Main menu

মহাদেব সাহা: মিহিন সেলায়ে রচিত কবিতার অন্তরাত্মা

বাইশ বছরের ঢাকার জীবনে আমার যথেষ্ট মদ, মেয়ে মানুষ আর কবি দেখা হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় সেসব নিয়ে লিখবো। কিন্তু পরমুহুর্তেই থেমে যাই, কারণ অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে আহত হবেন, অনেকের সম্মান ক্ষুণ হবে। তাই সেসব কথা আর লেখা হয় না।

তবু আজ কবি আর কবিতা সমাচার নিয়ে লিখতে বসলাম। কয়েকদিন আগে ইমরুল হাসান লিখলেন “মহাদেব সাহা’র কবিতা কেন এখন পড়ার দরকার পড়ে না?” শিরোনামে একটা লেখা। এই লেখা পড়ার পড়ে আমার ভেতরে কিছু স্মৃতির উদ্‌গীরণ ঘটেছে, তা এখানে উপস্থাপন করলাম।

মহাদেব সাহার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ২০১২ সালের মার্চ মাসে। কৈশোর পেরনো আমার তারুণ্যকে বহুদিন ছুঁয়েছিল “করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও-আঙ্গুলের মিহিন সেলাই”। সেই কবিকে সামনাসামনি দেখতে পাওয়া, মুখোমুখি কথা বলতে পারা এ যে কি অনুভূতি তা তো শব্দে প্রকাশ করা যাবে না। তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল মধ্যমা প্রকাশনীতে। আমি আমার পকেট থেকে সাইবার শট ক্যামেরা বের করে তাঁর বেশ কিছু ছবি তুলি এবং ঐদিন আবার তাঁর পুরোন কিছু বই ঘেটে দেখি। বই দেখতে দেখতে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এলো, মহাদেব সাহাকে নিয়ে নতুন আঙ্গিকে একটা বই করার। একপাশে একটা কবিতা থাকবে আর অন্যপাশে তাঁর একটা ফটোগ্রাফ থাকবে, বিভিন্ন সময়ের। আমার বন্ধু সঞ্জয় গাইনের সাথে বিষয়টা শেয়ার করতেই বলল চমৎকার আইডিয়া। একটা কিছু করতে যাচ্ছি এই ভেবে একটা ঘোরের মধ্যে আমার সময় কেটে যাচ্ছে।

ঐ সময় সন্দর্ভ গিরি নামে নেপালের এক হবু ডাক্তারের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। এবং অল্প দিনের মধ্যে আমাদের মধ্যে এক বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। বন্ধুত্ব হবার কারণ আমি ঐ সময় দিল্লী বিরোধী একটা কবিতা লিখেছিলাম এবং এক কবিতা পাঠের আসরে পড়েছিলামও। ঐ আসরে মি. গিরিও একটা কবিতা পড়েছিল (সেটা ইংরেজি কবিতা)। গিরির কবিতাটিও ছিল দিল্লীর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। এরপর আমরা কোন কবিতার আসরে গেলে পরস্পর পরস্পরকে এই কবিতা দুটি পড়ার অনুরোধ করতাম। তো ঐ বছরই মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে সঞ্জয় গাইনের মধ্যেস্থতায় একটা আড্ডার আয়োজন হলো। সেই আড্ডার মধ্যমনি ছিলেন মহাদেব সাহা। আমি, সন্দর্ভ গিরি, সঞ্জয় গাইনসহ আরও অনেকেই ছিল। কাটাবনের অষ্টব্যঞ্জন রেস্টেুরেন্টে আমাদের আড্ডা চলছিল। মি. গিরি মহাদেব সাহার নানা কবিতা নিয়ে আলাপ করলেন। এক পর্যায়ে মহাদেব সাহা’র অনুরোধ গিরি একটা কবিতা পড়ে, আমার এবং সঞ্জয়ের অনুরোধে গিরি ইংরেজি কবিতাটিই পড়ে (ইংরেজিতে হওয়ায় কবিতাটির নাম এখন আমার মনে নেই)। Continue reading

এমন এক অডিয়েন্স থাকে যারা আসলে কোথাও এগজিস্ট করে না – হা জিন

This entry is part 25 of 27 in the series ইন্টারভিউ সিরিজ

হা জিনের জন্ম চায়নাতে, কিন্তু লেখক হয়া উঠসেন আমেরিকা আইসা। ১৯৮৯ সালে চীনে তিয়েনানমেন স্কয়ারে প্রতিবাদকারীদের উপর সরকারি বাহিনির হামলা না হইলে হয়ত কখনোই তিনি রাইটার হইতেন না। হামলায় কতোজন মারা গেছে সেইটার হিসাব এক্সাক্টলি কারো জানা না থাকলেও বিভিন্ন সোর্স অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা হাজার জনের উপরে। এই ঘটনা স্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকায় আসা হা জিনরে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ঘটনার পরে তিনি ঠিক করলেন আমেরিকাতেই থাইকা যাবেন তিনি। এই ম্যাসাকারের পরেই সিরিয়াসলি ইংলিশে লিখতে শুরু করেন। কোনো একটা সিগনিফিকেন্ট ইভেন্ট যে মানুষরে কোর থেকা পাল্টায়া দিতে পারে তার একটা এক্সামপল হা জিন।

হা জিনের জন্ম ১৯৫৬ সালে উত্তর-পূর্ব চায়নার লিয়াওনিং প্রদেশে। বাপ ছিলেন রেভল্যুশনারি আর্মির একেবারে প্রথমদিককার মেম্বার। আম্মা ছিলেন সিভিলিয়ান। নানা জমির মালিক ছিল দেইখা বিপ্লবের পর কিছুদিন তার মা’রে গারবেজ কালেক্টর বানায়া রাখা হইসিল পানিশমেন্ট হিসেবে। মিলিটারি বাপের ঘন ঘন ট্রান্সফারের কারণে অনেকগুলা প্রদেশে তার থাকা হইসে।

চায়নায় কালচারাল রেভল্যুশন স্টার্ট হওয়ার টাইমে জিনের বয়স ছিল দশ। ফ্যান্সি একটা স্কুলে পড়তেসিলেন তিনি, কিন্তু রেভল্যুশনের কারণে তারটা সহ দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়া যায়। চোদ্দ বছর বয়সে জিন নির্ধারিত বয়সের আগেই চিপাচুপা দিয়া আর্মিতে জয়েন করেন। তার পোস্টিং পড়সিল বর্ডার এলাকায়, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চায়নার ছাড়া ছাড়া সংঘর্ষ চলতেসিল। উনিশ বছর বয়সে মিলিটারি ছাইড়া ফেরত আসেন হা জিন। পাঁচ বছরের মিলিটারি সার্ভিসে তিনি লাইফের হার্ডশিপ এবং চাইনিজ লাইফের কমপ্লেক্সিটি এক্সপেরিয়েন্স করার সুযোগ পান, যেগুলার অনেককিছুই পরে তার লেখায় দেখা যায়।

মিলিটারি ছাইড়া আসার পর জিন হেইলংজিয়াং ইউনিভার্সিটি থেকা ইংলিশ স্টাডিজে ব্যাচেলর আর শ্যানডং ইউনিভার্সিটি থেকা অ্যাংলো-আমেরিকান লিটারেচার নিয়া মাস্টার্স করেন। তারপর তিনি স্কলারশিপে আমেরিকার ব্র্যান্ডেইস ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যান। ঐখানে পড়ার সময়েই চীনে তিয়েনানমেন স্কয়ার ম্যাসাকার হয়। পরে হা জিন ক্রিয়েটিভ রাইটিং নিয়া MFA এবং একটা PhD ডিগ্রিও নেন। আমেরিকায় আসার পর বিভিন্ন জব করার পর তার ক্যারিয়ার সেটল হয় ইউনিভার্সিটির মাস্টার হিসেবে। বর্তমানে হা জিন ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে লিটারেচার এবং ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর ওপর মাস্টারি করেন।

রাইটিং স্টাইল আর গল্পের থিম নিয়া পরিক্ষা-নিরিক্ষার জন্য কনটেম্পোরারি লিটারেচারে হা জিন আলাদা জায়গা বানায়া নিতে পারসেন। মিনিমালিস্ট গদ্য, ইনসাইটফুল ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট আর মানুষের রিলেশনশিপের জটিলতার জায়গাগুলা এক্সপ্লোর করা তার লেখালিখির অন্যতম বৈশিষ্ট। হা জিনের বেশিরভাগ গল্প-উপন্যাস লেখা হইসে চায়নার বিশৃঙ্খল ইতিহাস আর আমেরিকায় বাস করা একজন ইমিগ্র্যান্টের এক্সপেরিয়েন্সের কনটেক্সট থেকা।

সাধারণ মানুষ এবং তাদের লাইফে পলিটিকাল ও সোশাল পাওয়ারগুলার প্রভাব নিয়া এক্সপ্লোরেশন তার কাজের আরেক বৈশিষ্ট্য। চীনের বিশৃঙ্খল ইতিহাস আর কালচারাল রেভল্যুশনরে কেন্দ্রে রাইখা অনেকগুলা গল্প তিনি লিখসেন। হা জিনের হিস্টোরিকাল উপন্যাস War Trash একজন ইয়াং চাইনিজ সোলজারের গল্প যারে কোরিয়ান যুদ্ধে ‘ভলান্টিয়ার’ হিসেবে উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে পাঠানো হইসিল। তিনি সাধারন সিটিজেনদের জীবন তুইলা ধরেন তার লেখায়, যারা পলিটিকাল ইডিওলজি আর সরকারি পলিসির মাঝখানে পইড়া ধরা খায়। The Crazed উপন্যাস লেখা হইসে ১৯৮৯ সালে মানুষের ওপর চায়নার তিয়েনানমেন স্কয়ার বিক্ষোভের গভির এবং স্থায়ি প্রভাব নিয়া। উপন্যাসের নায়ক জিয়ান এক বুড়া প্রফেসরের দেখাশোনা করে। অসুস্থ প্রফেসর বিক্ষোভের দ্বারা ট্রিগার্ড হয়া নিজের মানসিক ভারসাম্য হারায়া ফেলেন, আর হয়া উঠেন লাগামছাড়া জবানের একজন মানুষ। ইডিওলজি আর পলিটিকাল পাওয়ারের কাছে নিপিড়িত হইতে থাকা মানুষের এই অবস্থার ইমেজ তার লেখারে কইরা তোলে ইউনিভার্সাল।

মানুষের রিলেশনের জটিলতাগুলারে তুইলা ধরা হা জিনের লেখার আরেক বৈশিষ্ট্য। মানুষের আবেগের জটিল বন্ধনগুলারে ফুটায়া তুলতে তিনি পারদর্শী, যে বন্ধনগুলা তার ক্যারেক্টারদের একজন আরেকজনের সাথে বাইধা রাখে। Waiting উপন্যাসটা লেখা হইসে কালচারাল রেভল্যুশন পরবর্তী চায়নায় লিন কং নামের একজন মিলিটারি ডাক্তারের জীবনের ওপর। এই লোক তার ভালোবাসার মানুষরে বিয়ে করার জন্য প্রথম ম্যারেজ থেকা ডিভোর্সের জন্য আঠারো বছর অপেক্ষা করেন। ছোটগল্পের বই The Bridegroom-এ থিম হিসেবে হা জিন বাইছা নিসেন কনটেমপোরারি চায়নার কনটেক্সটে ভালোবাসা, ফ্যামিলি আর পারসোনাল রিলেশনশিপের ওপর। বইতে হা জিন এক্সপ্লোর করসেন দ্রুত বদলায়া যাইতে থাকা একটা সমাজ, যেখানে ট্রেডিশনের সাথে মডার্নিটির ক্ল্যাশ হয় এমন একটা জায়গাতে রিলেশনগুলা কিভাবে ফাংশন করে। বাজে একটা বিয়ের সম্পর্ক কিংবা দুইটা মানুষের অস্বাভাবিক বন্ধুত্ব, টপিক যেটাই হউক, হা জিনের লেখা মানুষের ইন্টার‍্যাকশনগুলারে মাঝখানে রাইখা। Continue reading

[বই থেকে] ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন – শাহেদ আলী

[পাকিসতান আমলে দুইটা ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশন হইছিল, একটা ১৯৫৪ সালে, এবং আরেকটা ১৯৭০ সালে। ১৯৫৪ সালের ইলেকশনে খেলাফতে রাব্বানী পার্টি থিকা ইলেকশন করছিলেন গল্পকার শাহেদ আলী।

খেলাফতে রব্বানী পার্টির মেইন লিডার ছিলেন আবুল হাশিম (ব্রিটিশ আমলে যিনি মুসলিম লিগের সভাপতি ছিলেন, বাংলা-প্রদেশের)। মুসলিম লিগ থিকা বাইর হয়া আইসা এই দল বানাইছিলেন উনি, এবং উনি ছিলেন মুসলিম-লিগ বিরোধি যুক্তফ্রন্ট তৈরি করার একজন কারিগর, থিওরেটিকালি এবং পলিটিকালি; কিনতু শেষে তাদেরকেই যুক্তফ্রন্টে রাখা হয় নাই। ১০টা সিটে রব্বানী পার্টি ইলেকশন করছিল, শাহেদ আলী ছিলেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের কেনডিটেট।

উনার ইলেকশন করার কাহিনি উনার মুখেই শুনেন। উনার “জীবন কথা” বই থিকা নেয়া হইছে নিচের কথাগুলা।]

১৯৫৩ সাল। আমি তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করছি। একবার ছুটিতে ঢাকায় এসেছি। তখন নির্বাচনের খুব তোড়জোড় চলছে। আল্লামা আবুল হাশিম সারা পূর্ব পাকিস্তান ট্যুর করেন। সে-সময় মোমেনশাহীতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সমমনা বিরোধী দলগুলো যুক্তফ্রন্ট গঠনের ডাক দেয়। মুহূর্তে রাজনীতির অঙ্গনে এক প্রচণ্ড চাঞ্চল্যকর অবস্থা শুরু হয়ে গেল। আমি রব্বানী পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, যার প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন জনাব আবুল হাশিম। (রব্বানী পার্টি: খেলাফতে রব্বানী পার্টি, প্রতিষ্ঠাকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৫৩।) তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি রংপুর যাবার সময় আমার একটা চিঠি নিয়ে যেয়ো। ওখানে আমার ঘনিষ্ঠ একজন নামকরা উকিল আছে। আবু হোসেন সরকার। আমাদের আন্দোলনের জন্য তাঁকে আমাদের একান্ত দরকার। তাঁকে বুঝিয়ে বলবে, উত্তরবঙ্গে তাঁকে ছাড়া আমাদের চলবে না। শেরেবাংলারও একই কথা।’

আমি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ফিরে পরদিন সকালে জনাব আবু হোসেন সরকারের সঙ্গে দেখা করি। দীর্ঘদেহী জনাব আবু হোসেন সরকার। তাঁর গোলাকৃতি মস্ত বড়ো মাথায় ঘন কাঁচাপাকা চুল। দাড়ি-গোঁফ কামানো মজবুত স্বাস্থ্য।

সরকার সাহেব আমাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে নম্রকণ্ঠে বললেন, ‘আপনার পরিচয়? কোনো কেস আছে?’

আমি আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘আমি কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক। আমি জনাব আবুল হাশিমের একটা চিঠি এবং শেরেবাংলার একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’ এ-কথা বলার পর আমি আবুল হাশিমের চিঠিখানা সরকার সাহেবের অনিচ্ছুক হাতে তুলে দিলাম। তিনি চিঠি হাতে নিয়ে বললেন, ‘আবুল হাশিম এবং শেরেবাংলাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন, তাঁরা আমাকে স্মরণ করেছেন বলে। এককালে রাজনীতি করলেও আমি এখন আর রাজনীতি করি না। আমি দুঃখিত।’

আমি সরকার সাহেবের এই নিরুত্তাপ সংক্ষিপ্ত জবাবে হতাশ হয়ে পড়লাম। সরকার সাহেব বললেন, ‘আসুন, বসুন, চা খান। আপনি কেবল শিক্ষকতাই করেন, না রাজনীতিও করেন?’

বললাম, ‘এখন পর্যন্ত অধ্যাপনাতেই আছি। আর রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে পারি না। আমরা আপনাকে মুসলিম লীগ শাহির বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে সামনের সারিতে পেতে চাই।’ আমি ও সরকার সাহেব মুখোমুখি বসলাম। তিনি বললেন, ‘দেখুন, বয়স হয়েছে, জীবনে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি, জেলও কেটেছি। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। ওকালতি করে দুটো পয়সা আয় করি। আমাকে রোজ পঞ্চাশটি মুখে ভাত তুলে দিতে হয়। সুতরাং রাজনীতি করা আমার আর সাজে না।’

আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, ‘আপনার মুখে এ-কথা শুনব, আশা করিনি। আপনার পরিবারকে আপনি পঞ্চাশ জনের একটি পরিবার মনে কেন করছেন? দেশবাসী মনে করে পাঁচ কোটি মানুষ নিয়ে আপনার পরিবার। এই পাঁচ কোটি মানুষের মুখে আপনি ভাত তুলে দেবেন। আপনার কাছে এই তো দেশবাসীর ঢাবি।’

এবার সরকার সাহেবের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমাকে কিছু ভাবতে দিন। আমি কিছু দিনের মধ্যেই ঢাকা যাচ্ছি। তখন আমি শেরেবাংলা ও হাশিম সাহেবের সঙ্গে আলাপ করব।’ কিছু দিনের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠল। আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে। জনাব আবুল হাশিম সাহেব দাবি করলেন, কেবল সমমনা ইসলামবিশ্বাসী দলগুলো নিয়েই যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে হবে। কিন্তু বামপন্থিরা দাবি করল তাদেরও যুক্তফ্রন্টে নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত খেলাফতে রব্বানী পার্টিকে বাইরে রেখেই শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট। খেলাফতে রব্বানী পার্টি দাবি করেছিল দশটি আসন, যেসব আসনে যুক্তফ্রন্ট নমিনি দেবে না। অন্যসব আসনে রব্বানী পার্টি যুক্তফ্রন্ট নমিনিদের পক্ষে কাজ করবে। সেই দাবিও গৃহীত হলো না। খেলাফতে রব্বানী পার্টি বাধ্য হয়ে দশটি আসনে তাদের নিজস্ব নমিনির নাম ঘোষণা করে।

আমি তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। আমার কাছে টেলিগ্রাম গেল। আমাকে আমার জেলা সিলেটের ১ নম্বর আসনে নমিনেশন পেপার সাবমিট করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ নিয়ে গঠিত ছিল এই বিশাল নির্বাচনী এলাকা। নমিনেশন পেপার সাবমিট করার সময় প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এই সময়ে আমার ওপর এই নির্দেশ আমার কাছে বজ্রপাতের মতো মনে হলো। আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে ১৯৫১ সালে। এর পর থেকে আমি প্রথমে বগুড়া কলেজে ও পরে কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করেছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় বলতে গেলে আমাকে কেউ চেনে না। আমিও সুনামগঞ্জের দু-একজন লোক ছাড়া আর কাউকে চিনি না। আমার নির্বাচনী এলাকায় তাদের কোনো পরিচিতিও নেই।

সুনামগঞ্জের একজন জাঁদরেল সাংবাদিক মকবুল হোসেন চৌধুরী, যিনি সাবেক আসামের প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য ছিলেন এককালে, এখন পেয়েছেন যুক্তফ্রন্টের টিকিট। প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির সিটিং সদস্য জনাব আবদুল খালেক আহমেদ পেয়েছেন মুসলিম লীগের টিকিট। দুজনেই এলাকায় সুপরিচিত। এই এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা তাঁদের সমর্থক ও কর্মী। এই অবস্থায় আমি আমার নমিনেশন নিয়ে মহাসংকটে পড়লাম। এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা আমাকে চেনে না। কারণ আমার জীবন কেটেছে বাইরে-বাইরে। ১৯৪৭-এর নির্বাচনে এবং রেফারেন্ডামের সময়ে আমি এলাকায় কাজ করেছি। রেফারেন্ডামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, জিন্নাত আলী প্রমুখ আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু নির্বাচন এবং রেফারেন্ডামের পরে আমি এলাকা ছেড়ে চলে আসি। এলাকার কোনো লোকের সঙ্গেই আমার দৃঢ় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনে কে আমার পক্ষে কাজ করবে? কেন্দ্রেও আমার কোনো লোকজন নেই যে ওখানে গিয়ে তারা কাজ করবে। এলাকায় কেবল একজন লোক আছে, নাম হাফেজ আবদুর রহিম। তাকে কোথায় পাব? কী করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করব? আমার শ্বশুর সাহেব ঢাকায় থাকেন, আমার স্ত্রীও ঢাকায় থাকেন। আমি এ-ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারিনি।

অধ্যাপক গোলাম আযম ও কবি মোফাখখারুল ইসলাম কারমাইকেল কলেজে ছিলেন। আমি তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা সুনামগঞ্জ রওয়ানা হলাম। সোজা মানে-ট্রেনে রংপুর থেকে গাইবান্ধা হয়ে বাহাদুরাবাদ ফেরি পার হয়ে ময়মনসিংহ; ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে আখাউড়া, সেখান থেকে ট্রেনে সিলেট, সিলেট থেকে বাসে চড়ে সুনামগঞ্জ। এই পথ পাড়ি দিতে তখন বিরাট-বিরাট ফেরিঘাট ছিল অনেকগুলো। এভাবে কোনোমতে গিয়ে সুনামগঞ্জ গিয়ে পৌঁছলাম। রাত পোহালে একটিমাত্র দিন থাকবে নমিনেশন সাবমিট করার। তার মানে এক দিনে আমার নমিনেশন সাবমিট করতে হবে। ভেবেচিন্তে সুনামগঞ্জের মাহবুব ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। তাঁর আসল নাম মির্জা গোলাম সামদানী। শুনলাম, কেবল আমার এলাকারই রেজিস্টার্ড ভোটারই নমিনেশন পেপারে প্রস্তাবক এবং সমর্থক হতে পারে। কিন্তু সুনামগঞ্জ শহরে আমি কোথায় পাব আমার এলাকার ভোটার? সুনামগঞ্জ থেকে তাহেরপুর এবং ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ এখান থেকে অনেক দূর। এলাকায় যাওয়া-আসা করতে হয় নদীপথে নৌকা করে। তখন ইঞ্জিনবোট বলতে কিছুই ছিল না। তাহিরপুরের একজন লোক আমার পরিচিত। প্রভাবশালী একজন লোক। সম্ভবত সেকান্দার আলী ছিল তার নাম। তাঁকে বললাম, ‘আপনি আমার একটা নমিনেশন পেপারে প্রপোজার হন।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি আবদুল খালেক সাহবেকে কথা দিয়ে ফেলেছি তাঁর প্রপোজার হব। আমি দুঃখিত।’

তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আগামী কালের মধ্যে নমিনেশন পেপার সাবমিট করতে হবে। ভাবলাম, গয়নাঘাটে গিয়ে দেখি, যে-সময় নৌকা ছাড়বে সে-সময় আমাদের এলাকার কোনো লোক পাই কি না। গয়নাঘাটে গিয়ে পেলাম লক্ষ্মীছড়ির হোসেন বখতকে। হোসেন বখত রাজনৈতিক কর্মী। গণতন্ত্রী দলের ওয়ার্কার। আমার পেরেশানি দেখে বললেন, ‘কী ব্যাপার প্রফেসর সাব, এত চিন্তিত কেন? কাউকে খুঁজছেন?’

আমি তাঁকে খুব সংক্ষেপে আমার অবস্থাটা বুঝিয়ে বললাম। শুনে তাঁর কিছুটা সহানুভূতি হলো। একটা নৌকা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই নৌকায় আপনার এলাকার একজন কর্মীলোক যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগেই নৌকায় তাঁর বিছানা তোলা হয়েছে। একটু অপেক্ষা করুন, এক্ষুনি ওই লোক এসে পড়বে।’ সূর্য ডোবার আগেই সেই লোক এসে হাজির গয়নার ঘাটে। হোসেন বখত বললেন, ‘একে চেনেন? আপনার এলাকার লোক, অধ্যাপক শাহেদ আলী। নির্বাচনের জন্য আপনাদের এলাকায় নমিনেশন পেয়েছেন। কালকের মধ্যেই নমিনেশন পেপার সাবমিট করতে হবে। তার জন্য দরকার আপনার এলাকার ভোটার, যারা প্রপোজ করবে এবং সাপোর্ট করবে। দেখেন আপনি কিছু করতে পারেন কি না।’

সেই লোক একজন তরুণ দীর্ঘদেহী দৃঢ় অভিব্যক্তির মানুষ, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তিনি বললেন, ‘আমি একজন প্রপোজার হতেই পারি, কিন্তু আরেকজন কোথায় পাব?’ এরপর একটু চুপ করে থেকে কপালে আঙুলের টোকা দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ আমাদের এলাকার কয়েকটি যুবক এখানে একটা ট্রেনিঙে এসেছে। ওরা প্রত্যেকেই ভোটার। দেখি এদের নিয়ে আসতে পারি কি না।’ তিনি আমার ঠিকানা জেনে নিলেন এবং সন্ধ্যার পরই চার জন যুবককে নিয়ে হাজির হলেন। এভাবে নমিনেশন পেপার সাবমিট করার সংকট থেকে পরিত্রাণ পেলাম। আমি তখন সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলাম আল্লাহর ওপর। বুঝতে পারলাম, তাঁর ইচ্ছেতেই সকল জটিলতার গিটগুলো খুলে যাচ্ছে। Continue reading

(বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৪

৯: অলৌকিক কান্ড

হালিমার গৃহে অবস্থানকালে হযরত মুহম্মদের জীবনে একটি অলৌকিক কান্ড ঘটিয়াছিল বলিয়া জানা যায়।

এই ঘটনা হাদিস শরীফে নিম্নরূপে উল্লিখিত হইয়াছে : “আনাস বলিতেছেন: একদা হযরত বালকদিগের সহিত খেলা করিতেছিলেন, এমন সময় জিব্রাইল ফিরিশতা তথায় উপস্থিত হইলেন। জিব্রাইল হযরতকে একটু আড়ালে লইয়া তাঁহাকে চিৎ করিয়া শোয়াইলেন; তারপর তাঁহার বুক চিরিয়া হৃৎপিণ্ডটিকে বাহিরে আনিয়া তাহার মধ্য হইতে খানিকটা জমা-রক্ত বাহির করিয়া ফেলিলেন এবং বলিলেন: শয়তানের অংশ যেটুকু তোমার মধ্যে ছিল তাহা এই। তারপর সেই হৃৎপিণ্ডটিকে একটি সোনার তশতরীতে রাখিয়া জমজমের পবিত্র পানি দ্বারা ধৌত করিলেন। অতঃপর সেটিকে জোড়া লাগাইয়া পুনরায় যথাস্থানে সংস্থাপন করিলেন। বালকেরা দৌড়াইয়া গিয়া হালিমাকে বলিল: ‘দেখ গিয়া, মুহম্মদ নিহত হইয়াছে।” তখন সকলে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মুহম্মদ বিবর্ণ হইয়া পড়িয়া আছেন। আনাস বলিতেছেন: ‘আমি হযরতের বুকে সেলাইয়ের দাগ দেখিয়াছি।”

শুধু যে আনাসই এই হাদিসটি বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা নহে। ইবনে হিশাম এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকগণও অনুরূপ হাদিস বর্ণনা করিয়াছেন। ইবনে হিশাম বলিতেছেন :

“হালিমা বলিয়াছেন: মুহম্মদ একদিন তাহার দুধভাইদের সহিত বাড়ীর নিকট মেষ চরাইতেছিল, এমন সময় বালকেরা ছুটিয়া আসিয়া আমার নিকট বলিল যে, দুইজন শ্বেতবাসপরিহিত লোক আসিয়া তাহাদের কোরেশ-ভাইকে ধরিয়া তাহার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। আমি এবং আমার স্বামী তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম মুহম্মদ বিবর্ণ ও ভীত অবস্থায় পড়িয়া আছেন। আমরা বালকটিকে আলিংগন করিলাম এবং এরূপ হইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। তখন বালক উত্তর দিল: “দুইটি শ্বেতবাস-পরিহিত লোক আমার নিকট আসিযা আমাকে চিৎ করিয়া শোয়াইয়া আমার কলিজা বাহির কবিয়া লইল এবং উহার মধ্য হইতে একটা-কিছু বাহির করিয়া ফেলিল। সে যে কী জিনিস, আমি জানি না।”

অন্য আর একটি হাদিসে আছে :

“একদা কতিপয় লোক হযরতের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিজের সম্বন্ধে কিছু, বলিতে অনুরোধ করিল। হযরত বলিতে লাগিলেন: “হযরত ইসমাইলের প্রতি খোদাতালা যে আশীর্বাদ প্রেরণ করিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, আমি সেই আশীর্বাদ এবং যিশু যাহার সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, আমি সেই ব্যক্তি। আমি যখন মায়ের পেটে ছিলাম, তখন আমার মা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন যে তাঁহার মধ্য হইতে একটি দিব্যজ্যোতিঃ বিকীর্ণ হইয়া সিরিয়ার রাজপ্রাসাদকে আলোকিত করিয়া তুলিয়াছে। একদিন আমি আমার দুভাইদের সংগে মেষ চরাইতেছিলাম এমন সময় শুভ্রবেশধারী দুই ব্যক্তি আমার নিকট উপস্থিত হইযা আমাকে চিৎ করিয়া শোয়াইয়া ফেলিয়া হৃৎপন্ড বিদীর্ণ করিয়া উহার মধ্য হইতে এক ফোঁটা কালো রক্ত বাহির করিয়া ফেলিলেন। তারপর তাঁহাদের হস্তস্থিত তরীর পানিতে উহা ধৌত করিয়া দিলেন। তখন একজন ফিরিশতা আমাকে ওজন করিবার জন্য অপরকে বলিলেন। ওজনে আমি দশজনের চেয়েও ভারী প্রমাণিত হইলাম। তখন আমাকে একশত জনের বিরুদ্ধে ওজন করা হইল, এবারেও আমি সকলের চেয়ে ওজনে ভারী হইলাম। তখন একজন অপরজনকে বলিলেন: আর দরকার নাই, সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে ওজন করিলেও ইহার ভার কম হইবে না।” Continue reading

বাংলাদেশি ফিকশন: অগ্নিগিরি – কাজী নজরুল ইসলাম

This entry is part 4 of 9 in the series বাংলাদেশি ফিকশন

বীররামপুর গ্রামের আলি নসিব মিয়াঁর সকল দিক দিয়েই আলি নসিব। বাড়ি, গাড়ি ও দাড়ির সমান প্রাচুর্য! ত্রিশাল থানার সমস্ত পাটের পাটোয়ারি তিনি।

বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কাঁঠাল-কোয়ার মত টকটকে রং। আমস্তক কপালে যেন টাকা ও টাকের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র।

তাঁকে একমাত্র দুঃখ দিয়াছে – নিমকহারাম দাঁত ও চুল। প্রথমটা গেছে পড়ে, দ্বিতীয়টার কতক গেছে উঠে, আর কতক গেছে পেকে। এই বয়সে এই দুর্ভাগ্যের জন্য তাঁর আপশোশের আর অন্ত নাই। মাথার চুলগুলোর অধঃপতন রক্ষা করবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেননি; কিন্তু কিছুতেই যখন তা রুখতে পারলেন না, তখন এই বলে সান্ত্বনা লাভ করলেন যে, সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডেরও টাক ছিল। তাঁর টাকের কথা উঠলে তিনি হেসে বলতেন যে, টাক বড়োলোকদের মাথাতেই পড়ে – কুলি-মজুরের মাথায় টাক পড়ে না! তা ছাড়া, হিসেব নিকেশ করবার জন্য নি-কেশ মাথারই প্রয়োজন বেশি। কিন্তু টাকের এত সুপারিশ করলেও তিনি মাথা থেকে সহজে টুপি নামাতে চাইতেন না। এ নিয়ে কেউ ঠাট্টা করলে তিনি বলতেন – টাক আর টাকা দুটোকেই লুকিয়ে রাখতে হয়, নইলে লোকে বড়ো নজর দেয়। টাক না হয়ে লুকোলেন, সাদা চুল-দাড়িকে তো লুকোবার আর উপায় নেই। আর উপায় থাকলেও তিনি আর তাতে রাজি নন। একবার কলপ লাগিয়ে তাঁর মুখ এত ভীষণ ফুলে গেছিল, এবং তার সাথে ডাক্তাররা এমন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল যে, সেইদিন থেকে তিনি তৌবা করে কলপ লাগানো ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু, সাদা চুল-দাড়িতে তাঁর এতটুকু সৌন্দর্যহানি হয়নি। তাঁর গায়ের রং-এর সঙ্গে মিশে তাতে বরং তাঁর চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে। এক বুক শ্বেত শ্মশ্রু – যেন শ্বেত বালুচরে শ্বেত মরালী ডানা বিছিয়ে আছে!

এঁরই বাড়িতে থেকে ত্রিশালের মাদ্রাসায় পড়ে – সবুর আখন্দ। নামেও সবুর, কাজেও সবুর! শান্তশিষ্ট গো-বেচারা মানুষটি। উনিশ-কুড়ির বেশি বয়স হবে না, গরিব শরিফ ঘরের ছেলে দেখে আলি নসিব মিয়াঁ তাকে বাড়িতে রেখে তার পড়ার সমস্ত খরচ জোগান।

ছেলেটি অতিমাত্রায় বিনয়াবনত। যাকে বলে – সাত চড়ে রা বেরোয় না। তার হাবভাব যেন সর্বদাই বলছে – ‘আই হ্যাভ দি অনার টু বি সার ইয়োর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট’।

আলি নসিব মিয়াঁর পাড়ার ছেলেগুলি অতিমাত্রায় দুরন্ত। বেচারা সবুরকে নিয়ে দিনরাত তারা প্যাঁচা খ্যাঁচরা করে। পথে ঘাটে ঘরে বাইরে তারা সবুরকে সমানে হাসি ঠাট্টা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জল ছিঁচে উত্যক্ত করে। ছেঁচা জল আর মিছে কথা নাকি গায়ে বড়ো লাগে – কিন্তু সবুর নীরবে এ সব নির্যাতন সয়ে যায়, এক দিনের তরেও বে-সবুর হয়নি।

পাড়ার দুরন্ত ছেলের দলের সর্দার রুস্তম। সে-ই নিত্য নূতন ফন্দি বের করে সবুরকে খ্যাপানোর। ছেলে মহলে সবুরের নাম প্যাঁচা মিয়াঁ। তার কারণ, সবুর স্বভাবতঃই ভীরু নিরীহ ছেলে ; ছেলেদের দলের এই অসহ্য জ্বালাতনের ভয়ে সে পারতপক্ষে তার এঁদো কুঠরি থেকে বাইরে আসে না। বেরুলেই প্যাঁচার পিছনে যেমন করে কাক লাগে, তেমনি করে ছেলেরা লেগে যায়।

সবুর রাগে না বলে ছেলেদের দল ছেড়েও দেয় না। তাদের এই খ্যাপানোর নিত্য নূতন ফন্দি আবিষ্কার দেখে পাড়ার সকলে যে হেসে লুটিয়ে পড়ে, তাতেই তারা যথেষ্ট উৎসাহ লাভ করে।

পাড়ার ছেলেদের অধিকাংশই স্কুলের পড়ুয়া। কাজেই তারা মাদ্রাসা-পড়ুয়া ছেলেদের বোকা মনে করে। তাদের পাড়াতে কোনো মাদ্রাসার ‘তালবিলিম’ (তালেবে এলম বা ছাত্র) জায়গির থাকত না পাড়ার ছেলেগুলির ভয়ে। সবুরের অসীম ধৈর্য! সে এমনি করে তিনটি বছর কাটিয়ে দিয়েছে। আর একটা বছর কাটিয়ে দিলেই তার মাদ্রাসার পড়া শেষ হয়ে যায়।

সবুর বেরোলেই ছেলেরা আরম্ভ করে – ‘প্যাঁচারে, তুমি ডাহ! হুই প্যাঁচা মিয়াঁগো, একডিবার খ্যাচখ্যাচাও গো!’ রুস্তম রুস্তমি কন্ঠে গান ধরে –

ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায় –
যাইতে যাইতে খ্যাচখ্যাচায়।
কাওয়ারা সব লইল পাছ,
প্যাঁচা গিয়া উঠল গাছ।
প্যাঁচার ভাইশতা কোলা ব্যাং
কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং।
প্যাঁচা কয়, বাপ বারিত যাও,
পাস লইছে সব হাপের ছাও
ইঁদুর জবাই কইর‍্যা খায়,
বোচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়। Continue reading

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →