Main menu

ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৩)

এক ।। দুই ।।

প্রবাহ ৫: জয়নাবের জবাব

পতিবিয়োগে নারীজাতিকে চারি মাস দশ দিন বৈধব্যব্রত প্রতিপালন করিতে হয়। জয়নাব শাস্ত্রসঙ্গত বৈধব্য অবস্থায় দিনযামিনী যাপন করিতেছেন। এত মলিনভাব, তথাচ তাঁহার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও রূপমাধুর্যে মানুষমাত্রেই বিমোহিত।

মোস্‌লেম যথাসময়ে জয়নাবের ভবনে উপস্থিত হইলেন। জয়নাব পিতার বর্তমানে ও দেশীয় প্রথানুসারে এবং শাস্ত্রসঙ্গত স্বাধীনভাবেই মোস্‌লেমের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন। তাঁহার পিতা অদূরে দণ্ডায়মান থাকিয়া উভয়ের কথোপকথন আকর্ষণ করিতে লাগিলেন।

মোস্‌লেম বলিলেন, “যে উদ্দেশ্যে আমি দৌত্য কর্মে নিযুক্ত হইয়া আসিয়াছি, একে একে নিবেদন করি, শ্রবণ করুন। যদিও আপনার বৈধব্যব্রত আজ পর্যন্ত শেষ হয় নাই, কিন্তু প্রস্তাবে অধর্ম নাই। আমাদের দামেস্কাধিপতি হজরত মাবিয়ার বিষয় আপনার অবিদিত কিছুই নাই; তাঁহার রাজ-ঐশ্বর্য সকলই আপনি জ্ঞাত আছেন, সেই দামেস্কাধিপতির একমাত্র পুত্র এজিদের বিবাহ পয়গাম লইয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। যিনি এজিদ্কে স্বামিত্বে বরণ করিবেন, তিনিই দামেস্করাজ্যের পাটরাণী হইবেন।

পথে আসিতে আসিতে প্রভু মোহাম্মদের প্রিয় পারিষদ আক্কাস আমাকে কহিলেন, তিনিও আপনার প্রার্থী। ঈশ্বর তাঁহাকে সৃষ্টি করিয়া পুরুষ জাতির সৌন্দর্যের অতুল আদর্শ দেখাইয়াছেন। তিনি অতুল বিভবের অধীশ্বর। তিনিও আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন।

অধিকন্তু প্রভু মোহাম্মদের কন্যা বিবি ফাতেমার গর্ভজাত হজরত আলীর ঔরস-সম্ভূত-পুত্র মদিনাধিপতি হজরত হাসানও আপনার প্রার্থী কিন্তু এজিদের ন্যায় তাঁহার ঐশ্বর্য সম্পদ নাই, সৈন্য সামন্ত নাই, উজ্জ্বল রাজপ্রাসাদও নাই। এই সকল বিষয়ে সম্ভ্রমসম্পদশালী এজিদের সহিত কোন অংশেই তাঁহার তুলনা হয় না। তাঁহার দ্বারা ইহকালের সুখ সম্ভোগের কোন আশাই নাই, অথচ সেই হাসান আপনার প্রার্থী। এই আমার শেষ কথা। বিন্দুমাত্রও আমি গোপন করিলাম না-কিছুমাত্র অত্যুক্তি করিলাম না। এক্ষণে আপনার যেরূপ অভিরুচি।”

আদ্যোপান্ত সমস্ত শ্রবণ করিয়া জয়নাব অতি মৃদুস্বরে সুমধুর সম্ভাষণে বলিলেন, “আজ পর্যন্ত আমার বৈধব্যব্রত সম্পন্ন হয় নাই। ব্রতাবসানে অবশ্যই আমি স্বামী গ্রহণ করিব। কিন্তু এ সময় যে বিষয়ে আলোচনা করিলেও আমার মনে মহা কষ্টের উদ্রেক হয়। … ঈশ্বর যে উদ্দেশ্যে আমাকে সৃজন করিয়াছেন, সে উদ্দেশ্যের গুহ্য কারণ কেবল তিনিই জানেন। আমি তাঁহার যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপকরণ, তাহা আমার জানিবার বা বুঝিবার ক্ষমতা নাই। আমি ক্ষুদ্র জীব, আমি কেন-অনেকে আপন আপন মূল্যের পরিমাণ বুঝিতে অক্ষম। …জীবন কয় দিনের? জীবনের আশা কী? এই চক্ষু মুদ্রিত হইলেই সকল আশা-ভরসা ফুরাইয়া যাইবে। …স্থূল কথা, বিষয়বিভব, রাজপ্রাসাদ এবং রাজভোগের লোভী আমি নহি। সে লোভ এ জীবনে কখনোই হইবে না। মনের কথা আজ অকপটে আপনার নিকট বলিলাম।”

মোস্‌লেম কহিলেন, “ইহাতে তো আপনার মনোগত ভাব স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম না?”

“ইহা অপেক্ষা স্পষ্ট আর কি হইতে পারে? প্রভু হজরত মোহাম্মদের দৌহিত্র, তিনি যখন জয়নাবকে চাহিয়াছেন, তখন জয়নাবের স্বর্গসুখ ইহকালেই সমাগত। পাপীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত কোথায় না আছে? কিন্তু সাধু পুরুষের পদাশ্রিত হইতে পারিলে পরকালের মুক্তিপথের পাপকণ্টক বিদূরিত হইয়া স্বর্গের দ্বার পরিষ্কার থাকিবে। … আমার বৈধব্যব্রত পূর্ণ হইলেই প্রভু হাসান যে সময়ে আমাকে দাসীত্বে গ্রহণ করিবেন, আমি মনের আনন্দে সেই সময়েই সেই পবিত্র চরণে আত্মসমর্পণ করিব।”

মোস্‌লেম বলিল, “জয়নাব! তুমিই জগতে পবিত্র কীর্তি স্থাপন করিলে। জগৎ বিলয় পর্যন্ত তোমার এই অক্ষয়কীর্তি সকলের অন্তরে দেদীপ্যমান থাকিবে। … আমার আর কোন কথা নাই। আমি বিদায় হইলাম।”

মোস্‌লেম বিদায় হইলেন। যথাসময়ে প্রথমে ইমাম হাসান, পরিশেষে আক্কাসের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত প্রকাশ করিয়া অপূর্ব চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া দামেস্কাভিমুখে যাত্রা করিলেন।

 

প্রবাহ ৬: আমার মনে যে ব্যথা দিয়াছে, আমি তাহা অপেক্ষা শত সহস্রগুণে তাহাদের মনে ব্যথা দিব!

মোস্‌লেমকে জয়নাবের নিকটে পাঠাইয়া এজিদ্ প্রতিদিন দিন গণনা করিতে লাগিলেন। তাহার পর ক্রমে সপ্তাহ যায়, মোস্‌লেমর সংবাদ নাই। মাবিয়া পীড়িত। তাঁহার ব্যাধি সাংঘাতিক, বাঁচিবার আশা অতি কম। এজিদের সে দিকে দৃক্পাত নাই, পিতার সেবা-শুশ্রূষাতেও মন নাই; মোস্‌লেম আসিলেই জয়নাবের কথা শুনিবেন। কত আগ্রহে জয়নাব তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছে, কথার ছলে সে কথাটি অন্ততঃ দু’বার তিনবার দোহরাইয়া শুনিবেন। রজনী দ্বিপ্রহর গত হইল, তথাচ এজিদের চিন্তার শেষ হইল না। কখনো উঠিতেছেন, গৃহমধ্যে দুই চারি পদ চালনা করিয়া আবার বসিতেছেন, ক্ষণকাল ঐ উপবেশনশয্যাতেই শয়ন করিয়া এপাশ ওপাশ করিতেছেন। সমস্তই ভুল, কিছুতেই মন স্থির করিতে পারিতেছেন না।

মারওয়ান আসিয়াই অভিবাদন করিয়া সম্মুখে উপবেশন করিলেন। এজিদের চিত্তচাঞ্চল্য দেখিয়া চিন্তিতভাবে বলিলেন, “আপনি কোন প্রকার সন্দেহ মনে স্থান দিবেন না; নিশ্চয় জানিবেন, জয়নাব কখনোই অসম্মত হইবে না। আমি স্পষ্টাক্ষরে লিখিয়া দিতে পারি যে, জয়নাব আপনারই হইবে এবং আপনারই অঙ্ক শোভা করিবে।”

এজিদ্ সর্বদাই চকিত। কোন প্রকারের শব্দ কর্ণে প্রবেশ করিলেই এজিদের মন কাঁপিয়া উঠিত। কারণ আর কিছু নহে, কেবল মোস্‌লেমের আগমন সম্ভব। এজিদ্ উঠিয়া দেখিলেন যে, তাঁহার মাতার প্রধানা পরিচারিকা ত্রস্তে আসিতেছে। নিকটে আসিয়া বলিল, “শীঘ্র আসুন, মহারাজ আপনাকে মনে করিয়াছেন।”

এজিদ্ যে বেশে বসিয়াছিলেন, সেই বেশেই পিতার নিকটে গমন করিলেন।

মাবিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, “মোস্‌লেম ফিরিয়া আসিয়াছে। (এজিদ্ চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন, কাহাকেও দেখিলেন না।) জয়নাবের বুদ্ধিতে আমি শত শত ধন্যবাদ করি। ঈশ্বর তাহাকে যেমন সুশ্রী করিয়াছেন, তেমনি বুদ্ধিমতী করিয়া আরো দ্বিগুণ রূপ বাড়াইয়া দিয়াছেন! আবদুল জাব্বার নিরপরাধে ঐ অবলা সতীর মনে যে দুঃখ দিয়াছে, তাহার প্রতিফল সে অবশ্যই পাইবে।”

এজিদের মাতা বলিলেন, “ধর্মে মতি অনেকেরই আছে, সুশ্রীও অনেক আছে।”

মাবিয়া কহিলেন, “অনেক আছে, বটে, কিন্তু এমন আর হইবে না। যাঁহার পদাশ্রয় গ্রহণ করিলে পরকালে মুক্তি পাইবেন তাঁহার পয়গামই তিনি কবুল করিয়াছেন।”
এজিদ্ জিজ্ঞাস করিলেন, “কাহার পদাশ্রয় গ্রহণ করিলে পরকালে মুক্তি হয়? সে ব্যক্তি কে?”

মাবিয়া বলিলেন, “তিনি প্রভু মোহাম্মদের দৌহিত্র মাননীয় আলীর পুত্র হাসান। দেখ এজিদ্! তুমি আর হাসান হোসেনের প্রতি ক্রোধ করিয়ো না। মন হইতে সকল পাপ দূর কর। সত্যপথ অবলম্বন কর। আমি আর কয়দিন বাঁচিব? আমি যে প্রকারে হাসান-হোসেনের আনুগত্য ও দাসত্ব স্বীকার করিলাম, তুমি তাহার চতুর্গুণ করিবে।”

তখন এজিদের মুখে কথা ফুটিল, বাক্শক্তির জড়তা ঘুচিল। বলিতে অগ্রসর হইলেন, “আমি দামেস্কের-রাজপুত্র। আমার রাজকোষ ধনে সদা পরিপূর্ণ, সৈন্য-সামন্তে সর্ববলে বলীয়ান্! আমার সুরম্য অত্যুচ্চ প্রাসাদ এদেশে অদ্বিতীয়। আমি সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ এবং অভাবশূন্য। আমি যার জন্য প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত, আমি যার জন্য রাজ্যসুখ তুচ্ছ করিয়া এই কিশোর বয়সে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন করিতে অগ্রগামী, যার জন্য এতদিন এত কষ্ট সহ্য করিলাম, সেই জয়নাবকে হাসান বিবাহ করিবে? এজিদের চক্ষে তাহা কখনোই সহ্য হইবে না। আমার মনে যে ব্যথা দিয়াছে, আমি তাহা অপেক্ষা শত সহস্রগুণে তাহাদের মনে ব্যথা দিব! এখনি হউক, বা দুদিন পরেই হউক, এজিদ্ বাঁচিয়া থাকিলে ইহার অন্যথা হইবে না, এই এজিদের প্রতিজ্ঞা।”

মাবিয়া অতি কষ্টে শয্যা হইতে উঠিয়া সরোষে বলিতে লাগিলেন, “ওরে নরাধম! কি বলিলি? রে পাষণ্ড! কি কথা আজ মুখে উচ্চারণ করিলি? হায়! হায়!! নূরনবী মোহাম্মদের কথা আজ ফলিল! তাঁর ভবিষ্যৎবাণী আজ সফল হইল। তুই তো আজই জাহান্নামী হইলি! আমাকে সঙ্গী করিলি। তুই দূর হ!”

এজিদ্ ম্লান্ মুখে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। এজিদের মাতা নানা প্রকার সান্ত্বনা করিয়া মাবিয়াকে বুঝাইতে লাগিলেন, “আপনি স্থির হউন। ইহাতে আপনার পীড়াই বৃদ্ধি হইবে।”

মাবিয়া বলিলেন, “পীড়ার বৃদ্ধি হউক, আর আমার প্রাণ বাহির হইয়াই যাউক, যে কথা আমি আজ শুনিয়াছি, তিলার্ধকাল বাঁচিতে আমার আর ইচ্ছা নাই।”

 

প্রবাহ ৭: ফকির কে?

সময় যাইতেছে। যাহা যাইতেছে, তাহা আর ফিরিয়া আসিতেছে না। আজ যে ঘটনা হইল, কাল তাহা দুই দিন হইবে। ক্রমে দিনের পর দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস অতীত হইল, দেখিতে দেখিতে কালচক্রের অধীনে বৎসরে পরিণত হইবে। বৎসর, বৎসর, অনন্ত বৎসর। যে কোন ঘটনাই হউক, অবিশ্রান্ত গতিতে তাহা বহুদূরে বিনিপ্তি হইতেছে। জয়নাবের বৈধব্যব্রত সাঙ্গ হইল। হাসান স্বয়ং জয়নাবের ভবনে যাইয়া জয়নাবকে বিবাহ করিয়া আনিলেন।

প্রথমা স্ত্রী হাসনেবানু, দ্বিতীয়া জায়েদা, তৃতীয়া জয়নাব! হাসনেবানু প্রথমা স্ত্রী, তদ্গর্ভজাত একমাত্র পুত্র আবুল কাসেম। আবুল কাসেম পূর্ণবয়স্ক, সর্বগুণে গুণান্বিত। তাঁহার আপাদমস্তক পবিত্র। অস্ত্রবিদ্যাতেও বিশারদ। জায়েদার সন্তান-সন্ততি কিছুই নাই। হাসনেবানু হাসানের প্রধানা স্ত্রী সকলের মাননীয়া। জায়েদা ভাবিয়াছিলেন, হাসান তাহাতেই অনুরক্ত। এক্ষণে দেখিলেন, তাঁহার সে বিশ্বাস ভ্রমসঙ্কুল। হাসানের কথায়, কার্যে ভালবাসার কিছুই ত্রুটি পাইলেন না; তথাচ পূর্বভাব, পূর্ব প্রণয়, পূর্ব ভালবাসার মধ্যে কি যেন একটু ছিল তাহা নাই। সেই গৃহ, সেই স্বামী, সেই হাসান, সেই জায়েদা সকলই রহিয়াছে, তথাচ ইহার মধ্যে কি যেন অভাব রহিয়াছে। জায়েদা মনে মনে সাব্যস্ত করিলেন, এ দোষ আমার নয়, হাসানের নয়, এ দোষ জয়নাবের। জয়নাবকে যে এই দোষে দোষী সাব্যস্ত করিলেন আজিও করিলেন, কালিও করিলেন, জীবন শেষ পর্যন্ত করিয়া রাখিলেন। সে দোষ ক্রমেই অন্তরে বদ্ধমূল হইয়া শত্রুভাব আসিয়া দাঁড়াইল। জয়নাব এক্ষণে তাঁহার দুই চরে বিষ। জয়নাবকে দেখিলেই তাঁহার মনের আগুন জ্বলিয়া উঠে। শেষে হাসনেবানু পর্যন্ত জানিতে পারিলেন যে, জায়েদা জয়নাবের নাম শুনিলেই জ্বলিয়া উঠে। হাসনেবানু কাহাকেও কিছু বলিতেন না; কিন্তু জয়নাবকে মনে মনে ভালবাসিতেন।

হাসান প্রকাশ্যে স্ত্রীত্রয়ের মধ্যে যে কিছু ইতর বিশেষ জ্ঞান করিতেন, তাহা কেহ কখনোই জানিতে পারেন নাই। তিন স্ত্রীকেই সম-নয়নে দেখিতেন, সমভাবে ভালবাসিতেন, কিন্তু সেই সমান ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে হাসনেবানুকে অপেক্ষাকৃত অধিক মান্য করিতেন। জয়নাব সর্বাপেক্ষা সুশ্রী, স্বভাবত তাঁহাকে বেশি আদর ও বেশি যত্ন করেন, জায়েদার মনে এইটিই বদ্ধমূল হইল।

ইমাম হাসান ধর্মশাস্ত্রের অকাট্য বিধি উলঙ্ঘন করিয়া জয়নাবকে বিবাহ করেন নাই। তবে জায়েদা এত বিষাদিনী হইলেন কেন? বোধ হয় জায়েদা ভাবিতেন যে, একটি স্ত্রীর তিনটি স্বামী হইলে সে স্ত্রীলোকটি যে প্রকার সুখী হয়, তিনটি স্ত্রীর এক স্বামীও, বোধ হয়, সেই প্রকার সুখভোগ করে। কিন্তু সেই স্বামীত্রয়ের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে অসুবিধা কি কোন কারণে হিংসা, দ্বেষ ও ঈর্ষার প্রাদুর্ভাব হইয়া আত্মকলহ উপস্থিত হয় এবং একের অনিষ্ট চিন্তায় দ্বিতীয় যত্ন করে, তৃতীয় কাহারো স্বপক্ষে কি উভয়কে শত্রু মনে করিয়া শত্রুবিনাশে একেবারে কৃতসঙ্কল্প হয়, তবে আমারই বা না হইবে কেন? আমিও তো শরীরী, আমারও ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, মাংসপেশী, ধমনী, হৃদয়, শোণিত, অস্থি, চর্ম ও ইচ্ছা সকলই আছে, তবে মনোভাবের বিপর্যয় হইবে কেন? জগতে শত্রুও তিন প্রকার। প্রথমে প্রকৃত শত্রু, দ্বিতীয় শত্রুর বন্ধু, তৃতীয় মিত্রের শত্রু! এই সূত্র অনুসারে মৈত্রবন্ধন হইতে হাসান যেন অল্পে অল্পে সরিতে লাগিলেন।

স্বামীর নিরপেক্ষ ভালবাসা জায়েদা আর ভালবাসিলেন না, মনের কথা মনেই থাকিল। স্ত্রীলোকমাত্রেই স্বভাবতঃ কিছু চাপা। এক একটি স্ত্রীলোকের মনের কপাট খুলিয়া যদি বিশেষ তন্ন তন্ন ভাবে দেখা যায়, আর যাহা আছে, তাহা যদি চেনা যায়, তাহা হইলে অনেক বিষয়ে শিক্ষাও পাওয়া যায় এবং মনের অন্ধকার প্রায়ই ঘুচিয়া যায়। সে মনে না আছে, এমন জিনিসই নাই।

জয়নাবের বিবাহের পর এজিদের প্রতিজ্ঞা, মাবিয়ার র্ভৎসনা, সকল কথাই মদিনায় আসিয়াছে। মাবিয়া দিন দিন ক্ষীণ ও বলহীন হইতেছেন, বাঁচিবার ভরসা অতি কমই আছে, তাহাও লোকমুখে শুনিতেছেন। সাধারণের মুখে এক কথার শাখা-প্রশাখা বাহির হইয়া শত সহস্র পত্রে পরিণত হয়। সে সময় মূল কথার অণুমাত্রও বিশ্বাসের উপযুক্ত থাকে না। হাসান তাহাই বিবেচনা করিয়া এক কর্ণে শুনিলেন, অন্য কর্ণে বাহির করিয়া দিলেন। যদিও মদিনার রাজা, কিন্তু রাজসিংহাসনের পারিপাট্য নাই, সৈন্য সামন্ত ধন জন কিছুই নাই। মদিনাবাসীরা হাসান-হোসেন দুই ভ্রাতার আজ্ঞাবহ কিঙ্কর, তাঁহাদের কার্যে, তাঁহাদের বিপদে বিনা অর্থে, বিনা স্বার্থে, বিনা লাভে জীবন দিতে প্রস্তুত।

হাসান সন্ধ্যাকালীন উপাসনা সমাধা করিয়া তস্বি হস্তে উপাসনা-মন্দিরের সম্মুখে পদচালনা করিয়া ঈশ্বরের নাম জপ করিতেছেন, এমন সময় একজন ফকির জাতীয় প্রথানুসারে অভিবাদন করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। ফকিরের মলিন বেশ, শতগ্রন্থিযুক্ত পিরহান, মলিন বস্ত্রে শির আবৃত, গলায় প্রস্তরের তস্বি, হস্তে কাষ্ঠযষ্টি। হাসানের কিঞ্চিৎদূরে দণ্ডায়মান হইয়া সেই বৃদ্ধ বলিলেন, “প্রভো! আমি একটি পর্বতের উপর বসিয়াছিলাম। দেখি যে, একজন কাসেদ্ আসিতেছে, হঠাৎ ঈশ্বরের নাম করিয়া সেই কাসেদ্ ভূতলে পতিত হইল। কারণ কিছুই জানিতে পারিলাম না। নিকটস্থ হইয়া দেখি যে, একটি লৌহশর তাহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া পৃষ্ঠদেশ পার হইয়া, কঠিন প্রস্তর খণ্ড বিদ্ধ করিয়াছে। শোণিতের ধারা বহিয়া চলিতেছে। তখনও তাহার প্রাণ বিয়োগ হয় নাই। দুই একটি কথা অস্ফুট স্বর যাহা শুনিলাম, আর ভাবেও যাহা বুঝিতে পারিলাম, তাহার মর্ম এই যে হজরত মাবিয়া আপনার নিকট কাসেদ্ পাঠাইয়াছিলেন। তিনি অত্যন্ত পীড়িত, বাঁচিবার ভরসা অতি কম। জীবনে শেষ দেখাশুনার জন্যই আপনাকে সংবাদ দিতে বোধ হয়, কাসেদ্ আসিতেছিল, আমি দ্রুতগামী অশ্বের পদধ্বনি শুনিয়া সম্মুখে লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, এজিদ্ অশ্বোপরি বীরসাজে ধনুহস্তে বেগে আসিতে। পৃষ্ঠের বাম পার্শ্বে তূণীর ঝুলিতেছে, দেখিয়াই পর্বতের আড়ালে লুকাইলাম। আড়াল হইতে দেখিলাম, এজিদ্ অশ্ব হইতে নামিয়া পথিকের কটিবদ্ধ খুলিয়া, একখানি পত্র লইয়া, অশ্বে কষাঘাত করিতে করিতে চক্ষুর অগোচর হইল। আপনার নিকট সেই সংবাদ দিতে আসিয়াছি। আর আমার কোন কথা নাই।” এই বলিয়া আগন্তুক ফকির পুনারভিবাদন করিয়া একটু দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

হাসান ভাবিতে লাগিল ফকির কে? কেনই-বা আমাকে এ সংবাদ দিতে আসিয়াছিল? কথার স্বর ও মুখচ্ছবি একেবারে অপরিচিত বলিয়াও বোধ হইল না। অনেকণ পর্যন্ত ফকিরের বিষয় চিন্তা করিয়া তিনি শেষে সাব্যস্ত করিলেন যে, ফকির আর কেহই নয়, এ সেই আবদুল জাব্বার।

(টু বি কন্টিনিউ…)

Series Navigation
The following two tabs change content below.
Avatar photo
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →