Main menu

ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ২)

[মীর মোশারফ হোসেন (১৮৪৭ – ১৯১১) এর কাহিনি “বিষাদ-সিন্ধু” ১৮৮৫, ১৮৮৭ ও ১৮৯১ সালে তিনটা পার্টে ছাপা হয়, পরে ১৮৯১ সালে একসাথে ছাপা হয়। ১৯৩৯ সালে ছাপা-হওয়া একটা এডিশন ফলো করা কইরা একটা শর্ট-ভার্সন এইখানে হাজির করতেছি আমরা।]

এক

মহরম পর্ব

প্রথম প্রবাহ: এজিদের বাসনা

“তুমি আমার একমাত্র পুত্র। এই অতুল বিভব, সুবিস্তৃত রাজ্য এবং অসংখ্য সৈন্যসামন্ত সকলই তোমার। দামেস্ক-রাজমুকুট অচিরে তোমারই শিরে শোভা পাইবে। বল তো তোমার কিসের অভাব? কী মনস্তাপ?… তুমি সর্বদাই মলিন ভাবে বিষাদিত চিত্তে বিকৃতমনার ন্যায় অযথা চিন্তায় অযথাস্থানে ভ্রমণ করিয়া দিন দিন ক্ষীণ ও মলিন হইতেছ। আমি পিতা হইয়া মনের বেদনায় আজ তোমার হস্তধারণ করিয়া বলিতেছি সকল কথা মন খুলিয়া আমার নিকট কি জন্য প্রকাশ কর না?” মাবিয়া নির্জনে নির্বেদসহকারে এজিদ্‌কে জিজ্ঞাসা করিলেন।

এজিদ্ দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক বলিতে অগ্রসর হইয়াও কোন কথা বলিতে পারিলেন না; কণ্ঠরোধ হইয়া জিহ্বায় জড়তা আসিল। যদিও বহু কষ্টে ‘জয়’ শব্দটি উচ্চারণ করিলেন, কিন্তু সে শব্দ মাবিয়ার কর্ণগোচর হইল না। এজিদ্ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “পিতঃ! আমার দুঃখ অনন্ত। এ দুঃখের সীমা নাই, উপশমের উপায় নাই। আর অধিক বলিতে পারিতেছি না, ক্ষমা করিবেন।”

এই কথা শেষ হইতে-না-হইতেই বৃদ্ধা মহিষী একগাছি সূবর্ণ-যষ্টি-আশ্রয়ে ঐ নির্জন গৃহমধ্যে আসিয়া এক পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইলেন। এজিদ্ শশব্যস্তে উঠিয়া জননীর পদচুম্বন করিয়া পিতার পদধূলি গ্রহণান্তর সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

দামেস্কাধিপতি মহিষীকে অভ্যর্থনা করিয়া অতি যত্নে মস‌নদের পার্শ্বে বসাইয়া বলিতে লাগিলেন, “মহিষী! তোমার কথাক্রমে আজ বহু যত্ন করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারিলাম না; মনের কথা কিছুতেই ভাঙ্গিল না। পরিশেষে আপনিও কাঁদিল, আমাকেও কাঁদাইল।”

রাজমহিষী অতি কষ্টে মস্তক উত্তোলন করিয়া কম্পিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “মহারাজ! আমি অনেক সন্ধানে জানিয়াছি, আর এজিদ্ও আপনার নিকটে আভাসে বলিয়াছে। আবদুল জাব্বারকে বোধ হয় আপনি জানেন? সেই আবদুল জব্বারের স্ত্রী’র নাম জয়না। সেই জয়নাবকে দেখিয়াই এজিদ্ পাগল হইয়াছে। আমার নিকট কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, মা, যদি আমি জয়নাবকে না পাই, তবে আর আমাকে দেখিতে পাইবেন না।”

একটু সরোষে মাবিয়া কহিলেন, “মহিষী! তুমি আমাকে কী করিতে বল? তুমি আর ও-কথা বলিয়া আমার কর্ণকে কলুষিত করিয়ো না। আপনার জিহ্বাকে ও পাপকথায় অপবিত্র করিয়ো না। ভাবিয়া দেখ দেখি, ধর্ম-পুস্তকের উপদেশ কি? পরস্ত্রীর প্রতি কুভাবে যে একবার দৃষ্টি করিবে, কোন প্রকার কুভাবের কথা মনোমধ্যে যে একবার উদিত করিবে, তাহারও প্রধান নরক ‘জাহান্নামে’ বাস হইবে। ইহা কী একবারও এজিদের মনে হয় না? প্রজার ধন, প্রাণ, মান, জাতি, এ সমুদয়ের রক্ষাকর্তা রাজা। রাজার কর্তব্যকর্মই তাহা। এই কর্তব্যে অবহেলা করিলে রাজাকে ঈশ্বরের নিকট দায়ী হইতে হয়।  ঈশ্বরের বাক্য-লঙ্ঘন করিয়া মাবিয়া কি মহাপাপী হইবে? তুমি কি তাহা মনে কর মহিষী? আমার প্রাণ থাকিতে তাহা হইবে না, মাবিয়া জগতে থাকিতে তাহা ঘটিবে না-কখনোই না।”

বৃদ্ধা মহিষী একটু অগ্রসর হইয়া মহারাজের হস্ত দৃঢ়রূপে ধারণ করিয়া কাতরভাবে বলিতে লাগিলেন, “দেখুন মহারাজ! এজিদ্ যে ফাঁদে পড়িয়াছে, সে ফাঁদে জগতের অনেক ভাল ভাল লোক বাঁধা পড়িয়াছেন। শত শত মুনি-ঋষি, ঈশ্বরভক্ত, কত শত মহাতেজস্বী জিতেন্দ্রিয় মহাশক্তিবিশিষ্ট মহাপুরুষ এই ফাঁদে পড়িয়া তত্ত্বজ্ঞান হারাইয়াছেন, তাহার সংখ্যা নাই। আসক্তি, প্রেম ও ভালবাসার কথা ধর্মপুস্তকেও রহিয়াছে। ইহাতে এজিদের দোষ কি বলুন দেখি? এই নৈসর্গিক কার্য নিবারণ করিতে এজিদের কি ক্ষমতা আছে? না আমার ক্ষমতা আছে? না আপনারই ক্ষমতা আছে? যাহাই বলুন মহারাজ! ভালবাসার ক্ষমতা অসীম!”

মাবিয়া বলিলেন, “আমাকে তুমি কি করিতে বল?”

মহিষী বলিলেন, “আর কি করিতে বলিব। যাহাতে ধর্ম রক্ষা পায়, লোকের নিকটেও নিন্দনীয় না হইতে হয় অথচ এজিদের প্রাণরক্ষা পায়, এমন কোন উপায় অবলম্বন করাই উচিত।

আপনাকে কিছুই করিতে হইবে না, কিছু বলিতেও হইবে না, কিন্তু কোন কার্যে বাধা দিতেও পারিবেন না। মারওয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াই আমি সকল কার্য করিব। ধর্মবিরুদ্ধ, ধর্মের অবমাননা কী ধর্মোপদেষ্টার আজ্ঞা লঙ্ঘনের অণুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতে পান, বাধা দিবেন, আমরা ক্ষান্ত হইব।”

প্রবাহ ২: পদমর্যাদার এমনই কুহক!

মহারাজের সহিত মহিষীর পরামর্শ হইল। এজিদ্ও কথার সূত্র পাইয়া তাহাতে নানাপ্রকার শাখা-প্রশাখা বাহির করিয়া বিশেষ সতর্কতার সহিত আবদুল জাব্বারের নিকট ‘কাসেদ্’ প্রেরণ করিলেন।

আবদুল জাব্বার ভদ্রবংশসম্ভূত, অবস্থাও মন্দ নহে; স্বচ্ছন্দে ভদ্রতা রক্ষা করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতে পারিতেন; তজ্জন্য পরের স্বারস্থ হইতে হইত না; তাঁহার ধনলিপ্সা অত্যন্ত প্রবল ছিল। তাহার একমাত্র স্ত্রী জয়নাব, স্বামীর অবস্থাতেই পরিতৃপ্তা ছিলেন, কোন বিষয়েই তাঁহার উচ্চ আশা ছিল না। যে অবস্থাতেই হউক, সতীত্বধর্ম পালন করিয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করাই তাঁহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল। ধর্মচিন্তাতেও তিনি উদাসীন ছিলেন না। আবদুল জাব্বার সুশ্রী পুরুষ না হইলেও তাঁহার প্রতি তিনি ভক্তিমতী ছিলেন। ভ্রমেও ধর্মপথ হইতে এক পদ বিচলিত হইতেন না। বলিতেন, ঈশ্বর যে অবস্থায় যাহাকে রাখিয়াছেন, তাহাতেই পরিতৃপ্ত হইয়া কায়মনে তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা কর্তব্য। পরের ধন, রূপ, দেখিয়া নিজ অদৃষ্টকে ধিক্কার দেওয়া বুদ্ধিমানের কর্তব্য নহে। স্ত্রীর কথায় আবদুল জাব্বার কোন উত্তর করিতেন না, কিন্তু কথাগুলি বড় ভাল বোধ হইত না। তিনি সর্বদাই অর্থচিন্তায় ব্যস্ত থাকিতেন; ব্যবসায় বাণিজ্য যখন যাহা সুবিধা মনে করিতেন, তখন তাহাই অবলম্বন করিতেন; নিকটস্থ বাজারে অন্যান্য ব্যবসায়িগণের নিকট প্রায় সর্বদা উপস্থিত থাকিয়া অর্থোপার্জনের পথ অনুসন্ধান করিতেন। কেবল আহারের সময় বাটী আসিতেন। আহার করিয়া পুনরায় কার্যস্থানে গমন করিতেন।

ব্যবসায়ের সাহায্যকারী অথচ নিকট-আত্মীয় ওস্‌মান অতি ব্যস্তভাবে আসিয়া বলিলেন, “আবদুল জাব্বার! দামেস্ক হইতে একজন কাসেদ্ আসিয়াছে-অত্যন্ত ব্যস্ত, অতিশয় পরিশ্রান্ত, অতিশয় ক্লান্ত। সেই লোক তোমাকেই অন্বেষণ করে। তোমার বাসস্থানের অনুসন্ধান না পাইয়া অনেক ঘুরিয়াছে। শুনিলাম, তাহার নিকট দামেস্কাধিপতির আদেশপত্র আছে।” ওস্‌মানের মুখে এই কথা শুনিয়া আবদুল জাব্বার শশব্যস্তে বাটীর বাহিরে আসিলেন। কাসেদ্ ঈশ্বরের গুণানুবাদ করিয়া দামেস্কাধিপতির বন্দনার পর অতি বিনীতভাবে আবদুল জাব্বারের হস্তে শাহীনামা প্রদান করিলেন।

তাহাতে লিখিত আছে-

“সম্ভ্রান্ত আবদুল জাব্বার!

তোমাকে জানান যাইতেছে যে, দামেস্কাধিপতি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে স্মরণ করিয়াছেন। অবিলম্বে রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া রাজপ্রসাদলাভে সৌভাগ্য জ্ঞান কর।

প্রধান উজির-
মারওয়ান।”

আবদুল জাব্বার এতৎপাঠে মহাসৌভাগ্য জ্ঞান করিয়া জয়নাবকে কহিলেন, “আমি এখনই দামেস্কনগরে যাত্রা করিব। আমি এমন কী পুণ্য কার্য করিয়াছি যে, স্বয়ং বাদশাহ আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। ঈশ্বর জানেন, ভবিষ্যতে কী আছে।”

আবদুল জাব্বার ব্যতিব্যস্ত হইয়া রাজধানী গমনের উদ্যোগী হইলেন। আত্মীয়-স্বজন এবং সাধারণ প্রতিবেশীগণের নিকট ও জয়নাবের সমক্ষে বিনয়নম্রভাবে বিদায় গ্রহণ করিলেন। জয়নাবের চক্ষু দুটি বাষ্প-সলিলে পরিপূর্ণ হইল। মনের উল্লাসে আবদুল জাব্বার তৎকালে এতদূর বিহ্বল হইয়াছিলেন যে, যাত্রাকালে প্রিয়তমা জয়নাবকে একটিও মনের কথা বলিয়া যাইতে মনে হইল না। সামান্যতঃ বিদায় গ্রহণ করিয়াই ত্বরিতগতিতে রাজদর্শনে যাত্রা করিলেন।

পদমর্যাদার এমনই কুহক!

প্রবাহ ৩: তালাকনামা

মারওয়ান্ যদিও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু এজিদের বুদ্ধি, বল, সহায়, সাহস যত কিছু কার্য সকলই মারওয়ান্। প্রধানমন্ত্রী হামান কেবল রাজকার্য ব্যতীত সাংসারিক অন্য কোন কার্যে মারওয়ানের মতে বাধা দিতে পারিতেন না; কারণ তিনি এজিদের প্রিয়পাত্র। সকল সময়েই সকল বিষয়েই মারওয়ানের সহিত এজিদের পরামর্শ হইত। সে পরামর্শের সময় অসময় ছিল না। কি পরামর্শ তাহা তাঁহারাই জানিতেন।

মারওয়ান বলিলেন, “রাজকুমার! মহারাজ বর্তমান না থাকিলে আপনাকে কখনোই এত কষ্ট পাইতে হইত না।”

এজিদ্ বলিলেন, “পুত্রের স্বাধীনতা কোথায়? কী করি, পিতা বর্তমানে পিতার অমতে কোন কার্যে অগ্রসর হওয়া পুত্রের পক্ষে অনুচিত। আমি হাসান-হোসেনের ভক্ত নহি শাহজাদা বলিয়া মান্য করি না, তাহাদের আনুগত্য স্বীকার করি না; নতশিরে তাহাদের নামে দণ্ডবৎ করি না; সেইজন্যই পিতা মহাবিরক্ত। আবার অন্যায় বিচারে একজনের প্রাণবধ করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করিতে সাহস হয় না, ইচ্ছাও করে না। একটা গুরুতর পাপভার মাথায় বহন করিবারই বা প্রয়োজন কী? নরহত্যা মহাপাপ।”

হঠাৎ সাদিয়ানা বাদ্য বাজিয়া উঠিল। উভয়ে একটু ত্রস্তভাবে দরবার-অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। পথে কাসেদের সহিত দেখা হইল। কাসেদ্ সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিয়া নিবেদন করিলেন, “রাজাদেশ প্রতিপালিত হইয়াছে। আবদুল জাব্বার সমাদরে গৃহীত হইয়াছেন। মহারাজ আম-দরবার বরখাস্ত করিয়া আবদুল জাব্বারের সহিত খোশমহলে বার দিয়াছেন।” এই কথা বলিয়া কাসেদ্ পুনরায় অভিবাদন পূর্বক যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন।

এজিদ্ মারওয়ানের সহিত আনন্দমহলে উপস্থিত হইয়া মহারাজকে অভিবাদন করিলেন এবং রাজাজ্ঞাপ্রাপ্তিক্রমে নির্দিষ্ট স্থানে উপবেশন করিয়া আবদুল জাব্বারের সহিত মহারাজের কথোপকথন শুনিবার অপেক্ষায় উৎসুক রহিলেন।

পুত্রের পরামর্শমত এজিদের জননী স্বামীর নিকট যাহা বলিয়াছিলেন, যে প্রকার কথার প্রস্তাব করিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন, মাবিয়া অবিকল সেইরূপ বলিতে লাগিলেন, “আবদুল জাব্বার! আমার ইচ্ছা তোমাকে আমি সর্বদা আমার নিকট রাখি। আমার ইচ্ছা যে, তোমাকে নিশ্চিন্তভাবে রাজপরিবারের মধ্যে রাখিয়া দিই।”

করজোড়ে আবদুল জাব্বার বলিলেন, “আমি দাসানুদাস আজ্ঞাবহ ভৃত্য। যাহা আদেশ করিবেন, শিরোধার্য করিয়া প্রতিপালন করিব। আমার নিতান্ত সৌভাগ্য যে, আমি আমার আশার অতিরিক্ত আদৃত হইয়া রাজসমীপে উপবেশনের স্থান পাইয়াছি।”

মাবিয়া বলিলেন, “আবদুল জাব্বার! আমার মনোগত অভিপ্রায় প্রধান উজির মারওয়ানের মুখে শ্রবণ করিয়া তোমার প্রতিজ্ঞা পালন কর। আমার উপাসনার সময় অতীত প্রায়, আমি আজিকার মত বিদায় হইলাম।”

এই কথা বলিয়া মাবিয়া খোশমহল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

মন্ত্রী মারওয়ান্ বাদশাহের প্রতিনিধিস্বরূপ বলিতে লাগিলেন, “মাননীয় আবদুল জাব্বার সাহেব! আমাদের ইচ্ছা ছিল যে, রাজসংসার হইতে রাজোচিত আপনার নিত্য নিয়মিত ব্যয়োপযোগী সম্পত্তি প্রদানপূর্বক অদ্বিতীয় রূপযৌবনসম্পন্না বহুগুণবতী নিষ্কলঙ্কচন্দ্রাননা মহামাননীয়া-রাজকুমারী সালেহার সহিত শাস্ত্রসঙ্গত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করিয়া এই দামেস্কনগরে আপনাকে স্থায়ী করি। ইহাতে আপনার মত কি?”

কর্ণে এই কথা প্রবেশ করিবামাত্র আবদুল জাব্বার মনের আনন্দে বিভ্রান্ত হইয়া কিছুই উত্তর করিতে পারিলেন না। এজিদের ভগ্নী সালেহার পাণিগ্রহণ করিবেন, স্বাধীনভাবে ব্যয়বিধান জন্য সম্পত্তিও প্রাপ্ত হইবেন, ইহা অপেক্ষা সুখের বিষয় আর কি আছে? জীবনে যাহা তিনি আশা করেন নাই, স্বপ্ন যে অমূলক চিন্তা, স্বপ্নেও কোন দিন যাহা উপদেশ পান নাই, অভাবনীয়রূপে আজ তাহাই তাঁহার ভাগ্যে ঘটিল? ঈশ্বর সকলই করিতে পারেন। মন্ত্রীমুখে এই বাক্য শ্রবণ করিয়া আবদুল জাব্বার যেন ক্ষণকালের জন্য আত্মহারা হইলেন! তখনই সম্মতিসূচক অভিপ্রায় জানাইতেন, কিন্তু হর্ষবিহ্বলতা আশু তাঁহার বাক্শক্তি হরণ করিল। ক্ষণকাল পরে বলিলেন, “মন্ত্রীবর। আমার পরম সৌভাগ্য! রাজাদেশ শিরোধার্য।”

মারওয়ান্ বলিলেন, “আপনার অঙ্গীকারে আমরাও পরমানন্দ লাভ করিলাম; সমস্তই প্রস্তুত, এখনই এই সভায় এই শুভলগ্নে শুভকার্য সুসম্পন্ন হউক।”

পূর্ব হইতেই এজিদ্ সমস্ত প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছেন। মারওয়ান্‌কে ইঙ্গিত করিবামাত্র পুরোহিত, অমাত্যবর্গ, পরিজনবর্গ সকলেই একসঙ্গে উপস্থিত হইলেন। মঙ্গলবাদ্য বাজিতে লাগিল। পুরোহিতের আদেশ মত এজিদ্ পাত্রীপক্ষের প্রতিনিধি সাব্যস্ত হইলেন; মারওয়ান্ এবং আবদুর রহমান সাক্ষী হইলেন।

পাত্রীর সম্মতিসূচক স্বীকারবাক্য স্বকর্ণে শ্রবণ করিবার জন্য প্রতিনিধি মহাশয় সাক্ষীসহ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁহারা সভায় প্রত্যাগত হইয়া জাতীয় রীত্যনুসারে সভাস্থ সভ্যগণকে অভিবাদনপূর্বক কহিলেন, “বিবি সালেহা এ বিষয়ে অসম্মত নহেন; কিন্তু তাঁহার একটি কথা আছে। সে কথা এই যে, তিনি পরম্পরায় শুনিয়াছেন, এই মাননীয় সম্ভ্রান্ত আবদুল জাব্বার সাহেবের জয়নাব নামে আর একটি স্ত্রী আছেন, ধর্মশাস্ত্রানুসারে জয়নাবকে না পরিত্যাগ করিলে তিনি এ বিবাহে সম্মতিদান করিতে পারেন না।” আরো তিনি বলিলেন, “জয়নাবের কত দেহমোহরের জন্য আবদুল জাব্বার দায়ী তাহার পরিমাণ তিনি জানিতে চাহেন না, তদতিরিক্ত জয়নাবের ভরণপোষণের জন্য আরো সহস্র মুদ্রা প্রদানে তিনি প্রস্তুত আছেন।”

যেমনি প্রশ্ন তেমিন উত্তর। আবদুল জাব্বার বলিলেন, “আমি সম্মত আছি। মুখের কথা কেন, তালাকনামা এখনই লিখিয়া দিতেছি।”

লেখনী ও কাগজ সকলই প্রস্তুত ছিল, আবদুল জাব্বার প্রথমে পরমেশ্বরের নাম, পরে প্রভু মোহাম্মদের নাম লিখিয়া পতিপরায়ণা নিরপরাধিনী সাধ্বী সহধর্মিণী জয়নাবকে তালাক দিলেন। সভাস্থ অনেক মহোদয় সাক্ষী শ্রেণীতে স্ব-স্ব নাম-ধাম স্বাক্ষর করিলেন। প্রতিনিধির হস্ত দিয়া সেই তালাকনামাখানি সালেহার নিকট প্রেরিত হইল।

প্রতিনিধি ফিরিয়া আসিলেন। পূর্ব রীত্যনুসারে সভাস্থ সকলকেই পুনরাভিবাদন করিয়া বলিলেন,- “এ সভায় রাজমন্ত্রী, রাজসভাসদ, রাজপরিষদ্, রাজাত্মীয়, রাজহিতৈষী, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং বহুদর্শী ব্যক্তিগণ সকলেই উপস্থিত আছেন। সালেহা বিবি যাহা বলিলেন, ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ জানিয়া আমি তাহা অবিকল বলিতেছি, আপনারা মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করুন।-

‘যে ব্যক্তি ধনলোভে কী রাজ্যলোভে, কী মানসম্ভ্রম বৃদ্ধির আশয়ে নিরপরাধিনী সহধর্মিণীকে পরিত্যাগ করিতে পারে, বহুকালের প্রণয় ও ভালবাসা যে ব্যক্তি এক মুহূর্তে ভুলিতে পারে, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ দাম্পত্য প্রণয়ের বন্ধন-রজ্জু অকাতরে ছিন্ন করিতে পারে, তাহাকে বিশ্বাস কী? তাহার কথায় আস্থা কী? তাহার মায়ায় আশা কী? এমন বিশ্বাসঘাতক স্ত্রীবিনাশক অর্থলোভী নরপিশাচের পাণিগ্রহণ করিতে সালেহা বিবি সম্মত নহেন।’”

সভাস্থ সকলেই রাজকুমারীর বুদ্ধি ও বিবেচনার প্রশংসা করিতে লাগিলেন। আবদুল জাব্বারের মস্তকে যেন সহস্র অশনির সহিত আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। তাঁহার আকাশ-কুসুমের আমূল চিন্তাবৃটি এককালে নির্মূল হইয়া গেল। প্রতিনিধির বাক্য-বজ্রাঘাতে সুখ-স্বপ্ন-তরু দগ্ধীভূত হইল, পরিচারকগণ রাজকুমারীর অঙ্গীকৃত অর্থ আবদুল জাব্বারের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল। আবদুল জাব্বার তাহা গ্রহণ করিলেন না, কাহাকেও কিছু না বলিয়া সভাভঙ্গের গোলযোগে রাজভবন হইতে বহির্গত হইয়া রাজদত্ত পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করিলেন এবং ফকিরের বেশ ধারণ করিয়া বনে বনে, নগরে নগরে, বেড়াইতে লাগিলেন; গৃহে আর প্রতিগমন করিলেন না।

কথা গোপন থাকিবার নহে। আবদুল জাব্বারের সঙ্গীরা ফিরিয়া যাইবার পূর্বেই তাঁহার আবাসপল্লীতে উক্ত ঘটনা রাষ্ট্র হইয়াছিল। মূল কথাগুলি নানা অলঙ্কারে বর্ধিত-কলেবর হইয়া বাতাসের অগ্রে অগ্রে ছুটিয়া জয়নাবকে এবং প্রতিবেশিগণকে মহা দুঃখিত করিয়াছিল। তখন পর্যন্তও নিশ্চিত সংবাদ কেহই পান নাই। অনেকেই বিশ্বাস করেন নাই। সেই অনেকের মধ্যে জয়নাবও একজন। আবদুল জাব্বারের সঙ্গিগণ বাটিতে ফিরিয়া আসিলে সন্দেহ দূর হইল। জয়নাবের আশা-তরী বিষাদ-সিন্ধুতে ডুবিয়া গেল। জয়নাব কাহাকেও কিছু বলিলেন না, কেবল তাঁহার পিতাকে সংবাদ দিয়া অতি মলিন-বেশে দুঃখিত হৃদয়ে পিত্রালয়ে গমন করিলেন।

প্রবাহ ৪: বিবাহ-পয়গাম

পথিক ঊর্ধ্বশ্বাসে চলিতেছেন, বিরাম নাই। মুহূর্তকালের জন্য বিশ্রাম নাই। এজিদ্ গোপনে বলিয়া দিয়াছেন, যখন নিতান্ত ক্লান্ত হইবে, চলৎ-শক্তি রহিত হইবে, ক্ষুধা পিপাসায় কাতর হইয়া পড়িবে, সেই সময় একটু বিশ্রাম করিয়ো। কিন্তু বিশ্রামহেতু সময়টুকু অপব্যয় হইবে, বিশ্রামের পর দ্বিগুণ বেগে চলিয়া তাহা পরিপূর্ণ করিবে। পথিক এজিদের আজ্ঞা লঙ্ঘন না করিয়া অবিশ্রান্ত যাইতেছেন। কয়েকদিন পর্যন্ত অবিশ্রান্ত চলিয়া এক্ষণে অনেক দুর্বল হইয়া অতি কষ্টে যাইতেছেন। নির্দিষ্ট পর্বতের নিকটস্থ হইলে পূর্ব পরিচিত আক্কাস ও তৎসহ কয়েকজন অনুচরের সহিত দেখা হইল।

মোস্‌লেমকে দেখিয়া আক্কাস জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভাই মোস্‌লেম! কোথায় যাইতেছ?” মোস্‌লেম উত্তর করিলেন, “পিপাসায় বড়ই কাতর, অগ্রে পিপাসা-নিবৃত্তি করি, পরে আপনার কথার উত্তর দিতেছি।”

আক্কাস বলিলেন, “জল নিকটেই আছে। ঐ কয়েকটি খর্জুর বৃক্ষের নিকট দিয়া সুশীতল নির্ঝরিণী অতি মৃদু মৃদু ভাবে বহিয়া যাইতেছে। চল ঐ খর্জুর-বৃতলে বসিয়া সকলেই একটু বিশ্রাম করি, আমিও কয়েকদিন পর্যন্ত অত্যন্ত ক্লান্ত হইতেছি।”

সকলে একত্র হইয়া সেই নির্দিষ্ট খর্জুর-বৃতলে উপবেশন করিলেন। আক্কাস একখণ্ড প্রস্তর ভূমি হইতে উঠাইয়া, তত্তলস্থ ঝর্ণার সুস্নিগ্ধ জলে জলপাত্র পূর্ণ করিয়া এবং থলিয়া হইতে কতকগুলি র্খোমা বাহির করিয়া মোস্‌লেমের সম্মুখে রাখিয়া দিলেন। মোস্‌লেম প্রথমে জলপান করিয়া কথঞ্চিৎ সুস্থ হইলেন। দুই একটি র্খোমা মুখে দিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভাই আক্কাস! এজিদের বিবাহ-পয়গাম লইয়া আমি জয়নাবের ভবনে যাত্রা করিতেছি।”

আক্কাস জিজ্ঞাসিলেন, “কত দিন আবদুল জাব্বার জয়নাবকে পরিত্যাগ করিয়াছে?

“অতি অল্প দিন মাত্র।”

“বোধ হয়, এখন ইদ্দত্ সময় উত্তীর্ণ হয় নাই?”

“প্রস্তাবে তো আর কোন বাধা নাই। ইদ্দত্ সময় উত্তীর্ণ হইলেই শুভকার্য সম্পন্ন হইবে।”

“ভাই মোস্‌লেম! আমিও তোমাকে আমার পক্ষে উকীল নিযুক্ত করিলাম। জয়নাবের নিকট প্রথমে এজিদের প্রস্তাব, শেষে আমার প্রার্থনার বিষয়ও প্রকাশ করিয়ো। রাজভোগ পরিত্যাগ করিয়া যে আমার প্রার্থনা গ্রাহ্য করিবে, যদিও ইহা সম্ভব নহে, তথাপি ভুলিয়ো না। দেখ ভাই! আশাতেই সংসার, আশাতেই সুখ এবং আশাতেই জীবন, আশা কাহারই কম নহে। আমার কথা ভুলিয়ো না। জয়নাব রূপলাবণ্যে দেশবিখ্যাত, পুরুষমাত্রেরই চক্ষু জয়নাবরূপে মোহিত; স্বভাব, চরিত্র, ধীরতা এবং নম্রতাগুণে জয়নাব সকলের নিকটেই সমাদৃত; তাহা আমি বেশ জানি। এ অবস্থাতেও বোধ হয় আমার আশা দুরাশা নহে। যাহাই হউক, আমার প্রার্থনা জয়নাবের নিকট অবশ্যই জানাইও।”

এইরূপ কথোপকথনের পর পরস্পর অভিবাদন করিয়া উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়া গেলেন। মোস্‌লেম কিছুদূর যাইয়া দেখিলেন, মাননীয় ইমাম হাসান সশস্ত্র মৃগয়ার্থ বহির্গত হইয়াছেন।

শাহজাদা হাসান বলিলেন, “ভাই কোথায় যাইতেছ?”

“এজিদের পরিণয়ের পয়গাম জয়নাবের নিকট লইয়া যাইতেছি। হজরত মাবিয়ার আদেশ, যত শীঘ্র হয়, জয়নাবের অভিপ্রায় জানিয়া সংবাদ দিতে হইবে।”

“এজিদ্ যে কৌশলে এই ঘটনা ঘটাইয়াছে, তাহা সকলই আমি শুনিয়াছি। হজরত মাবিয়া যে যে কারণে এজিদের কার্যের প্রতিপোষকতা করিয়াছেন, তাহাও জানিয়াছি। অথবা মাবিয়া যে ঐ সকল ষড়যন্ত্রের মূল বৃত্তান্ত ঘুণাক্ষেরও অবগত নহেন, তাহাও আমার জানিতে বাকি নাই।”

“আক্কাসও জয়নাবের প্রার্থী। বিশেষ অনুনয় করিয়া এমন কি, ঈশ্বরের শপথ দিয়া তিনি বলিয়াছেন, অগ্রে এজিদের প্রস্তাব করিয়া পরিশেষে আমার প্রস্তাবটি করিয়ো। এজিদ্ এবং আক্কাস, উভয়েরই পয়গাম লইয়া আমি জয়নাবের নিকট যাইতেছি। তিনি যে কাহার প্রস্তাব গ্রাহ্য করিবেন, তাহা ঈশ্বরই জানেন।”

হাস্য করিয়া হাসান কহিলেন, “মোস্লেম! আক্কাসের প্রস্তাব লইয়া যাইতে যখন সম্মত হইয়াছ, তখন এ গরীবের কথাটিই বা বাকি থাকে কেন? আমিও তোমাকে উকীল নিযুক্ত করিলাম। সকলের শেষে আমার প্রার্থনাটিও জয়নাবকে জ্ঞাপন করিও। স্ত্রী-জাতি প্রায়ই ধনপিপাসু হয়, আবার কেহ কেহ রূপেরও প্রত্যাশী হইয়া থাকে। আমার না আছে ধন, না আছে রূপ। এজিদের তো কথাই নাই; আক্কাসও যেমন ধনবান, তেমনি রূপবান; অবশ্যই ইহাদের প্রার্থনা অগ্রগণ্য! জয়নাব-রত্ন ইহাদেরই হৃদয়ভাণ্ডারে থাকিবার উপযুক্ত ধন। সে ভাণ্ডারে যত্নের ত্রুটি হইবে না, আদরেরও সীমা থাকিবে না। যদিও আমি মদিনার সিংহাসনে উপবেশন করিয়াছি, কিন্তু ধরিতে গেলে আমি ভিখারী। আমার গৃহে ঈশ্বরের উপাসনা ব্যতীত কোন প্রকার সুখবিলাসের আশা নাই। সকলের শেষে আমার এই প্রস্তাব জয়নাবকে জানাইতে ভুলিয়ো না। মনে রাখিয়ো। ফিরিয়া যাইবার সময় যেন জানিতে পারি যে, জয়নাব কাহার প্রার্থনা মঞ্জুর করিলেন।”

এই বলিয়া পরস্পর অভিবাদনপূর্বক উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিকে গমন করিলেন। পথিক যাইতেছেন।  চিন্তারও বিরাম নাই, গতির বিশ্রাম নাই।

প্রবাহ ৫: জয়নাবের জবাব

পতিবিয়োগে নারীজাতিকে চারি মাস দশ দিন বৈধব্যব্রত প্রতিপালন করিতে হয়। জয়নাব শাস্ত্রসঙ্গত বৈধব্য অবস্থায় দিনযামিনী যাপন করিতেছেন। এত মলিনভাব, তথাচ তাঁহার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও রূপমাধুর্যে মানুষমাত্রেই বিমোহিত।

মোস্‌লেম যথাসময়ে জয়নাবের ভবনে উপস্থিত হইলেন। জয়নাব পিতার বর্তমানে ও দেশীয় প্রথানুসারে এবং শাস্ত্রসঙ্গত স্বাধীনভাবেই মোস্‌লেমের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন। তাঁহার পিতা অদূরে দণ্ডায়মান থাকিয়া উভয়ের কথোপকথন আকর্ষণ করিতে লাগিলেন।

মোস্‌লেম বলিলেন, “যে উদ্দেশ্যে আমি দৌত্য কর্মে নিযুক্ত হইয়া আসিয়াছি, একে একে নিবেদন করি, শ্রবণ করুন। যদিও আপনার বৈধব্যব্রত আজ পর্যন্ত শেষ হয় নাই, কিন্তু প্রস্তাবে অধর্ম নাই। আমাদের দামেস্কাধিপতি হজরত মাবিয়ার বিষয় আপনার অবিদিত কিছুই নাই; তাঁহার রাজ-ঐশ্বর্য সকলই আপনি জ্ঞাত আছেন, সেই দামেস্কাধিপতির একমাত্র পুত্র এজিদের বিবাহ পয়গাম লইয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। যিনি এজিদ্কে স্বামিত্বে বরণ করিবেন, তিনিই দামেস্করাজ্যের পাটরাণী হইবেন।

পথে আসিতে আসিতে প্রভু মোহাম্মদের প্রিয় পারিষদ আক্কাস আমাকে কহিলেন, তিনিও আপনার প্রার্থী। ঈশ্বর তাঁহাকে সৃষ্টি করিয়া পুরুষ জাতির সৌন্দর্যের অতুল আদর্শ দেখাইয়াছেন। তিনি অতুল বিভবের অধীশ্বর। তিনিও আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন।

অধিকন্তু প্রভু মোহাম্মদের কন্যা বিবি ফাতেমার গর্ভজাত হজরত আলীর ঔরস-সম্ভূত-পুত্র মদিনাধিপতি হজরত হাসানও আপনার প্রার্থী কিন্তু এজিদের ন্যায় তাঁহার ঐশ্বর্য সম্পদ নাই, সৈন্য সামন্ত নাই, উজ্জ্বল রাজপ্রাসাদও নাই। এই সকল বিষয়ে সম্ভ্রমসম্পদশালী এজিদের সহিত কোন অংশেই তাঁহার তুলনা হয় না। তাঁহার দ্বারা ইহকালের সুখ সম্ভোগের কোন আশাই নাই, অথচ সেই হাসান আপনার প্রার্থী। এই আমার শেষ কথা। বিন্দুমাত্রও আমি গোপন করিলাম না-কিছুমাত্র অত্যুক্তি করিলাম না। এক্ষণে আপনার যেরূপ অভিরুচি।”

আদ্যোপান্ত সমস্ত শ্রবণ করিয়া জয়নাব অতি মৃদুস্বরে সুমধুর সম্ভাষণে বলিলেন, “আজ পর্যন্ত আমার বৈধব্যব্রত সম্পন্ন হয় নাই। ব্রতাবসানে অবশ্যই আমি স্বামী গ্রহণ করিব। কিন্তু এ সময় যে বিষয়ে আলোচনা করিলেও আমার মনে মহা কষ্টের উদ্রেক হয়। ঈশ্বর যে উদ্দেশ্যে আমাকে সৃজন করিয়াছেন, সে উদ্দেশ্যের গুহ্য কারণ কেবল তিনিই জানেন। আমি তাঁহার যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপকরণ, তাহা আমার জানিবার বা বুঝিবার ক্ষমতা নাই। আমি ক্ষুদ্র জীব, আমি কেন-অনেকে আপন আপন মূল্যের পরিমাণ বুঝিতে অক্ষম। …জীবন কয় দিনের? জীবনের আশা কী? এই চক্ষু মুদ্রিত হইলেই সকল আশা-ভরসা ফুরাইয়া যাইবে। …স্থূল কথা, বিষয়বিভব, রাজপ্রাসাদ এবং রাজভোগের লোভী আমি নহি। সে লোভ এ জীবনে কখনোই হইবে না। মনের কথা আজ অকপটে আপনার নিকট বলিলাম।”

মোস্‌লেম কহিলেন, “ইহাতে তো আপনার মনোগত ভাব স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম না?”

“ইহা অপেক্ষা স্পষ্ট আর কি হইতে পারে? প্রভু হজরত মোহাম্মদের দৌহিত্র, তিনি যখন জয়নাবকে চাহিয়াছেন, তখন জয়নাবের স্বর্গসুখ ইহকালেই সমাগত। পাপীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত কোথায় না আছে? কিন্তু সাধু পুরুষের পদাশ্রিত হইতে পারিলে পরকালের মুক্তিপথের পাপকণ্টক বিদূরিত হইয়া স্বর্গের দ্বার পরিষ্কার থাকিবে। আমার বৈধব্যব্রত পূর্ণ হইলেই প্রভু হাসান যে সময়ে আমাকে দাসীত্বে গ্রহণ করিবেন, আমি মনের আনন্দে সেই সময়েই সেই পবিত্র চরণে আত্মসমর্পণ করিব।”

মোস্‌লেম বলিল, “জয়নাব! তুমিই জগতে পবিত্র কীর্তি স্থাপন করিলে। জগৎ বিলয় পর্যন্ত তোমার এই অক্ষয়কীর্তি সকলের অন্তরে দেদীপ্যমান থাকিবে। আমার আর কোন কথা নাই। আমি বিদায় হইলাম।”

মোস্‌লেম বিদায় হইলেন। যথাসময়ে প্রথমে ইমাম হাসান, পরিশেষে আক্কাসের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত প্রকাশ করিয়া অপূর্ব চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া দামেস্কাভিমুখে যাত্রা করিলেন।

 

Series Navigation
The following two tabs change content below.
Avatar photo
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →