বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক
- বাঙ্গালা ভাষা ।। লিখিবার ভাষা* – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় [১৮৬৪]
- Bengali, Spoken and Written. Sayamacharan Ganguli (1877). কিস্তি ১
- Bengali, Spoken and Written. Sayamacharan Ganguli (1877). কিস্তি ২ ।।
- Bengali, Spoken and Written. Sayamacharan Ganguli (1877). শেষ কিস্তি ।।
- বাঙ্গালা ভাষা – গ্রাডুএট্ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী) [১৮৮১]
- একখানি পুরাতন দলিল: আবদুল করিম [১৯০৬]
- আমাদের ভাষাসমস্যা – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৯১৭)
- “মুসলমানী বাঙ্গালা” কি? – আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ
- বাঙ্গালা বানান সমস্যা (১৯৩১) – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
- বাংলাভাষা পরিচয় – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৯৩৮]
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ১ ।।
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ২ ।।
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ৩।।
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। শেষ কিস্তি।।
- আমাদের ভাষা ।। আবুল মনসুর আহমেদ ।। ১৯৫৮ ।।
- আঞ্চলিক ভাষার অভিধান [১৯৬৪] : সৈয়দ আলী আহসান ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষা প্ল্যানিং
- (বই থেকে) স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রিক বনাম কৃষ্টিক স্বাধীনতা – আবুল মনসুর আহমদ (১৯৬৮)
- বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক
- বাংলা ভাষার আধুনিকায়ন: ভাষিক ঔপনিবেশিকতা অথবা উপনিবেশিত ভাষা
- বাংলা ভাষা নিয়া কয়েকটা নোকতা
- খাশ বাংলার ছিলছিলা
- বাছবিচার আলাপ: খাশ বাংলা কি ও কেন? [২০২২]
[বাংলা একাডেমি’র ‘ভাষা, শ্রেণি ও সমাজ’ নামে একটা সেমিনারে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক ১৯৮৫ সালে এই কথাগুলা বলছিলেন। পরে ‘জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক স্মারক গ্রন্থ’ বইয়ে এইটা ছাপানো হইছে। তো, যে কোন ওরাল বলা-বাংলা যখন রিটেন ফরমেটে আসে তখন এক ধরনের ‘শুদ্ধিকরন’ বা ‘প্রমিতকর’ ঘটে নরমালি, যেহেতু নানান সোর্স থিকা আমরা জানি যে আবদুর রাজ্জাক সাহেবের মুখের কথা এতোটা ‘শুদ্ধ’ আছিল না, এইখানেও এই জিনিস ঘটার কথা বইলা সনদেহ করতে পারি আমরা…]
সভাপতি সাহেব এবং বন্ধুবর্গ,
আমাকে বসে বলার অনুমতি দেওয়ায় আমি নিতান্ত অনুগৃহীত। প্রধান অতিথি করার জন্য নয়, প্রধান অতিথি করা তো এখন রেওয়াজ হয়ে গেছে, কী কারণে করা হয় জানি না। ভাষা, শ্রেণি এবং সমাজ কোনোটা সম্বন্ধেই আমার এমন কিছু বলার নেই যা সভা করে বলা প্রয়োজন। দুটো-একটা নিতান্ত সাধারণ কথা ছাড়া আর কিছুই বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
ভাষা সবচেয়ে পুরনো, সাহিত্য কিংবা ব্যাকরণের সঙ্গে তুলনা করলে। দ্বিতীয়ত, ভাষা একেবারেই সর্বজনীন, ক্ষুদ্রতম মানুষও এই ভাষার পরিপুষ্টিতে অংশীদার। সাহিত্য, ব্যাকরণ তো নয়ই, দুটোর একটাও এই ধরনের কিছু না। সাহিত্য সব সময়ই, একেবারে আরম্ভের যুগে, পুরোহিতদের কাজ ছিল এবং পরেও নিতান্তই মুষ্টিমেয় লোকের হাতে গড়ে উঠেছে, লোকসাহিত্যের কথা স্মরণ রাখলেও। এই যে মুষ্টিমেয় লোকসংখ্যা, যাঁরা সাহিত্য কিংবা ব্যাকরণ রচনা করেছেন এঁদের প্রথম কন্ডিশন ছিল কিছু পরিশ্রম না করে জীবনধারণের ক্ষমতা থাকা অর্থাৎ বদরুদ্দীন উমর কিংবা মার্কসিস্টরা যাকে বলবেন এক্সপ্লয়টিং ক্লাস। মার্কস কিংবা লেনিন প্রোলেটারিয়েট ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের অবদান প্রোলেটারিয়েট মুভমেন্টে অবিসংবাদিত। সাহিত্যেও অনেক সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁরা সমস্ত মানুষের কথাই বলেছেন। কিন্তু সব সময়ই তাঁরা একটা ছোট শ্রেণি থেকে এসেছেন।
ভাষা সম্বন্ধে কৌতূহল, সাহিত্য অনেক পরে আসা সত্ত্বেও, সাহিত্য সম্বন্ধে কৌতূহলের অনেক পরে এসেছে দেড়শো দুশো বছর হবে। অনেক আগে গ্রিক আমলে হয়তো সামান্য কিছু লেখাপড়া হয়েছে ভাষা সম্বন্ধে, সংস্কৃতেও কিছু হয়েছে। কিন্তু মোটের ওপর গত দেড় হাজার বছর পর্যন্ত সাহিত্য সম্বন্ধে যতটা কৌতূহল দেখা গেছে ভাষা সম্বন্ধে তার একশ ভাগের এক ভাগও হয়নি। এখনো আমরা ভাষা সম্বন্ধে যা জানি তা খুব বেশি কিছু না। ভাষা কীভাবে উদ্ভূত হয়, ভাষা কীভাবে বর্ধিত হয় কিংবা ভাষার অন্যান্য বিশিষ্টতা এ সম্বন্ধে একেবারেই প্রাথমিক যুগে। কিন্তু ভাষা সম্বন্ধে কৌতূহলের দুটো যে দিক, পণ্ডিতি কৌতূহল – যেগুলো ব্যাকরণবিদ কিংবা সুনীতিবাবু কিংবা ড. শহীদুল্লাহ্ কিংবা চমস্কিদের। এছাড়াও আরেকটা কৌতূহলের কারণ আছে – সেটা আমি শিক্ষা-বিভাগের সঙ্গে জড়িত থাকায় আমার কৌতূহলটি। পঞ্চাশ বছর শিক্ষকতার ফল-জ্ঞানে এই একটিমাত্র নিশ্চিত যে, মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া শিক্ষা-ব্যবস্থা কখনোই পূর্ণ হতে পারে না, বিশেষত আমাদের দেশে।
আমাদের দেশে সাধারণত ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য চৌদ্দ, পনের, ষোল অথবা বছর কুড়ি নিই। দুনিয়ার কোনো দেশে বিদেশি ভাষা শেখার জন্য এবং এইরকম ইনকমপ্লিটেন্ট নলেজ একোয়ার করার জন্য এত সময় দেওয়া হয় না। পনের বা বিশ বছর পরেও যে ইংরেজি আমাদের শেখা হয় যেসব দেশে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলে সেসব দেশে গেলে বোঝা যায় যে এই শেখাটা কত অসম্পূর্ণ। এই অসম্পূর্ণ জ্ঞানের ভিত্তিতে শিক্ষক এবং ছাত্র মিলে যে অবস্থার সৃষ্টি করেন এটা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উল্লেখ্য নয়। শুধু এইমাত্র কারণে আমি মনে করি যে, বাংলা ভাষা ছাড়া, মাতৃভাষা ছাড়া, শিক্ষার বাহন আর কিছুই হতে পারে না।
আমরা সকলেই দুঃখ করি যে বিশ, পঁচিশ, ত্রিশ, চল্লিশ বছর যাবৎ ভাষা-আন্দোলন, সংগ্রাম করার পরেও বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থা আমাদের দেশে লজ্জাকর। আমি ঠিক একমত নই। এই যে অন্য ভাষায় লেখাপড়া শেখা, বিদ্যাচর্চা করা, এটা বাঙালির বাংলাভাষীর বিশেষ দুর্ভাগ্য নয়। দুনিয়ার সব দেশেই আবহমানকাল সাধারণত একটা বিদেশি ভাষায় বিশেষ শ্রেণি শিক্ষালাভ করেছেন, জ্ঞান অর্জন করেছেন কোনো সময় গ্রিক, কোনো সময় ল্যাটিন, কোনো সময় সংস্কৃত, আরবি, ফারসি। এবং এই অবস্থার পরিবর্তন করতে ওইসব সৌভাগ্যবান দেশে (এখনকার দিনে সৌভাগ্যবান দেশে) যে সময় লেগেছে, যে পরিশ্রম করতে হয়েছে, তার তুলনায় এই সামান্য চল্লিশ বছরে বাংলা ভাষার বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি এটা বিশেষ লজ্জাকর মনে করি না। লজ্জাকর মনে করি না এইজন্য যে আমার পঞ্চাশ বছরের আগেকার স্মৃতি সম্পূর্ণ জাগরূক। যে অবস্থা আমাদের ছাত্রাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল, যে কটি শিক্ষক কিংবা যে কটি ছাত্র-ছাত্রী চলনসই বাংলায় দু-চার, পাঁচ-দশ মিনিট কথা বলতে পারতেন তার তুলনায় আমার চোখে অন্তত এখনকার অবস্থা এজ নেয়ারলি একোয়ারড এজ ইউ ক্যান থিংক অফ, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয় কথা এই যে বাংলা ভাষা আরো চালু হওয়ার জন্য অফিস-আদালতে এর প্রচলন নিতান্ত প্রয়োগ না হলেই হবে না, এটাও আমার ঠিক বোধগম্য নয়। আমি মনে করি যে অফিস-আদালতে আমরা যদি হুকুম দিয়ে বাংলা প্রচলন করি বা করাবার চেষ্টা করি, একটু উন্নতি হবে, বিশেষ না। বাংলা ভাষা অফিস-আদালতে চালু হবে সে সময় যে সময় ভালো বাংলা লিখতে পারে এই রকম ছেলেমেয়ে অফিসে কাজ করবে। গত যুগেও সিভিল সার্ভেন্ট কিংবা অন্যান্য অফিস-আদালতে কিছু কিছু লোক জানি যাঁদের বাংলা ভাষার ওপরে দখল আমার অন্তত বিস্ময়ের উদ্রেক করে। শামসুর রহমান (সিভিল সার্ভেন্ট শামসুর রহমান, কবি না), এ কে এম আহসান এবং বলাটা হয়তো উচিত নয় সানাউল হক তো নিশ্চয়ই মনজুরে মওলাও ভালো বাংলাই বলেন। অসুবিধা তো হয়নি কিছুই, কিন্তু আরো দু-চারজন যদি এইরকম বাংলা লিখতে পারতেন তাহলে খুব ভালো কথা হতো, গৌরবের বিষয় হতো। কিন্তু সমাজে বাংলা প্রচলনে এটা একটা ইনডিসপেনসেবল (indispensable) অঙ্গ – এটা মনে করি না। বাংলা প্রচলিত হবে, বাংলা প্রাইমারি স্কুল, সেকেন্ডারি স্কুল, জুনিয়র কলেজগুলিতে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন, বাংলা লিখবেন এবং যেসব ছেলেমেয়ে বাংলা লিখতে পারে, তাদের একটু আদর করবেন, আর বিশেষ কিছু প্রয়োজন নাই।
আমি মনে করি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড় কনসট্রাকটিভ কনট্রিবিউশন তাঁর বর্ণপরিচয়। এই ধরনের কাজ যাতে খুব সম্ভব বাংলা একাডেমি এওয়ার্ড পাওয়া যাবে না এইদিকে যদি একটু মন দেয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব শিক্ষক বাংলা পড়ান, অযাচিতভাবে হলেও, তাঁদের যদি একটু বেশি খাতির করেন, এটা বেশি ফলপ্রসূ হবে। অফিস-আদালতে হলে ভালো কথা, না হলে আত্মহত্যা করার কোনো কারণ নেই। এবং যখন বাংলা-জানা ছেলেমেয়ে বাড়বে, অনেকেই তো এরা ভালো বাংলায় বক্তৃতা দেয় সরকারি চাকরিতে যায় না, অন্যান্য কাজ করে এদেরও সরকারি চাকরিতে যেতে হবে, গেলে অনেকটা উন্নতি হবে।
আরেকটা কারণ পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারেন যেসব খ্যাতনামা সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী ইংরেজি চালু রাখার জন্য জীবনপাত করতে রাজি হচ্ছেন এ থেকে কি কোনো লেসন নিতে পারেন? কেন এটা হলো? যাঁরা নিজেরা এত বড় সাহিত্যকর্ম করেন, সত্যি বিদ্বান, তাঁরা যেভাবে ইংরেজি তুলে দিলে কী সর্বনাশ হবে এ সম্বন্ধে বক্তৃতা এবং লেখা প্রকাশ করছেন, এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি আপনাদের মধ্যে হওয়ার বিশেষ কোনো সম্ভাবনা নেই। আমার মনে হয়, শুধু বাংলা না, যে-কোনো ভারনাকুলারের (vernacular-এর), মাতৃভাষার, ভারতবর্ষে অবস্থা নিতান্ত সংকটাপন্ন। এর একটি মাত্র কারণ ইংরেজি ভাষার বই প্রকাশ এখন বিগ বিজনেস, সেভেন হানড্রেড মিলিয়ন মার্কেট রয়েছে – দুনিয়ার যে-কোনো মার্কেটের চেয়ে বড়ো। অন্য কোনো আঞ্চলিক ভাষা – ভারতবর্ষের কোনো একটি ভাষার এই ধরনের মার্কেটের সম্ভাবনা নেই।
সুতরাং আমার মনে হয়, ওই সরকারি অফিসে বাংলা লেখা হোক, যারা লেখে না তাদের ধিক্কার দেওয়া হোক ভালো কথা। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা বই এই ছোটখাটো বই, বর্ণপরিচয়ের বই, ওয়ান-টু-থ্রির বই এগুলো যাতে একটু বেশি ক্ষমতাশালী লেখকরা লেখেন এবং বইগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করেন তাহলে অনেক উপকার হবে। ভাষা, শ্রেণি এবং সমাজ সম্বন্ধে আমার আর কোনো গুরুতর কথা বলবার সাধ্য নেই। আমি এখানে উপস্থিত হয়েছিলাম, কারণ রেহমান সোবহান, আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দীন উমর, আবু আবদুল্লাহ এঁরা উপস্থিত থাকবেন, বক্তৃতা দেবেন এবং আমাকে হুকুম করায় এখানে আসা। আমার চরিত্রের এমন জোর নেই যে, আমি তাতে না করতে পারতাম। তা নইলে আমার এখানে আসার কোনো কারণ নেই।
/১৯৮৫
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024