গরিব যেমনে মরে – জর্জ অরওয়েল
১৯২৯ সালে আমি প্যারিসের ১৫ সাব-ডিভিশনের এক্স হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহ ছিলাম। রিসেপশন ডেস্কে আমার সেইখানকার কেরানিদের কাছে সবসময়ের মত বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে হইল, এবং ঢুকতে দেয়ার আগে প্রায় বিশ মিনিট আমারে সেইখানে দাঁড় করায়ে রাখা হইসিল। আপনি যদি কখনো কোনো ল্যাটিন দেশে কোনোপ্রকার ফর্ম ফিলাপ কইরা থাকেন, তাইলে হয়তো প্রশ্নগুলার ধরণ আপনি বুঝবেন। বেশ আগে থেকেই আমার রেউমুর (তাপমাত্রার পরিমাপ) থেকে ফারেনহাইটের হিসাব করতে সমস্যা হয়, তবু আমি জানি যে আমার গায়ের তাপমাত্রা তখন ১০৩ এর মত ছিল, এবং ওই কড়া জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হইতে হইতে আমার জন্য দাঁড়ায়ে থাকাটাও কঠিন হয়া পড়সিল। আমার পিছনে অপেক্ষা করতেসিল রোগীদের বিশাল সারি, হাতে রঙিন রুমাল। তারাও তাদের ইন্টেরোগেশনের পালার অপেক্ষা করতেসিল।
ইন্টেরোগেশনের পরেই গোসল – যারা নতুন আসে তাদের এইটা করতেই হয়, অনেকটা কোনো কারখানা বা জেলখানার মত। আমার কাছ থেকে আমার জামাকাপড় নিয়া যাওয়া হয়। কাঁপতে কাঁপতে কয়েক মিনিট পাঁচ ইঞ্চির মত গরম পানির উপর দাঁড়ায়ে থাকার পরে আমারে একটা লিনেনের নাইটশার্ট আর ফ্ল্যানেলের গাউন দেয়া হয়। আমার পায়ের সাইজের কোনো স্লিপার নাকি তারা পান নাই, তাই ওই অবস্থায়ই আমারে বাইরে নিয়া যাওয়া হয়। ওইটা ছিল ফেব্রুয়ারির এক রাত, আর আমার তখন নিউমোনিয়া। যেই ওয়ার্ডের কাছে আমরা যাইতেসিলাম সেইটা প্রায় ২০০ গজ দূরে ছিল, এবং হাসপাতালের পুরা গ্রাউন্ড পার হইয়া ওইখানে যাওয়া লাগতেসিল। পাথুরে পথটা ঠাণ্ডায় জইমা ছিল, আর বাতাসে ফ্ল্যানেলের নাইটশার্টটা আমার উদাম উরুর উপরে ঝাপ্টাইতেসিল। ওয়ার্ডরুমে পৌছানোর পর আমার কেমন যেন একটা চেনা-চেনা অনুভূতি হইতেসিল যেইটার সোর্স আরো রাত হওয়ার আগে আমি ধরতে পারি নাই। রুমটা বেশ লম্বা, নিচু আর অন্ধকার-অন্ধকার ছিল। সেইখানে ফিসফিস শব্দ শোনা যাইতেসিল সবসময়, আর তিনটা বিছানা একটা আরেকটার খুবই কাছাকাছি ঠাসা ছিল। একটা বিচ্ছিরি, পায়খানা-টাইপ আবার মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ আসতেসিল। আমি শুইয়া পড়তেই দেখি আমার উল্টাপাশের বিছানায় একজন ছোটখাটো, গোল কাধ আর খসখসে চুলওয়ালা একজন লোক আধল্যাংটা হয়ে বইসা আছে আর একজন ডাক্তার আর তার ছাত্র লোকটার উপর অদ্ভূত কোনো অপারেশন চালাইতেসে। ডাক্তারটা প্রথমেই তার কালো ব্যাগ থেকে প্রায় ডজনখানেক ছোট ছোট ওয়াইনের গ্লাসের মত গ্লাস বাইর করলো, আর ছাত্রটা ম্যাচ জ্বালায়ে সব বাতাস বাইর কইরা নিল। এরপর রোগী লোকটার পিঠে বা বুকে গ্লাসগুলা চাইপা ধইরা রাখার পর ভ্যাকিউমের মাধ্যমে রক্ত জমাট বাইধা আসলো। কিছুক্ষণ পর আমি টের পাইলাম ওনারা কী করতেসে। ওইটারে বলা হয় কাপিং। এই চিকিৎসার কথা পুরানা ডাক্তারি বইতে পাওয়া যায়, কিন্তু এতদিন আমি ভাইবা আসছি এই অপারেশন কেবল ঘোড়ার উপরই চালানো হয়।
বাইরের ঠাণ্ডা বাতাসে আমার গায়ের তাপমাত্রা মনে হয় কইমা আসছিল, আর এই জঘন্য চিকিৎসার কায়দাটা আমি মানসিকভাবে একটু দূর থেকে আর এমনকি খানিকটা মজা নিয়াই দেখতেসিলাম। কিন্তু তার পরপরই ডাক্তার আর তার ছাত্র আমার বিছানার দিকে আগাইলো। হ্যাচকা টানে আমারে সোজা কইরা বসাইয়া একইভাবে সেম গ্লাসগুলা কোনোভাবে না ধুইয়া-টুইয়াই আমার গায়ে বসানো শুরু করলো। হাল্কা একটু প্রতিবাদ আমি করসিলাম, কিন্তু তা কোনো জানোয়ারের ডাকের চাইতে বেশি আমলে নিলো না তারা। যেইভাবে তারা আমার উপরও একই কায়দায় সেই চিকিৎসা শুরু করলো তা দেইখা বেশ ইম্প্রেসডই হইলাম। এর আগে আমি কখনো কোনো হাসপাতালের পাবলিক ওয়ার্ডে থাকি নাই, তাই ডাক্তারদের এইভাবে রোগীর সাথে কথাও না বলা, বা মানুষ হিসেবে রোগীদের নোটিসই না করার ব্যাপারটা আমি এর আগে কখনো দেখি নাই। আমার উপরে তারা ছয়টা গ্লাস লাগাইলো, তারপর রক্তের জমাট বাঁধা জায়গায় গ্লাসগুলা আবার লাগাইলো। প্রতিটা গ্লাসে প্রায় এক চামচ কইরা কালো রক্ত উইঠা আসলো। আমার সাথে যা করা হইল তার কথা ভাইবা প্রচণ্ড ঘিন্না, ভয় আর অপমানে আমি শুইয়া পড়লাম আর ভাবলাম এখন অন্তত তারা আমারে ছাইড়া দিবে। কিন্তু না, একদমই না। আরো একটা ইলাজ বাকি ছিল: গায়ে সরিষাবাটা লাগানো। এইটা ওই গরম পানি দিয়া গোসলের মতই রেগুলার জিনিস ছিল। দুইজন নোংরা মতন নার্স আগে থিকাই সরিষাবাটা রেডি কইরা রাখসিলেন, এরপর তারা সেইটা স্ট্রেইটজ্যাকেটের মত আমার গায়ে মাখাইয়া দিলেন। ওদিকে ট্রাউজার আর শার্ট পইরা ওয়ার্ডে ঘুরঘুর করতে থাকা কতগুলা লোক আমার কাছে আইসা জটলা পাকাইয়া আধা-দরদের সাথে ভ্যাটকাইতে থাকলো। পরে আমি জানসিলাম সে অন্য কোনো রোগীর গায়ে সরিষাবাটা মাখাইতে দেখা এই ওয়ার্ডের এন্টারটেইনমেন্টের অন্যতম উৎস। প্রায় পোনে এক ঘণ্টা এগুলা মাখায়া রাইখা দেয়া হয়, আর বাইরের লোকের কাছে এইটা ফানি লাগাটাই স্বাভাবিক। প্রথম পাঁচ মিনিটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, কিন্তু তাও মনে ভরসা থাকে যে সইয়া ফেলা যাবে। পরের পাঁচ মিনিটে সেই ভরসাও উইবা যায়। আর সরিষাবাটার কাপড়টা বেল্ট দিয়া বাইন্ধা রাখা হয়, কোনোভাবেই খোলা যায় না। এইটাই দর্শকরা সবচাইতে মজা নিয়া দেখে। শেষের পাঁচ মিনিটে, আমি খেয়াল করলাম, একপ্রকার অবশ হইয়া আসে সব। তারপর সরিষাবাটা গা থিকা উঠায়া ফেলার পর আমার মাথার নিচে বরফ-ভরা একটা ওয়াটারপ্রুফ বালিশ দিয়া আমারে একলা রাইখা সবাই চইলা গেল। কিন্তু আমি ঘুমাইলাম না। এবং আমার জানামতে, এইটাই আমার জীবনের একমাত্র রাত—মানে যেই রাতে আমি বিছানায় ছিলাম—কিন্তু একটুও ঘুমাইতে পারি নাই, এক মিনিটের জন্যেও না। Continue reading