বাংলাদেশি ফিকশন: গালিভরের সফরনামা – আবুল মনসুর আহমদ
গালিভরের সফরনামা
(অপ্রকাশিত শেষাংশ)
প্রকাশকের আরজ
গালিভর সাহেব ছিলেন মশহুর মুসাফির। দুনিয়ার ছোট-বড় ছেলে-বুড়ো সবাই তাঁর নাম জানেন, যেমন আমরা সবাই জানি ‘ইত্তেফাকে’র মুসাফিরের নাম। তবে তফাৎ এই যে, ‘ইত্তেফাকে’র মুসাফিরের খ্যাতি পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ; কারণ পাসপোর্ট-ভিসার হাংগামায় তিনি দেশের বাইরে সফর করিতে পারেন না। তাছাড়া, আজকাল বিদেশে সফর করিতে হইলে হাওয়াই জাহাজে চড়া চাই। হাওয়াই জাহাজের ভাড়া যোগাতে পারে কেবল সরকারি তহবিল। ‘ইত্তেফাকে’র মুসাফিরের এসব সুবিধা নাই। কাজেই, তিনি বিদেশে সফরে যাইতে পারেন নাই। কিন্তু গালিভর সাহেবের আমলে সফরের খুবই সুবিধা ছিল। পাসপোর্ট ভিসার কোন হাংগামা ছিল না। সের খানেক চিড়া, চার পয়সার বাতাসা অথবা কিছু চিনা বাদাম পুটলায় বাঁধিয়া বাহির হইয়া পড়িলেই হইত। গালিভর সাহেব তাই ইচ্ছামত সফর করিতে পারিতেন এবং করিতেন। তাই দুনিয়া-জোড়া তাঁর নাম।
এই গালিভর সাহেবের যে সফর-নামা আপনারা সবাই পড়িয়াছেন, সেখানা লেখা ইংরাজিতে। অজ্ঞ লোকের ধারণ, গালিভর সাহেব শুধু ইংরাজিতেই একখানামাত্র সফর-নামা লিখিয়াছিলেন। কিন্তু আসল কথা তা নয়। আসলে গালিভর সাহেব দুইখানা সফর-নামা লিখিয়া যান: একখানা ইংরাজিতে, অপরখানা বাংলায়। এইখানে এতকালের এই গোপন কথা আজ প্রকাশ করিয়া দেওয়া আমি আবশ্যক মনে করিতেছি যে, গালিভর সাহেব বাঙলা জানিতেন; কারণ, তাঁর মাতৃভাষাই ছিল বাঙলা-যেহেতু তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় স্পষ্টবাদী। তাঁর স্পষ্ট কথাকে লোকে গালি মনে করিত। তাই, শত্রুরা তাঁর দুর্নাম দিয়াছিল গালি-ভরা।
এই বইয়ের প্রথম মুদ্রণের পর আরও কিছু পুরাতন ও উলি-কাটা কাগজ-পত্র উদ্ধার করিয়াছি। তাতে দেখা যায় যে, গালিভর সাহেব নোয়াখালী জেলার বাশেন্দা ছিলেন। তাঁর আসল নাম ছিল গালিব। নোয়াখালী জেলার গালিবপুর গ্রাম আজও তাঁর স্মৃতি বহন করিতেছে। এতে স্বচ্ছন্দে অনুমান করা যাইতে পারে যে, দুশমনেরা গালিব নামকেই বিকৃত করিয়া ‘গালিবর বা গালিভর’ করিয়াছিল।
যা হোক, গালিভর সাহেবের দু’খানা সফর-নামার মধ্যে ইংরাজিখানা প্রকাশের ভার তিনি দিয়া যান জনাথন সুইফ্টের উপর; আর বাঙলাখানা প্রচারের ভার দেন তিনি আমার উপর। গালিভর সাহেব তাঁর ইংরাজি সফর-নামাখানা আঠার শতকেই প্রকাশের হুকুম দিয়াছিলেন; কিন্তু বাঙলা খানার প্রকাশ তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখিতে ওসিয়ত করিয়া যান। তার কারণ এই যে, ইংরাজি সফর-নামা লিখিয়াছিলেন তিনি ফিজিক্যাল জায়েন্টে (দেও) ও ফিজিক্যাল ডুয়ার্ফ (বাউন)-দের লইয়া; আর বাঙলা সফর-নামা লিখিয়াছিলেন তিনি ইন্টেলেকচুয়াল জায়েন্ট (দেও) ও ইন্টেলেকচুয়াল ডুয়ার্ফ (বাউন) দের লইয়া। ফিজিক্যাল জায়েন্ট ও ফিজিক্যাল ডুয়ার্ফদের কাহিনী বুঝিবার মত বুদ্ধি-শুদ্ধি মানুষের আঠার শতকেই হইয়াছিল। কিন্তু ইন্টেলেকচুয়াল জায়েন্ট ইন্টেলেকচুয়াল ডুয়ার্ফদের কাহিনী বুঝিবার মত বুদ্ধি-আক্কেল বিশ শতকের আগে মানুষের হইবে না, গালিভর সাহেব ইহা আন্দাজ করিয়াছিলেন। বিশ শতকের ঠিক কোন সময়ে কোন সালে এবং কোন দিন ইহা প্রকাশ করিলে, পাঠকরা তা বুঝিতে পারিবে, সেটা আন্দাজ করিবার ভার গালিভর সাহেব আমারই উপর দিয়া গিয়াছিলেন।
কিন্তু গালিভর সাহেব একটু ভুল করিয়াছিলেন। লোকজনের বুদ্ধি-আক্কেল পাকিল কিনা, সেটা বুঝিতে গেলে বুঝনেওয়ালারও যথেষ্ট বুদ্ধি-আক্কেল থাকা চাই। দুর্ভাগ্যবশত আমার বুদ্ধি-আক্কেলের যথেষ্ট প্রখরতার অভাবে বড় দেরিতে আজ বুঝিতে পারিয়াছি যে, গালিভর সাহেবের বাংলা সফর-নামা বুঝিবার মত বুদ্ধি আক্কেল মানুষের অনেক আগেই হইয়া গিয়াছে। তথাপি ‘বেটার লেইট দ্যান নেভার’ এই নীতির উপর ভরসা করিয়া গালিভর সাহেবের বাঙলা সফর-নামা বিলম্বে হইলেও প্রকাশ করিলাম। প্রকাশ থাকে যে, আমার বাক্সপেটেরা বা আলমারি না থাকায় আমি গালিভর সাহেবের পাণ্ডুলিপিটি বাঁশের চোংগায় ভরিয়া ঘরের চালে লটকাইয়া রাখিয়াছিলাম। এত সাবধানতা অবলম্বনের ফলে পাণ্ডুলিপিটি চুরি যায় নাই বটে, কিন্তু উলিতে উহার কয়েক পাতা খাইয়া ফেলিয়াছে। উলির মাটি ঝাড়িয়া পুছিয়া যে কয় পাতা উদ্ধার করা গিয়াছে, নিম্নে তাই ছাপা হইল। Continue reading