ডোরিস লেসিং, কেউ কেউ তারে প্রফেট বইলা ডাকতো, উনি সেইটা পছন্দ করতেন না। তার ছবি দেখলে মনে হয় কিছু মুখ আছে, যাগো দিকে তাকাইলে তারা দেখতে সুন্দর কিনা এই প্রশ্ন ইনকনসিকুয়েনশিয়াল হয়ে যায়। তার জন্ম ১৯১৯ সালে, ইরানে। জাতে ব্রিটিশ। তিনি সাহিত্যিক, ২০০৭ সালে নোবেল পাইছিলেন। বাপের কর্ম আর বাতিকের সুবাদে জন্মের পর ১৯২৫ সাল পর্যন্ত কাটছে ইরানে, এরপর রোডেশিয়ায়। ইংল্যান্ডে ফিরতে ফিরতে তার ১৯৩৭। তাই ব্রিটিশ হইয়াও সে খুব একটা ব্রিটিশ না।
তার মৃত্যুর পর গার্ডিয়ানে যে অবিচুয়ারি বাইর হয়, সেইখানে লেখা হইছে সে জীবনে অনেক কিছু হইছে। কোনো সময় কমুনিস্ট সোশাল রিয়েলিস্ট, কোনো সময় দায়ে পড়ে নারীবাদী, কিছুকাল খুঁজলেন সুফীবাদ, হইলেন ক্যাসান্দ্রা (গ্রীক পুরাণে আছে, অ্যাপোলো এই নারীরে আশির্বাদ দিছিলো, তার প্রফেসি সব সত্যি হবে আর অভিশাপ দিছিলো, কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না), এরপর নিজেই নিজেরে বসাইলেন কসমিক অ্যানথ্রোপলজিস্টের পদে।
কসমিক অ্যানথ্রোপলজিস্টরা হইলো অ্যানথ্রোপলজিস্ট, যারা কয় মানবজাতি বিশ্বজগৎ সম্পর্কে যা ভাবে তা তাগো সমাজের কাঠামো তৈরিতে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়। ক্যাসান্দ্রা বা প্রোফেটের ব্যাপার যেইটা হইলো, উনি নাকি অনেক আগে থেকেই বুঝতে পারতেন রাজনীতি, সমাজ এইগুলার ট্রেন্ড কী হইতে যাচ্ছে। এবং তার লেখাপত্তরে সেইসব পাওয়া যাইতো। যেমন এহন তো আমরা টেররিস্ট শব্দডা ধুমসে সবাই জানি। কিন্তু ১৯৮৫ সালে তেমন কেউ জানতো না। কথাই হইতো না এইডা নিয়া। অথচ তহন উনি লিখলেন ‘দ্য গুড টেররিস্ট’। সেইখানে আবার দেখাইলেন, জীবনে কিছুই যেমন ঠিকঠাক চলে না, যেমন চলার কথা তেমন চলে না, তেমন টেররিস্টরাও ঠিকঠাক কইরা টেররিস্টগিরি করতে পারে না। তারে কেউ কেউ কয় শেপ শিফটার। কারণ উনি একেক সময় একেক রকম লিখছেন। কোনো সময় হার্ডকোর রিয়েলিজম আবার কোনো সময় নির্জলা ফ্যান্টাসি।
এই ইন্টারভিউতেই কইছেন, রিয়েলিস্টরা তারে কয় ফ্যান্টাসি রাইটার, ফ্যান্টাসিওয়ালারা কয় উনি লেখেন রিয়েলিজম। গার্ডিয়ান তার অবিচুয়ারিতে কইছে তার ছোটগল্প, উপন্যাস এইগুলা হইলো ভয়ানক রকমের মৌলিক। দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং (১৯৫০), দ্য চিলড্রেন অফ ভায়োলেন্স সিকোয়েন্স (১৯৫২-৬৯), দ্য গোল্ডেন নোটবুক (১৯৬২)– এইগুলারে বিবেচনা করা হয় ২০ শতকের ক্লাসিক। আরো আছে কানোপাস ইন আরগোস (১৯৭৯-৮৩) নামের সায়েন্স ফিকশন সিরিজ, মেমোয়ার্স অফ এ সার্ভাইভার (১৯৭৪), গুড টেররিস্টের কথা তো আগেই কওয়া হইছে, লাভ, এগেইন (১৯৯৬) এইসব। এইগুলা একটা আরেকটার চেয়ে অনেক আলাদা। আর জেন সমার্স নামে যে খেলাটা খেললেন, সেইটা নিয়া টমাস ফ্রিক-ই খুঁচায়া খুঁচায়া শুনছেন।
ফ্রিক এই ইন্টারভিউটা নিছিলেন ১৯৮৮ সালে, দ্য প্যারিস রিভিউ পত্রিকার জন্য। ইন্টারভিউয়ের এক জায়গায় লেসিং বলছেন, তার লেখা পইড়া পাঠক এক ধরণের গোসল দিয়া ওঠে, এইরকম ভাবতে তার ভালো লাগে। তার ইন্টারভিউ পইড়াই অনুবাদক ভালো একটা গোসল দিয়া উঠছে। লেখা পইড়া না জানি কী হবে।
অক্টেবর, ২০২৩
…
ডোরিস লেসিং-এর এই ইন্টারভিউটা নেওয়া হইছিলো ম্যানহ্যাটনের ইস্ট ফোর্টিজে, রবার্ট গটলেইবের বাসায়। ভদ্রলোক অনেকদিন ধরে নফ (Knopf) পাবলিকেশনে লেসিং-এর সম্পাদক ছিলেন। এখন উনি নিউ ইয়র্কারের এডিটর। ম্যানহ্যাটনে লেসিং আসছেন অল্প কয়দিনের জন্য, একটা কাস্টিং-এর কাজে। উনার ‘দ্য মেকিং অফ দ্য রিপ্রেসেন্টেটিভ ফর প্ল্যানেট এইট’ উপন্যাস নিয়া অপেরা বানাইতে চান ফিলিপ গ্লাস। সেখানে লিব্রেটো (libretto) লেখছেন ডোরিস (লিব্রেটো হইলো অপেরার গানের লিরিক্স)। এই অপেরার প্ল্যান খালি বদলাইতেছে। ইন্টারভিউটার সময় ঠিক করার জন্য বেশ কয়েকদফা পোস্টকার্ড চালাচালি করা লাগছে লেসিং-এর সাথে। উনি আবার বেশিরভাগ সময় পোস্টকার্ডে যোগাযোগ করেন, যেগুলা সাধারণত ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে নেওয়া।
টেপ রেকর্ডার রেডি করতে করতে লেসিং বলতেছিলেন, “একসারি বাড়ির পেছনে বাগান, তাও কি গ্যাঞ্জাম ভাবো একবার।” হাত তুলে রাস্তার ওইপাশে টাউন হাউজ দেখায়ে বললেন, ওইখানে ক্যাথরিন হেপবার্ন থাকে। এরপর কিছুক্ষণ শহর নিয়াই কথা হইলো। চল্লিশ বছর ধইরা লন্ডনে আছেন উনি, এরপরো মনে হয়, “শহরের সবকিছু সবসময়ই অসাধারণ!” আরেকখানে সে যা বলছিলো, তা আরেকটু বেশি কড়া, “ধরো যদি জানা যায়, বিল্ডিং-এর সাইজ আমাদের এমনে প্রভাবিত করে যে আমরা ভাবতেও পারি না, তাইলে আমি মোটেও অবাক হবো না।” বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগে ছয়মাস লন্ডনে ছিলেন ডোরিস, বলতেছিলেন, “আমার মনে হয় বাচ্চাদের নিয়া ঘুরাঘুরি করা উচিত। বাপ-মায়ের জন্য ঝামেলার হইলেও বাচ্চাদের জন্য বিষয়টা খুবই ভালো।”
ইন্টারভিউটা নেওয়া হয় বাগানের বারান্দায় বসে। কালো চুলগুলার মাঝে দুই একটা সাদা হয়ে গেছে। মাঝখানে সিঁথি করে সেগুলা পিছন দিকে খোপা করা। পরনে ছোটোখাটো স্কার্ট, ব্লাউজ আর জ্যাকেট। দেখতে বইয়ের কভারে থাকা ফোটোর মতোই লাগতেছিলো উনারে। ক্লান্ত কিছুটা, তা গত কিছুদিনের ব্যাপক ঘুরাঘুরির ফল। গলার স্বর তেজী আর সুরালো, একই সাথে তীক্ষ্ণ আর বিস্মিত, আকুল আর রসালো।
টমাস ফ্রিক
১৯৮৮
ইন্টারভিউয়ার: আপনি তো পারস্য দেশে জন্মাইছিলেন, যেইটা এখন ইরান। আপনার বাপ-মা ওইখানে গেছিলো কেমনে?
ডোরিস লেসিং: আমার আব্বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। যুদ্ধ শেষে উনি আর ইংল্যান্ডে থাকতে পারেন নাই। ওই দেশ তখন তার কাছে অনেক ছোটো মনে হইতো। যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের এতো বিশাল অভিজ্ঞতা হয় যে, এরপর তারা আর বাড়িতে টিকতে পারে নাই। তাই আব্বা তার ব্যাঙ্কের কাছে বলে তারে অন্য কোথাও পাঠায় দিতে। তো তারা তারে পারস্য পাঠায় দেয়। ওইখানে আমাদেরকে অনেক বড় একটা বাড়ি দেয়া হইছিলো, যেইখানে ঘরগুলাও ছিলো বিশাল। অনেক জায়গা ছিলো আশেপাশে। এমনকি চড়ার জন্য ঘোড়াও দিছিলো আমাদের। সককিছু অনেক খোলামেলা, অনেক সুন্দর ছিলো। আমি জাস্ট শুনলাম যে, ওই শহর এখন ভাইঙ্গা ফেলছে। ওইটা ছিলো একটা সময়ের স্মৃতি। ওইটা ছিলো অনেক পুরান পুরান বাজার আর সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং-এর শহর। কেউ খেয়ালই করলো না। এতো কিছু ভাংছে যে আমাদের আর খেয়াল করার টাইম নাই। তো তারপর তারে তেহরান পাঠানো হয়। ওইটা দেখতে খুব বাজে একটা শহর। তয় আমার মা সেইখানে অনেক ভালো ছিলো, কারণ সে একটা গ্রুপের সাথে মিশা শুরু করে। সেইটার নাম ছিলো “লেগেশন সেট’’। মা ওদের সাথে থাকা প্রতিটা সেকেন্ড খুব এনজয় করত। প্রতিরাতেই তাদের ডিনার পার্টি থাকতো। এরপর ১৯২৪ সালে আমরা ইংল্যান্ড ব্যাক করি। ওইখানে তখন এম্পায়ার এক্সিবিশন নামে এক মেলা চলতেছিলো (মাঝে মাঝেই গল্প উপন্যাসে এর নাম শোনা যায়) যেইটার একটা বিশাল বড় প্রভাব থাকার কথা সেইসময়। সেই মেলায় দক্ষিণ রোডেশিয়ার যে তাবু ছিলো, সেইখানে বিশাল বড় বড় যব, ভুট্টো এইসব সাজানো ছিলো। ওদের স্লোগানে “পাঁচ বছরে বড়লোক হয়ে যান” আর এইরকম অনেক হাবিজাবি লেখা ছিলো। এইগুলা দেখে আমার রোমান্টিক আব্বা ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করলো। যুদ্ধের সময় পায়ে আঘাত পাওয়ার জন্য উনি পেনশনের সামান্য কিছু টাকা পান – পাঁচ হাজার পাউন্ড মতো – সেইটা নিয়া উনি চললেন অজানা এক দেশে, কৃষক হওয়ার জন্য। Continue reading →