশ করেতছি, আশা করি, প্রত্নতত্ত্ব হিসাবে উহার মূল্য নিতান্ত নগণ্য হইবে না। এরূপ প্রাচীন দলিল হইতে অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করা যাইতে পারে। সেজন্য এ সমস্ত বিলোপোন্মুখ জিনিসের ফটোগ্রাফ করিয়া রাখাই উচিত; কিন্তু দুঃখের বিষয়, দরিদ্র সাহিত্যসেবীর পক্ষে তাহা সকল সময়ে সম্ভব হয় না। যাহা হউক, আমরা উহার যথাসম্ভব অবৈকল্য রক্ষা করিতেই যত্ন করিয়াছি । দলিলখানি এইরূপ :
শ্রীকৃষ্ণমনি
চক্ৰবৰ্ত্তীর্ণ
শ্রীমিত্তুঞ্জ
অ চক্রবত্তিণ=
৭ ইআদকীদ্দ শ্রীরাম প্রসাদ ভট্টাচার্য্য স্থানে লিখীতং শ্রীকৃষ্ণমনি চক্রবর্ত্তি ও কালিচরণ চক্রবর্ত্তি ও মীক্তুর্জ্জএ চক্রবর্ত্তি কস্য মনিস্য বিক্রয় পত্রমীদং আগে আহ্মারাড় পৈতৃক মনিস্য দুলার স্ত্রি শ্রীমতি ষুলোচনি ও তাঞব কন্যা ষুতিষ্ঠা এবং দুইজন মনির্স্যর জথার্থঃ মূল্য নগদ পুরোজন দহমাসী১ মবলক ১২ বাদ্রূূ রূপাইআ তোহ্মার হোতে বুঝি পাইআ (আপনা)২ আহ্মরা আপনা ২ খোস রজী রগবতে দির্দ্দাএ বিক্রঅ করিলাম তুহ্মি দান বিক্রয় অধিকার হইআ তুহ্মি ও তোহ্মার পুত্র পৌত্রাদি ক্রমে দাস দাসীত্ব কর্ম করাঅ আহ্মরাও আহ্মরাড় পুত্র পৌত্রাদী লই ভাই বেরাদরান লই ওআরীসআন লই কস্মিনকালে এই মনিস্য মজকুর লই কোন এলার্ক্কা নাই এই করারে মনিস্য বিক্রম পত্র লেখীয়া দিলাম ইতি সন ১১৩৯ মংঘি৩ এঘার স ঊনচল্লিস মঘি তারীখ ২৫ স্রাবন ।।
(অপর পৃষ্ঠায়।)
ইসাদি
শ্রীনিদিরাম
চক্রবর্ত্তি=
[১ ‘পুরোজন দহমাসী’ কি, বুঝা গেল না । এই দলিলের সংগ্রাহক চট্টগ্রাম কালেক্টরীর মোক্তার সুকবি শ্রীযুক্ত বাবু জগচ্চন্দ্র ভট্টাচার্য্য মহোদয় ঐ স্থলে ‘পূরাতন কুমপানী’ এরূপ পাঠ করিতে চাহেন; আমাদের কিন্তু উক্ত পাঠ গ্রহণ করিতে বিষম দ্বিধা বোধ হইতেছে।
২. ‘আপনা’ এই শব্দটি পরে কাটিয়া দেওয়া গিয়াছে ।
৩. মংঘি-মঘী। এই সন চট্টগ্রামে আজও প্রচলিত আছে । ৬৩৮-৩৯ খৃঃ অব্দ হইতে ব্রহ্মরাজ থেঙ্গা-রাজা বা পৌক-পা-ছাও (Thenga Raza or Ponk-pagan) এই সন গণনা আরম্ভ করেন। তিনি ৬২০ পুঃ অব্দে রাজা হন ও ব্রহ্মদেশীয় পঞ্জিকার সংস্কার সাধন করত এই অব্দ প্রচলিত করেন। ইহা বঙ্গাব্দের মত বৈশাখের প্রথমে আরম্ভ হইয়া চৈত্র সংক্রান্তিতে শেষ হইয়া থাকে। বাঙ্গালার পঞ্জিকাকারগণ এতৎসনের নির্দ্দেশে একটা বড়ই ভুল করিয়া থাকেন। এক বঙ্গাব্দের মোতাবেক (corresponding) এক মঘী সনই হইবে, কিন্তু তাঁহারা যুগ্ম সনেরই ব্যবস্থা করেন। যথা, বৰ্ত্তমান ১৩১৩ বঙ্গাব্দের মোতাবেক ১২৬৮/৬৯ বা ১২৬৯/৭০ মঘী না হইয়া কেবল ১২৬৮ মঘীই হইবে।]
এখন দলিলখানি সম্বন্ধে আমরা এখানে কয়েকটা কথা বলিতে ইচ্ছা করি। আশা করি, পাঠক মহাশয়েরা নিজেরাও ইহা হইতে অনেক তথ্য সংগ্রহ করিতে চেষ্টা করিবেন ।
(১) ইহা একখানি পুরাতন বাঙ্গালা কাগজে লেখা। কাগজখানির পরিমাণ প্রায় ১২×১০ অঙ্গুলি। উর্দ্ধভাগে প্রায় ৬ অঙ্গুলি পরিমিত স্থান খালি রাখিয়া ঠিক মাঝামাঝি ভাবে লেখার আরম্ভ। স্বাক্ষরিত নামগুলির অবস্থান প্রায় অবিকল প্রদর্শিত হইল। [হরাইজন্টাল হবে, এইখানে দেখানো যাইতেছে না – এডিটর, বাছবিচার] দলিলের অপর পৃষ্ঠায় নিম্নভাগে কেবল ১ জন সাক্ষীর নাম মাত্র লিখিত আছে। কাগজখানি অত্যন্ত জীর্ণ হইয়া গেলেও লেখা আজও সম্পূর্ণ স্পষ্ট।
(২) তিনজন বিক্রেতার মধ্যে ১ জনের (কালীচরণ চক্রবর্ত্তীর) নাম স্বাক্ষরিত নাই কেন, বুঝিয়া উঠা দুষ্কর। দলিল লেখকের নামেরও কোন উল্লেখ ইহাতে দেখা যাইতেছে না। দস্তখতের নাম তিনটার লেখাগুলি ব্যতীত দলিলের আর সমস্ত লেখাগুলি একই হস্তের বলিয়া বোধ হয়। অক্ষরগুলি বেশ পরিমিত ও সুডৌল, লেখা অতি পরিষ্কার ও সুন্দর। লেখক যিনিই হউন না কেন, তিনি যে একজন সেকেলে মুন্সী ছিলেন, তদ্বিষয়ে সন্দেহ মাত্র হইতে পারে না। স্বাক্ষরিত নাম তিনটার লেখাগুলি দেখিতে প্রায় একরূপই বোধ হয়।
(৩) অনেকগুলি অক্ষরের আকৃতি বিচিত্র; তদ্রূপ আকার এখন আর কুত্রাপি দেখা যায় না। অ, ক, জ, শ্রী, কৃষ্ণ, তৃ, মু, পু প্রভৃতির লিখন ভঙ্গী যেরূপ বৈচিত্র্যপূর্ণ, সেরূপ সুন্দরও বটে। ‘ড়’-এর নীচে বিন্দু নাই। ‘র’-এর পেট কাটা । সেকালে গুরুমহাশয়েরা ‘র’ কে পেট-কাটা ‘র’ই বলিতেন। তৎকালে অনেকস্থলে ‘ব’ ফলাই উকারের স্থান গ্রহণ করিয়া তৎকার্য্য সম্পাদন করিত। এরূপ প্রাচীন হস্তাক্ষর দেখিয়া অক্ষরের আকৃতি পরিবর্তনের অনেক রহস্য হৃদয়ঙ্গম করা যায়। এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলিবার ছিল, কিন্তু ফটোগ্রাফের সাহায্য ভিন্ন লেখনী যোগে সকল কথা প্রকাশ করার সুবিধা নাই দেখিয়া ক্ষান্ত হইলাম।
(৪) সেকালে বর্ণবিন্যাসের কোন বাঁধাবাঁধি নিয়ম ছিল বলিয়া বোধ হয় না। আমরা দেখিয়াছি, সেকেলে লেখকগণ ইচ্ছানুরূপই বর্ণবিন্যাস করিতেন। এই দলিলেই তাহার নিদর্শন সুপ্রচুর।
(৫) প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে আরব্য ও পারস্য ভাষার প্রভুত্ব খুবই বেশী। বৈষয়িক ব্যাপারে উক্ত ভাষাদ্বয়ের সাহায্য ব্যতীত কোনরূপেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারিত না। এই দলিল উক্ত ভাষাদ্বয়ের শব্দগুলি ব্যবহৃত না হইলে কেমন করিয়া চলিত, সহজে বুঝা যায় না। অন্য পন্থাবলম্বন করিলেও তাহা বিষয়ী লোকের মনঃপুত হইত না নিশ্চয়ই । অদ্যাপি আদালতী ও বিষয় ব্যাপার সম্বন্ধীয় ভাষায় মুসলমানী ভাষার পূর্ণ প্রভাব দেদীপ্যমান ।
(৬) দলিলখানি ১২৮ বৎসর পূর্ব্বে সম্পাদিত হইয়াছে। ইহাতে দাতা ও গ্রহীতাদের মধ্যে কাহারো পিতৃনাম এবং বাসস্থানের উল্লেখ নাই। সাক্ষী ১ জন লোক মাত্র; কাগজখানিও বেসরকারী এবং আগেই বলিয়াছি, দলিলদাতার মধ্যে একজনের (কালীচরণের) স্বাক্ষর পর্যন্ত নাই। সুতরাং রাজসরকারে পরিগৃহীত ও স্বীকৃত হওয়ার মত কোন গুণই ইহার নাই ও ছিল না। এরূপ অবস্থাতেও কিন্তু বিক্রীত লোক দুইটি এই দলিল মানিয়া আজীবন পুত্র পৌত্রাদি ক্রমে দাসত্ব বিগড়ে আবদ্ধ রহিয়া গিয়াছে; বিক্রেতারাও কোন প্রকার গোলযোগ করে নাই। বলিহারি সেকালের অকৈতব সারল্য! এমন অকপট ধৰ্ম্মভয় ও বাক্য নিষ্ঠা অধুনা স্বপ্নেরও অগোচর।
(৭) যে সময়ে এই দলিলে সম্পাদন-কার্য্য সাধিত হয়, তাহার ২০/২২ বৎসর পূর্ব্বে মাত্র পলাশী প্রাঙ্গনে মুসলমানের গর্ব্ব খর্ব্ব করিয়া ব্রিটিশ রাজশক্তি বঙ্গদেশে বদ্ধমূল হইয়াছিল । ১৭৫৭ খৃঃ অব্দে পলাশীর যুদ্ধ ঘটে এবং ১৭৬০ খৃঃ অব্দে নবাব মীরকাদিম কোম্পানী বাহাদুরকে পুরস্কার স্বরূপ ‘চট্টগ্রাম’ প্রদান করেন। সুতরাং চট্টগ্রামে তখনও ইংরাজ রাজশক্তির পূর্ণপ্রভাব বিস্তারিত এবং মুসলমান রাজলক্ষ্মীর পুণ্যস্মৃতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নাই।
(৮) কালের কি কুটিল গতি! মাত্র দ্বাদশটি মুদ্রায় দুইটি মানুষের স্বাধীনতা-বিক্রয়, – একদিকে সুখের, শান্তির স্পষ্ট আভাষ প্রদান করিতেছে, অপরদিকে সংসার সংগ্রামের কি ভীষণতাই না সূচিত করিতেছে। ১২৮ বৎসর পূর্ব্বের এই দলিলখানি, অথচ ইহারই মধ্যে ভারতের কত না পরিবর্তন সাধিত হইয়া গিয়াছে। আমাদের জীবন সংগ্রাম এমনই ভয়াবহ হইয়া উঠিয়াছে যে, ক্রয়ের কথা দূরে থাকুক, মাসিক ১২ টাকায় অধুনা একজন ঠিকা চাকরও মিলিতেছে না! সেকালে দেশ ধনধান্যে পূর্ণ ছিল। তখন দীনদুঃখী থাকিলেও আজ কালকার মত তাহাদিগকে তেমন কষ্ট পাইতে হইত না। ধনিগণ দান ধর্ম্মে যে অর্থ ব্যয় করিতেন, তাহাতেই দরিদ্রদিগের দিন গুজরান হইত। তখন টাকার অগ্নিমূল্য ছিল; আর এখন টাকার এক কপর্দ্দকের মূল্যও নাই। ইংরাজ আমলে বাহ্য দৃষ্টিতে আমরা সুখী হইয়াছি; ভিতরে কিন্তু সবই দারিদ্রের ঘোর নিষ্পেষণে ম্রিয়মান। তখনকার লোকের হয়ত একদিকেই দারিদ্র ছিল; এখন কিন্তু আমরা সকল বিষয়েই ধনী এবং সকল দিকেই দরিদ্র! এক দারিদ্র্য ঢাকিতে গেলে সহস্র দারিদ্র্য আসিয়া এখন আমাদিগকে ভ্রূকুটী প্রদর্শন করে! পেটে অন্ন নাই, দেহে স্বাস্থ্য নাই, মনে সুখ নাই; অথচ আমরা দেখাইতে চাই যে, এ দুনিয়াতে আমাদের মত সুখী আর একটি মিলা কঠিন! আত্ম-প্রবঞ্চনা করিতে আমরা এমনই দক্ষ হইয়া উঠিয়াছি! মোটকথা, আমাদের এখন লেফাফা মাত্র দোরস্ত- আছে; ভিতরে কিরূপ আছে না আছে, তাহা প্রত্যেক পাঠকই স্ব স্ব অন্তরে অনুভব করিতেছেন। ঈশ্বর আমাদিগকে আর সেরূপ সুদিন দিবেন কি, যে দিন আমরা দেশের মোটা ভাত মোটা কাপড়ে সন্তুষ্ট থাকিতে ব্যগ্র হইব?
অগ্রহায়ন, ১৩৬০
নভেম্বর, ১৯৫৩
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024