Main menu

ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৭)

প্রবাহ ১৩. আমার স্বামী আর আমি – আমার প্রাণের প্রাণ – কলিজার টুকরা

মায়মুনা ইমাম হাসানের অন্তঃপুরে প্রায়ই যাতায়াত করিত। হাসনেবানুর নিকট তাহার আদর ছিল না। হাসনেবানুকে দেখিলেই সে ভয়ে জড়সড় হইত। নিতান্ত আবশ্যক না হইলে জয়নাবের নিকটে আর যাইতও না। জায়েদার সঙ্গে বেশি আলাপ, বেশি কথা, বেশি কান্না। মায়মুনাকে পাইলেই জায়েদা মনের কপাট খুলিয়া বসিতেন। জায়েদা ভাবিয়াছিলেন, মদিনার মধ্যে যদি কেহ তাঁহাকে ভালবাসে, তবে সে মায়মুনা। তাঁহার অন্তরের দুঃখে যদি কেহ দুঃখিত হয়, তবে সে মায়মুনা। দুটা মুখের কথা কহিয়া সান্ত্বনা করিবার যদি কেহ থাকে, তবে সে মায়মুনা। কোনরূপ উপকারের আশা থাকিলেও সেই মায়মুনা। মায়মুনাকে দেখিয়াই ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মায়মুনা! এ কয়েকদিন দেখি নাই কেন?”

মায়মুনা উত্তর করিল, “তোমার কাজ না করিয়া কেবল যাওয়া আসায় লাভ কি? আমি তোমার উপকার করিবই করিব। আমি ভুলি নাই।”

জায়েদা কহিলেন, “পাগলের মত একদিন কী বলিয়াছিলাম, তুমি তাই মনে করিয়া রাখিয়াছ; যাক্ ও-কথা যাক্ ও-কথা তুমি আর কখনো মনে করিয়ো না; কোন চেষ্টা করিয়ো না। কৌশলে স্বামী বশ, মন্ত্রের গুণ স্বামীর মন ফিরান, মন্ত্রে ভালবাসা, ঔষধের গুণে স্বামী বশে আনা,-এ সকল বড় লজ্জার কথা। সকলই অদৃষ্টের লেখা।”

ব্যঙ্গচ্ছলে মায়মুনা জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কী আপস্ হইয়াছে, না ভাগ-বণ্টন-বিলি-ব্যবস্থা করিয়া ভাগাভাগী করিয়া লইয়াছ?”

জায়েদা উত্তর করিলেন, “ভাগ-বণ্টন করি নাই, আপসও করি নাই; মিটমাটও করি নাই, এ জীবনে তাহা হইবে না, জায়েদা বাঁচিয়া থাকিতে স্বামী ভাগ করিয়া লইবেও না। যাহাদের স্বামী, যাহাদের ঘরকন্না, তাহারাই থাকুক, তাহারাই সুখভোগ করুক। জায়েদা আজিও যে ভিখারিণী, কালিও সেই ভিখারিণী।”

মায়মুনা কহিল, “এত উদাস হইও না। যাহা কর, বুদ্ধি স্থির করিয়া আগুপাছু বিবেচনা করিয়া করিয়ো। শুনিতে পাই, জয়নাবকেই তিনি বেশি ভালবাসেন; কিন্তু কই? আমি তো তাহার কিছুই দেখিতে পাই না; বরং দেখিতে পাই, তোমার প্রতিই তাঁহার টান অধিক।”

ঈষৎ হাস্য করিয়া জায়েদা কহিলেন, “তুমি কি বুঝিবে? প্রকাশ্যে কিছু ইতরবিশেষ দেখিতে পাও না, তাহা ঠিক। ভিতরে যে কি আছে তাহা কে বুঝিবে? বিশেষত ইহারা ইমাম। প্রকাশ্যে সকল স্ত্রীকে সমান দেখেন। কিন্তু দেখাও অনেক প্রকার আছে। এখন তিনি কথা কহেন, কিন্তু পূর্বেকার সে স্বর নাই, সে মিষ্টতাও নাই। ভালবাসেন, কিন্তু তাহাতে রস নাই। আদর করেন, কিন্তু সে আদরে মন গলে না, বরং বিরক্তিই জন্মে। ঘরের কথা, মনের কথা, কে বুঝিবে বল দেখি? এখন শীঘ্র শীঘ্র মরণ হইলে আমি নিস্তার পাই।”

কাঁদিয়া কাঁদিয়া মায়মুনা বলিতে লাগিলেন, “জায়েদা! তুমি কেন মরিতে চাও? তুমি মনে করিলে কী-না করিতে পার? মনে করিলেই তুমি রাজরাণী, মনে না করিলেই ভিখারিণী।” জায়েদা জিজ্ঞাসা করিলেন, “মনে করিলেই যদি মনের দুঃখ যায় তবে জগতে কে না মনে করে?” মায়মুনা উত্তর করিল, “আমি তো আর দশ টাকা লাভের জন্য তোমার মনোমত কথা বলিতেছি না। যাহা বলি, মন ঠিক করিয়া একবার মনে কর দেখি, তোমার মনের দুঃখ কোথায় থাকে?” জায়েদা কহিলেন, “তোমার কোন্ কথাটা আমি মনের সহিত শুনি নাই, মায়মুনা? তুমি আমার পরম হিতৈষিণী। যাহা বলিবে, তাহার অন্যথা কিছুতেই করিব না।” মায়মুনা কহিল, “যদি মনে না লাগে, তবে করিয়ো না। কিন্তু মন হইতে কখনোই মুখে আনিতে পারিবে না। ধর্ম সাক্ষী করিয়া আমার নিকট প্রতিজ্ঞা কর, এখনি বলিতেছি।” জায়েদা কহিলেন, “প্রতিজ্ঞা আর কি, তোমারই মাথায় হাত দিয়া বলিতেছি, যাহা বলিবে, তাহাই করিব; সে কথা কাহারো নিকট ভাঙ্গব না।”

উত্তম সুযোগ পাইয়া মায়মুনা অতি মৃদু স্বরে অনেক মনের কথা বলিল! জায়েদা ভয়ে থতমত খাইয়া বলিলেন, “শেষের কার্যটি জায়েদা প্রাণ থাকিতে হইবে না। আমার স্বামী আর আমি-আমার প্রাণের প্রাণ-কলিজার টুকরা আর আমি-”

শেষ কথাটি শেষ করিতে না দিয়াই মায়মুনা কহিল, “যে রাজরাণী জয়নাব হইত, সেই রাজরাণী-আবার প্রথমেই সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার। সকলই সুখের জন্য। জগতে যদি চিরকালই দুঃখের বোঝা মাথায় করিয়া বহিতে হয়, তবে মনুষ্যকুলে জন্মলাভে কী ফল? আমার কথা কয়েকটি বড় মূল্যবান। ইহার এক-একটি করিয়া সফল করিতে না পারিলে, পরিশ্রম ও যত্ন সকলই বৃথা। এক-একটি কার্যের এমনি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে একের অভাবে অন্যটি সাধিত হইতে পারে না। আজি আমি আর বেশি কিছু বলিব না।” এই বলিয়া মায়মুনা জায়েদার নিকট হইতে বিদায় লইল।

একদিকে রাজভোগের লোভ, অপরদিকে স্বামীর প্রণয়, এই দুটি ক্রমে ক্রমে তুলনা করিতে লাগিলেন। জয়নাবের নাম মনে পড়িবামাত্রই পরিমাণদণ্ডের যে দিকে স্বামীর প্রাণ, সেই দিকে একেবারে লঘু হইয়া উচ্চে উঠিল। জায়েদা মনে মনে সিদ্ধান্ত করিয়া – দর্পণে মুখখানি ভাল করিয়া দেখিয়া বোর্কা পরিধানপূর্বক গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন।

১৪. কিঞ্চিৎ মধু

মায়মুনার গৃহ বেশি দূর নহে। জায়েদা মায়মুনার গৃহে উপস্থিত হইয়া বোর্কা মোচনপূর্বক তাহার শয়নকে যাইয়া বসিলেন। জায়েদা মনের কথা অকপটে ভাঙ্গিলেন। মায়মুনার সমুদয় কথাতেই জায়েদা সম্মত হইলেন। মায়মুনা মহা সন্তুষ্ট হইয়া বলিতে লাগিল, “বোন্! এত দিনে যে বুঝিয়াছ, সেই ভাল, আর বিলম্ব নাই, যত বিলম্ব হইবে, ততই তোমার অমঙ্গলের ভাগ বেশি হইবে। ধর, এই ঔষধ নেও।” এই বলিয়া মায়মুনা শয্যার পার্শ্ব হইতে খর্জুরপত্র নির্মিত একটি ক্ষুদ্র পাত্র বাহির করিল। তন্মধ্য হইতে অতি ক্ষুত্র একটি কৌটা জায়েদার হস্তে দিয়া বলিল, “বোন্। খুব সাবধান! এই কোটাটি গোপনে লইয়া যাও, সুযোগমত ব্যবহার করিয়ো।

জায়েদা কহিলেন, “মায়মুনা! তোমার উপদেশেই আমি সকল মায়া পরিত্যাগ করিলাম। জয়নাবের সুখস্বপ্ন আজ ভাঙ্গিব। আমার দশার দিকে ফিরিয়াও চাহিলাম না। স্বামী বধ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। জয়নাবের সর্বনাশ করিতে আমার সর্বনাশ! কিন্তু বোন্! তুমি আমাকে নিরাশ্রয় করিয়া বিষাদসমুদ্রে ভাসাইয়া দিয়ো না।”

ধীরে ধীরে কথাগুলি বলিয়া জায়েদা বিদায় হইলেন। মায়মুনাও গৃহকার্যে ব্যপৃত হইলেন। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে সেই কৌটার বস্তু মিশাইবেন, ইহাই মায়মুনার উপদেশ। একটা পাত্রে কিঞ্চিৎ মধু ছিল, তাহাতেই সেই বস্তুর কিঞ্চিৎমাত্র মিশাইয়া রাখিলেন। কৌটাটিও অতি যত্নে সংগোপনে রাখিয়া দিলেন।

হজরত হাসান প্রতিদিনই একবার জায়েদার গৃহে আসিয়া দুই-এক দণ্ড নানাপ্রকার আলাপ করিতেন। কয়েক দিন আসিবার সময় পান নাই, সেই দিন মহাব্যস্তে জায়েদার ঘরে আসিয়া বসিলেন। জায়েদা পূর্বমত স্বামীর পদসেবা করিয়া জলযোগের আয়োজন করিতে লাগিলেন। হাসান আজ জায়েদার গৃহে বাস করিবেন, মনে মনে স্থির করিলেন। জায়েদাও নানাপ্রকার হাবভাব প্রদর্শনে স্বামীর মন হরণ করিয়া প্রাণ হরণ করিতে বসিলেন। ঈশ্বরভক্তই হউন, মহামহিম ধার্মিকপ্রবরই হউন, মহাবলশালী বীরপুরুষই হউন, কী মহাপ্রাজ্ঞ সুপণ্ডিতই হউন, স্ত্রীজাতির মায়াজাল ভেদ করা বড়ই কঠিন। নারীবুদ্ধির অন্ত পাওয়া সহজ নহে। জায়েদা এক পাত্রে মধু ও অন্য পাত্রে জল আনিয়া স্বামীর সম্মুখে রাখিলেন।

সকৌতুকে হাসান জিজ্ঞাসা করিলেন, “অসময়ে মধু?” মায়াপূর্ণ আঁখিতে হাসানের দিকে একবার তাকাইয়া জায়েদা উত্তর করিলেন, “আপনার জন্য আজ আট দিন এই মধু সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছি। পান করিয়া দেখুন, খুব ভাল মধু।”

মধুর পেয়ালা হস্তে তুলিয়া হাসান বলিতে লাগিলেন, “আমার জন্য আট দিন যত্ন করিয়া রাখিয়াছ, ধন্য তোমার যত্ন ও মায়া! আমি এখনই খাইতেছি।” হাসান সহর্ষে এই কথা বলিয়া মধুপাত্র হস্তে তুলিয়া মধু পান করিলেন। মুহূর্ত মধ্যেই বিষের কার্য আরম্ভ হইল। ক্রমে কণ্ঠ, তালু ও জিহ্বা শুষ্ক হইয়া আসিল, চক্ষু লৌহিতবর্ণ হইয়া শেষে দৃষ্টির ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। তিনি যেন চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। জায়েদাকে বলিলেন, “জায়েদা! এ কী হইল? এ কেমন মধু? এত জল পান করিলাম, পিপাসার শান্তি হইল না। ক্রমেই শরীর অবশ হইতেছে, পেটের মধ্যে কে যেন আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে। কিসে কি হইল?”

জায়েদা বায়ুব্যজনে প্রবৃত্ত হইলেন। মস্তকে শীতল জল ঢালিতে লাগিলেন, কিছুতেই হাসান সুস্থির হইলেন না। ক্রমেই শরীরের জ্বালা বর্ধিত হইতে লাগিল। বিষের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া সামান্য শয্যার উপর গড়াগড়ি দিতে লাগিলেন। হাসান অত্যন্ত কাতর হইয়া অবশেষে কাতরস্বরে জিজ্ঞাসা করিরেন, “জায়েদা! এ কিসের মধু? মধুতে এত আগুন? আর আমি সহ্য করিতে পারি না।”

জায়েদা যেন অবাক্; মুখে কথা নাই। অনেকক্ষণ পরে কেবল মাত্র এই কথা, “সকলই আমার কপালের দোষ। মধুতে এমন হইবে, তা কে জানে! দেখি দেখি, আমিও একটু খাইয়া দেখি।” হাসান এই অবস্থাতেই নিষেধ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “জায়েদা! আমার কথা রাখ; ও মধু তুমি খাইয়ো না।”

পত্নীকে এই কথা বলিয়া হাসান ঈশ্বরের নাম করিতে লাগিলেন। কাহাকেও সংবাদ দিলেন না। পবিত্র হৃদয়ে পবিত্র মুখেই দয়াময়ের পবিত্র নাম পুনঃপুনঃ উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। বিষের বিষম যাতনা নামের গুণে কতক পরিমাণে অল্প বোধ হইতে লাগিল। প্রভাতী উপাসনার সময়ে অতি কষ্টে জায়েদার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া প্রভু মোহাম্মদের সমাধি-মন্দিরে গমন করিলেন। বিনীতভাবে ঈশ্বরের নিকট সকাতরে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন।

প্রভু মোহাম্মদের সমাধি-মন্দিরের পবিত্রতাগুণে, ঈশ্বরের মহিমায় হাসান আরোগ্য লাভ করিলেন। কিন্তু এই প্রথম বিষপান হইতে (মৃত্যু পর্যন্ত চল্লিশ দিন) প্রায় কোন না কোন প্রকারে শরীরের গ্লানি ছিল। এ কথা (প্রথম বিষপান ও আরোগ্য লাভ) অতি গোপনে রাখিলেন। কাহারো নিকটে প্রকাশ করিলেন না।

প্রণয়ী বিশ্বাসী ব্যক্তি যদি শত্রু হইয়া দাঁড়ায়, তাহার হস্ত হইতে রক্ষা পাওয়া নিতান্ত কঠিন। চিরশত্রুর হস্ত হইতে অনেকেই রক্ষা পাইতে পারে, কিন্তু মিত্র যদি শত্রু হয়, তাহার হস্ত হইতে রক্ষা পাওয়ার আশা কিছুতেই থাকে না। বিশেষত স্ত্রীজাতি শত্রুতাসাধনে উত্তেজিত হইয়া উঠিলে, তাহা শেষ না করিয়া প্রাণ থাকিতে ক্ষান্ত হয় না। জায়েদা ক্ষান্ত হইবেন কেন? জায়েদার পশ্চাতে আরো লোক আছে।

মায়মুনা মনে মনে ভাবিয়াছিল, যাহা দিয়াছি তাহাতে আর রক্ষা নাই। একবার গলাধঃকরণ হইলেই কার্যসিদ্ধি হইবে। প্রভাত হইয়া আসিল, তবুও ক্রন্দনশব্দ তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল না। দুই-এক পদ করিয়া জায়েদার গৃহ পর্যন্ত আসিল, জায়েদার মুখে সমুদয় ঘটনা শুনিয়া আশ্চর্যান্বিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “তবে উপায়?”

“বোন্! স্ত্রীজাতির এমনি একটি মোহিনীশক্তি আছে যে, পুরুষের মন অতি কঠিন হইলেও সহজে নোয়াইতে পারে, ঘুরাইতে পারে, ফিরাইতেও পারে। তবে অন্যের প্রণয়ে মজিলে একটু কথা আছে বটে, কিন্তু হাতে পাইয়া নির্জনে বসাইতে পারিলে, কাছে ঘেঁষিয়া মোহন মন্ত্রগুলি ক্রমে ক্রমে আওড়াইতে পারিলে অবশ্যই কিছু-না-কিছু ফল ফলাইতে পারিবই পারিবে। যে পথে দাঁড়াইয়াছি, আর ফিরিব না, যাহা করিতে হয়, আমিই করিব।”

মায়মুনা কহিল, “আমি খেজুর লইয়া শীঘ্রই আসিতেছি।” মায়মুনা বিদায় হইল। জায়েদা অবশিষ্ট মধু, যাহা পাত্রে ছিল, তাহা আনিয়া দেখিয়া দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, “যেমন মধু তেমনই আছে; ইহার চারি ভাগের এক ভাগও যদি উদরস্থ হইত, তাহা হইলে আজ এতক্ষণ জয়নাবের সুখতরী ডুবিয়া যাইত, সুখের বাসা ভাঙ্গিয়া একেবারে দুঃখের সাগরে ডুবিত, স্বামীসোহাগিনীর সাধ মিটিয়া যাইত!”

মায়মুনা খেজুর লইয়া উপস্থিত হইল। বলিল, “সাবধান! আর আমি বিলম্ব করিব না। যদি আবশ্যক হয়, সময় বুঝিয়া আমার বাটীতে যাইয়ো।” এই কথা বলিয়া মায়মুনা চলিয়া গেল। জায়েদা সেই খেজুরগুলি বাছিয়া বাছিয়া দুই ভাগ করিলেন। এক ভাগের প্রত্যেক খেজুরে এমন এক একটি চিহ্ন দিলেন যে তিনি ভিন্ন অন্য কাহারো চক্ষে তাহা পড়িবার সম্ভাবনা রহিল না। অবশিষ্ট অচিহ্নিত খেজুরগুলিতে সেই কৌটার সাংঘাতিক বিষ মিশ্রিত করিয়া, উভয় খেজুর একত্র করিয়া রাখিয়া দিলেন।

হাসান জয়নাবকে বলিয়াছিলেন যে, “গত রাত্রিতে জায়েদার গৃহে বাস করিব ইচ্ছা ছিল, দৈববশে এমনই একটি ঘটনা ঘটিল যে সমস্ত রাত্রি পেটের বেদনায়, শরীরের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। মুহূর্তকালের জন্যও সুস্থির হইতে পারি নাই। ভাবনায় চিন্তায় জায়েদা কোন কথাই মুখে আনিতে পারিল না। কেবলমাত্র বলিয়াছিল যে, ‘সকলই আমার কপাল!’ তা যাহাই হউক, আজিও আমি জায়েদার গৃহে যাইতেছি!”

জয়নাব বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া হাসানকে বিদায় দান করিলেন। জয়নাবের ইচ্ছা যে, কাহারো মনে দুঃখ না হয়, স্বামীধনে কেহই বঞ্চিত না হয়।

হাসানের শরীরের গ্লানি ও দুর্বলতা এবং উদরের জড়তা এখনো অনেক আছে। এ সকল থাকা সত্ত্বেও তিনি জায়েদার গৃহে উপস্থিত হইয়া গত রাত্রির ঘটনা আলোচনা করিতে লাগিলেন। সেই মধুর কথাও জিজ্ঞাসা করিলেন। জায়েদা উত্তর করিলেন, “যে মধুতে এত যন্ত্রণা, এত কে­শ; সেই মধু আমি আবার গৃহে রাখিব? পাত্রসমেত তাহা আমি তৎক্ষণাৎ দূর করিয়া ফেলিয়া দিয়াছি।”

জায়েদার ব্যবহারে হাসান যারপরনাই সন্তুষ্ট হইলেন। সুযোগ পাইয়া জায়েদা সেই খর্জুরের পাত্র ইমাম হাসানের সম্মুখে রাখিয়া, নিকটে বসিয়া খর্জুর ভক্ষণের অনুরোধ করিলেন। চতুরা জায়েদা স্বামীর অগ্রেই চিহ্নিত খেজুরগুলি খাইতে আরম্ভ করিয়া দিলেন। দেখাদেখি, ইমাম হাসানও চিহ্নিত এবং অচিহ্নিত উভয়বিধ খেজুর একটি একটি করিয়া খাইতে আরম্ভ করিলেন। ঊর্ধ্ব সংখ্যা সাতটি উদরস্থ হইলেই বিষের কার্য আরম্ভ হইল। হাসান সন্দেহপ্রযুক্ত আর খাইলেন না, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অস্থির হইয়া পড়িলেন। আর বিলম্ব করিলেন না, কোন কথাও কহিলেন না; নিতান্ত দুঃখিতভাবে প্রাণের অনুজ হোসেনের গৃহাভিমুখে গমন করিলেন। এবারো কাহাকে কিছু বলিলেন না; কিছুক্ষণ ভ্রাতৃগৃহে অবস্থিতি করিলেন। নিদারুণ বিষের যন্ত্রণা ক্রমশ অসহ্য হইয়া উঠিল। পুনরায় তিনি প্রভু মোহাম্মদের ‘রওজা মোবারকে’ (পবিত্র সমাধিক্ষেত্রে) যাইয়া ঈশ্বরের নিকটে আরোগ্য প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। দয়াময় এবারেও হাসানকে আরোগ্য করিয়া প্রাণ রক্ষা করিলেন।

জায়েদার আচরণ হাসান কিছু বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তথাপি সে কথা মুখে আনিলেন না; কাহারো নিকট প্রকাশ করিলেন না। কিন্তু মনে মনে বড়ই দুঃখিত হইলেন। আমি জ্ঞানপূর্বক জায়েদার কোন অনিষ্ট করি নাই, কোন প্রকারে কষ্টও দিই নাই। জয়নাবকে বিবাহ করিয়াছি বলিয়াই কী জায়েদা আমার প্রাণ লইতে সঙ্কল্প করিয়াছে? স্বহস্তে পতিবধে প্রবৃত্ত হইয়াছে? নিশ্চয়ই জায়েদার মন অন্য কোন লোভে আক্রান্ত হইয়াছে। অবশ্যই জায়েদা কোন আশায় ভুলিয়াছে, কুহকে পড়িয়াছে। বাহিরের শত্রু হইতে রক্ষা পাওয়াও সহজ, কিন্তু ঘরের শত্রু হইতে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর! আর এস্থানে থাকিব না। এ পুরীতে আর থাকিব না।”

এইরূপে দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়া হাসান আপন প্রধান মিত্র আব্বাস ও কতিপয় এয়ার সমভিব্যাহারে মদিনার নিকটস্থ মুসাল নগরে গমন করিলেন।

১৫. আমাকে মদিনায় লইয়া চল

কপাল মন্দ হইলে তাহার ফলাফল ফিরাইতে কাহারো সাধ্য নাই। মুসাল নগরে আসিয়া হাসান কয়েকদিন থাকিলেন। এই বিশ্বসংসারে শত্রুসংখ্যা যদি আমরা জানিতে পারি, বাহ্যিক আকারে শত্রু মিত্র যদি চিনিতে পারি, তবে কি আর বিপদের সম্ভাবনা থাকে? চিনিতে পারিলে কি আর শত্রুরা শত্রুতা সাধন করিতে পারে? ইমাম হাসানের ভাগ্যে সুখ নাই।

মদিনার সংবাদ দামেস্কে যাইতেছে, দামেস্কের সংবাদ মদিনায় আসিতেছে। ইমাম হাসান মদিনা ছাড়িয়া মুসাল নগরে আসিয়াছেন, এ কথাও এজিদের কর্ণে উঠিয়াছে, অপর সাধারণেও শুনিয়াছে। ঐ নগরের একচক্ষুবিহীন জনৈক বৃদ্ধের প্রভু মোহাম্মদের প্রতি জাতক্রোধ ছিল। সেই বৃদ্ধ প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, সুযোগ পাইলেই মোহাম্মদের বংশমধ্যে যাহাকে হাতে পাইবে, তাহারই প্রাণ সংহার করিবে। হাসানের মুসাল নগরে আগমন বৃত্তান্ত শুনিয়া সেই ব্যক্তি বিশেষ যত্নে হলাহল সংযুক্ত এক সুতীক্ষ্ণ বর্শা প্রস্তুত করিয়া মুসাল নগরে যাত্রা করিল। কয়েক দিন পর্যন্ত অবিশ্রান্ত গমনের পর মুসাল নগরে যাইয়া সন্ধানে জানিল যে, ইমাম হাসান ঐ নগরস্থ উপাসনা-মন্দিরে অবস্থান করিতেছেন । বৃদ্ধ উল্লিখিত উপাসনা-মন্দিরের সীমাবর্তী গুপ্তস্থানে বর্শা লুকাইয়া রাখিয়া একেবারে হাসানের নিকটস্থ হইল। ইমাম হাসানের দৃষ্টি পড়িবামাত্র ধূর্ত বৃদ্ধ তাঁহার পদতলে পতিত হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, “প্রভু! আমাকে রক্ষা করুন। আমি এতদিন শয়তানের কুহকে পড়িয়া পবিত্র মোহাম্মদীয় ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস করিয়াছি। স্বপ্নে দেখিয়াছি যে, ইমাম হাসান মদিনা হইতে মুসাল নগরে আসিয়াছেন। সেই স্বপ্নেই কে যেন আমায় বলিল যে, ‘শীঘ্র ইমাম হাসানের নিকট যাইয়া সত্যধর্মে দীক্ষিত হও, পূর্ব পাপ স্বীকার করিয়া মার্জনার জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা কর। আমি ঐ শ্রীপাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করিতে আসিয়াছি, যাহা অভিমত হয়, আজ্ঞা করুন।”

দয়ার্দ্রচিত্ত হাসান আগন্তুক বৃদ্ধকে অনেক আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “আমি তোমাকে মোহাম্মদীয় ধর্মে দীক্ষিত করিতে এখনি প্রস্তুত আছি।” এই কথা বলিয়াই ইমাম হাসান তৎক্ষণাৎ তাহার হস্ত স্পর্শ করিয়া তাহাকে ‘বায়েৎ’ করিলেন। বৃদ্ধও ঈমান্ আনিয়া হাসানের পদধূলি গ্রহণ করিল।

আগন্তুককে বিশ্বাস করিতে নাই, এ কথা হাসান যে না জানিতেন, তাহা নহে; কিন্তু সেই মহাশক্তি-সুকৌশলসম্পন্ন ঈশ্বরের লীলা সম্পন্ন হইবার জন্যই অনেক সময়ে অনেক লোকে অনেক জানিয়াও ভুলিয়া যায় – চিনিয়াও অচেনা হয়।

ইবনে আব্বাস বলিলেন, “এই যে দামেস্ক হইতে আগত একচক্ষুবিহীন পাপস্বীকারী বৃদ্ধ এবং আপনার বিশ্বাসভাজন নব শিষ্য, ইহার প্রতি আমার সন্দেহ হয়।”

“কী সন্দেহ?”

“আমি অনেক চিন্তা করিয়াছি, অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছি, এই বৃদ্ধ শুধুমাত্র ধর্মে দীক্ষিত হইতে আসে নাই। আমার বোধ হয়, কোন দুরভিসন্ধি সাধনমানসে কিংবা কোন গুপ্ত সন্ধান লইবার জন্য আমাদের অনুসরণে আসিয়াছে।”

“তিন কাল কাটাইয়া শেষে কী এই বৃদ্ধকালে বাহ্যিক ধর্ম-পরিচ্ছদে কপট বেশে পাপকার্যে লিপ্ত হইবে?”

ইবনে আব্বাস আর কোন উত্তর করিলেন না। অন্য কথার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন। আগন্তুক বৃদ্ধও মন্দিরের অপর পার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাহার লুক্কায়িত বর্শার ফলকটি বিশেষ মনঃসংযোগে দেখিতেছে এবং মৃদু স্বরে বলিতেছে, “এই তো আমার সময়; যে বিষ ইহাতে সংযুক্ত করিয়াছি, রক্তের সহিত একটু মিশ্রিত হইলে কাহার সাধ্য হাসানকে রক্ষা করে? যেমন ‘সেজদা’ দিবে আমিও সেই সময় বর্শার আঘাত করিব। পৃষ্ঠে আঘাত করিলে বক্ষঃস্থলে বিদ্ধ না হইলে আর ছাড়িব না।” ইবনে আব্বাসের অলক্ষিতে পাপিষ্ঠ অনেকক্ষণ দেখিতে লাগিল। কোনক্রমেই কোন সময়েই বর্শা নিক্ষেপের সময় পাইল না।

বৃদ্ধ হাসানের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করিতেই বর্শা সন্ধান করিল। ইবনে আব্বাসের চক্ষু চারি দিকে। হঠাৎ আগন্তুক বৃদ্ধের বর্শাসন্ধান তাঁহার চক্ষে পড়িল। হাসানের হস্ত ধরিয়া টানিয়া উঠাইলেন এবং ধূর্তের উদ্দেশে উচ্চ কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “ওরে পিশাচ! তোর এই কীর্তি!”

এদিকে বর্শাও আসিয়া পড়িয়াছে। নিক্ষেপকারীর সন্ধান ব্যর্থ হইবার নহে। কেবল ইবনে আব্বাসের কৌশলেই হাসানের পরিত্রাণ-বর্শাটা পৃষ্ঠে না লাগিয়া হাসানের পদতল বিদ্ধ করিল। ইবনে আব্বাস কী করেন, দুরাত্মাকে ধরিতে যান, কী এদিকে আঘাতিত হাসানকে ধরেন। ইমাম হাসান বর্শার আঘাতে ভূতলে পড়িয়া গেলেন; ইবনে আব্বাস সে দিকে লক্ষ্য না করিয়া অতি ত্রস্তে যাইয়া বৃদ্ধকে ধরিলেন। বর্শার নিকটে টানিয়া আনিয়া ঐ বর্শা দ্বারা সেই বৃদ্ধর বক্ষে আঘাত করিতে উদ্যত, এমন সময়ে ইমাম হাসান অনুনয়-বিনয় করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভাই! প্রিয় আব্বাস! যাহা হইবার হইয়াছে, ক্ষমা কর। ভাই! বিচারের ভার হস্তে লইয়ো না। সর্ববিচারকের প্রতি বিচারের ভার দিয়া বৃদ্ধকে ছাড়িয়া দাও, এই আমার প্রার্থনা।”

হাসানের কথায় ইবনে আব্বাস বৃদ্ধকে ছাড়িয়া দিয়া হাসানকে বলিলেন, “আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য; কিন্তু সর্বদা স্মরণ রাখিবেন, আগন্তুকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের এই ফল।” শোণিতের ধারা বহিতেছে। বর্শার আঘাতে হাসান অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িলেন। তথাচ বলিতে লাগিলেন, “আব্বাস! তোমার বুদ্ধিকে ধন্যবাদ! তোমার চক্ষুরও সহস্র প্রশংসা! আমি কাহারো মন্দ করি নাই, তথাচ আমার শত্রুর শেষ নাই! পদে পদে, স্থানে স্থানে, নগরে নগরে আমার শত্রু আছে, ইহা আগে জানিতাম না। যেদিকে তাকাই, সেই দিকেই হন্তা, সেই দিকেই আমার প্রাণনাশক শত্রু! আমি ভাবিয়াছিলাম, জায়েদাই আমার পরম শত্রু; এখন দেখি, জগৎময় আমার চিরশত্রু।”

হাসান ক্রমশঃই অস্থির হইতে লাগিলেন। কাতরস্বরে ইবনে আব্বাসকে বলিলেন, “আব্বাস! যত শীঘ্র পার, আমাকে মাতামহের ‘রওজা শরীফে’ লইয়া চল। যদি বাঁচি, তবে আর কখনোই ‘রওজা মোবারক’ হইতে অন্য স্থানে যাইব না। ভ্রমেই লোকের সর্বনাশ হয়, ভ্রমেই লোকে মহাবিপদ্গ্রস্ত হয়, ভ্রমে পড়িয়াই লোকে কষ্ট ভোগ করে, প্রাণও হারায়। কথা কহিতে কষ্ট হইতেছে। যত শীঘ্র হয়, আমাকে মদিনায় লইয়া চল।”

ইবনে আব্বাস হাসানকে লইয়া মদিনায় যাত্রা করিলেন। যেখানে যমদূতের দৌরাত্ম্য নাই, হিংসাবৃত্তিতে হিংস্র লোকের ও হিংস্র জন্তুর প্রবৃত্তি নাই, খাদ্যখাদকের বৈরীভাব নাই, নিয়মিত সময়ে হাসান সেই মহাপবিত্র ‘রওজা মোবারকে’ আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং সর্বাঙ্গে রওজা মোবারকের ধুলা মাখিয়া ঈশ্বরের নিকট আরোগ্য প্রার্থনা করিলেন। ঈশ্বরানুগ্রহে বিষের যন্ত্রণা অনেক লাঘব হইল। কিন্তু আঘাতের বেদনা-যাতনা তেমনই রহিয়া গেল। ক্ষতস্থান দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। জ্বালা-যন্ত্রণাও বাড়িতে লাগিল। ইমাম হাসান শেষে উত্থানশক্তি রহিত হইয়া পড়িলেন। একদিন হোসেন আসিয়া ভ্রাতাকে বলিলেন, “ভ্রাতঃ! পবিত্র স্থানে পবিত্র অবস্থায় না থাকিতে পারিলে স্থানের অবমাননা করা হয়। ক্ষতস্থান কেমন ভয়ানক রূপ ধারণ করিয়াছে, বাটীতে চলুন, আমরা সকলেই আপনার সেবা-শুশ্রূষা করিব।”

ইমাম হাসান হোসেন এবং আবুল কাসেমের স্কন্ধোপরি হস্ত রাখিয়া অতি কষ্টে বাটীতে আসিয়া পৌঁছিলেন। প্রিয় ভ্রাতা হোসেনের গৃহেই আবাস গ্রহণ করিলেন। সকলেই তাঁহার সেবা-শুশ্রূষায় রত হইল। হাসনেবানুর সেবা-শুশ্রূষায় ইমাম হাসানের বিরক্তিভাব কেহই দেখিতে পায় নাই। জয়নাব আসিয়া নিকটে বসিলে কিছু বলিতেন না, কিন্তু জায়েদাকে দেখিলেই চক্ষু বন্ধ করিয়া ফেলিতেন।

হাসনেবানু কহিলেন, “আমি সাহস করিয়া কিছু বলিতে পারি না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, যাহা হইবার তাহা হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে খাদ্যসামগ্রীর কোন দোষে আর পীড়া বৃদ্ধি হইবে না। আমি বিশেষ সতর্ক হইয়াছি।”

হাসনেবানুর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক ইমাম হাসান বলিলেন, “অদৃষ্টের লেখা খণ্ডাইতে কাহারো সাধ্য নাই। তোমার যাহাতে সন্দেহ দূর হয়, তুমি সেই প্রকারে আমার আহারীয় ও পানীয় সমুদয় দ্রব্য সাবধানে ও যত্নে রাখিয়ো।” হোসেনও সতর্ক রহিলেন। হাসনেবানুও সদাসর্বদা সাবধানে থাকিতে লাগিলেন।

জায়েদা মাঝে মাঝে স্বামীকে দেখিতে আসিতেন, কিন্তু জয়নাবকে স্বামীর নিকটে বসিয়া থাকিতে দেখিলে আর ঘরেই প্রবেশ করিতেন না। একদিন জায়েদার সহিত মায়মুনাও হজরত হাসানকে দেখিতে আসিল। শয্যার কিঞ্চিৎ ব্যবধানে জায়েদা, তৎপার্শ্বে মায়মুনা। তাঁহাদের নিকটে অপরাপর সকলে শয্যার প্রায় চতুষ্পার্শ্বে ঘেরিয়া বসিয়া আছেন। জান্নাতবাসিনী জগজ্জননী বিবি ফাতেমাও মায়মুনাকে ভালবাসিতেন; মায়মুনাও তাঁহাকে ভক্তির সহিত ভালবাসিত। হাসান-হোসেনও মাতার ভালবাসা বলিয়া মায়মুনাকে বিশেষ ভক্তি করিতেন। মায়মুনার মন যে কালকূট বিষম বিষে পরিপূর্ণ, তাহা জায়েদা ভিন্ন আর কেহ জানিতে পারেন নাই।

ইমাম হাসানের পীড়িত অবস্থা দেখিয়া মায়মুনার চক্ষে জল আসিল। মায়মুনা শুধু চক্ষের জলই সকলকে দেখাইতেছে তাহা নহে; আরো উদ্দেশ্য আছে। ঘরের মধ্যে যেখানে যেখানে যে জিনিস যে যে পাত্রে রক্ষিত আছে, তাহা সকলই মনঃসংযোগ করিয়া জলপূর্ণ-নয়নে বিশেষরূপে দেখিতে লাগিল।

হাসানের জলপিপাসা হইয়াছে। সঙ্কেতে হাসনেবানুকে জলপানেচ্ছা জানাইলেন। তিনি মহাব্যস্তে ‘আব্খোরা’ পরিষ্কার করিয়া সুরাহীর শীল ভগ্ন করিবেন এবং সুরাহীর জলে আব্খোরা পূর্ণ করিয়া হাসানের সম্মুখে ধরিলেন। জলপানে তৃপ্তিলাভ করিয়া হাসান পুনরায় শয্যাশায়ী হইলেন।

যে যাহাকে দেখিতে ইচ্ছা করে না, সে তাহার নামও শুনিতে ভালবাসে না। জগতে এমন অনেক লোক আছে, যাহারা স্বভাবতঃই এক-একজনকে দেখিতে ভালবাসে না। অন্য পক্ষে – পরিচয় নাই, শত্রুতা, মিত্রতা নাই, আলাপ নাই, স্বার্থ নাই, কিছুই নাই, তথাপি মুখখানি দেখিতে ইচ্ছা করে। মনের সহিত ভালবাসিতেও ইচ্ছা করে। এমন মুখও জগতে অনেক আছে, পরিচয়ে পরিচিত না হইলেও সেই মুখখানি যতবার দেখিতে পাওয়া যায়, ততবারই সুখবোধ হয়।

হাসনেবানু জলের সুরাহী যথাস্থানে রাখিয়া ঈষৎ বিরক্তির সহিত মায়মুনার দিকে চাহিয়া চলিয়া গেলেন। রোগীর পথ্য লইয়া জয়নাব সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। জায়েদা আড়নয়নে বিষদৃষ্টিতে দেখিয়াই উঠিয়া চলিয়া গেলেন। মায়মুনাও হাসনেবানুর আসিবার সাড়া পাইয়া আস্তে আস্তে গৃহ ত্যাগ করিল।

Series Navigationফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৮) >>
The following two tabs change content below.
Avatar photo
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →