ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৬)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৬)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৫)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৪)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৩)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ২)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ১)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৭)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৮)
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৯)
১১. “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্”
মদিনাবাসীরা কিছুদিন এজিদের পত্র লইয়া বিশেষ আলোচনা করিলেন। সর্বসাধারণের অন্তরেই এজিদের পত্রের প্রতি ছত্র, প্রতি অক্ষর, সুতীক্ষ্ণ তীরের ন্যায় বিঁধিয়াছিল। কিছুদিন গত হইল, দামেস্কে আর কোন সংবাদ নাই। এজিদের আন্দোলন ক্রমে ক্রমে অনেক পরিমাণে কমিয়া আসিল।
মদিনাবাসীরা আপন আপন গৃহে শুইয়া আছেন, নিশা প্রায় অবসান হইয়া আসিয়াছে, এমন সময় সহসা নাকাড়ার শব্দ শুনিতে পাইয়া অগ্রে প্রান্তসীমাবাসীরা জাগিয়া উঠিলেন। ইহার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজনাও নিকটবর্তী হইতে লাগিল।
আবদুর রহমান দ্রুতগমন করিয়া হাসান-হোসেনের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত জানাইলেন। তাঁহারাও আর কালবিলম্ব না করিয়া এজিদের বিরুদ্ধে জেহাদ (ধর্মযুদ্ধ) ঘোষণা করিয়া যুদ্ধের আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত হইলেন। মুহূর্ত মধ্যে মদিনার ঘরে ঘরে জেহাদ রবের প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল।
মদিনার বালক, বৃদ্ধ, পূর্ণবয়স্ক সকলেই রণবেশে সুসজ্জিত হইতে লাগিলেন। নগরবাসীরা হাসান-হোসেনকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসিতেন। ঘোষণা প্রচার হইতে হইতেই সহস্রাধিক লোক কাহারো আদেশের অপেক্ষা না করিয়া যাহার যে অস্ত্র আয়ত্ত ছিল, যাহার যে অস্ত্র সংগ্রহ ছিল, যে যাহা নিকটে পাইল, তাহাই লইয়া বেগে শত্রুর উদ্দেশে ধাইয়া চলিল। তদ্দৃষ্টে এজিদের সৈন্যগণ আর অগ্রসর হইল না; গমনে ক্ষান্ত দিয়া শিবির নির্মাণে প্রবৃত্ত হইল।
হাসান ও আবদুর রহমান প্রভৃতি আত্মীয়-স্বজন সমভিব্যাহারে রওজা-মোবারকে যাইয়া হাসান প্রথমেই ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন, “দয়াময়! আমার ধনবল, বুদ্ধিবল, সৈন্যবল কিছুই নাই। কেবল তোমার নাম ভরসা করিয়াই অসীম শত্রুপথে যাইতেছি। তুমিই সহায়, তুমিই রক্ষাকর্তা।”
সকলেই “আমিন আমিন” বলিয়া পরে নূরনবী মোহাম্মদের গুণানুবাদ করিয়া একে একে অশ্বারোহণে রাজপথে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নগরবাসীরা ব্যগ্রতা-সহকারে তাঁহাদের চারিদিকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। বলিতে লাগিল, “আমরা বাঁচিয়া থাকিতে আপনাকে শত্রুসম্মুখে যাইতে দিব না।”
হাসান অশ্ব হইতে নামিয়া বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! ঈশ্বরের রাজ্যে বাস করিয়া ঈশ্বরের কার্যে জীবন শেষ করাই জীবের কর্তব্য! এ জগতে কেহ কাহারো রাজা নহে, সকলেই সেই মহাধিরাজ সর্বরাজাধিরাজ, ওয়াহ্দাহু লা শরিকালাহু! সকলেই সেই মহান্ রাজার সৃষ্ট, তাঁহার শক্তি মহান্! আমরা সেই রাজার রাজ্যের প্রজা। সাধ্যানুসারে সেই সর্বশক্তিমান, অদ্বিতীয় মহারাজের ধর্মরাজ্য রক্ষণাবেক্ষণ করাই আমাদের সর্বতোভাবে কর্তব্য এবং তাহাই আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাঁহার নামই আমাদের আশ্রয়। সেই নাম সহায় করিয়াই আমরা তাঁহার ধর্মরাজ্য রক্ষা করিব। বিধর্মী এজিদ্ নূরনবী হজরত মোহাম্মদের বিরোধী ঈশ্বরের বিরোধী পবিত্র কোরানের বিরোধী। যে কেহ ঈশ্বরের বিরোধী, আমরা তাহার বিরোধী। ঈশ্বরের প্রসাদে জয়-পরাজয় উভয়ই আমাদের মঙ্গল। ভ্রাতৃগণ! আজ আমাদের এই স্থির প্রতিজ্ঞা যে, হয় জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া মহম্মদীয় ধর্মের উৎকর্ষ সাধন করিব, না হয় অকাতরে রক্তস্রোতে আমাদের এই অস্থায়ী দেহ খণ্ডে খণ্ডে ভাসাইয়া দিব।”
এই পর্যন্ত শুনিয়াই শ্রোতাগণ সমস্বরে “আল্লাহু আক্বার!” বলিয়া পাগলের ন্যায় কাফেরের মুণ্ডপাত করিতে ছুটিলেন।
হাসান-হোসেন ও আবদুর রহমান পুনরায় অশ্বারোহণে কিঞ্চিৎ দূর গমন করিয়া যে দৃশ্য দর্শন করিলেন, তাহাতে হাসান আর অশ্রুসম্বরণ করিতে পারিলেন না। আবদুর রহমানকে বলিলেন, “ভাই! আমি অবলাগণকে সান্ত্বনা করিয়া আসিতেছি। তোমরা যাও আর অপেক্ষা করিয়ো না।”
এই কথা বলিয়া অশ্ব হইতে নামিয়াই ইমাম হাসান অতি বিনীতভাবে নারীগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগ্নিগণ! এই বিপদ সময়ে তোমরা এ বেশে কোথা যাইতেছ?” স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে একজন বলিলেন, – “হজরত! আপনার এই মহাবিপদকালেও কী আমরা অবলাচারের বাধ্য হইয়া অন্তঃপুরেই আবদ্ধ থাকিব? আপনার জন্য স্বামী, পুত্র, ভ্রাতা যদি বিধর্মীর রক্তে রঞ্জিত হইয়া ধর্মরক্ষা ও জন্মভূমি রক্ষা করিতে পারে, তবে আমরাই-বা কাফেরের মাথা কাটিতে অস্ত্র গ্রহণ করিব না কেন? দুনিয়া কয় দিনের? আমরা শূন্যদেহ লইয়া কেন আর ঘরে থাকিব?” আর একটি স্ত্রীলোক কহিলেন, “হজরত! আমরা যে কেবল সন্তান-সন্ততি প্রতিপালন করিতেই শিখিয়াছি, তাহা মনে করিবেন না, এই হস্ত বিধর্মীর মস্তক চূর্ণ করিতেও সম; এই অস্ত্রে কাফেরের মুণ্ডপাত করিতেও জানি।”
বিস্মিত হইয়া হাসান বলিলেন, “আমি আপনাদের অনুগত এবং আজ্ঞাবহ। আমি বাঁচিয়া থাকিতে বিধর্মীবধে আপনাদিগকে অস্ত্র ধরিতে হইবে না। ভগ্নিগণ! আপনারা ঘরে বসিয়া ঈশ্বরের নিকট ধর্ম ও জন্মভূমির রার জন্য কায়মনে প্রার্থনা করুন।” প্রথমা স্ত্রী সবিনয়ে বলিলেন, “আপনার আদেশ প্রতিপালন করিলাম; কিন্তু ইহা নিশ্চয়ই জানিবেন যে, মদিনার একটি অবলার প্রাণ দেহে থাকিতে এজিদ্ কদাচ নগরের সীমায় আসিতে পারিবে না।” এই কথা বলিয়া স্ত্রীলোকেরা দুই হস্ত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন।
আশীর্বাদ করিয়া কামিনীগণ স্ব-স্ব নিকেতনে চলিয়া গেলেন। হাসানও ‘বিস্মিল্লাহ্’ বলিয়া অশ্বে আরোহণ করিলেন। মুহূর্তমধ্যে নগরপ্রান্তে আসিয়া ভীষণতর শব্দ শুনিতে শুনিতে যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটস্থ হইলেন। দেখিলেন যে, বিষমবিক্রমে মদিনাবাসীরা বিপক্ষগণকে আক্রমণ করিয়াছে ও মুহূর্তে মুহূর্তে ‘আল্লাহ্’ রবে চতুর্দিক কাঁপাইয়া তুলিতেছে।
মদিনাবাসীরা শত্রুদিগকে প্রায় শেষ করিয়া ফেলিয়াছে। শত শত বিধর্মীর মস্তকোচ্ছেদন করিয়া শেষে নিজে নিজে ‘শহীদ’ হইতেছে। কেহ কাহারো কথা শুনিতেছে না, কিছু বলিতেছে না, জিজ্ঞাসাও করিতেছে না। হোসেনের চালিত তরবারি বিদ্যুতের ন্যায় চমকিতেছে। শত্রুপক্ষীয়েরা যে পলাইয়া প্রাণ রা করিবে, তাহারও উপায় নাই। তবে বহুদূর হইতে যাহার সেই ঘূর্ণিত তরবারির চাকচিক্য দেখিয়াছিল কেবল তাহারাই, কেহ জঙ্গলে, কেহ পর্বতগুহায় লুকাইয়া প্রাণ রক্ষা করিল। হাসান অনেকক্ষণ পর্যন্ত একস্থানে দাঁড়াইয়া ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হইয়া এই ভীষণ যুদ্ধ দর্শন করিতে লাগিলেন। মদিনাবাসীদের মুখে কেবল “মার! মার! কোথায় এজিদ্? কোথায় মারওয়ান?” এইমাত্র রব।
হোসেন ও আবদুর রহমান প্রভৃতিকে দেখিয়াছিলেন; অথচ কেহ কাহারো কোন সন্ধান লন নাই। জিজ্ঞাসাও করেন নাই। এক্ষণে পরস্পর পরস্পরের সহিত দেখা হইতে লাগিল। যাহারা তাঁহাদের দৃষ্টিপথের প্রতিবন্ধকতা জন্মাইয়াছিল, ঈশ্বর কৃপায় তাহারা আর নাই, প্রায় সকলেই রক্তস্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে। ক্রমে সকলেই একত্র হইতে লাগিলেন। সকলেই উচ্চৈঃস্বরে ঈশ্বরের নাম করিয়া জয়ধ্বনির সহিত “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” বলিয়া যুদ্ধে ক্ষান্ত দিলেন। অনন্তর রক্তমাখা শরীরে আঘাতিত অঙ্গে মনের আনন্দে হাসানের সহিত আলিঙ্গন করিলেন। হাসানও সকলকে আশীর্বাদ করিয়া সমস্বরে ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে সিংহদ্বার অতিক্রম করিয়া নগর মধ্যে প্রবেশ করিলেন।
বালক, বৃদ্ধ ও স্ত্রীলোকেরা পথের দুই পার্শ্ব হইতে ঈশ্বরের নিকট শোক্রাণা করিয়া বিজয়ী বীরপুরুষগণকে মহানন্দে অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। জাতীয় ধর্ম ও জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া বীরগণ বিজয় পতাকা উড়াইয়া গৃহে আসিতেছেন। বিজয়ী বীরগণ একেবারে প্রভু মোহাম্মদের রওজা শরিফে আসিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন। মদিনার প্রতি গৃহ, প্রতি দ্বার, প্রতি পল্লী ও প্রতি পথ এককালে আনন্দময় হইয়া উঠিল।
মদিনাবাসীরা বিজয়-নিশান উড়াইয়া রণভূমি পরিত্যাগ করিলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মৃতদেহ মধ্যে প্রাণের ভয়ে যাঁহারা লুকাইয়াছিলেন, ক্রমে ক্রমে তাঁহারা মস্তক উত্তোলন করিয়া দেখিলেন, আর জনপ্রাণীমাত্র যুদ্ধেক্ষেত্র নাই। ক্রমে ক্রমে দুইটি তিনটি করিয়া একত্র হইলেন। পর্বতগুহায় যাঁহারা লুকাইয়া ছিলেন, তাঁহারাও যুদ্ধক্ষেত্রের নীরব নিস্তব্ধভাব বুঝিয়া ক্রমে ক্রমে বাহির হইলেন। তন্মধ্যে মারওয়ান ও ওত্বে অলীদ উভয়েই ছিলেন। মারওয়ান বলিলেন, “ভাই অলীদ! মদিনাবাসীর অস্ত্রে এত তেজ, হোসেনের এত পরাক্রম, ইহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই। যাহা হইবার হইয়াছে। পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করিব, পুনরায় হাসান-বধ চেষ্টা করিব। সৈন্যগণ! তোমরা একজন এখনই দামেস্কনগরে যাত্রা কর। আর যাহা স্বচক্ষে দেখিলে, কিছুই গোপন করিও না, তৎসমস্তই অকপটে প্রকাশ করিয়া বলিয়ো।”
মারওয়ানের আজ্ঞামাত্র এম্রান নামক এক ব্যক্তি দামেস্কে যাত্রা করিলেন। মারওয়ান ছদ্মবেশে নগরের কোন এক গুপ্ত স্থানে অলীদের সহিত বাস করিতে লাগিলেন।
১২. মায়মুনা
ঋণের শেষ, অগ্নির শেষ, ব্যাধির শেষ, শত্রুর শেষ থাকিলে ভবিষ্যতে মহাবিপদ। পুনরায় তাহা বর্ধিত হইলে আর শেষ করা যায় না। রাত্রি দুই প্রহর; মদিনাবাসীরা সকলেই নিদ্রিত; মারওয়ান ছদ্মবেশে নগরভ্রমণ করিয়া আসিতেছেন। মদিনা তন্নতন্ন করিয়াও আজ পর্যন্ত মনোমত লোক খুঁজিয়া পান নাই। কেবল একটি বৃদ্ধা স্ত্রীর সহিত কথায় কথায় অনেক কথার আলাপ করিয়াছেন; আকার ইঙ্গিতে লোভও দেখাইয়াছেন। বৃদ্ধার বাড়ি ঘর গোপনভাবে দেখিয়া আসিয়াছেন। আজ নিশীথসময়ে বৃদ্ধার সহিত নগরপ্রান্তে নির্দিষ্ট পর্বতগুহার নিকট দেখা হইবে এরূপ কথা স্থির আছে। সেই স্ত্রীলোকটির নাম মায়মুনা। মায়মুনার কেশপাশ শুভ্র বলিয়াই লেখক তাহাকে বৃদ্ধা বলিয়াই সম্বোধন করিয়াছেন। কিন্তু মায়মুনা বাস্তবিকই বৃদ্ধা নহে।
নির্দিষ্ট গিরিগুহার নিকটে মারওয়ান অপেক্ষা করিতেছিলেন। মায়মুনা বলিল, “আপনার কথাবার্তার ভাবে আমি অনেক জানিতে পারিয়াছি। আমাকে যদি বিশ্বাস করেন, তবে একটি কথা আগে বলি।” মারওয়ান কহিলেন, “তোমাকে বিশ্বাস না করিলে মনের কথা ভাঙ্গিব কেন? তোমার কথাক্রমে এই নিশীথসময়ে জনশূন্য পর্বতগুহার নিকটেই-বা আসিব কেন? তোমার যাহা ইচ্ছা বল।”
মায়মুনা কহিল, “কার্য শেষ করিলে তো দিবেনই, কিন্তু অগ্রে কিছু দিতে হইবে। এই কার্যের জন্যই আমাকে সর্বদা চিন্তিত থাকিতে হইবে। দিবারাত্রি কেবল এই মন্ত্রণা, এই কথা লইয়াই ব্যতিব্যস্ত থাকিতে হইবে।” কথার ভাব বুঝিয়া কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা মায়মুনার হস্তে দিয়া মারওয়ান বলিলেন, “যদি কৃতকার্য হইতে পার, সহস্র সুবর্ণ মোহর তোমার জন্য ধরা রহিল।”
মোহরগুলি রুমালে বাঁধিয়া মায়মুনা বলিল, “দেখুন। যার দুই-তিনটি স্ত্রী, তার প্রাণবধ করিতে কতক্ষণ লাগে? সে তো আজরাইলকে সর্বদা নিকটে বসাইয়া রাখিয়াছে। তার প্রাণ রক্ষা হওয়াই আশ্চর্য নয়।” মারওয়ান কহিলেন, “দুই তিনটি স্ত্রী হওয়া আর ভয়ের কারণ কি?”
মায়মুনা কহিল, “পয়গম্বরই হউন, ইমামই হউন, ধার্মিক পুরুষই হউন, আর রাজাই হউন, এক প্রাণ কয়জনকে দেওয়া যায়? ভাগী জুটিলেই নানা কথা, নানা গোলযোগ।”
মারওয়ান বলিলেন, “হাসানের প্রাণবধ করিতে পারিলেই আমি তোমাকে সহস্র মোহর পুরস্কার দিব। আর একটি কথা। এই বিষয় তুমি আমি ভিন্ন আর কেহই জানিতে না পারে।”
মায়মুনা বলিল, “কেহ জানিতে না পারিলে কার্য উদ্ধার হইবে কি প্রকারে? তবে এই পর্যন্ত বলিতে পারি, আসল কথাটি আর একজনের কর্ণ ভিন্ন দ্বিতীয়জনের কর্ণে প্রবেশ করিবে না।”
“সে তোমার বিশ্বাস। কার্য উদ্ধারের জন্য যদি কাহারো নিকট কিছু বলিতে হয় বলিয়ো; কিন্তু তিনজন ভিন্ন আর একটি প্রাণীও যেন জানিতে না পারে।”
মায়মুনা বলিল, “হজরত! আমাকে নিতান্ত সামান্য স্ত্রীলোক মনে করিবেন না। যেখানে অস্ত্রের বল নাই, মহাবীরের বীরত্ব নাই, সাহস নাই, সাধ্য নাই, সেইখানেই এই মায়মুনা। শত অর্গলযুক্ত দ্বারও অতি সহজে খুলিয়া থাকি। যেখানে বায়ুর গতিবিধি নাই, সেখানেও আমি অনায়াসে গমন করি। যে যোদ্ধার অন্তর পাষাণে গঠিত, তাহার মন গলাইয়া মোমে পরিণত করিতে পারি। যে কুলবধূ সূর্যের মুখ কখনো দেখে নাই, চেষ্টা করিলে তাহার সঙ্গেও দুটো কথা কহিয়া আসিতে পারি। নিশ্চয় জানিবেন, পাপশূন্য দেহ নাই, লোকশূন্য জগৎ নাই। যেখানে যাহা খুঁজিবেন, সেইখানেই তাহা পাইবেন।”
মারওয়ান কহিলেন, “মুখে অনেকেই অনেক কথা বলিয়া থাকে, কার্যে তাহার অর্ধেক পরিমাণ সিদ্ধ হইলেও জগতে অসুখের কারণ থাকিত না, অভাবের নামও কেহ মুখে আনিত না। তোমার কথাও রহিল, আমার কথাও থাকিল। রাত্রিও প্রায় শেষ হইয়া আসিল। গুপ্ত পরামর্শ আবশ্যক হইলে নিশীথ সময়ে উভয়ে এই গিরিগুহার সন্নিকটে আসিয়া সমুদয় কথাবার্তা কহিব ও শুনিব।” এই বলিয়া মারওয়ান বিদায় হইলেন। মায়মুনাও বাটীতে গেল। গৃহমধ্যে শয্যার উপর বসিয়া মোহরগুলি দীপালোকে এক এক করিয়া গণিয়া যথাস্থানে স্থাপনপূর্বক আপনাআপনি বলিতে লাগিল-
“হাসান আমার কে? হাসানকে মারিতে আর আমার দুঃখ কী? আর ইহাও এক কথা, আমি নিজে মারিব না, আমি কেবল উপলক্ষ মাত্র। আমার পাপ কি?” মনে মনে এইরূপ আন্দোলন করিতে করিতে মায়মুনা শয়ন করিল।
রাত্রি প্রভাত হইল। ক্রমে সকলেই জাগিয়া উঠিল। মদিনাবাসীমাত্রেই ঈশ্বরের উপাসনায় ব্যতিব্যস্ত, কেবল মায়মুনা ঘোর নিদ্রায় অভিভূতা। মায়মুনা নিদ্রিত অবস্থাতেই শয্যাপরিস্থ উপাধান চাপিয়া ধরিয়া গোঙাইতে গোঙাইতে বলিতে লাগিল, “আমি নহি, আমি নহি! মারওয়ান;-এজিদের প্রধান উজির মারওয়ান।” দুই তিনবার মারওয়ানের নাম করিয়া মায়মুনার নিদ্রাভঙ্গ হইল। মায়মুনা নিস্তব্ধ হইয়া শয্যাপরি বসিয়া রহিল। এক দৃষ্টে কী দেখিল, কী ভাবিল, নিজেই জানিল; শেষে বলিয়া উঠিল, “স্বপ্নসকল অমূলক চিন্তা। বুদ্ধিহীন মূর্খেরাই স্বপ্ন বিশ্বাস করিতে থাকে। যাহাই আমার কপালে থাকুক, আমি স্বপ্নে যাহা দেখিলাম, সে ভয়ে হাজার মোহরের লোভ কখনোই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। এ কী কম কথা! একটা নয়, দুটো নয়, দশ শত মোহর! প্রস্তরাঘাতে মারিবে,-যে দিবে সেই মারিবে। এ কী কথা!”-এই বলিয়াই অন্য গৃহে গমন করিল। কিঞ্চিৎ বিলম্বে নূতন আকারে, নূতন বেশে, গৃহ হইতে বহির্গত হইল।
…
কারবালার জারি
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- ঢাকা শহরের বইয়ের দোকান - ডিসেম্বর 4, 2023
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৩ - সেপ্টেম্বর 28, 2023
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৯) - জুলাই 28, 2023